ঢাকা ০৫:৫৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তীব্র গরমে অস্থির নগরজীবন

  • আপডেট সময় : ১০:১৯:০০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
  • ১১ বার পড়া হয়েছে

ভ্যাপসা গরমে বাইরে বের হলে দম নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। সকাল ১০টা পর্যন্ত তাপমাত্রা কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে রোদের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এই গরমে রাজধানীতে দুর্ভোগ বেশি বাড়িয়েছে শ্রমজীবী মানুষের। এরইমধ্যে গতকাল রোববার থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় নগরজীবনে যানজট বৃদ্ধির সাথে গরমের অস্বস্তি আরো বেড়েছে।
সরেজমিনে দুপুর আড়াইটার দিকে হাতিরঝিল লেকপাড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, লেকের পাড়ে অসংখ্য মানুষ জমায়েত হয়েছেন। কেউ কেউ আবার পাটি বিছিয়েও পরিবার নিয়ে বিশ্রাম করছেন, কেউ কেউ গাছের নিচে বসার বেঞ্চে গভীর নিদ্রায় আছেন। তাদের অনেকেরই চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। অনেকের রয়েছে জীবনজীবিকার চিন্তাও।
‘এই গরমে কাম করতে পারি না, বাসায়ও থাকতে পারি না। টিনশেডের ঘরের মধ্যে মনে হয় আগুনের গোল্লা বাইর হয়, ফ্যান ছাড়লে গরম বাতাস বাইর হয়। তাই এই হাতিরঝিলে গাছের নিচে বইসা আছি। একদিন কাম করি একদিন জিরাই।’
সম্প্রতি এক দুপুরে একটি সংবাদসংস্থার সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন কারওয়ান বাজারের দিনমজুর তাজুল ইসলাম।
৪৮ বছর বয়সী এই শ্রমজীবী বলেন, বেগুনবাড়ি বস্তিতে থাকি, দিনের বেলা কারওয়ান বাজারের লেবারের (শ্রমিক) কাম করি। গতকাইল কাম কইরা কাহিল হইয়া গেছি। আইজকা আর কামে যাইতে সাহস পাইনাই। ১১টা নাগাদ ঘরে ফ্যান ছাইরা শুইয়া ছিলাম। তয় গরমে আর থাকতে পারি নাই। আইলাম হাতিরঝিল গাছের নিচে, এইহানে একটু বাতাস পামু। এইহানেও বাতাস নাই, তয় ছায়া আছে। তিন বছরের শিশু শিফাতকে নিয়ে বেগুনবাড়ির সাবানা বসেছিলেন লেকপাড়ে। তিনি বলেন, গরমে ঘরে থাকতো পারি না। কী করুম! তাই এই যায়গায় বইসা আছি। এই যায়গাতেও গরম অনেক, তয় একটু পর পর বাতাস আহে। এইহানে গাছের ছায়া আছে, তাই একটু গরম কম আরকি। ঘরের মধ্যে থাকলে দম বন্ধ হইয়া যায়। মনে হয় সিদ্ধ হইয়া যাই। হাতিঝিলেও একটু পর পর অনেক গরম বাতাস আহে, মনে হয় চেহারা পুইরা যায়। গরমের মধ্যে রান্নাও করতে পারি না। এক বেলা রাইনদা তিন বেলা খাই।
বউবাজার এলাকায় থাকেন সুমি। তিনি তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে পাটি বিছিয়ে বিশ্রাম করছেন হাতিরঝিলে। তিনি বলেন, বাচ্চাগো লইয়া ঘরে থাকতে পারি না। রাস্তায় বাইর হইলে মনে হয় শরীরডা পুইরা যায়। লেকপাড়ে আইসা বইসা আছি। রোদ কমলে বিকালে বাসায় যাইয়া রান্না কইরা খামু। দুপুরে না খাইয়াই আছি। বাচ্চাগো রুডি কিনা দিছিলাম একটু আগে।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের কয়েকদিন পর থেকেই গরমে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশুসহ প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মুগদা জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগে ইতোমধ্যে কোনো শয্যা খালি নেই। ঢাকা মেডিকেলে সিট না পেয়ে মেঝেতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকেই। এছাড়াও মহাখালীতে আইসিডিডিআরবি মেডিকেলেও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকে ডায়রিয়া রোগীতে।
