ঢাকা ১১:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫

ঘৃণার উজান-ভাটি ও ভেজাল-খাঁটি

  • আপডেট সময় : ০৮:৫৩:২৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ জুলাই ২০২২
  • ১৩৯ বার পড়া হয়েছে

শিশির ভট্টাচার্য্য : বাংলাদেশে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের দুরাবস্থার সূচক দৃশ্যত ঊর্ধ্বমুখী– প্রথমে কান ধরে উঠবস, এরপর বক্তব্য রেকর্ড, তারপর জুতার মালা, অবশেষে পিটিয়ে মেরে ফেলা! অল্প সময়ে দেখার মতো উন্নতি বটে। আজ ভদ্র, কাল হৃদয়, পরশু স্বপনৃ এই জন্মগতভাবে সংখ্যালঘু এবং পেশায় শিক্ষকদের অপদস্থ করে এক ঢিলে কয়েক পাখি মারা হচ্ছে। সংখ্যালঘু, শিক্ষক এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী সবার কাছে দেশত্যাগের বার্তা চলে যাচ্ছে, বিশেষত, পদ্মাসেতু হয়ে দেশত্যাগ যেহেতু সহজতর হয়েছে।
যে কোনো অপরাধ একের পর এক ঘটার কারণ আর কিছু নয়, স্রেফ বিচারহীনতা, যার শুরু সেই পাকিস্তান আমলে। প্রথমত, দ্রুত এবং উচিৎ বিচার হচ্ছে না এবং দ্বিতীয়ত, উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে, যার মানে, সরকার স্বীকার করছে, অপরাধ একটা হয়েছে। কিন্তু এই অপরাধ যে পুলিশ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে করেছে, সেটা কি প্রমাণ হয়েছে? বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। এমন দোর্দ-প্রতাপ পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে যখন ‘গুরুগলে পাদুকামালা’ পরানো হয়েছে, এই ঘটনার পেছনে অবশ্যই এমন একটি পক্ষ সক্রিয় আছে পুলিশ ও প্রশাসন যার সামনে অসহায়।
অপরাধটা যদি স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা করে থাকেন, তবে বিচার করে তাদের শাস্তিবিধান করা হোক। একটি ঘটনায় ঠিকঠাকমতো বিচার ও শাস্তি হলে সম্ভাব্য অপরাধীদের কাছে একটা বার্তা যাবে এবং এমন ঘটনা আর সহজে ঘটবে না। অপদস্থ শিক্ষকের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে তাকে পদস্থ করা আর ধর্ষিতার সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ে দেওয়া একই কথা। এমন বিয়ে বা বিচার কখনই ধর্ষণের সংখ্যা কমাতে সাহায্য করে না।
বলা হয়ে থাকে, অপরাধীর কোনো দল নেই। সরকারের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তারা ক্ষমতাসীন দলকেই স্থান-কাল নির্বিশেষে তারা নিজেদের দল বানিয়ে নেয়। এই অপকর্মগুলোর পিছনে দলীয় চক্রান্ত অবশ্যই আছে। ধর্মকে স্রেফ ব্যবহার করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু সহজ টার্গেট। নারী, মুক্তচিন্তার লোকজনৃ এদের টার্গেট করা হবে অচিরেই এবং দলের ছত্রচ্ছায়ায়। ত্রিশের দশকের জার্মানিতে এমন ঘটনা ঘটেছিল। কিছু মানুষ তাদের প্রতিহিংসা ও ধান্দা চরিতার্থ করেছিল নাৎসি দলের ছত্রচ্ছায়ায়।
একটি ধর্মপন্থী দলের নেতারা প্রকাশ্য বক্তৃতায় গলা ফাটিয়ে বলেছেন, সংখ্যালঘু শিক্ষকদের (ডারউইনের) বাঁদরের মতো পিটিয়ে মেরে ছাত্ররা উচিত কাজই করছে! ত্রিশের দশকে হিটলারের জার্মানিতে নাৎসিরা ইহুদী ও কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে এমন আক্রমণাত্মক কথা বলত এবং জনগণ কিছুই বলতো না। তারা ভাবতো, অমনটা বলেই থাকে ওরা। বলবে, তবে তেমন কিছু করবে না। কিংবা ভাবতো, সরকার তো আছেই, আমরা কথা বলে কী লাভ! কথা বলায় বিপদ যতটা না ছিল, ভয় ছিল তার চেয়ে বহুগুণ বেশি, সে যুগে এবং এ যুগে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ভয়জনিত সুবিধাবাদী নীরবতাই যুগে যুগে ফ্যাসিবাদীদের জয়ের সূচক।
সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরুর ঘৃণাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি: খাঁটি এবং ভেজাল। উজানের দেশের ঘৃণা অপেক্ষাকৃত নির্ভেজাল, ভাটির দেশের ঘৃণা ততটা খাঁটি নয়। ত্রিশের দশকে উজানের দেশ জার্মানিতে ইহুদিদের প্রতি জার্মান তথা ইওরোপীয়দের যে ঘৃণা ছিল, সেই ঘৃণা ছিল শতভাগ খাঁটি। নিছক ইহুদির সম্পদ দখল করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং ইহুদি বলেই ব্যক্তিকে ঘৃণা করা হতো, হোন তিনি আইনস্টাইন, কিংবা ওয়াল্টার বেঞ্জামিন। পাকিস্তান-আফগানিস্তানে সুন্নিরা অমুসলিম এবং অ-সুন্নিদের মন থেকে ঘৃণা করে। ওসব দেশে দাঙ্গা, মসজিদে বোমাবাজি, ‘নারায়ে তাকবির’ বলে গলা কেটে ফাঁক করে দেওয়া ইত্যাদিতে এই ঘৃণার অসঙ্কোচ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই ঘৃণা চলমান জীবনের এতটাই অবিচ্ছেদ্য অংশ যে ঘৃণাকারী এবং ঘৃণিত, দুজনের কারও মনেই ঘৃণার অস্তিত্ব নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সংখ্যালঘুর সম্পদের প্রতি লোভের কারণে কি সংখ্যালঘুকে ঘৃণা করা হয় এই দুই দেশে? এর উত্তর আমার জানা নেই, তবে উজানের এই দুই দেশে সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরুর ঘৃণায় কোনো ভেজাল সম্ভবত নেই, অন্ততপক্ষে আমাদের ভাটির দেশের মতো নেই, যে কারণে সম্ভবত এই দুই দেশে সংখ্যালঘুর সংখ্যা শতকরা একেরও নিচে নেমে এসেছে।
পাকিস্তানে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ খাঁটি হবার অন্যতম কারণ জাতিগঠন না হওয়া। ‘পাকিস্তানি’ জাতি বলে কিছু নেই। পাকিস্তানের নামকরণে পাঞ্জাবের ‘পা’, কাশ্মিরের ‘কি’, সিন্ধুর ‘স’, বেলুচিস্তানের ‘তান’ এর জগাখিচুড়ি হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, এই জগাখিচুড়ি সিদ্ধ হয়ে একদিন পাকিস্তানি জাতির জন্ম হবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচি যে যার মতো রয়ে গেছে, চালে-ডালে মেশেনি। জগাখিচুড়ি যেমন কোনোমতে গেলা যায়, স্বাদ হয় না, পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রথমত, ঘৃণাটা খাঁটি হবার কারণে এবং দ্বিতীয়ত, কখনও জাতিগঠন না হবার কারণে দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তানে অমুসলিম, অ-সুন্নির সংখ্যা কমেছে জ্যামিতিক হারে।
সাম্প্রতিক শিক্ষক হেনস্থায় দেখা গেছে, শাসক দলের স্থানীয় রাজনীতিকেরা মৌলবাদ এবং হিন্দুবিদ্বেষকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করেছে। ১৯৪৭ সাল থেকেই পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘু বিতাড়ণের পিছনে মূল কারণ ছিল সংখ্যালঘু বা হিন্দুধর্মের প্রতি ঘৃণা নয়, সংখ্যালঘুর ‘জানমাল’ (দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতে হবে ‘মাল’ বলতে এ অঞ্চলে নারীও বোঝায়!) দখল। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, ময়মনসিংহ থেকে মনপুরা, বাংলাদেশের সর্বত্র, সেই মোনায়েম খান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেকেই কমবেশি এই অপরাধে জড়িত। কেউ যদি আপনাকে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ভালোবাসে, সেই ভালোবাসাকে আপনি যেমন খাঁটি বলতে পারেন না, তেমনি উদ্দেশ্যপূর্ণ ঘৃণাও প্রকৃত ঘৃণা নয় বলে সন্দেহ করা যেতেই পারে।
