ঢাকা ০১:৩৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫

চট্টগ্রামে পানির উৎপাদন কমেছে, ভোগান্তিতে নগরবাসী

  • আপডেট সময় : ০৬:৫২:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫
  • ১৮ বার পড়া হয়েছে

সংগৃহীত ফাইল ছবি

প্রত্যাশা ডেস্ক: চট্টগ্রাম ওয়াসার উৎপাদন কমে যাওয়ায় নগরীতে পানির সংকট বেড়েছে। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে বিপুল সংখ্যক ওয়াসার গ্রাহক। সংবাদসংস্থা বাংলা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াসার পানির উৎস হালদা ও কর্ণফুলী নদী। এরমধ্যে হালদা নদীতে লবণাক্ততা বেড়েছে এবং কর্ণফুলী নদীতে ভাটার সময় পানির স্তর কমছে উল্লেখযোগ্য হারে। যে কারণে এ দুই নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল ওয়াসার চারটি পানি শোধনাগার প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছে ৬ কোটি লিটার পর্যন্ত। ওয়াসার এ চার প্রকল্পের উৎপাদিত পানি সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসিন্দাদের মাঝে।

নগরে পানির সংকট: শুষ্ক মৌসুম শুরুর মধ্যে দিয়ে পানির সংকটের মধ্যে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরীর বেশ কিছু এলাকার বাসিন্দারা। বিশেষ করে নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন হামজারবাগ, আতুরার ডিপো, সঙ্গীত আবাসিক, বাকলিয়া, হালিশহর, ডবলমুরিং থানাধীন পোস্তারপাড়, ধনিয়ালা পাড়া, পান্না পাড়া, পতেঙ্গা থানাধীন বাংলা বাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা নিয়মিত ওয়াসার পানি পাচ্ছে না। এতে বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

নগরীর হামজারবাগ সঙ্গীত আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. রফিক জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে এ আবাসিক এলাকায় ওয়াসার পানি নেই। নানা কষ্ট করে পানির জোগান দিতে হচ্ছে। বিষয়টি ওয়াসার কর্মকর্তাদের জানানোর পর তারা দ্রুত সুরাহা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন শুক্রবার (১৪ মার্চ) পর্যন্ত পানি সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।

পানির সংকট তীব্র হওয়ায় পানির দাবিতে গত মঙ্গলবার (১১ মার্চ) চট্টগ্রাম ওয়াসা ভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকার কয়েক শতাধিক লোক। পরে ঘেরাও কর্মসূচি পালনকারীরা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বরাবরে স্মারকলিপি দেন। ওয়াসার কর্মকর্তারা পানির সমস্যা দ্রুত সমাধান করার আশ্বাস দিলে তারা ফিরে যান।

চার প্রকল্পে উৎপাদন কমেছে ৬ কোটি লিটার পানি: চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম সংবাদসংস্থাটিকে বলেছেন, ‘চলতি শুষ্ক মৌসুমে ওয়াসার প্রকল্পগুলো নানা সমস্যার মধ্যে পড়েছে। ওয়াসার পানির উৎস হালদা নদী ও কর্ণফুলী নদী। বর্তমানে হালদা নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে দৈনিক ৯ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্প এবং ৯ কোটি লিটার পানির উৎপাদন সক্ষমতার মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছে ৩ কোটি লিটারের মতো। হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার কারনে দিনে দুই বার জোয়ারের সময় দুটি প্রকল্প ৫ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হয়। কেননা হালদা নদীর পানিতে এক হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত প্রতি লিটার পানিতে লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। অপরদিকে ভাটার সময় কর্ণফুলী নদীতে পানির স্তর কমেছে। কর্ণফুলী নদীর পানির উপর নির্ভরশীল দৈনিক ১৪ কোটি লিটার করে ২৮ কোটি লিটার পানির উৎপাদন সক্ষমতার কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প দুটিতে ভাটার সময় পানির স্তর কমে গেছে। এ কারণে এ দুই প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছে দৈনিক ২ থেকে ৩ কোটি লিটার। সব মিলিয়ে চারটি পানি শোধনাগার প্রকল্পে ৫ থেকে ৬ কোটি লিটারের মতো পানির উৎপাদন কমেছে। যার প্রভাব পড়েছে গ্রাহকদের মাঝে।’

