ক্রীড়া ডেস্ক : ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচগুলোর একটির স্বাক্ষী এই মাঠ। ১৯৬০ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই ম্যাচ ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে প্রথম ‘টাই’ টেস্ট নামে। সেই ম্যাচের সঙ্গে তুলনীয় কিছু পাওয়া কঠিন, বাংলদেশ ও জিম্বাবুয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে অতটা বড় দলও নয়। তবে এই দুই দল মিলেই গ্যাবার ঐতিহাসিক আঙিনায় উপহার দিল অসাধারণ এক ম্যাচ। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা আর শেষের অবিশ্বাস্য নাটকীয়তার পর যেখানে শেষ হাসি বাংলাদেশের।
শেষ বলের ফয়সালায় রোমাঞ্চ তো সবসময় থাকেই। সঙ্গে এবার যোগ হলো নতুন মাত্রা। দারুণ এক জয়ের পর বাংলাদেশের উদযাপন, ডাগআউটের সামনে দুই দলের ক্রিকেটারদের করমর্দন, সব হয়ে গেল। কিন্তু দুই আম্পায়ার তখনও মাঠে ঠায় দাঁড়িয়ে। গোটা স্টেডিয়াম অবাক হয়ে দেখল, ম্যাচ এখনও শেষ নয়! বাংলাদেশের কিপার নুরুল হাসান সোহান শেষ বলে স্টাম্পের সামনে থেকেই বল ধরে ফেলায় তৃতীয় আম্পায়ার রিপ্লে দেখে ‘নো বল’ ডাকেন। হতবাক ক্রিকেটাররা আবার মাঠে ফেরেন। এক বলে প্রয়োজন চার রান, সঙ্গে ফ্রি হিট, যে কোনো কিছুই তো সম্ভব!
শেষ পর্যন্ত স্নায়ুর চাপকে জয় করেন বোলার মোসাদ্দেক হোসেন। তার জোরের ওপর করা ডেলিভারিতে ব্যাট ছোঁয়াতে পারেননি জিম্বাবুয়ের ব্লেসিং মুজারাবানি। ৩ রানের জয়ে আরেকবার জয় উদযাপন করে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় এমনিতে হয়তো বড় কিছু নয়। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো মঞ্চ, ম্যাচের প্রেক্ষাপট, আবহ এবং শেষের অমন ঘটনার ঘনঘটা মিলিয়ে মনে রাখার মতো একটি জয় পেল বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে দুটি জয় ধরা দিল প্রথমবার। শুধু কী শেষের এই ঘটনা! গ্যাবায় রোববার ম্যাচের শেষ ভাগের পুরোটাই ছিল নাটকীয়তায় ভরা। ১৫১ রান তাড়ায় শেষ ৩ ওভারে যখন ৪০ রান প্রয়োজন, শন উইলিয়ামসের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে প্রবলভাবে ম্যাচে ফেরে জিম্বাবুয়ে। ৯ বলে যখন প্রয়োজন ১৯ রান, উইলিয়ামসের হাত ধরে জিম্বাবুয়েকেই মনে হচ্ছিল সম্ভাবনায় এগিয়ে। শেষ ওভারের জন্য বিশেষজ্ঞ বোলার যে আর নেই! তখনই সাকিব আল হাসানের এক মুহূর্তের একটি ‘ব্রিলিয়ান্স’ বড় পার্থক্য গড় দেয় মাঠে। বাংলাদেশ অধিনায়কের বল সামনে ঠেলে দ্রুত একটি রান নেওয়ার চেষ্টা করেন উইলিয়ামস। বোলার সাকিব চোখের পলকে ছুটে বল কুড়িয়ে ভারসাম্যহীন অবস্থায়ই নিখুঁত এক থ্রো করেন, বল সরাসরি স্টাম্পে।
৪২ বলে ৬৪ রানের বিরোচিত ইনিংস খেলে উইলিয়ামস যখন ফিরছেন, জিম্বাবুয়ের সম্ভাবনার মৃত্যুও দেখছিলেন অনেক। কিন্তু এই ম্যাচ যেন ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ।’
শেষ ওভারে ১৬ রানের সমীকরণে বোলিংয়ে আসেন মোসাদ্দেক। তার প্রথম বলে ১ রানের পর দ্বিতীয় বলে আউট হয়ে যান ব্র্যাড ইভান্স। পরের বলে লেগ বাই থেকে চার পেয়ে যায় জিম্বাবুয়ে, চতুর্থ বলে আলগা বল পেয়ে রিচার্ড এনগারাভা চালিয়ে দেন ব্যাট, বল উড়ে যায় ছক্কায়। ম্যাচে আরেক দফা উত্তেজনা। তবে মোসাদ্দেক পরে ফিরে আসেন নিজেকে সামলে। পঞ্চম বলে স্টাম্পড এনগারাভা। শেষ বলেও মুজারাবানিকে স্টাম্পিং করেন সোহান। বাংলাদেশ মেতে ওঠে জয়ের উৎসবে। কিন্তু দেখা গেল ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’-এর নতুন অধ্যায়। এরপর ওই ‘নো’ বলের চমক ও বাংলাদেশের আরেক দফা ম্যাচ শেষ করার চ্যালেঞ্জ।