বাংলাদেশে অন্য অনেক কিছুর মতো সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ এবং মৌলবাদও ভেজালমুক্ত নয় এবং এই ভেজাল ঘৃণার কারণে পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘুরা দেশভাগের পর থেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছে। ১৯৭১ সালে ভারত থেকে সংখ্যালঘুদের প্রত্যাবর্তনের পেছনেও এই একই বিভ্রান্তি কাজ করেছিল নিশ্চয়ই। সংখ্যালঘুর প্রতি ঘৃণা খাঁটি এবং চলমান না হবার কারণেই সম্ভবত বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর সংখ্যা অতিদ্রুত ক্রমহ্রাসমান, কিন্তু পাকিস্তানের মতো এখনও শতকরা এক ভাগের নিচে নেমে আসেনি।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর প্রতি ঘৃণায় এই ভেজালের মূল উৎস বাঙালি জাতীয়তাবাদ যা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের মতো ভুঁইফোঁড় নয়। হাজার বছর ধরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমরা যে বাঙালি, এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। মাঝে মাঝে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাতাস লেগে সংখ্যালঘুর প্রতি ঘৃণায় জং ধরে সংখ্যালঘুর মনে হয়, সংখ্যাগুরুর মনে তার প্রতি বিদ্বেষ প্রশমিত হয়ে গেছে। তখন ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’, ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি ফুল, হিন্দু-মুসলমান!’ এই সব কথা বলা হতে থাকে। অমুসলমান এবং অ-সুন্নী এই সব শুনেটুনে ভাবে, সত্যিই তো, এই দেশ তো ওদের মতো আমারও। সংখ্যাগুরুর ঘৃণাকে সে অমূলক মনে করতে থাকে, ক-দিনের মতো সংখ্যালঘুর দেশত্যাগে কিছুটা ভাটা পড়ে।
ত্রিশের দশকের জার্মানিতে কোনো ইহুদি উচ্চপদে ছিল না। হয় তারা পালিয়ে বেঁচেছিল কিংবা তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। ইহুদিরা সেই সময়ে ইউরোপে সরকারি পদে নিয়োগ পাবার আশা করত না। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিজ যোগ্যতায় উচ্চপদে আছে বটে, কিন্তু সেটা নিয়ে সংখ্যাগুরুর একাংশের মনে অসন্তোষ এবং ঈর্ষাও আছে, যারা মনে করে, সংখ্যালঘু হবার কারণেই বেশ কিছু লোককে উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের মেধা ও যোগ্যতার কারণে নয়। এটা অনেকটা জিয়ল মাছের জীবন, বাঁচিয়েও রাখা হবে, কিন্তু জীবনের নিত্য ঝুঁকিও থাকবে। ভেজাল ঘৃণার এটাও এক উদাহরণ বটে।
ভাটির দেশের ঘৃণা দৃশ্যত উজানের দেশের ঘৃণার চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভেজাল। নাৎসি জার্মানির মতো পাকিস্তান-আফগানিস্তানে সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হয়, কিন্তু স্বদেশে নিজের অবস্থান নিয়ে বিন্দুমাত্র বিভ্রান্তি নেই তাদের মনে। কেউ যদি নিশ্চিত জানে একবার বাগে পেলে সুন্দর বনের বাঘে তাকে ছাড়বে না, তবে বাঘের সহবাস সে যথাসাধ্য পরিহার করবে। মানুষের প্রতি বাঘের আচরণের মতো উজানের নির্ভেজাল ঘৃণা নিষ্ঠুর, তাতে সন্দেহ কী, কিন্তু বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ তাতে নেই।
খাঁটি কিংবা ভেজাল, সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ দেশ ও জাতির দীর্ঘমেয়াদী এবং অপূরণীয় ক্ষতি করে। দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান ও সহজাত ঘৃণা দূর করা জাতিরাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই লক্ষ্য অর্জনে যে রাষ্ট্র যতটা ব্যর্থ, সেই রাষ্ট্র ততটাই অসফল। পঞ্চাশের দশকে হিন্দু শিক্ষকেরা ভারতে চলে গিয়ে পূর্ববঙ্গের কী ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে কোনো গবেষণা কখনো হয়নি। ‘আমরা মুসলমান বিজ্ঞানী চাই!’ পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের এই ঘোষণার পর সত্যেন বোস, অমিয় চক্রবর্তীর মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিরাই দেশে থাকতে সাহস করেননি। সাধারণ শিক্ষকেরা প্রাণ বাঁচাতে শিয়ালদহের প্ল্যাটফর্মকেই শ্রেয়তর বাসস্থান মনে করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বাংলাদেশে থেকে সংখ্যালঘু পালাচ্ছে জীবন ও সম্মান বাঁচাতে। সংখ্যাগুরুদের মধ্যে যারা মুক্তমনা এবং বুদ্ধিমান, তারা জানে, এর পর আসবে তাদের ‘পালা’। সুতরাং তারাও ‘পালা’-নোর পথ দেখছে। যারা টাকা চুরি করে বেগমপাড়ায় পলায়নপর, তারা চুপ থাকে, কারণ চোরের মায়ের বড় গলা হওয়া শোভন নয়। যারা স্বদেশে নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে পালায়, তারা বলে, লেখে: ‘আই হেট বিডি!’ এই লেখা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। অনেকে সাহস করে মুখে বলে না, লেখে না, কিন্তু মনে মনে ভাবে তো ঠিকই। বিখ্যাত নায়ক শাকিব খানও নাকি মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। ক্ষমতাসীনদের অতি কাছের আত্মীয়-স্বজনেরও মার্কিন-কানাডিয়ান নাগরিকত্ব নেই কি? বাংলাদেশ যদি বাসযোগ্য দেশ হতো, তবে ক্ষমতাবানদেরও কেন আগে থেকে বিদেশে পালাবার রাস্তা পরিষ্কার রাখতে হয়?
দেড় দশক অনেক লম্বা সময়, অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল ইত্যাদি অবকাঠামো করে দেখাতে চেষ্টা করা হচ্ছে, দেশের শরীর ঠিক আছে, হাত-পা বেশ সুন্দর, শক্তপোক্ত হয়েছে। কিন্তু মনের খবর কি জানি আমরা? প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় সব পরিবেশ যথাসাধ্য নষ্ট হয়েছে। মানুষ এতটাই অসহিষ্ণু এবং হতাশ হয়ে পড়েছে যে সে পাগলামী এবং সুস্থ আচরণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছে না। প্রথম সুযোগেই সে পদ্মা সেতুর উপর প্রশ্রাব করছে, মারা যাচ্ছে, নাটবল্টু খুলে নিচ্ছে, কারণ আর কিছু নয়, সে সুস্থ নেই। ভুললে চলবে না যে গত পনেরো বছরেই এদের বেশির ভাগ সাবালক হয়েছে। এর জন্যে কিছুটা দায়ী জনগণ, অনেকটা দায়ী আমলাতন্ত্র এবং সবচেয়ে বেশি দায়ী অপরিণামদর্শী রাজনীতিকেরা।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রয়োজনীয় খবর এখন প্রথমে সামাজিক মিডিয়ায় আগে আসে। কয়েকদিন পর সরকারের ইঙ্গিত বুঝে বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করে, তারপর সরকার ব্যবস্থা নেয়, তারপর বুনিয়াদি মিডিয়া খবরটা প্রকাশ করে। ততদিনে ক্ষতি যা হবার তা হয়ে যায়। এই ঢাক ঢাক গুড়গুড় আর কত দিন? ঘা হলে ঘায়ের তড়িৎ চিকিৎসা করতে হয়। ঘা লুকালে কি ঘা সারবে? এই সামাজিক মিডিয়ার যুগে তো বটেই, কোনো কালেই দুরারোগ্য রোগ লুকানো যেত না। ঢোলের বাড়ি কাপড় দিয়ে ঢেকে আটকানো যায় না, কাপড় যত পুরুই হোক না কেন।
২০২১ সালে বাংলাদেশের কুড়ি হাজার লোক ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছে। সারা পৃথিবীতে এই সংখ্যা কয়েক গুণ হবে। যারা পালাচ্ছে, তারা বিদেশে মানবেতর জীবন যাপন করছে। যারা পালাতে পারছে না, তারা হতাশায় ভুগছে। কেন এই পালানোর পরিবেশ সৃষ্টি হলো স্বাধীনতার পর? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তো ছিল ‘সোনার’ বাংলা! সেটা কেন ‘শোনার’ বাংলা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন? মানুষকে সুখে রাখার জন্যেই তো ত্রিশ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল, নাকি? আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এখনও সময় আছে, মানুষের মনের যতœ নিন। মন নষ্ট হলে সবই শেষ। মেঘনাদবধ কাব্যে ‘সমুদ্রের প্রতি রাবণ’ অংশের একটি প্যারোডি দিয়ে লেখা শেষ করি:
“কী সুন্দর মালা আজি পরায়েছ গুরুগলে!