কাপ্তাই হৃদের পানি কমে যাওয়ার প্রভাব কর্ণফুলী নদীতে: রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর কমে যাওয়ায় কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। ২৪২ মেগাওয়ার্ট উৎপাদন সক্ষমতার কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট থেকে শুক্রবার (১৪ মার্চ) উৎপাদন হয়েছে একটি ইউনিট থেকে মাত্র ৪০ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ। কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটি মাত্র ইউনিট চালু থাকায় পানি ছাড়া হচ্ছে কম। এ কারণে কর্ণফুলী নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির স্তর কমেছে। জোয়ারের সময় কর্ণফুলী নদীতে পানি স্বাভাবিক থাকলেও ভাটার সময় পানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। এ সময় কর্ণফুলী নদীর উপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম ওয়াসার ২৮ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার দুই প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছে ৩ কোটি লিটারের মতো।

তবে ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট একটি চালু থাকায় স্বল্প পরিমানে পানি ছাড়া হচ্ছে। আরো বেশি ইউনিট চালু থাকলে পানির সংকটে ওয়াসার প্রকল্পে উৎপাদন কমে যেত না।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জাহের বলেন, ‘কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাঁচটি ইউনিটে ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর অনেক কমে গেছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়াতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। শুক্রবার রুলকার্ভ অনুযায়ী কাপ্তাই হ্রদে পানির উচ্চতা ছিল ৮৭ দশমিক ৫৯ এমএসএল। অথচ এ সময়ে পানির উচ্চতা থাকার কথা ছিল ৯১ দশমিক ২৪ এমএসএল। একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ৪০ মেগাওয়াট।’

তিনি আরো বলেন, বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে গেলে দ্রুত কাপ্তাই হ্রদের পানি শেষ হয়ে যাবে। যার কারণে কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট সচল থাকা সত্বেও একটি ইউনিট চালু রেখে অল্প পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে একটি করে ইউনিট চালু রাখা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বৃষ্টি খুবই জরুরি। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত স্বল্প পরিমাণে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে।

ওয়াসার পানির উৎপাদন সক্ষমতা: চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম নগরে দৈনিক ৬০ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সরবরাহের সক্ষমতা আছে ৫০ কোটি লিটার। এরমধ্যে চারটি প্রকল্প থেকে ৪৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হয়। চার প্রকল্পের মধ্যে দুটি হালদা নদী অপর দুটি প্রকল্প অবস্থিত কর্ণফুলী নদীর পাড়ে। মূলত প্রকল্পগুলো এই দুই নদীর পানি সংগ্রহ করে তা পরিশোধনের পর নগরের গ্রাহকদের সরবরাহ করা হয়। রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে অবস্থিত কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-১ এবং কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-২ এ দুটি প্রকল্প দৈনিক ১৪ কোটি লিটার করে ২৮ কোটি লিটার পানির উৎপাদন সক্ষমতা আছে।

অপরদিকে হালদা নদীর পানির উপর নির্ভরশীল মদুনঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্প এবং মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্প। এ প্রকল্প দুটি দৈনিক ৯ কোটি লিটার করে ১৮ কোটি পানির উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। বাকি ৪ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হয় গভীর নলকূপ থেকে।

ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা: চট্টগ্রাম নগরীতে ৪১টি ওয়ার্ড রয়েছে। শুধু এসব ওয়ার্ড এলাকায় রয়েছে ওয়াসার পানির সংযোগ। এতে ৭৮ হাজার ৫৪২টি আবাসিক গ্রাহক এবং ৭ হাজার ৭৬৭ টি আছে বাণিজ্যিক সংযোগ। ৭৭০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে সংস্থাটি পানি সরবরাহ করে থাকে। তবে নগরীর অনেক এলাকায় এখনও পানির সংযোগ পৌঁছায়নি।

কর্মকর্তারা যা বলছেন: চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে কম। এ কারণে ভাটার সময় কর্ণফুলী নদীতে পানির স্তর অনেক কমে যাচ্ছে। এ কারণে ভাটার সময় কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্পে উৎপাদন অনেক কমে যায়। অনেক সময় জোয়ার না আসা পর্যন্ত প্রকল্প দুটি বন্ধ রাখতে হয়। ১৪ কোটি করে ২৮ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার দুটি প্রকল্প থেকে বর্তমানে দুই-তিন কোটি লিটার পানির উৎপাদন কমেছে।’

