ঢাকা ০৩:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫

খাদ্যের অপচয় রোধে সচেতন হতে হবে

  • আপডেট সময় : ১০:২৭:৩৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • ১২০ বার পড়া হয়েছে

ড. মতিউর রহমান : প্রতি বছর বিশ্বে যত খাদ্য নষ্ট হয় তা উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয় ১.৪ বিলিয়ন হেক্টর জমি; যা বিশ্বের মোট কৃষি জমির ২৮ শতাংশ। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঋঁহফ ভড়ৎ অমৎরপঁষঃঁৎধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ (ওঋঅউ) এর প্রধান বলেন, সম্পদের অভাব নয়; খাদ্য অপচয় সারা বিশ্বে ক্ষুধার প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রতিবছর উৎপাদিত খাদ্যের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়।

ডড়ৎষফ ঋড়ড়ফ চৎড়মৎধসসব (ডঋচ) এর হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি রাতে ৮১১ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যায়। ঋড়ড়ফ ধহফ অমৎরপঁষঃঁৎধষ ঙৎমধহরুধঃরড়হ (ঋঅঙ) এর মতে, প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হয় বা আবর্জনায় ফেলে দেওয়া হয় তার এক তৃতীয়াংশ দিয়ে বিশ্বের ৮৭৭ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানো যেতে পারে ।

টঘ ঊহারৎড়হসবহঃ চৎড়মৎধসসব (টঘঊচ) ২০২১ সালে ঋড়ড়ফ ডধংঃব ওহফবী নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ১০.৬ মিলিয়ন টন খাদ্য অপচয় হয়। টঘঊচ সূচক অনুযায়ী, একজন বাংলাদেশি বছরে ৬৫ কেজি খাবার নষ্ট করে। ভারত ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য অপচয়কারী দেশ।

ঋঅঙ গত বছর (২০২১) বাংলাদেশে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল, যেখানে দেখা গেছে যে উচ্চ আয়ের পরিবারে প্রতি মাসে মাথাপিছু ২৬ কেজি খাদ্য নষ্ট হয়। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩৮.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। এর প্রায় ২৫.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাকি অংশ বীজ, পশুখাদ্য ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়।
আমরা বছরে যে ২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল খাবার হিসেবে খাই, তার মধ্যে ৫.৫ শতাংশ অজ্ঞতা এবং বিলাসবহুলতার কারণে পারিবারিক পর্যায়ে অপচয় হয়। যার পরিমাণ কমপক্ষে ১ মিলিয়ন ৩ লাখ ৮৬ হাজার টন। এর মধ্যে ৩ শতাংশ বা সাত লাখ ৫৬ হাজার টন খাদ্য সংগ্রহ ও তৈরিতে (চাল ধোয়া, রান্না ইত্যাদি) এবং আড়াই শতাংশ বা ছয় লাখ টন পরিবেশন পর্যায়ে অপচয় হয়।
সরকারের হিসাব মতে, জনপ্রতি দৈনিক চাল খাওয়ার পরিমাণ ৪০৫ গ্রাম। সে অনুযায়ী গৃহস্থালির অপচয় রোধ করা গেলে বছরে প্রায় ৯.৪ মিলিয়ন মানুষের চালের চাহিদা পূরণ হবে। আর খাবার টেবিলের অপচয় রোধ করা গেলে বছরে ৪ মিলিয়ন ২ লাখ ৬২ হাজার মানুষের চালের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
অ্যাকশনএইড এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিয়েতে সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয়। এর পরেই খাবার নষ্ট হয় রেস্তোরাঁয়। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। বুফে রেস্টুরেন্টও খাবার নষ্ট হয়। একটি বুফে তাদের দৈনিক খাদ্যের বর্জ্য পরিমাপ করেছে ২৯ কেজি, যা সহজেই ৮৫ থেকে ৯০ জন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াতে পারত। কখনও কখনও এই পরিমাণ বেশি হয়।
যদি একটি বুফে রেস্টুরেন্ট ২৯ কেজি খাবার অপচয় করে, তাহলে দেশব্যাপী হাজার হাজার হোটেল ও রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন কত খাবার অপচয় হয় তার হিসাব কি আমরা করি? শহরে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে প্রতিদিন প্রচুর খাবার জমতে দেখা যায়। এগুলি আবর্জনার মতো দেখায় কিন্তু আসলে এগুলি অনেক লোকের জীবন রক্ষাকারী উপাদান। এভাবে প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে প্রচুর খাবার আমরা নষ্ট বা অপচয় করি।
আমাদের দেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও প্রতি বছর গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করতে হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। খাবার নষ্ট করার অর্থও বৈদেশিক মুদ্রা নষ্ট করা। পানিসম্পদ, সার ও কীটনাশক ব্যবহার এবং পরিবেশের ক্ষতি এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে খাবার টেবিলে একটি শস্যের দানা পৌঁছতে যে দীর্ঘ সময় লাগে তা কি আমরা কখনো উপলব্ধি করি?
অপচয়ের কারণে অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য বনভূমি প্রতিনিয়ত কৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষার কাজ কঠিন হয়ে পড়ছে। কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে নদী-নালা, খাল-বিল ও ফসলের ক্ষেত বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ ও পশুপাখি।
অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনে অতিরিক্ত জ্বালানির ব্যবহার গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়াচ্ছে। প্রতি বছর ৩৩০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। অপচয়ের ফলে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের নেতিবাচক প্রভাব শুধু পরিবেশ ধ্বংসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং আমরা যত বেশি খাদ্য অপচয় করছি, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে তত বেশি ভূমিকা রাখছি।
সাম্প্রতিক কালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের কাছে খাবার কেনার টাকা নেই। আর এভাবেই বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কায় শিশুরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বিছানায় যায় বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। আফগানিস্থানসহ আফ্রিকার দেশগুলোর অবস্থাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও একই ধরনের সংকটের দিকে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দিনে সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট তীব্র হবে। সেই অবস্থা এখন কোনো কোনো দেশে দৃশ্যমান হচ্ছে। দিনে দিনে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ হতে পারে। সামনে কঠিন সময় ও মন্দা আসছে। বৈশ্বিক মন্দার পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব এখন দৃশ্যমান।
জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, বৃষ্টিপাতের অভাব, অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে কৃষি জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মাটি ক্ষয় ইত্যাদির কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং পানির ঘাটতির কারণে এশিয়ার কিছু অংশে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। এই অবস্থায় খাদ্যের অপচয় কোনোভাবেই কাম্য নয়। খাবারের অপচয় মানে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার থেকে বঞ্চিত করা। আর ক্ষুধার্তকে বঞ্চিত করা মানবতার বিরুদ্ধে এক প্রকার অপরাধ। সুতরাং, খাদ্যের অপচয় রোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