হা ধিক্, ওহে বঙ্গজনপদবাসী। এই কি সাজে তোমারে?
শ্রদ্ধেয়, পূজ্য যিনি, হায়! এই কি হে তাহার ভূষণ?
মুঢ়মতি, কহ শুনি, কি কারণে, কি দোষে অপমানিছ তুমি তাহারে?
সত্য বটে, ঝাড়েবংশে মূর্খ যেবা, চতুর্দশ পুরুষেতে
জ্ঞান, চিন্তা ও যুক্তির লেশমাত্র নাই, তোতাপক্ষীসম আবৃত্তি করিতে পারে,
পারে না, চাহে না বুঝিতে, পদুমাসেতুর বুকে আষাঢ়স্য প্রশম দিবসে
মুত্রধারা দিয়া উদ্বোধনী আলপনা আঁকে যে মর্কট,
উহা দ্বারা কি না সম্ভবে?
অধম ভালুকে শৃঙ্খলিয়া যাদুকর, খেলে তারে লয়ে।
হে মহামদন! নিজস্বার্থ উদ্ধারিতে অদৃশ্য কেহবা তোমারে লয়ে
খেলিছে তেমতি। পথপ্রদর্শক গুরু, তাহারে পরাও তুমি পাদুকার মালা!
ওহে বঙ্গজন, মণি হয়ে শোভে যেবা তব বক্ষঃস্থলে,
কৌস্তুভ-রতন যথা মাধবের বুকে, কেন তারে নিক্ষেপিছ
বৃথা কুশবনে? গুরুহীন, বৈচিত্র্যহীন, সংখ্যালঘুহীন, সংস্কৃতিহীন
একশৈলিক বঙ্গভূমি বৃথা কেন আকাঙ্ক্ষিছ তুমি?
উঠ, বাছা, অকৃতকারক! বীরবলে এ জাঙাল ভাঙি,
দূর কর অপবাদ। ক্ষমা চাহ গুরুপদতলে পড়ি, অনতিবিলম্বে!
খুলিয়া পাদুকামালা, গুরুগলে পঙ্কজ-মালিকা দেহ শ্রদ্ধাভরে,
পদুমা নদীর বুকে তব অতি আহ্লাদের সেতুসম।
গুরুগলে পাদুকা, গুরু নহে, শিষ্যের নিজেরই অপমান!
রেখো না গো তব ভালে এ কলঙ্ক-রেখা!
হেন ক্রান্তিকালে বঙ্গজ জনের কানে, সখে, সখারীতে,
মধুছন্দে, জন্মদিনে এ মম মিনতি।”
লেখক : অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শুধু আইনি লড়াই নয়, আইনি সহায়তার রাষ্ট্র হোক
ফারজানা কাশেমী
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বা আইন দ্বারা বাধ্যগত বাক্যসমূহ শুধুমাত্র পুঁথিগত সমাচারমাত্র। আইনের যথাযথ প্রয়োগ উপরোক্ত বাক্যের ভাবগত অর্থ সুনিশ্চিত করতে পারে। প্রচলিত আইনে অপরাধের ধরন, শাস্তি, ব্যাখ্যা স্পষ্টত থাকলেও সর্বজনবিদিত হয়ত নয়। যদিও, রমহড়ৎধহপব ড়ভ ষধি রং হড় বীপঁংব. আইনসিদ্ধ উপায়ে সকল অপরাধের শাস্তি যথাযথ সময়ে কার্যকর করা সম্ভব হলে হয়ত মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কিছু অংশে হ্রাস পেতো।
বাংলাদেশে প্রচলিত চবহধষ ঈড়ফব, ১৮৬০ এ মারামারিকে তুচ্ছ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ও শাস্তি উল্লেখ আছে। তেমনি গণধোলাইকে ও চবহধষ ঈড়ফব, ১৮৬০ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যদিও গণধোলাই-এর আসামী চিহ্নিতকরণ এক জটিল সমীকরণ। বেশকিছু বছর আগে সাভারের আমিন বাজারে শবেবরাত-এর রাতে কিছু সংখ্যক ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে গণধোলাই দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে সেই ছাত্রদের প্রাণহানি হয়। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়েরর মধ্যে আইনের প্রয়োগ সীমাবদ্ধতার চক্করে আইনের উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে খুলনা বিভাগে ডাঃ রাকিব নামের এক চিকিৎসক গণধোলাইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এই নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিত হত্যার বিচার সুনিশ্চিতকরণ সময়োপযোগী দাবি। প্রতিটি পেশাজীবীর নিরাপদ
কর্মস্থল হয়ত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিতকরণ কিছু অংশে সম্ভবপর। তাই বাস্তবিক অর্থে আইনের প্রয়োগ কার্যত অর্থে অপরাধ নির্মূলে সহায়ক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
