ঢাকা ১১:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

ডেঙ্গু চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম নি¤œবিত্তরা

  • আপডেট সময় : ০২:২৯:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ অক্টোবর ২০২২
  • ৯৮ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রতিদিন অসংখ্য ডেঙ্গুরোগী বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন। রোগীর চাপে রাজধানীর কোনো হাসপাতালেই বিছানা ফাঁকা নেই। বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা নিতে হিমশিম খাচ্ছে নি¤œবিত্ত পরিবারগুলো। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯২৩ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গতকাল ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিন হাজার ৩৮০ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১২০ জন।
রোগীর স্বজনরা বলছেন, রাজধানীতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু। প্রতিদিনই শত শত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এ ভাইরাসে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে বহু নি¤œবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবার। কারণ একসঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
স্বজনদের অভিযোগ, দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তির সুযোগ মিলছে না। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে অসংখ্য ডেঙ্গুরোগী বহির্বিভাগ বা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যেখানে তাদের চিকিৎসাব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা করাতে গেলে নানা শর্ত ও পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মূলত চিকিৎসকের ফি, একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের খরচ, যাতায়াত খরচ, হাসপাতালের বিছানা বা কেবিন ভাড়া, ইনটেনসিভ করোনারি কেয়ার ইউনিট (আইসিসিইউ), হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ), ভেন্টিলেশন সাপোর্টে (লাইফ সাপোর্ট) বিল মেটাতে হচ্ছে, যা নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন নি¤œবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।
অধিকাংশ রোগীর পরিবার জানিয়েছে, সাধারণ অবস্থায় একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকার সিবিসি টেস্ট, ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেড ভাড়া ও ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। রোগীর পরিস্থিতির অবনতি হলে এ খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
ডেঙ্গুর চিকিৎসা খরচের বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গত বছরের তথ্য বলছে, একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩৩ হাজার ৮১৭ টাকা। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় এ চিকিৎসায় খরচ করতে হয় ২২ হাজার ৩৭৯ টাকা আর বেসরকারি হাসপাতালে রোগীপ্রতি গড় খরচ ৪৭ হাজার ২৩০ টাকা।
চিকিৎসকের ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ, ওষুধের খরচ, যাতায়াত খরচ, হাসপাতাল বিল ইত্যাদি, সম্মিলিত ব্যয়কে একজন রোগীর মোট খরচ হিসাবে দেখানো হয়েছিল ওই গবেষণায়। তাতে দেখা গেছে, এক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের রোগীপ্রতি ৬ হাজার ৭৬ টাকা খরচ হয়। নি¤œ ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে তাদের মোট আয়ের ১৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যয় করেছিল। সংশ্লিষ্ট পরিবার তাদের সঞ্চয়, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ বা সম্পদ বিক্রি করে এ ব্যয়ের অর্থ জোগান দিয়েছে।
সরেজমিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশ কয়েকটি পরিবারের কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। অন্যদিকে রাজধানীর নামি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এ খরচ লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সেখানে বেড ভাড়াসহ সব খরচ তুলনামূলক বেশি। ডেঙ্গু রোগীর শরীরে প্লাটিলেট দেওয়া বা আইসিইউতে রাখার প্রয়োজন হলে খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
টানা নয়দিন রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলে সমুজ্জ্বল সামুকে চিকিৎসা করিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। চিকিৎসা বাবদ তাকে গুনতে হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা, যা এ পরিবারের একমাত্র সঞ্চয় ছিল।
সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘হাসপাতালে থাকাবস্থায় এ খরচ তার বড় ভাই দিয়েছিলেন। পরে পরিবারের একমাত্র ডিপিএস (সঞ্চয়) ভেঙে তা পরিশোধ করেন। খরচের ভয়ে প্রথমে তিনি ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু কোথাও সিট (বিছানা) না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে ছেলেকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ভর্তি করেছেন।
একই বিষয়ে মুদিদোকানি এজাজুল হকের সঙ্গে কথা হয়। এজাজুল জানান, তার এক ছেলে ও এক মেয়ে ডেঙ্গু আক্তান্ত হয়েছিল। সপ্তাহখানেক আগে ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠেছে মেয়ে। তিনদিন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ হওয়ায় খরচ কিছুটা কম হয়েছে। তিনি আরও জানান, ছেলেকে প্রথমে তিনি বাড়িতেই চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরে মুগদা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে তিনদিনে প্রায় ১১ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে তার। আর আগে বাড়িতে চারদিনে খরচ হয়েছে আট হাজার টাকা। তবে, খরচের বেশিরভাগ রক্তের সিবিসি পরীক্ষা ও চার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের পেছনে ব্যয় হয়। এছাড়া তরল ও ফলমূল খাওয়ার পেছনেও অর্থের বড় একটি অংশ ব্যয় হয়। বিআইডিএসের গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার বলেন, নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য সবধরনের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য। এর মধ্যে ডেঙ্গুর খরচ বেশি ভোগাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবারের একাধিক সদস্য এ রোগে ভুগছে। এমন