২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, প্রতি বছরই এই সিজনে দেশের তাপমাত্রা বেশি থাকে। তাই সুস্থ থাকতে হলে সবাইকেই কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। দিনের বেলা বাইরে বের হলে অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করা উচিত। এছাড়াও সবাইকেই সুতি কাপড় পরিধান করে চলাচল করতে হবে। কিছুক্ষণ পর পর বিশুদ্ধ খাবার পানি পান করতে হবে।
আয়েশা আক্তার বলেন, যারা দিনের বেলায় বাইরে থাকেন তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যদি ক্লান্তি অনুভব হয়, মাথা ঘুরায় তাহলে ছায়াযুক্ত স্থানে যেতে হবে। শরীরে বাতাস লাগাতে হবে। মাথায় ও হাতে মুখে পানি দিতে হবে। প্রয়োজন হলে নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে হবে। কারণ এই সময়টাতে হিট স্ট্রোকের আশঙ্কা বেশি থাকে।
রিকশাচালক ও দিনমজুরদের উদ্দেশ করে এই চিকিৎসক বলেন, যারা দিনমজুর বা রিকশা চালান তাদের একটু পর পর বিশ্রাম নিয়ে কাজ করতে হবে। টানা রৌদের মধ্যে কাজ করলে অসুস্থ হবার আশঙ্কা বেশি থাকে। এমনকি হিট স্ট্রোক করে মৃত্যুঝুঁকি থাকে। অনেকের খিচুনি হতে পারে এবং বমিও হতে পাড়ে। সেই ক্ষেত্রে দ্রুত সময়ে তাদের চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
গরমের দিনে বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রতি বেশি নজর রাখতে হবে উল্লেখ করে আয়েশা আক্তার বলেন, এই গরমে বৃদ্ধ এবং শিশুদের বেশি করে নজরদারি করতে হবে। কারণ এই সময় ডায়রিয়া ও কলেরার প্রকোপ বেশি থাকে। তাদেরকে বাতাসের মধ্যে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে তারা ঘামাচ্ছে কি না। ঘাম হলে সঙ্গে সঙ্গে শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। বিশুদ্ধ পানি ও শাক-সবজি, ফল খাওয়াতে হবে বেশি বেশি। পচা-বাসি কোনোমতেও খাওয়ানো যাবে না। চিকিৎসক আয়েশা আক্তার বলেন, এই সময়টাতে যারা বাইরে কাজ করেন দিনের বেলা বাইরেই থাকতে হয়। তারা বাইরের খাবার খেয়ে থাকেন। বাইরের খোলা পানি পান করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের উচিত খোলা খাবার পরিহার করা। অনেক সময় খাবার ঢেকে না রাখায় জীবাণু ছরায়। পানিপানের ক্ষেত্রে পরিস্কার বিশুদ্ধ পানি পান করতেই হবে।
রাজধানীতে তীব্র এই গরমে বেশি বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষেরা। বিশেষ করে দিনের বেলা দিনমজুর, রিকশা-ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষদের কর্মজীবন ব্যহত হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমজীবীদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা টাইমসের। তারা জানিয়েছেন গরমের জন্য দিনের বেলা আগের মতো কাজ করতে পারছেন না। অনেকেই একটু কাজ করলেই অসুস্থ হচ্ছেন।
মগবাজার এলাকায় ৫৮ বছর বয়সী রিকশাচালক আব্দুল লতিফ তার রিকসায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেলেন। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ৩২ বছর ধইরা রিকশা চালাই ঢাকা শহরে, তয় এমন গরম আগে কহনো লাগে নাই। রৌদের লগে গরম বাতাস বাইর হয়। মনে হয় শরিলডা পুইরা যায়। কয়েকদিন আগেই ডেইলি রিকশা চালাইয়া ১৫০০-১৬০০ টাহা ঘরে লইয়া যাইতাম। এই দুই-তিন দিন ধইরা খ্যাপ মারতে পারি না। রিকশা চালাইতে অনেক কষ্ট হয়। এহন ডেইলি চারশ-পাঁচশ টাকার খ্যাপ মারতে পারি। আর এই গরমে যাত্রীও পাই না। আগের মতো কেউ রাস্তায় বাইর হয় না। একটা খ্যাপ মারলে আধাঘণ্টা বইসা জিরান লাগে, লেবুর শরবত খাওন লাগে।