রাজধানীর স্বনামধন্য বেসরকারি হাসপাতাল টহরঃবফ ঐড়ংঢ়রঃধষ এ সাইফুল নামের এক কর্মচারি কর্তৃক আইসিউতে এক নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। উক্ত ঘটনার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করেছিল। মহামারির সময়ে খুলনায় এক হাসপাতালের কর্মচারি দ্বারা করোনা আক্রান্ত নারীর যৌন হয়রানির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
ঝবীঁধষ ঙভভবহফবৎ ও ঝবীঁধষ উরংড়ৎফবৎ -এর মধ্যকার পার্থক্য নিশ্চিতকরণ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়। মানসিক বিকারগ্রস্ত, মানসিক ভারসাম্যহীনসহ সকল মানসিক রোগীর চিকিৎসা আশু প্রয়োজন। গড়ে ২৮ জন ব্যক্তি প্রতিদিন আতœহত্যা করেন। আতœহত্যা বা অপমৃত্যু রোধে আইনের প্রয়োগ বিদ্যমান। ১৮ বছরের নিচে কোনো অপরাধীর শাস্তির পরির্বতে তাকে আইনগতভাবে সংশোধন কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
ঈৎরসড়মবহরপ ঐরংঃড়ৎু ও অপরাধের বিচার করার জন্য প্রয়োজন। ঐশী নামের এক কিশোরী নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তার বাবা, মাকে খুন করেছিল। আলোচিত সেই ঘটনায় এই কিশোরীর সর্বোচ্চ শাস্তি রহিত হয়েছে তার ঈৎরসড়মবহরপ ঐরংঃড়ৎু বিবেচনায়। তাই অপরাধ বিবেচনায় ব্যক্তির বয়স, মানসিক অবস্থা, অপরাধের ধরন, প্রকৃত কারণ নির্ধারণের নিমিত্তে অপরাধীর শাস্তি সুনিশ্চিতকরণ প্রয়োজন। আইনের বাস্তবিক দিক বিবেচনায়, আইনের কার্যত প্রয়োগে অপরাধীর বিচার হোক। মানবিক হোক মানুষ। অপরাধের নৃসংশতা দূরীকরণে আইন হোক সহায়ক। বেড়াজালের আইন নয়, সকলের বোধ্যগম্য আইন। তাই শুধু আইনি লড়াই নয়, আইনি সহায়তার রাষ্ট্র হোক।
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

ঘৃণার উজান-ভাটি ও ভেজাল-খাঁটি

আপডেট সময় : ০৮:৫৩:২৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ জুলাই ২০২২

শিশির ভট্টাচার্য্য : বাংলাদেশে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের দুরাবস্থার সূচক দৃশ্যত ঊর্ধ্বমুখী– প্রথমে কান ধরে উঠবস, এরপর বক্তব্য রেকর্ড, তারপর জুতার মালা, অবশেষে পিটিয়ে মেরে ফেলা! অল্প সময়ে দেখার মতো উন্নতি বটে। আজ ভদ্র, কাল হৃদয়, পরশু স্বপনৃ এই জন্মগতভাবে সংখ্যালঘু এবং পেশায় শিক্ষকদের অপদস্থ করে এক ঢিলে কয়েক পাখি মারা হচ্ছে। সংখ্যালঘু, শিক্ষক এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী সবার কাছে দেশত্যাগের বার্তা চলে যাচ্ছে, বিশেষত, পদ্মাসেতু হয়ে দেশত্যাগ যেহেতু সহজতর হয়েছে।
যে কোনো অপরাধ একের পর এক ঘটার কারণ আর কিছু নয়, স্রেফ বিচারহীনতা, যার শুরু সেই পাকিস্তান আমলে। প্রথমত, দ্রুত এবং উচিৎ বিচার হচ্ছে না এবং দ্বিতীয়ত, উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে, যার মানে, সরকার স্বীকার করছে, অপরাধ একটা হয়েছে। কিন্তু এই অপরাধ যে পুলিশ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে করেছে, সেটা কি প্রমাণ হয়েছে? বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। এমন দোর্দ-প্রতাপ পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে যখন ‘গুরুগলে পাদুকামালা’ পরানো হয়েছে, এই ঘটনার পেছনে অবশ্যই এমন একটি পক্ষ সক্রিয় আছে পুলিশ ও প্রশাসন যার সামনে অসহায়।