ক্যাব-এর উদ্বেগ: চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সংকটে গ্রাহকদের ভোগান্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও নগর কমিটির নেতারা। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ক্যাবের নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘রমজান শুরুর আগে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই চট্টগ্রাম ওয়াসা তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করলেও বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে। এছাড়ারাও ওয়াসার পানির উৎস হালদা নদীতে লবণাক্ততা ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বেড়েছে। যে কারণে ওয়াসার চারটি প্রকল্প থেকে পানির উৎপাদন কমেছে ৬ কোটি লিটারের মতো।’

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, পানির সংকটে পড়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকরা। এমনিতেই নগরীর এক চতুর্থাংশ এলাকায় সরবরাহকৃত পানিতে ময়লা ও ঘোলা পানি এবং লাইনে পানি না থাকার মতো নানা সংখটে গ্রাহকরা বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহে চরম দুর্ভোগ পড়েছেন।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা: হালদা নদী গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. শফিকুল ইসলাম বলেন,‘হালদা নদী হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর একটি শাখা খাল। হালদা নদীতে জোয়ারের সময় বঙ্গোপসাগর থেকে লবণাক্ততা পানি প্রবেশ করছে। তা কি পরিমাণ লবণাক্ততা পানি প্রবেশ করছে তা গবেষণার বিষয়। তবে সম্প্রতি ওয়াসার একটি রিপোর্ট আমি দেখেছি। যেখানে বলা হচ্ছে, ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত প্রতি লিটারে তারা হালদার পানিতে লবণাক্ততা পেয়েছে। এটা হলে অত্যন্ত ভয়াবহ। এ পানি পরিশোধন করার পরও লবণের পরিমাণ থেকে যাবে। যা খাওয়ার অনুপযোগী।’

তিনি আরো বলেন, জোয়ারের সময় বঙ্গোপসাগর থেকে হালদা নদীতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে। অন্যদিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে কম। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পর্যাপ্ত পানি ছাড়া হলে তাহলে হালদায় লবণাক্ততা থাকতো না। উজানের পানির স্রোতে হালদায় সাগরের পানি প্রবেশ করতে পারতো না। হালদা নদীতে ৯৮ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। যারমধ্যে চারটি আছে কার্প জাতীয় মাছ। লবণাক্ততা বেড়ে গেলে এসব মাছের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারে জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বেগ

চট্টগ্রামে পানির উৎপাদন কমেছে, ভোগান্তিতে নগরবাসী

আপডেট সময় : ০৬:৫২:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: চট্টগ্রাম ওয়াসার উৎপাদন কমে যাওয়ায় নগরীতে পানির সংকট বেড়েছে। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে বিপুল সংখ্যক ওয়াসার গ্রাহক। সংবাদসংস্থা বাংলা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াসার পানির উৎস হালদা ও কর্ণফুলী নদী। এরমধ্যে হালদা নদীতে লবণাক্ততা বেড়েছে এবং কর্ণফুলী নদীতে ভাটার সময় পানির স্তর কমছে উল্লেখযোগ্য হারে। যে কারণে এ দুই নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল ওয়াসার চারটি পানি শোধনাগার প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছে ৬ কোটি লিটার পর্যন্ত। ওয়াসার এ চার প্রকল্পের উৎপাদিত পানি সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসিন্দাদের মাঝে।

নগরে পানির সংকট: শুষ্ক মৌসুম শুরুর মধ্যে দিয়ে পানির সংকটের মধ্যে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরীর বেশ কিছু এলাকার বাসিন্দারা। বিশেষ করে নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন হামজারবাগ, আতুরার ডিপো, সঙ্গীত আবাসিক, বাকলিয়া, হালিশহর, ডবলমুরিং থানাধীন পোস্তারপাড়, ধনিয়ালা পাড়া, পান্না পাড়া, পতেঙ্গা থানাধীন বাংলা বাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা নিয়মিত ওয়াসার পানি পাচ্ছে না। এতে বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

নগরীর হামজারবাগ সঙ্গীত আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. রফিক জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে এ আবাসিক এলাকায় ওয়াসার পানি নেই। নানা কষ্ট করে পানির জোগান দিতে হচ্ছে। বিষয়টি ওয়াসার কর্মকর্তাদের জানানোর পর তারা দ্রুত সুরাহা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন শুক্রবার (১৪ মার্চ) পর্যন্ত পানি সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।