ভূমিকম্পে শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত, রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত

খাদ্যের অপচয় রোধে সচেতন হতে হবে

আপডেট সময় : ১০:২৭:৩৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

ড. মতিউর রহমান : প্রতি বছর বিশ্বে যত খাদ্য নষ্ট হয় তা উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয় ১.৪ বিলিয়ন হেক্টর জমি; যা বিশ্বের মোট কৃষি জমির ২৮ শতাংশ। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঋঁহফ ভড়ৎ অমৎরপঁষঃঁৎধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ (ওঋঅউ) এর প্রধান বলেন, সম্পদের অভাব নয়; খাদ্য অপচয় সারা বিশ্বে ক্ষুধার প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রতিবছর উৎপাদিত খাদ্যের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়।

ডড়ৎষফ ঋড়ড়ফ চৎড়মৎধসসব (ডঋচ) এর হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি রাতে ৮১১ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যায়। ঋড়ড়ফ ধহফ অমৎরপঁষঃঁৎধষ ঙৎমধহরুধঃরড়হ (ঋঅঙ) এর মতে, প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হয় বা আবর্জনায় ফেলে দেওয়া হয় তার এক তৃতীয়াংশ দিয়ে বিশ্বের ৮৭৭ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানো যেতে পারে ।

টঘ ঊহারৎড়হসবহঃ চৎড়মৎধসসব (টঘঊচ) ২০২১ সালে ঋড়ড়ফ ডধংঃব ওহফবী নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ১০.৬ মিলিয়ন টন খাদ্য অপচয় হয়। টঘঊচ সূচক অনুযায়ী, একজন বাংলাদেশি বছরে ৬৫ কেজি খাবার নষ্ট করে। ভারত ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য অপচয়কারী দেশ।