বাংলামোটর মোড়ে গিয়ে দেখা যায় রাস্তার পাশে কয়েকজন মোটরসাইকেল চালক ছায়ায় বসে আছেন। তাদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা টাইমসের এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, গরমে আগের মত অনেকেই পাঠাও বা মোটরসাইকেলে যাত্রী উঠছে না। বর্তমানে অনেক রাইডাররাই যাত্রী সংকটে ভুগছেন।
এদিকে রাজধানীর অফিস পাড়াগুলোতেও অসহনীয় গরমে দিশেহারা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরাও। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় অনেকের গরমের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সচিবালয় এলাকার নিরাপত্তায় থাকা একাধিক পুলিশ সদস্য ঢাকা টাইমসকে বলেন, তীব্র গরমে তাদের দাঁড়িয়ে ও বসে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় টানা দাড়িয়েও দায়িত্ব পালন করতে হয়, সেখানে মাথার ওপর ছায়াও থাকে না।
এদিকে দিনের বেলা ছাতা নিয়ে সড়কে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় ট্র্যাফিক সদস্যদের। তবে গরমে তারাও অতিষ্ঠ বলে জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাফিক সদস্যরা জানান, রোদের তাপে ছাতা দিয়ে সূর্যের আলো এড়ানো গেলেও গরম এড়ানো যাচ্ছে না। তাছাড়াও একদিকে গণপরিবহনের ইঞ্জিনের তাপ, অন্যদিকে ভ্যাপসা গরম, এরমধ্যে গরম হাওয়া, সব মিলিয়ে সড়কে দায়িত্ব পালন করাটাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের।
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, মার্চ-এপ্রিল মাস হচ্ছে উষ্ণতম মাস, এই সময় আমাদের দেশের ওপর সূর্য কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। তখন সূর্য সোজা মাথার ওপর কিরণ দিয়ে থাকে। তাই তাপমাত্রা বেশি থাকে। এই মৌসুমে ভ্যাপসা গরম বা গরম হাওয়া বয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, আমাদের দেশে প্রধানত উত্তর-দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত। এ সময় দক্ষিণ দিক থেকে বেশি বাতাস প্রবাহিত হলে ভ্যাপসা গরম বা গরম হাওয়া অনুভুত হয়। বাসের আদ্রতা মূলত বেড়ে গেলে ভ্যাপসা গরম বেড়ে যায়। আমাদের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থাকায় জলিয়বাস্পের পরিমাণ বেশি হয়। বাতাসে জলিয়বাস্পের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং তাপমাত্র বেশি থাকলে গরম বেশি মনে হয়।
তাপমাত্র বেশি হলে সবার করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে নাজমুল হক বলেন, যারা মাঠে কাজ করেন তাদের কর্ম পরিকল্পনার সময়ের পরিবর্তন করতে হবে। কর্মঘণ্টা পরিবর্তন করে কাজ করতে হবে। দেশে এই সিজনে দুপুর ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত বেশি গরম থাকে। তাই এই সময়টাতে রোদের মধ্যে কাজ না করে বিশ্রাম নেওয়াটাই উত্তম। সেই ক্ষেত্রে ভোর ৫টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আবার বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করা যেতে পারে। তাহলেও দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করা যায়।
নাজমুল হক বলেন, গরমের দিনে অধিকাংশ রিকশাচালক এবং দিনমুজুরেরা অসুস্থ হন। কারণ তারা নিয়ম মানতে অভ্যস্ত নন। তারা রাস্তায় খোলা পানি পান করেন এবং খোলা খাবার খেয়ে থাকেন। তাদের এই অভ্যাস পরিহার করতে হবে। প্রয়োজনে তারা বাসা থেকে রান্না করা খাবার ও পানি সঙ্গে রেখে সময়মত খেতে পারেন।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