পানির সংকট তীব্র হওয়ায় পানির দাবিতে গত মঙ্গলবার (১১ মার্চ) চট্টগ্রাম ওয়াসা ভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকার কয়েক শতাধিক লোক। পরে ঘেরাও কর্মসূচি পালনকারীরা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বরাবরে স্মারকলিপি দেন। ওয়াসার কর্মকর্তারা পানির সমস্যা দ্রুত সমাধান করার আশ্বাস দিলে তারা ফিরে যান।

চার প্রকল্পে উৎপাদন কমেছে ৬ কোটি লিটার পানি: চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম সংবাদসংস্থাটিকে বলেছেন, ‘চলতি শুষ্ক মৌসুমে ওয়াসার প্রকল্পগুলো নানা সমস্যার মধ্যে পড়েছে। ওয়াসার পানির উৎস হালদা নদী ও কর্ণফুলী নদী। বর্তমানে হালদা নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে দৈনিক ৯ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্প এবং ৯ কোটি লিটার পানির উৎপাদন সক্ষমতার মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছে ৩ কোটি লিটারের মতো। হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার কারনে দিনে দুই বার জোয়ারের সময় দুটি প্রকল্প ৫ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হয়। কেননা হালদা নদীর পানিতে এক হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত প্রতি লিটার পানিতে লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। অপরদিকে ভাটার সময় কর্ণফুলী নদীতে পানির স্তর কমেছে। কর্ণফুলী নদীর পানির উপর নির্ভরশীল দৈনিক ১৪ কোটি লিটার করে ২৮ কোটি লিটার পানির উৎপাদন সক্ষমতার কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প দুটিতে ভাটার সময় পানির স্তর কমে গেছে। এ কারণে এ দুই প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছে দৈনিক ২ থেকে ৩ কোটি লিটার। সব মিলিয়ে চারটি পানি শোধনাগার প্রকল্পে ৫ থেকে ৬ কোটি লিটারের মতো পানির উৎপাদন কমেছে। যার প্রভাব পড়েছে গ্রাহকদের মাঝে।’

কাপ্তাই হৃদের পানি কমে যাওয়ার প্রভাব কর্ণফুলী নদীতে: রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর কমে যাওয়ায় কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। ২৪২ মেগাওয়ার্ট উৎপাদন সক্ষমতার কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট থেকে শুক্রবার (১৪ মার্চ) উৎপাদন হয়েছে একটি ইউনিট থেকে মাত্র ৪০ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ। কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটি মাত্র ইউনিট চালু থাকায় পানি ছাড়া হচ্ছে কম। এ কারণে কর্ণফুলী নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির স্তর কমেছে। জোয়ারের সময় কর্ণফুলী নদীতে পানি স্বাভাবিক থাকলেও ভাটার সময় পানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। এ সময় কর্ণফুলী নদীর উপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম ওয়াসার ২৮ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার দুই প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছে ৩ কোটি লিটারের মতো।

তবে ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট একটি চালু থাকায় স্বল্প পরিমানে পানি ছাড়া হচ্ছে। আরো বেশি ইউনিট চালু থাকলে পানির সংকটে ওয়াসার প্রকল্পে উৎপাদন কমে যেত না।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জাহের বলেন, ‘কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাঁচটি ইউনিটে ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর অনেক কমে গেছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়াতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। শুক্রবার রুলকার্ভ অনুযায়ী কাপ্তাই হ্রদে পানির উচ্চতা ছিল ৮৭ দশমিক ৫৯ এমএসএল। অথচ এ সময়ে পানির উচ্চতা থাকার কথা ছিল ৯১ দশমিক ২৪ এমএসএল। একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ৪০ মেগাওয়াট।’

তিনি আরো বলেন, বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে গেলে দ্রুত কাপ্তাই হ্রদের পানি শেষ হয়ে যাবে। যার কারণে কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট সচল থাকা সত্বেও একটি ইউনিট চালু রেখে অল্প পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে একটি করে ইউনিট চালু রাখা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বৃষ্টি খুবই জরুরি। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত স্বল্প পরিমাণে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে।