ঋঅঙ গত বছর (২০২১) বাংলাদেশে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল, যেখানে দেখা গেছে যে উচ্চ আয়ের পরিবারে প্রতি মাসে মাথাপিছু ২৬ কেজি খাদ্য নষ্ট হয়। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩৮.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। এর প্রায় ২৫.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাকি অংশ বীজ, পশুখাদ্য ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়।
আমরা বছরে যে ২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল খাবার হিসেবে খাই, তার মধ্যে ৫.৫ শতাংশ অজ্ঞতা এবং বিলাসবহুলতার কারণে পারিবারিক পর্যায়ে অপচয় হয়। যার পরিমাণ কমপক্ষে ১ মিলিয়ন ৩ লাখ ৮৬ হাজার টন। এর মধ্যে ৩ শতাংশ বা সাত লাখ ৫৬ হাজার টন খাদ্য সংগ্রহ ও তৈরিতে (চাল ধোয়া, রান্না ইত্যাদি) এবং আড়াই শতাংশ বা ছয় লাখ টন পরিবেশন পর্যায়ে অপচয় হয়।
সরকারের হিসাব মতে, জনপ্রতি দৈনিক চাল খাওয়ার পরিমাণ ৪০৫ গ্রাম। সে অনুযায়ী গৃহস্থালির অপচয় রোধ করা গেলে বছরে প্রায় ৯.৪ মিলিয়ন মানুষের চালের চাহিদা পূরণ হবে। আর খাবার টেবিলের অপচয় রোধ করা গেলে বছরে ৪ মিলিয়ন ২ লাখ ৬২ হাজার মানুষের চালের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
অ্যাকশনএইড এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিয়েতে সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয়। এর পরেই খাবার নষ্ট হয় রেস্তোরাঁয়। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। বুফে রেস্টুরেন্টও খাবার নষ্ট হয়। একটি বুফে তাদের দৈনিক খাদ্যের বর্জ্য পরিমাপ করেছে ২৯ কেজি, যা সহজেই ৮৫ থেকে ৯০ জন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াতে পারত। কখনও কখনও এই পরিমাণ বেশি হয়।
যদি একটি বুফে রেস্টুরেন্ট ২৯ কেজি খাবার অপচয় করে, তাহলে দেশব্যাপী হাজার হাজার হোটেল ও রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন কত খাবার অপচয় হয় তার হিসাব কি আমরা করি? শহরে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে প্রতিদিন প্রচুর খাবার জমতে দেখা যায়। এগুলি আবর্জনার মতো দেখায় কিন্তু আসলে এগুলি অনেক লোকের জীবন রক্ষাকারী উপাদান। এভাবে প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে প্রচুর খাবার আমরা নষ্ট বা অপচয় করি।
আমাদের দেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও প্রতি বছর গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করতে হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। খাবার নষ্ট করার অর্থও বৈদেশিক মুদ্রা নষ্ট করা। পানিসম্পদ, সার ও কীটনাশক ব্যবহার এবং পরিবেশের ক্ষতি এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে খাবার টেবিলে একটি শস্যের দানা পৌঁছতে যে দীর্ঘ সময় লাগে তা কি আমরা কখনো উপলব্ধি করি?
অপচয়ের কারণে অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য বনভূমি প্রতিনিয়ত কৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষার কাজ কঠিন হয়ে পড়ছে। কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে নদী-নালা, খাল-বিল ও ফসলের ক্ষেত বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ ও পশুপাখি।
অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনে অতিরিক্ত জ্বালানির ব্যবহার গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়াচ্ছে। প্রতি বছর ৩৩০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। অপচয়ের ফলে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের নেতিবাচক প্রভাব শুধু পরিবেশ ধ্বংসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং আমরা যত বেশি খাদ্য অপচয় করছি, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে তত বেশি ভূমিকা রাখছি।
সাম্প্রতিক কালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের কাছে খাবার কেনার টাকা নেই। আর এভাবেই বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কায় শিশুরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বিছানায় যায় বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। আফগানিস্থানসহ আফ্রিকার দেশগুলোর অবস্থাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও একই ধরনের সংকটের দিকে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দিনে সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট তীব্র হবে। সেই অবস্থা এখন কোনো কোনো দেশে দৃশ্যমান হচ্ছে। দিনে দিনে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ হতে পারে। সামনে কঠিন সময় ও মন্দা আসছে। বৈশ্বিক মন্দার পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব এখন দৃশ্যমান।
জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, বৃষ্টিপাতের অভাব, অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে কৃষি জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মাটি ক্ষয় ইত্যাদির কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং পানির ঘাটতির কারণে এশিয়ার কিছু অংশে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। এই অবস্থায় খাদ্যের অপচয় কোনোভাবেই কাম্য নয়। খাবারের অপচয় মানে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার থেকে বঞ্চিত করা। আর ক্ষুধার্তকে বঞ্চিত করা মানবতার বিরুদ্ধে এক প্রকার অপরাধ। সুতরাং, খাদ্যের অপচয় রোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।