তীব্র গরমে অস্থির নগরজীবন

আপডেট সময় : ১০:১৯:০০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

ভ্যাপসা গরমে বাইরে বের হলে দম নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। সকাল ১০টা পর্যন্ত তাপমাত্রা কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে রোদের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এই গরমে রাজধানীতে দুর্ভোগ বেশি বাড়িয়েছে শ্রমজীবী মানুষের। এরইমধ্যে গতকাল রোববার থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় নগরজীবনে যানজট বৃদ্ধির সাথে গরমের অস্বস্তি আরো বেড়েছে।
সরেজমিনে দুপুর আড়াইটার দিকে হাতিরঝিল লেকপাড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, লেকের পাড়ে অসংখ্য মানুষ জমায়েত হয়েছেন। কেউ কেউ আবার পাটি বিছিয়েও পরিবার নিয়ে বিশ্রাম করছেন, কেউ কেউ গাছের নিচে বসার বেঞ্চে গভীর নিদ্রায় আছেন। তাদের অনেকেরই চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। অনেকের রয়েছে জীবনজীবিকার চিন্তাও।
‘এই গরমে কাম করতে পারি না, বাসায়ও থাকতে পারি না। টিনশেডের ঘরের মধ্যে মনে হয় আগুনের গোল্লা বাইর হয়, ফ্যান ছাড়লে গরম বাতাস বাইর হয়। তাই এই হাতিরঝিলে গাছের নিচে বইসা আছি। একদিন কাম করি একদিন জিরাই।’
সম্প্রতি এক দুপুরে একটি সংবাদসংস্থার সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন কারওয়ান বাজারের দিনমজুর তাজুল ইসলাম।
৪৮ বছর বয়সী এই শ্রমজীবী বলেন, বেগুনবাড়ি বস্তিতে থাকি, দিনের বেলা কারওয়ান বাজারের লেবারের (শ্রমিক) কাম করি। গতকাইল কাম কইরা কাহিল হইয়া গেছি। আইজকা আর কামে যাইতে সাহস পাইনাই। ১১টা নাগাদ ঘরে ফ্যান ছাইরা শুইয়া ছিলাম। তয় গরমে আর থাকতে পারি নাই। আইলাম হাতিরঝিল গাছের নিচে, এইহানে একটু বাতাস পামু। এইহানেও বাতাস নাই, তয় ছায়া আছে। তিন বছরের শিশু শিফাতকে নিয়ে বেগুনবাড়ির সাবানা বসেছিলেন লেকপাড়ে। তিনি বলেন, গরমে ঘরে থাকতো পারি না। কী করুম! তাই এই যায়গায় বইসা আছি। এই যায়গাতেও গরম অনেক, তয় একটু পর পর বাতাস আহে। এইহানে গাছের ছায়া আছে, তাই একটু গরম কম আরকি। ঘরের মধ্যে থাকলে দম বন্ধ হইয়া যায়। মনে হয় সিদ্ধ হইয়া যাই। হাতিঝিলেও একটু পর পর অনেক গরম বাতাস আহে, মনে হয় চেহারা পুইরা যায়। গরমের মধ্যে রান্নাও করতে পারি না। এক বেলা রাইনদা তিন বেলা খাই।
বউবাজার এলাকায় থাকেন সুমি। তিনি তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে পাটি বিছিয়ে বিশ্রাম করছেন হাতিরঝিলে। তিনি বলেন, বাচ্চাগো লইয়া ঘরে থাকতে পারি না। রাস্তায় বাইর হইলে মনে হয় শরীরডা পুইরা যায়। লেকপাড়ে আইসা বইসা আছি। রোদ কমলে বিকালে বাসায় যাইয়া রান্না কইরা খামু। দুপুরে না খাইয়াই আছি। বাচ্চাগো রুডি কিনা দিছিলাম একটু আগে।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের কয়েকদিন পর থেকেই গরমে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশুসহ প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মুগদা জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগে ইতোমধ্যে কোনো শয্যা খালি নেই। ঢাকা মেডিকেলে সিট না পেয়ে মেঝেতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকেই। এছাড়াও মহাখালীতে আইসিডিডিআরবি মেডিকেলেও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকে ডায়রিয়া রোগীতে।
