আইরিন সুলতানা : রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার পতিত জমি চাষ করতে দিলেন গোপাল ভাঁড়কে। তা কী ফলাবে গোপাল? সবজি। কী সবজি হে? আজ্ঞে বেগুন; বেগুনের অনেক গুণ।
বেগুনে ভিটামিন আছে। আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। বেগুন চোখের জন্য ভালো। ত্বকের জন্য ভালো। বেগুন ভর্তা মুখরোচক। পোলাও পাতে আর কিছু না হোক, গোল গোল বেগুন মচমচে করে ভাজা হলেও বর্তে যাই। শীতেও বেগুন। গরমেও বেগুন। প্রতি রোজায় বেগুনের দাম চড়ে গেলে কি সরকার কি সিন্ডিকেট, কাউকেই ছাড় দেয় না পাবলিক, অ্যাকটিভিস্ট, কলামনিস্টরা। সেই বেগুন আবার আলোচনায়। সেই বেগুন এবার গবেষণায়।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে স্বাস্থ্য নিয়ে হরেক গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ানের মতো বিদেশি পত্রিকাগুলো সেসব নিয়ে খবর করে। সেই সব ইংরেজি খবরের বাংলা হয় দেশের পত্রিকাতেও। দেড়শ বছর পুরোনো নেচার জার্নালের নামও নিশ্চিত এভাবে অনেকের নজরে পড়বে। তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশলের জন্য রয়েছে আইইইই, রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইলেকট্রনিকস। কারও যদি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের নাম মনে পড়ে যায়, তাহলে বলে রাখি এটা অবশ্য একটা পত্রিকা।
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণাপত্রও প্রকাশ পাচ্ছে দেশি-বিদেশি কনফারেন্স পেপার ও জার্নালে। গবেষণা মানেই খটমটে কিছু। এরপরও হালে দুটো গবেষণাপত্র নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে জমাটে আলোচনা দেখা গেছে।
বেগুনে ক্যান্সারের উপাদান পাওয়া গেছে বলে ১৮ অক্টোবর দৈনিক জনকণ্ঠ খবর করেছিল। বাংলা ট্রিবিউনে এই খবর আসে সপ্তাহ দুয়েক পর; ১ নভেম্বর। এরপর একাত্তর চ্যানেলে টকশো হয়। টকশোতে বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্টই দেখানো হয়। হয়তো এ কারণে টকশোতে আলোচক হিসেবে ছিলেন ওই পত্রিকার সংবাদকর্মী উদিসা ইসলাম। যদিও মূল গবেষণাপত্রটি কিন্তু টকশোতে দেখানো হয়নি একবারও।
আলোচিত গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ঐঁসধহ যবধষঃয রসঢ়ষরপধঃরড়হং ড়ভ ঃৎধপব সবঃধষ পড়হঃধসরহধঃরড়হ রহ ঃড়ঢ়ংড়রষং ধহফ নৎরহলধষ ভৎঁরঃং যধৎাবংঃবফ ভৎড়স ধ ভধসড়ঁং নৎরহলধষ‑ঢ়ৎড়ফঁপরহম ধৎবধ রহ ইধহমষধফবংয; যে শিরোনামে কিছু চুম্বক অংশ আছে। এক. বাংলাদেশের বহুল পরিচিত বেগুন উৎপাদনশীল এলাকা, দুই. সেখানে চাষ করা বেগুনে ট্রেস ধাতু দূষণ, তিন. সেই জমির উপরিভাগের মাটিতে (টপসয়েল) ট্রেস ধাতু দূষণ এবং চার. এই ট্রেস ধাতু থাকা বেগুনে মানব স্বাস্থ্যে প্রভাব।
গবেষণায় বেগুন নেওয়া হলে ঝিংগা কেন নয়? টকশোতে রোষকষায়িত নেত্রে প্রশ্নটি করেন সাংবাদিক-লেখক মাসুদা ভাট্টি। ওই সময় উদিসা ইসলাম চেহারায় সমর্থনের হাসি ছড়িয়ে বলেন, এক্সাক্টলি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ইধহমষধফবংয অমৎরপঁষঃঁৎধষ ঝঃধঃরংঃরপং ণবধৎনড়ড়শ-২০১৮ এবং ২০১৫ সালের চড়ঢ়ঁষধঃরড়হ চৎড়লবপঃরড়হ ড়ভ ইধহমষধফবংয: উুহধসরপং ধহফ ঞৎবহফং ২০১১–২০৬১ প্রকাশনার বরাতে বেগুন নিয়ে দারুণ পদের তথ্য আছে এই গবেষণাপত্রে। এই গবেষণার জন্য এলাকা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে জামালপুর জেলার ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলা। কেন?
