রাজধানীতে গণপরিবহনে যাত্রী হয়রানি যেন নিত্যদিনের ঘটনা। তবে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন নারী যাত্রীরা। পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা ঠেকাতে সরকারি সংস্থাগুলো নানা কথা বললেও মাঠে কোনো প্রভাবই নেই। এদিকে চতুর্থবারের মতো যাত্রী ১৩ সেপ্টেম্বর অধিকার দিবস পালনের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতিসহ এ খাত নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। এবার দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই’। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতিসহ যাত্রী অধিকার ও সড়ক নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, বর্তমানে নগরীর কোনো পরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর নেই। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চলছে। এই সময়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় তর্কের জেরে গণপরিবহগুলোতে অন্তত ২৫টি যাত্রী লাঞ্চনার ঘটনা ঘটে। এতে বাস থেকে ফেলে ১৪ যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন ১০ জন যাত্রী। এতে গণপরিবহন ব্যবহারে যাত্রী সাধারণের মাঝে ভীতি সঞ্চার হয়। এদিকে এমন একটি দিবস পালন করতে হয় বলে আক্ষেপ করেছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও যাত্রী অধিকার দিবস নেই। কারণ বিশ্বের সব জায়গায় যাত্রীদের সেবার মান খুব ভালো। এটা হলো একটি পরিষেবা, দিতে হবেই। এজন্য সেসব দেশে এ দিবস পালন করতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে যাত্রীসেবা নেই বললেই চলে। তাই এ দিবস পালন করা হয়। ’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে পরিবহন মালিকরা এটাকে সেবা হিসেবে না নিয়ে শুধু বাণিজ্যের জন্য চালান। যার ফলে প্রতিনিয়ত যাত্রীরা এ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। সরকারের উচিত কঠোরভাবে গণপরিবহনকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাহলে দেশে যাত্রীসেবার মান বাড়বে। তখন আর এ দেশে এই দিবস পালন করতে হবে না। ’
প্রতি পদে ভোগান্তির শিকার হতে হয় নারী যাত্রীদের। ভিড় থাকলে বাসেই ওঠানো হয় না নারী যাত্রীদের। সংরক্ষিত নারী সিটে বসেন পুরুষ যাত্রীরা আবার শারিরীক ও মানসিক হয়রানির শিকার হতে হয় নারী যাত্রীদের। সেভ দ্য রোডের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মোমিন মেহেদী বলেন, গত দুই বছর আগে আমাদের এক জরিপের মাধ্যমে দেখা যায়, গণপরিবহনে প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ ভাড়া নৈরাজ্যের শিকার হয়ে থাকেন। আর নারী হয়রানির শিকার হন প্রায় ৮২ শতাংশের মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শারমিন রহমান বলেন, গণপরিবহনে নারী যাত্রীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাস পাওয়া যায় না। আর নারী যাত্রীদের জন্য যে সিট বরাদ্দ থাকে, সেগুলোতে পুরুষ যাত্রীরা বসে থাকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা যাত্রীসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী কর্মজীবী লুভানা বিশ্বাস বর্তমানে কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাংলানিউজ প্রতিবেদককে তিনি জানান ভোগান্তির সে অভিজ্ঞতা।
লুভানা বিশ্বাস বলেন, বাসে প্রতিদিনের যাতায়াত করতে হয়। মাঝে মাঝে অনান্য যাত্রীসহ বাসের হেল্পারদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানিমূলক আচরণের শিকার হতে হয় নারী বলে। নারী যাত্রীদের বাসেও তোলে না অনেকসময়। রাতে বা সন্ধ্যায় নিরাপত্তার অভাবসহ আরও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বলেও জানান এ নারী যাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী উম্মে আম্মারা ইভা। তিনিও বাসে নারীদের হয়রানির কথা জানালেন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি বলেন, বাস ছাড়া তো ঢাকা শহরে চলাচলের সহজ কোনো মাধ্যম নেই। সিএনজি বা বাইক রাইডে প্রতিদিন যাতায়াত করতে অনেক বেশি খরচ, তাই বাসই ভরসা। অথচ বাসে ওঠার আগেই শুরু হয়ে যায় হয়রানি। অনেক দিন এমন হয় যে, বাসে সিট খালি না থাকার অজুহাতে হেল্পার নারীদেরকে বাসে তুলতে চায় না। বাসে ওঠার সময়ে বা বাসের ভেতরে অস্বস্তিকর হয়রানির ভয় তো আছেই। সেভ দ্য রোডের মহাসচিব শান্তা ফারজানা বলেন, গণপরিবহনে ৮২ শতাংশ নারী নিগৃহীত হন। নারীদের বসার জন্য সিট যদি ২০ শতাংশ নিশ্চিত করা যায় তাহলে সমস্যা কিছুটা সমাধান হবে। এছাড়া আচরণ বিষয়ক প্রশিক্ষণও চালক-শ্রমিকদের দিতে হবে। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রিয়াল টিম সার্বক্ষণিক সক্রিয় রাখলে নারীদের গণপরিবহনে নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু ছালেহ আতিফ বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ গণপরিবহনের সমস্যাগুলোর সমাধান নেই যুগের পর যুগ। যাত্রী অধিকারের জন্য যে দিবস আছে সেটিও জানতাম না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে সমস্যার সমাধান না হয়ে আরও বাড়বে যাত্রীদের। বিআরটিএ উপপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. হেমায়েত উদ্দিন বলেন, যেসব গণপরিবহনে ফিটনেস থাকে না, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে, আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আর সড়কে সবসময় আমরা মনিটরিং করে থাকি। যাত্রী হয়রানির অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হন ৮২ শতাংশ নারী
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