সব কিছু যখন শেষ হলো, নাজমুল হোসেন শান্তর প্রথম ফিফটি আর পরে তাসকিন আহমেদ ও মুস্তাফিজুর রহমানের দুর্দান্ত স্পেলকে তখন মনে হচ্ছিল যেন অনেক আগের ঘটনা! দুর্দান্ত বোলিং করে নেদারল্যান্ডস ম্যাচের মতো এই জয়েও ম্যাচের সেরা তাসকিন। নিজের সেরা সময়কে মনে করিয়ে দেওয়া বোলিংয়ে মুস্তাফিজুর রহমান ৪ ওভারে ১৫ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট। ম্যাচের শেষটা ভালো হলেও শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ওভারে সৌম্য সরকার বিদায় নেন শূন্য রানে। তিনে নেমে লিটন দাস চার দিয়ে শুরু করলেও পরে আউট হন দৃষ্টিকটূ স্কুপের চেষ্টায়। ম্যাচের প্রথম ৭ বলের মধ্যে দুটি বাউন্ডারি মেরে নাজমুল হোসেন শান্তও ঝিমিয়ে পড়েন। পাওয়ার প্লেতে রান আসে মোটে ৩২।
সাকিব আল হাসান ও শান্তর জুটি সেখান থেকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেন দলকে। তাদের জুটির শুরুটাও ছিল মন্থর। পরে দুজনই একটু বাড়ান রানের গতি। ৪৪ বলে ৫৪ রানের জুটি শেষ হয় সাকিবের ২৩ রানে বিদায়ে।
শান্ত ক্যারিয়ারের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি স্পর্শ করেন ৪৫ বলে। পরে ব্র্যাড ইভান্সের এক ওভারে দুই চার ও এক ছক্কায় চেষ্টা করেন তা পুষিয়ে দিতে। খুব বেশি দূর পারেননি, বিদায় নেন ৫৫ বলে ৭১ রান করে। জিম্বাবুয়ের একের পর এক ক্যাচ মিস আর আফিফ হোসেনের ১৯ বলে ২৯ রানের সৌজন্যে কোনোরকমে দেড়শ স্পর্শ করতে পারে দল।
উইকেটে গতি ও বাউন্স থাকলেও ব্যাটিংয়ের জন্য যথেষ্ট ভালো। বাংলাদেশের পুঁজি তাই যথেষ্ট ছিল না। তবে তাসকিন ও মুস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিং জিম্বাবুয়েকে ঠেলে দেয় জয় থেকে দূরে। নতুন বলে নিজের প্রথম দুই ওভারে দুটি উইকেট নেন তাসকিন। ষষ্ঠ ওভারে আক্রমণে এসে মুস্তাফিজও ধরেন জোড়া শিকার। এর মধ্যে ছিল সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উইকেটও, শূন্য রানে ফেরেন সিকান্দার রাজা।
৩৫ রানে ৪ উইকেট হারানো দলকে লড়াইয়ে ফেরান উইলিয়ামস। মাঠের ডাইমেনশনকে কাজে লাগিয়ে এক-দুই করে রান বাড়াতে থাকেন তিনি। বাজে বলকে পাঠান বাউন্ডারিতে। রেজিস চাকাভার সঙ্গে ৩৪ রানের জুটিতে সামাল দেন বিপর্যয়, রায়ান বার্লের সঙ্গে ৬৩ রানের জুটিতে জিইয়ে তোলেন জিম্বাবুয়ের সম্ভাবনা। এরপর শেষের ওই নাটকের পর নাটক। উইলিয়ামসকে ফেরানোর আশায় পেসারদের বোলিং আগেই শেষ করে করে দেন সাকিব। শেষ দুই ওভারে দায়িত্ব পড়ে তার নিজের ও মোসাদ্দেকের। পে-ুলামের মতো দুলতে থাকে ম্যাচের ভাগ্য। শেষ পর্যন্ত তা হেলে পড়ে বাংলাদেশের দিকে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৫০/৭ (শান্ত ৭১, সৌম্য ০, লিটন ১৪, সাকিব ২৩, আফিফ ২৯, মোসাদ্দেক ৭, সোহান ১, ইয়াসির ১; এগারাভা ৪-০-২৪-২, মুজারাবানি ২-০-১৩-২, চাটারা ৩-০-১৮-০, রাজা ৪-০-৩৫-১, ইভান্স ৩-০-৩২-০, মাধেভেরে ২-০-১৮-০, উইলিয়ামস ২-০-১০-১) জিম্বাবুয়ে: ২০ ওভারে ১৪৭/৮ (মাধেভেরে ৪, আরভিন ৮, শুম্বা ৮, উইলিয়ামস ৬৪, রাজা ০, চাকাভা ১৫, বার্ল ২৭, ইভান্স ২, এনগারাভা ৬, মুজারাবানি ০*; তাসকিন ৪-১-১৯-৩, হাসান ৪-০-৩৬-০, মোসাদ্দেক ৪-০-৩৪-২, মুস্তাফিজ ৪-০-১৫-২, সাকিব ৪-০-৩৪-০)
ফল: বাংলাদেশ ৩ রানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: তাসকিন আহমেদ।
নাটকীয়তার দোলায় বাংলাদেশের স্বস্তির জয়
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