গবেষণাপত্রে বলা আছে, দেশে বেগুন উৎপাদনে শীর্ষ জেলাগুলোর একটি জামালপুর। সারাদেশে মোট উৎপাদিত বেগুনের প্রায় ৮.৫% হয় জামালপুরে। আর এই উৎপাদনের বেশিরভাগই হয় ইসলামপুর উপজেলাতে; ৬০.৪%। গরম ও শীত মৌসুমে দেশে উৎপাদিত দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সবজি হচ্ছে বেগুন। দেশে প্রতিদিন একজন মানুষ ৭.২৮ গ্রাম বেগুন খেয়ে থাকেন। আর তাই এলাকা হিসেবে ইসলামপুর-মেলান্দহ এবং সবজি হিসেবে বেগুন গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া যেতেই পারে।
মাসুদা ভাট্টির কথায় বোঝা গেল, গবেষণাটি যে কোন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তা তিনি জানেনই না। মাসুদা ভাট্টি ক্ষণে ক্ষণে পত্রিকার খবর থেকে পাঠ করছিলেন; সেখানে কিন্তু লেখা ছিল জার্নালে প্রকাশের কথা। এ-ও বোঝা গেল, তিনি মূল গবেষণাটি পড়েননি।
গুগোলে সার্চ দিলে রেজাল্টে এই গবেষণাপত্র মেলা কষ্টকর কিছু নয়। রিসার্চগেট ডটনেট থেকে ১৫ পাতার পিডিএফ ফরম্যাট ডাউনলোড করা যাচ্ছে। নেচার ডটকম লিংকের সায়েন্টিফিক রিপোর্ট বিভাগে গত ২২ আগস্ট পুরো গবেষণা প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছে। স্প্রিংগার নেচার ও নেচার পোর্টফোলিও এবং সায়েন্টিফিক রিপোর্টস-এসব নাম, ট্যাগ বা ক্যাটাগরিগুলো কিছুটা ব্র্যান্ডের মতোই। জনকণ্ঠ লিখেছে, নেচার পোর্টফোলিওতে গবেষণার ফল প্রকাশ পেলে এ নিয়ে ‘তোলপাড় শুরু হয়’।
জনকণ্ঠে যখন প্রতিবেদন লেখা হচ্ছিল তখন এই গবেষণার ফল নিয়ে কোথায় তোলপাড় হচ্ছিল? জনকণ্ঠে প্রকাশের সপ্তাহদুয়েক পর বাংলা ট্রিবিউনে খবর হলে সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকে শেয়ার করেন। একাত্তরে টকশোর পরে অবশ্য তোলপাড় চলছে; তবে তা মিথিলা ফারজানা, উদিসা ইসলাম ও মাসুদা ভাট্টিকে নিয়ে। বাংলা ট্রিবিউন লিখেছে সায়েন্টিফিক রিপোর্ট জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ পেয়েছে। জার্নাল কোথায় প্রকাশ পেলো, তা জানা অবশ্যই জরুরি। এই দুটি পত্রিকা খবর প্রকাশের আগে গবেষকদের থেকে জেনে তথ্যটি নিশ্চিত করেনি কেন?
বাংলা ট্রিবিউনের খবরে ‘অধ্যাপক ডক্টর জাকির হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন’-এভাবে লেখা আছে। ‘গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন বলেন’-এভাবেও লেখা আছে। এই ‘নিশ্চিত’ করা এবং ‘বলেন’ এর উৎস কী? প্রেস রিলিজ নাকি ফোন-সরাসরি কথা?
জনকণ্ঠের খবরের শেষে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বরাতে লেখা হয়েছে, জামালপুরে কিডনি রোগী বাড়ার পেছনেও এই হেভি মেটালযুক্ত বেগুনের ভূমিকা থাকতে পারে। ওই একই কথা বাংলা ট্রিবিউনও লিখেছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. খুরশেদ আলমের বরাতে।
জামালপুরে কিডনি রোগী ‘বেড়ে যাচ্ছে’ এটি কি প্রমাণিত তথ্য? কবে থেকে রোগী বাড়ছে? শুধু ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি রোগী গুনে এই তথ্য দেওয়া হচ্ছে? গোটা জামালপুরে কোনো জরিপ হয়েছে?