অপরাধটা যদি স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা করে থাকেন, তবে বিচার করে তাদের শাস্তিবিধান করা হোক। একটি ঘটনায় ঠিকঠাকমতো বিচার ও শাস্তি হলে সম্ভাব্য অপরাধীদের কাছে একটা বার্তা যাবে এবং এমন ঘটনা আর সহজে ঘটবে না। অপদস্থ শিক্ষকের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে তাকে পদস্থ করা আর ধর্ষিতার সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ে দেওয়া একই কথা। এমন বিয়ে বা বিচার কখনই ধর্ষণের সংখ্যা কমাতে সাহায্য করে না।
বলা হয়ে থাকে, অপরাধীর কোনো দল নেই। সরকারের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তারা ক্ষমতাসীন দলকেই স্থান-কাল নির্বিশেষে তারা নিজেদের দল বানিয়ে নেয়। এই অপকর্মগুলোর পিছনে দলীয় চক্রান্ত অবশ্যই আছে। ধর্মকে স্রেফ ব্যবহার করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু সহজ টার্গেট। নারী, মুক্তচিন্তার লোকজনৃ এদের টার্গেট করা হবে অচিরেই এবং দলের ছত্রচ্ছায়ায়। ত্রিশের দশকের জার্মানিতে এমন ঘটনা ঘটেছিল। কিছু মানুষ তাদের প্রতিহিংসা ও ধান্দা চরিতার্থ করেছিল নাৎসি দলের ছত্রচ্ছায়ায়।
একটি ধর্মপন্থী দলের নেতারা প্রকাশ্য বক্তৃতায় গলা ফাটিয়ে বলেছেন, সংখ্যালঘু শিক্ষকদের (ডারউইনের) বাঁদরের মতো পিটিয়ে মেরে ছাত্ররা উচিত কাজই করছে! ত্রিশের দশকে হিটলারের জার্মানিতে নাৎসিরা ইহুদী ও কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে এমন আক্রমণাত্মক কথা বলত এবং জনগণ কিছুই বলতো না। তারা ভাবতো, অমনটা বলেই থাকে ওরা। বলবে, তবে তেমন কিছু করবে না। কিংবা ভাবতো, সরকার তো আছেই, আমরা কথা বলে কী লাভ! কথা বলায় বিপদ যতটা না ছিল, ভয় ছিল তার চেয়ে বহুগুণ বেশি, সে যুগে এবং এ যুগে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ভয়জনিত সুবিধাবাদী নীরবতাই যুগে যুগে ফ্যাসিবাদীদের জয়ের সূচক।
সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরুর ঘৃণাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি: খাঁটি এবং ভেজাল। উজানের দেশের ঘৃণা অপেক্ষাকৃত নির্ভেজাল, ভাটির দেশের ঘৃণা ততটা খাঁটি নয়। ত্রিশের দশকে উজানের দেশ জার্মানিতে ইহুদিদের প্রতি জার্মান তথা ইওরোপীয়দের যে ঘৃণা ছিল, সেই ঘৃণা ছিল শতভাগ খাঁটি। নিছক ইহুদির সম্পদ দখল করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং ইহুদি বলেই ব্যক্তিকে ঘৃণা করা হতো, হোন তিনি আইনস্টাইন, কিংবা ওয়াল্টার বেঞ্জামিন। পাকিস্তান-আফগানিস্তানে সুন্নিরা অমুসলিম এবং অ-সুন্নিদের মন থেকে ঘৃণা করে। ওসব দেশে দাঙ্গা, মসজিদে বোমাবাজি, ‘নারায়ে তাকবির’ বলে গলা কেটে ফাঁক করে দেওয়া ইত্যাদিতে এই ঘৃণার অসঙ্কোচ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই ঘৃণা চলমান জীবনের এতটাই অবিচ্ছেদ্য অংশ যে ঘৃণাকারী এবং ঘৃণিত, দুজনের কারও মনেই ঘৃণার অস্তিত্ব নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সংখ্যালঘুর সম্পদের প্রতি লোভের কারণে কি সংখ্যালঘুকে ঘৃণা করা হয় এই দুই দেশে? এর উত্তর আমার জানা নেই, তবে উজানের এই দুই দেশে সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরুর ঘৃণায় কোনো ভেজাল সম্ভবত নেই, অন্ততপক্ষে আমাদের ভাটির দেশের মতো নেই, যে কারণে সম্ভবত এই দুই দেশে সংখ্যালঘুর সংখ্যা শতকরা একেরও নিচে নেমে এসেছে।