২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, প্রতি বছরই এই সিজনে দেশের তাপমাত্রা বেশি থাকে। তাই সুস্থ থাকতে হলে সবাইকেই কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। দিনের বেলা বাইরে বের হলে অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করা উচিত। এছাড়াও সবাইকেই সুতি কাপড় পরিধান করে চলাচল করতে হবে। কিছুক্ষণ পর পর বিশুদ্ধ খাবার পানি পান করতে হবে।
আয়েশা আক্তার বলেন, যারা দিনের বেলায় বাইরে থাকেন তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যদি ক্লান্তি অনুভব হয়, মাথা ঘুরায় তাহলে ছায়াযুক্ত স্থানে যেতে হবে। শরীরে বাতাস লাগাতে হবে। মাথায় ও হাতে মুখে পানি দিতে হবে। প্রয়োজন হলে নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে হবে। কারণ এই সময়টাতে হিট স্ট্রোকের আশঙ্কা বেশি থাকে।
রিকশাচালক ও দিনমজুরদের উদ্দেশ করে এই চিকিৎসক বলেন, যারা দিনমজুর বা রিকশা চালান তাদের একটু পর পর বিশ্রাম নিয়ে কাজ করতে হবে। টানা রৌদের মধ্যে কাজ করলে অসুস্থ হবার আশঙ্কা বেশি থাকে। এমনকি হিট স্ট্রোক করে মৃত্যুঝুঁকি থাকে। অনেকের খিচুনি হতে পারে এবং বমিও হতে পাড়ে। সেই ক্ষেত্রে দ্রুত সময়ে তাদের চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
গরমের দিনে বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রতি বেশি নজর রাখতে হবে উল্লেখ করে আয়েশা আক্তার বলেন, এই গরমে বৃদ্ধ এবং শিশুদের বেশি করে নজরদারি করতে হবে। কারণ এই সময় ডায়রিয়া ও কলেরার প্রকোপ বেশি থাকে। তাদেরকে বাতাসের মধ্যে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে তারা ঘামাচ্ছে কি না। ঘাম হলে সঙ্গে সঙ্গে শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। বিশুদ্ধ পানি ও শাক-সবজি, ফল খাওয়াতে হবে বেশি বেশি। পচা-বাসি কোনোমতেও খাওয়ানো যাবে না। চিকিৎসক আয়েশা আক্তার বলেন, এই সময়টাতে যারা বাইরে কাজ করেন দিনের বেলা বাইরেই থাকতে হয়। তারা বাইরের খাবার খেয়ে থাকেন। বাইরের খোলা পানি পান করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের উচিত খোলা খাবার পরিহার করা। অনেক সময় খাবার ঢেকে না রাখায় জীবাণু ছরায়। পানিপানের ক্ষেত্রে পরিস্কার বিশুদ্ধ পানি পান করতেই হবে।
রাজধানীতে তীব্র এই গরমে বেশি বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষেরা। বিশেষ করে দিনের বেলা দিনমজুর, রিকশা-ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষদের কর্মজীবন ব্যহত হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমজীবীদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা টাইমসের। তারা জানিয়েছেন গরমের জন্য দিনের বেলা আগের মতো কাজ করতে পারছেন না। অনেকেই একটু কাজ করলেই অসুস্থ হচ্ছেন।
মগবাজার এলাকায় ৫৮ বছর বয়সী রিকশাচালক আব্দুল লতিফ তার রিকসায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেলেন। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ৩২ বছর ধইরা রিকশা চালাই ঢাকা শহরে, তয় এমন গরম আগে কহনো লাগে নাই। রৌদের লগে গরম বাতাস বাইর হয়। মনে হয় শরিলডা পুইরা যায়। কয়েকদিন আগেই ডেইলি রিকশা চালাইয়া ১৫০০-১৬০০ টাহা ঘরে লইয়া যাইতাম। এই দুই-তিন দিন ধইরা খ্যাপ মারতে পারি না। রিকশা চালাইতে অনেক কষ্ট হয়। এহন ডেইলি চারশ-পাঁচশ টাকার খ্যাপ মারতে পারি। আর এই গরমে যাত্রীও পাই না। আগের মতো কেউ রাস্তায় বাইর হয় না। একটা খ্যাপ মারলে আধাঘণ্টা বইসা জিরান লাগে, লেবুর শরবত খাওন লাগে।