জামালপুরের বেগুন পাইকাররা রাজধানী ঢাকার বাজারেও নিয়ে আসেন। তাহলে ঢাকায়ও কিডনি রোগী বেড়ে যাওয়ার কথা। জনকণ্ঠ, বাংলা ট্রিবিউন এবং একাত্তর চ্যানেলের কী অভিমত জামালপুরে কিডনি রোগী বেড়ে যাওয়া নিয়ে?
মাসুদা ভাট্টির ভীষণ উদ্বেগ, এই গবেষণা নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়ে গেল…! ফারজানা মিথিলা বললেন, এসব গবেষণা পাবলিক করতে হবে কেন?
গবেষণাটি বাংলাদেশের কৃষি-খাদ্য নিরাপত্তার মানের একটি দিক নিয়ে করা এবং বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত। তারমানে পাঁচ গবেষকের এই গবেষণাটি আরও অনেক গবেষণাপত্রের মতো সবার পড়ার জন্য উন্মুক্ত। গবেষক দল তাদের প্রকাশিত গবেষণার কথা জানাতেই পারেন প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে। সংবাদ সম্মেলন করেও। এটি খবর হিসেবে আদৌ ছাপা হবে কিনা তা একেবারেই ওই সংবাদমাধ্যমের বিষয়।
ঢাকা ও আশেপাশে দূষণে আক্রান্ত নদীতে অক্সিজেনের (ডিও) মান যাচাইয়ের পরীক্ষা হয় মাঝেমাঝে। সরকারিভাবেও হয়, আবার নদী গবেষকরাও করেন। পুরো নদী নয় বরং বিশেষ বিশেষ অংশে ভিন্ন ভিন্ন সময় পরীক্ষা করা হয়। হয়তো শীতলক্ষ্যায় ডেমরা ঘাটে ডিও মাপা হয়। বিশনন্দী খালের বেশ কয়েকটি স্থানের পানিতে ক্রোমিয়ামের অতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া যায়। এসব উদ্বেগজনক খবর বহু পত্রিকায় নিয়মিত হয়েছে।
মায়ের বুকের দুধে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে বলে অক্টোবরে একটি গবেষণাপত্র নিয়ে খবর করেছিল গার্ডিয়ানসহ কিছু বিদেশি পত্রিকা। সেই বরাতে বাংলাদেশেও শিরোনাম হয়েছিল খবরটি। ওই খবরে পাবলিকের উদ্বেগও দেখা গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়াতে।
ওই গবেষণায় মাত্র ৩৪ জন মায়ের বুকের দুধের নমুনা নিয়ে ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক পেয়েছিলেন গবেষকরা। শিশুদের শরীরে এর প্রভাব কী হতে পারে তা ওই গবেষণায় পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা মেসেজ দিয়েছিলেন, এরপর যেন বিস্তারিত গবেষণা হয়।
ঐবধাু সবঃধষ ফবঃবৎসরহধঃরড়হ ড়ভ নৎরহলধষ পঁষঃরাধঃবফ রহ ঝড়রষ রিঃয ধিংঃবং শিরোনামে দেশের বারি-১ ও বারি-৪ জাতের বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ঠবমবঃধনষবং পড়হঃধসরহধঃরড়হ নু যবধাু সবঃধষং ধহফ ধংংড়পরধঃবফ যবধষঃয ৎরংশ ঃড় ঃযব ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ রহ কড়শধ ধৎবধ ড়ভ পবহঃৎধষ ঊঃযরড়ঢ়রধ শিরোনামে ইথিওপিয়ার জমিতে উৎপাদিতে সবজিতে ভারী ধাতু থাকা নিয়েও গবেষণা হয়েছে বিদেশে। ঐবধাু সবঃধষ (অং, ঈফ, ধহফ চন) পড়হপবহঃৎধঃরড়হ রহ ংবষবপঃবফ ষবধভু াবমবঃধনষবং ভৎড়স ঔবহমশধ, গধষধুংরধ, ধহফ ঢ়ড়ঃবহঃরধষ যবধষঃয ৎরংশং শিরোনামে মালয়েশিয়ার গবেষণা প্রতিবেদন আছে স্প্রিংগার ডটকমে। এসব গবেষণা পাবলিক।
এমন অনেক গবেষণা পূর্ণাঙ্গ চিত্র না দিলেও কোনো বিশেষ দিকে আলো ফেলে, যেন এ নিয়ে আরও গবেষণা করার পথ তৈরি হয়। অল্প পরিসরে অনেক গবেষণাই নিয়মিত হয়, গবেষণার ফল প্রকাশ হয়। সময়, লোকবল, অর্থায়নের কারণেও একাডেমিক গবেষণার ফোকাস সীমিত থাকে। তবে এসব বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ-উপাত্ত পরের গবেষণার রেফারেন্স হয়ে ওঠে। জামালপুরের বেগুন নিয়ে এই গবেষণাটিও তেমন একটি রেফারেন্স হলো।
এই গবেষণার কারণে কী বেগুন ব্যান করতে হবে সরকারকে? বেগুনের দাম পড়ে যাবে? এমন আশংকা, উত্তেজনা চোখেমুখে-হাত নেড়ে প্রকাশ করেছেন মাসুদা ভাট্টি।
ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে এমন ভঙ্গিমায় মিথিলা ফারজানা জানতে চেয়েছেন, ভারী ধাতু তো পাওয়া গেল, তাহলে এখন করণীয় কী?