হচ্ছে তারা আর্থিক সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছেন। তিনি বলেন, এ জন্য সরকারের ডেঙ্গু বিস্তাররোধ কার্যক্রমের পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এ রোগে প্রচুর তরল খাবার প্রয়োজন, যেগুলো খুব বেশি ব্যয়বহুল, সেসব খাবারের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগ শনাক্তের জন্য সবধরনের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারণ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে সময় রাজধানীর সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে সরকার নির্ধারিত খরচের মধ্যে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী, ডেঙ্গুর মূল পরীক্ষা এনএসওয়ানের জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা, আইজিজি ও আইজিএম এই দুটি পরীক্ষার জন্য ৫০০ টাকা। এ ছাড়া সিবিসি পরীক্ষার জন্য ৪০০ টাকা নেওয়া যাবে। তবে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কিছু রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, তারা আইজিজি ও আইজিএম পরীক্ষায় ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা খরচ করেছেন।
২৪ ঘণ্টায় দুজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯২৩ রোগী : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯২৩ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ জনে। আর নতুন আক্রান্তসহ বর্তমানে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা তিন হাজার ৩৮০ জন।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এর আগে মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) ৭৫০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তির তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে ওইদিন কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
সোমবার (২৪ অক্টোবর) পাঁচজনের মৃত্যু এবং ৯০৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তির তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তার আগের দিন রোববার (২৩ অক্টোবর) একদিনে ১০৩৪ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, যা চলতি বছরে সর্বোচ্চ। এতে বলা হয়, মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) সকাল ৮টা থেকে বুধবার (২৬ অক্টোবর) সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯২৩ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫২০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪০৩ জন। নতুন আক্রান্তসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৮০ জনে। অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩ হাজার ৯২৩ জন। এরমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৩০ হাজার ৪২৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফলে ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১২০ জনে। চলতি বছরের ২১ জুন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা যায়নি। তবে ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। তার মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ডেঙ্গু চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম নি¤œবিত্তরা

আপডেট সময় : ০২:২৯:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ অক্টোবর ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রতিদিন অসংখ্য ডেঙ্গুরোগী বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন। রোগীর চাপে রাজধানীর কোনো হাসপাতালেই বিছানা ফাঁকা নেই। বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা নিতে হিমশিম খাচ্ছে নি¤œবিত্ত পরিবারগুলো। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯২৩ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গতকাল ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিন হাজার ৩৮০ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১২০ জন।
রোগীর স্বজনরা বলছেন, রাজধানীতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু। প্রতিদিনই শত শত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এ ভাইরাসে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে বহু নি¤œবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবার। কারণ একসঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
স্বজনদের অভিযোগ, দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তির সুযোগ মিলছে না। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে অসংখ্য ডেঙ্গুরোগী বহির্বিভাগ বা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যেখানে তাদের চিকিৎসাব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা করাতে গেলে নানা শর্ত ও পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মূলত চিকিৎসকের ফি, একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের খরচ, যাতায়াত খরচ, হাসপাতালের বিছানা বা কেবিন ভাড়া, ইনটেনসিভ করোনারি কেয়ার ইউনিট (আইসিসিইউ), হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ), ভেন্টিলেশন সাপোর্টে (লাইফ সাপোর্ট) বিল মেটাতে হচ্ছে, যা নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন নি¤œবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।
অধিকাংশ রোগীর পরিবার জানিয়েছে, সাধারণ অবস্থায় একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকার সিবিসি টেস্ট, ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেড ভাড়া ও ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। রোগীর পরিস্থিতির অবনতি হলে এ খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
ডেঙ্গুর চিকিৎসা খরচের বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গত বছরের তথ্য বলছে, একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩৩ হাজার ৮১৭ টাকা। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় এ চিকিৎসায় খরচ করতে হয় ২২ হাজার ৩৭৯ টাকা আর বেসরকারি হাসপাতালে রোগীপ্রতি গড় খরচ ৪৭ হাজার ২৩০ টাকা।