বাংলামোটর মোড়ে গিয়ে দেখা যায় রাস্তার পাশে কয়েকজন মোটরসাইকেল চালক ছায়ায় বসে আছেন। তাদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা টাইমসের এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, গরমে আগের মত অনেকেই পাঠাও বা মোটরসাইকেলে যাত্রী উঠছে না। বর্তমানে অনেক রাইডাররাই যাত্রী সংকটে ভুগছেন।
এদিকে রাজধানীর অফিস পাড়াগুলোতেও অসহনীয় গরমে দিশেহারা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরাও। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় অনেকের গরমের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সচিবালয় এলাকার নিরাপত্তায় থাকা একাধিক পুলিশ সদস্য ঢাকা টাইমসকে বলেন, তীব্র গরমে তাদের দাঁড়িয়ে ও বসে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় টানা দাড়িয়েও দায়িত্ব পালন করতে হয়, সেখানে মাথার ওপর ছায়াও থাকে না।
এদিকে দিনের বেলা ছাতা নিয়ে সড়কে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় ট্র্যাফিক সদস্যদের। তবে গরমে তারাও অতিষ্ঠ বলে জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাফিক সদস্যরা জানান, রোদের তাপে ছাতা দিয়ে সূর্যের আলো এড়ানো গেলেও গরম এড়ানো যাচ্ছে না। তাছাড়াও একদিকে গণপরিবহনের ইঞ্জিনের তাপ, অন্যদিকে ভ্যাপসা গরম, এরমধ্যে গরম হাওয়া, সব মিলিয়ে সড়কে দায়িত্ব পালন করাটাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের।
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, মার্চ-এপ্রিল মাস হচ্ছে উষ্ণতম মাস, এই সময় আমাদের দেশের ওপর সূর্য কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। তখন সূর্য সোজা মাথার ওপর কিরণ দিয়ে থাকে। তাই তাপমাত্রা বেশি থাকে। এই মৌসুমে ভ্যাপসা গরম বা গরম হাওয়া বয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, আমাদের দেশে প্রধানত উত্তর-দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত। এ সময় দক্ষিণ দিক থেকে বেশি বাতাস প্রবাহিত হলে ভ্যাপসা গরম বা গরম হাওয়া অনুভুত হয়। বাসের আদ্রতা মূলত বেড়ে গেলে ভ্যাপসা গরম বেড়ে যায়। আমাদের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থাকায় জলিয়বাস্পের পরিমাণ বেশি হয়। বাতাসে জলিয়বাস্পের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং তাপমাত্র বেশি থাকলে গরম বেশি মনে হয়।
তাপমাত্র বেশি হলে সবার করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে নাজমুল হক বলেন, যারা মাঠে কাজ করেন তাদের কর্ম পরিকল্পনার সময়ের পরিবর্তন করতে হবে। কর্মঘণ্টা পরিবর্তন করে কাজ করতে হবে। দেশে এই সিজনে দুপুর ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত বেশি গরম থাকে। তাই এই সময়টাতে রোদের মধ্যে কাজ না করে বিশ্রাম নেওয়াটাই উত্তম। সেই ক্ষেত্রে ভোর ৫টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আবার বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করা যেতে পারে। তাহলেও দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করা যায়।
নাজমুল হক বলেন, গরমের দিনে অধিকাংশ রিকশাচালক এবং দিনমুজুরেরা অসুস্থ হন। কারণ তারা নিয়ম মানতে অভ্যস্ত নন। তারা রাস্তায় খোলা পানি পান করেন এবং খোলা খাবার খেয়ে থাকেন। তাদের এই অভ্যাস পরিহার করতে হবে। প্রয়োজনে তারা বাসা থেকে রান্না করা খাবার ও পানি সঙ্গে রেখে সময়মত খেতে পারেন।