বুকের দুধে মাইক্রোপ্লাস্টিক মেলার পর এমন প্রশ্ন ওই গবেষকদেরও সামনে এসেছিল। উত্তরে মায়ের বুকের দুধের কোনো বিকল্প নেই, এমন কথাই বলেছিলেন গবেষকরা। কেউ বলেছিলেন মায়েরা যেন প্লাস্টিক মোড়কে থাকা খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলেন।
বাকৃবির বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্রে বলা আছে, ৬০টি টপসয়েল ও ৮০টি বেগুনের নমুনা নিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে। তাহলে এই গবেষণা স্পষ্টতই সারাদেশে উৎপাদিত বেগুনের জন্য নয়। এমনকি জামালপুর অঞ্চলের সব বেগুন ক্ষেতের চিত্রও এটি নয়।
চিংড়িতে জেলি পুশ করার ও প্লাস্টিক মেলার খবর গত কয়েক বছর ধরে আসছে পত্রিকায়। এতে ক্যান্সার ঝুঁকির কথাও উঠে এসেছে। এসব পাবলিক খবর। নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণেও এসব খবর হয়। চিংড়ি এখনও ব্যান হয়নি। চিংড়ির দাম কমেনি। দেশে কেউ আর চিংড়ি খাচ্ছে না এমনটিও জানা যায়নি। তবে চিংড়িতে বিষাক্ত জেলি মেশানোর কারণে কারাদ- হয়েছে। চিংড়ি নীতিমালা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বেশিরভাগ গবেষণাপত্র টেবিল-লেখচিত্রে তথ্য-উপাত্ত তুলনা করে শেষে কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকে। বেগুনে ভারী ধাতু পাওয়ার পর এই গবেষণাতেও তেমন পরবর্তী করণীয় বলা আছে। গবেষকরা বলেছেন, অজৈব সার-কীটনাশকের কারণে বেগুনে এই ভারী ধাতুর উপস্থিতি হতে পারে, যা তদন্ত করে দেখা জরুরি।
গবেষকরা বলছেন, সবজি এবং প্রকৃতির অপর দিকগুলোতে ট্রেস ধাতুর উপস্থিতি নিয়মিত নজরে রাখতে হবে। সবজিতে ভারী ধাতুর দূষণের উৎস বের করতে হবে। সবজিতে এমন দূষণের মাত্রা রোধ করতে হবে অথবা কমাতে হবে; এবং এর থেকে মানুষকেও রক্ষা করতে হবে। গবেষকরা বলছেন, সবজি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এমন অনাকাঙ্খিত বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি মেলাকে দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় গুরুতর বাধা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। গবেষকরা এ-ও বলেছেন, অন্য সবজি ও শস্যে বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি নিয়ে আরও বিশদ গবেষণা হওয়া জরুরি।
গবেষণার উপসংহারটুকু কোনোমতে দুশো শব্দের হবে। এটুক পড়তে বেশিক্ষণ লাগে না। টকশোতে সংযুক্ত হওয়ার আগে প্রিয় উদিসা ইসলাম, প্রিয় মাসুদা ভাট্টি এবং প্রিয় মিথিলা ফারজানার এটুকু সময় ব্যয় করা জরুরি ছিল পেশাগত দায় থেকে।
অনেকেই সমালোচনা করতে গিয়ে এই তিন আলোচককে নারী হিসেবে অবমাননা করছেন। কেউ কেউ ২০১৮ সালে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে মাসুদা ভাট্টির মানহানির মামলার শ্লেষ ঝাড়ছেন এই সুযোগে। যদিও মাসুদা ভাট্টি ভঙ্গুর কোনো নারী ব্যক্তিত্ব নন। তবে এই বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে তিনজন যে ভঙ্গিমায় কথা বলেছেন তাতে সমালোচনা তাদের প্রাপ্য।