চিকিৎসকের ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ, ওষুধের খরচ, যাতায়াত খরচ, হাসপাতাল বিল ইত্যাদি, সম্মিলিত ব্যয়কে একজন রোগীর মোট খরচ হিসাবে দেখানো হয়েছিল ওই গবেষণায়। তাতে দেখা গেছে, এক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের রোগীপ্রতি ৬ হাজার ৭৬ টাকা খরচ হয়। নি¤œ ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে তাদের মোট আয়ের ১৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যয় করেছিল। সংশ্লিষ্ট পরিবার তাদের সঞ্চয়, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ বা সম্পদ বিক্রি করে এ ব্যয়ের অর্থ জোগান দিয়েছে।
সরেজমিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশ কয়েকটি পরিবারের কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। অন্যদিকে রাজধানীর নামি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এ খরচ লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সেখানে বেড ভাড়াসহ সব খরচ তুলনামূলক বেশি। ডেঙ্গু রোগীর শরীরে প্লাটিলেট দেওয়া বা আইসিইউতে রাখার প্রয়োজন হলে খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
টানা নয়দিন রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলে সমুজ্জ্বল সামুকে চিকিৎসা করিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। চিকিৎসা বাবদ তাকে গুনতে হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা, যা এ পরিবারের একমাত্র সঞ্চয় ছিল।
সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘হাসপাতালে থাকাবস্থায় এ খরচ তার বড় ভাই দিয়েছিলেন। পরে পরিবারের একমাত্র ডিপিএস (সঞ্চয়) ভেঙে তা পরিশোধ করেন। খরচের ভয়ে প্রথমে তিনি ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু কোথাও সিট (বিছানা) না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে ছেলেকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ভর্তি করেছেন।
একই বিষয়ে মুদিদোকানি এজাজুল হকের সঙ্গে কথা হয়। এজাজুল জানান, তার এক ছেলে ও এক মেয়ে ডেঙ্গু আক্তান্ত হয়েছিল। সপ্তাহখানেক আগে ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠেছে মেয়ে। তিনদিন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ হওয়ায় খরচ কিছুটা কম হয়েছে। তিনি আরও জানান, ছেলেকে প্রথমে তিনি বাড়িতেই চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরে মুগদা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে তিনদিনে প্রায় ১১ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে তার। আর আগে বাড়িতে চারদিনে খরচ হয়েছে আট হাজার টাকা। তবে, খরচের বেশিরভাগ রক্তের সিবিসি পরীক্ষা ও চার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের পেছনে ব্যয় হয়। এছাড়া তরল ও ফলমূল খাওয়ার পেছনেও অর্থের বড় একটি অংশ ব্যয় হয়। বিআইডিএসের গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার বলেন, নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য সবধরনের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য। এর মধ্যে ডেঙ্গুর খরচ বেশি ভোগাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবারের একাধিক সদস্য এ রোগে ভুগছে। এমন হচ্ছে তারা আর্থিক সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছেন। তিনি বলেন, এ জন্য সরকারের ডেঙ্গু বিস্তাররোধ কার্যক্রমের পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এ রোগে প্রচুর তরল খাবার প্রয়োজন, যেগুলো খুব বেশি ব্যয়বহুল, সেসব খাবারের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগ শনাক্তের জন্য সবধরনের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারণ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে সময় রাজধানীর সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে সরকার নির্ধারিত খরচের মধ্যে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী, ডেঙ্গুর মূল পরীক্ষা এনএসওয়ানের জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা, আইজিজি ও আইজিএম এই দুটি পরীক্ষার জন্য ৫০০ টাকা। এ ছাড়া সিবিসি পরীক্ষার জন্য ৪০০ টাকা নেওয়া যাবে। তবে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কিছু রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, তারা আইজিজি ও আইজিএম পরীক্ষায় ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা খরচ করেছেন।
২৪ ঘণ্টায় দুজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯২৩ রোগী : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯২৩ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ জনে। আর নতুন আক্রান্তসহ বর্তমানে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা তিন হাজার ৩৮০ জন।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এর আগে মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) ৭৫০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তির তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে ওইদিন কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
সোমবার (২৪ অক্টোবর) পাঁচজনের মৃত্যু এবং ৯০৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তির তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তার আগের দিন রোববার (২৩ অক্টোবর) একদিনে ১০৩৪ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, যা চলতি বছরে সর্বোচ্চ। এতে বলা হয়, মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) সকাল ৮টা থেকে বুধবার (২৬ অক্টোবর) সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯২৩ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫২০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪০৩ জন। নতুন আক্রান্তসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৮০ জনে। অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩ হাজার ৯২৩ জন। এরমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৩০ হাজার ৪২৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফলে ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১২০ জনে। চলতি বছরের ২১ জুন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা যায়নি। তবে ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। তার মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।