ওয়াসার পানির উৎপাদন সক্ষমতা: চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম নগরে দৈনিক ৬০ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সরবরাহের সক্ষমতা আছে ৫০ কোটি লিটার। এরমধ্যে চারটি প্রকল্প থেকে ৪৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হয়। চার প্রকল্পের মধ্যে দুটি হালদা নদী অপর দুটি প্রকল্প অবস্থিত কর্ণফুলী নদীর পাড়ে। মূলত প্রকল্পগুলো এই দুই নদীর পানি সংগ্রহ করে তা পরিশোধনের পর নগরের গ্রাহকদের সরবরাহ করা হয়। রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে অবস্থিত কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-১ এবং কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-২ এ দুটি প্রকল্প দৈনিক ১৪ কোটি লিটার করে ২৮ কোটি লিটার পানির উৎপাদন সক্ষমতা আছে।

অপরদিকে হালদা নদীর পানির উপর নির্ভরশীল মদুনঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্প এবং মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্প। এ প্রকল্প দুটি দৈনিক ৯ কোটি লিটার করে ১৮ কোটি পানির উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। বাকি ৪ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হয় গভীর নলকূপ থেকে।

ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা: চট্টগ্রাম নগরীতে ৪১টি ওয়ার্ড রয়েছে। শুধু এসব ওয়ার্ড এলাকায় রয়েছে ওয়াসার পানির সংযোগ। এতে ৭৮ হাজার ৫৪২টি আবাসিক গ্রাহক এবং ৭ হাজার ৭৬৭ টি আছে বাণিজ্যিক সংযোগ। ৭৭০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে সংস্থাটি পানি সরবরাহ করে থাকে। তবে নগরীর অনেক এলাকায় এখনও পানির সংযোগ পৌঁছায়নি।

কর্মকর্তারা যা বলছেন: চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে কম। এ কারণে ভাটার সময় কর্ণফুলী নদীতে পানির স্তর অনেক কমে যাচ্ছে। এ কারণে ভাটার সময় কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্পে উৎপাদন অনেক কমে যায়। অনেক সময় জোয়ার না আসা পর্যন্ত প্রকল্প দুটি বন্ধ রাখতে হয়। ১৪ কোটি করে ২৮ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার দুটি প্রকল্প থেকে বর্তমানে দুই-তিন কোটি লিটার পানির উৎপাদন কমেছে।’

ক্যাব-এর উদ্বেগ: চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সংকটে গ্রাহকদের ভোগান্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও নগর কমিটির নেতারা। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ক্যাবের নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘রমজান শুরুর আগে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই চট্টগ্রাম ওয়াসা তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করলেও বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে। এছাড়ারাও ওয়াসার পানির উৎস হালদা নদীতে লবণাক্ততা ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বেড়েছে। যে কারণে ওয়াসার চারটি প্রকল্প থেকে পানির উৎপাদন কমেছে ৬ কোটি লিটারের মতো।’

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, পানির সংকটে পড়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকরা। এমনিতেই নগরীর এক চতুর্থাংশ এলাকায় সরবরাহকৃত পানিতে ময়লা ও ঘোলা পানি এবং লাইনে পানি না থাকার মতো নানা সংখটে গ্রাহকরা বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহে চরম দুর্ভোগ পড়েছেন।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা: হালদা নদী গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. শফিকুল ইসলাম বলেন,‘হালদা নদী হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর একটি শাখা খাল। হালদা নদীতে জোয়ারের সময় বঙ্গোপসাগর থেকে লবণাক্ততা পানি প্রবেশ করছে। তা কি পরিমাণ লবণাক্ততা পানি প্রবেশ করছে তা গবেষণার বিষয়। তবে সম্প্রতি ওয়াসার একটি রিপোর্ট আমি দেখেছি। যেখানে বলা হচ্ছে, ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত প্রতি লিটারে তারা হালদার পানিতে লবণাক্ততা পেয়েছে। এটা হলে অত্যন্ত ভয়াবহ। এ পানি পরিশোধন করার পরও লবণের পরিমাণ থেকে যাবে। যা খাওয়ার অনুপযোগী।’

তিনি আরো বলেন, জোয়ারের সময় বঙ্গোপসাগর থেকে হালদা নদীতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে। অন্যদিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে কম। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পর্যাপ্ত পানি ছাড়া হলে তাহলে হালদায় লবণাক্ততা থাকতো না। উজানের পানির স্রোতে হালদায় সাগরের পানি প্রবেশ করতে পারতো না। হালদা নদীতে ৯৮ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। যারমধ্যে চারটি আছে কার্প জাতীয় মাছ। লবণাক্ততা বেড়ে গেলে এসব মাছের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’