একজন গবেষক, একজন বিজ্ঞানীকে অনুষ্ঠানে এনে অবশ্যই অনেক ধরনের প্রশ্ন করা যাবে। যেন গবেষণার খুঁটিনাটি খোলাসা হয়। প্রশ্ন করাই যেত, রেফারেন্সের চেয়ে কী পরিমাণ বেশি ভারী ধাতু পাওয়া গেছে বেগুনে? ট্রেস মেটাল আর হেভি মেটাল কি একই? একজন স্বাস্থ্যবিদকে এনে প্রশ্ন তোলাই যেত, এ ধরনের ভারী ধাতু থাকা বেগুন একজন মানুষ প্রতিদিন খেলে কী পরিণতি হতে পারে?
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ওই চিকিৎসক-অধ্যাপককে কেন টকশোতে সংযুক্ত করা হলো না? জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকেও বিশেষজ্ঞ কাউকে সংযুক্ত করা যেত জামালপুর থেকে ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে আলোকপাতে।
কৃষি অধিপ্তদর অথবা উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তাকে এনে প্রশ্ন করা যেত, তারা নিরাপদ চাষাবাদ কীভাবে মনিটর করেন? প্রশ্ন করা যেত, এই গবেষণায় যে গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করা হয়েছে তা দিয়ে কী বোঝায়? কোন মেথডোলজিতে গবেষণা চলেছে? কীভাবে ডেটা অ্যানালিসিস হয়েছে?
প্রশ্ন করা যেত, টপসয়েল নমুনাতে কত মিমি-ইঞ্চি-ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি পরীক্ষা করা হয়? কী কী জাতের বেগুন নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে? ভোক্তা অধিদপ্তর সবজি বাজারে ভেজাল মনিটংরি করছে কি না, সে প্রশ্নও করা যেত কাউকে এনে।
গবেষণা ভিত্তিহীন হলে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলে এসব আলোচনা থেকে তা এমনিতেই স্পষ্ট হবে। আফসোস! অনুষ্ঠানে যেভাবে প্রশ্নগুলো এসেছে তা আমন্ত্রিত বিজ্ঞানীকে একহাত দেখে নেওয়ার মতো অতিরঞ্জিত ঠেকেছে। তিন আলোচকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এমন আলোচনার উপযুক্ত ছিল না। বিভ্রান্তি আসলে তারাই ছড়াচ্ছিলেন।
মুফতি কাজী ইব্রাহীম ওয়াজে বিজ্ঞান নিয়ে যেমন হাস্যকর গল্প ফাঁদেন, এই তিনজন অভিজ্ঞ আলোচক সেদিন তেমন হয়ে উঠেছিলেন। একাত্তরের টকশো দেখে মনে হয়েছে, যেন মৌলবাদের খপ্পরে পড়েছে বিজ্ঞান। তারা আলোচনা নয়, অ্যাকটিভিজম করছিলেন। এই তিনজনের সাথে সাথে চ্যানেলের পূর্ব প্রস্তুতির বিশাল ঘাটতিও দেখিয়ে দিয়েছে এই টকশো।
রকেট সায়েন্সর মতো গুরুগম্ভীর বিষয়কে পাবলিকের কাছে ইন্টারেস্টিংভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা থাকে নাসার। একাত্তর চ্যানেল এই হ-য-ব-র-ল অনুষ্ঠান করার অভিজ্ঞতা থেকে নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে পারে। চ্যানেলে হতে পারে দেশি-বিদেশি গবেষণা নিয়ে ‘সায়েন্স টক’ অনুষ্ঠান। আর তাতে বাদ যাবে না ঝিংগা নিয়ে গবেষণাও।
লেখক : কলামিস্ট


