পাকিস্তানে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ খাঁটি হবার অন্যতম কারণ জাতিগঠন না হওয়া। ‘পাকিস্তানি’ জাতি বলে কিছু নেই। পাকিস্তানের নামকরণে পাঞ্জাবের ‘পা’, কাশ্মিরের ‘কি’, সিন্ধুর ‘স’, বেলুচিস্তানের ‘তান’ এর জগাখিচুড়ি হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, এই জগাখিচুড়ি সিদ্ধ হয়ে একদিন পাকিস্তানি জাতির জন্ম হবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচি যে যার মতো রয়ে গেছে, চালে-ডালে মেশেনি। জগাখিচুড়ি যেমন কোনোমতে গেলা যায়, স্বাদ হয় না, পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রথমত, ঘৃণাটা খাঁটি হবার কারণে এবং দ্বিতীয়ত, কখনও জাতিগঠন না হবার কারণে দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তানে অমুসলিম, অ-সুন্নির সংখ্যা কমেছে জ্যামিতিক হারে।
সাম্প্রতিক শিক্ষক হেনস্থায় দেখা গেছে, শাসক দলের স্থানীয় রাজনীতিকেরা মৌলবাদ এবং হিন্দুবিদ্বেষকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করেছে। ১৯৪৭ সাল থেকেই পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘু বিতাড়ণের পিছনে মূল কারণ ছিল সংখ্যালঘু বা হিন্দুধর্মের প্রতি ঘৃণা নয়, সংখ্যালঘুর ‘জানমাল’ (দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতে হবে ‘মাল’ বলতে এ অঞ্চলে নারীও বোঝায়!) দখল। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, ময়মনসিংহ থেকে মনপুরা, বাংলাদেশের সর্বত্র, সেই মোনায়েম খান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেকেই কমবেশি এই অপরাধে জড়িত। কেউ যদি আপনাকে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ভালোবাসে, সেই ভালোবাসাকে আপনি যেমন খাঁটি বলতে পারেন না, তেমনি উদ্দেশ্যপূর্ণ ঘৃণাও প্রকৃত ঘৃণা নয় বলে সন্দেহ করা যেতেই পারে।
বাংলাদেশে অন্য অনেক কিছুর মতো সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ এবং মৌলবাদও ভেজালমুক্ত নয় এবং এই ভেজাল ঘৃণার কারণে পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘুরা দেশভাগের পর থেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছে। ১৯৭১ সালে ভারত থেকে সংখ্যালঘুদের প্রত্যাবর্তনের পেছনেও এই একই বিভ্রান্তি কাজ করেছিল নিশ্চয়ই। সংখ্যালঘুর প্রতি ঘৃণা খাঁটি এবং চলমান না হবার কারণেই সম্ভবত বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর সংখ্যা অতিদ্রুত ক্রমহ্রাসমান, কিন্তু পাকিস্তানের মতো এখনও শতকরা এক ভাগের নিচে নেমে আসেনি।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর প্রতি ঘৃণায় এই ভেজালের মূল উৎস বাঙালি জাতীয়তাবাদ যা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের মতো ভুঁইফোঁড় নয়। হাজার বছর ধরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমরা যে বাঙালি, এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। মাঝে মাঝে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাতাস লেগে সংখ্যালঘুর প্রতি ঘৃণায় জং ধরে সংখ্যালঘুর মনে হয়, সংখ্যাগুরুর মনে তার প্রতি বিদ্বেষ প্রশমিত হয়ে গেছে। তখন ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’, ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি ফুল, হিন্দু-মুসলমান!’ এই সব কথা বলা হতে থাকে। অমুসলমান এবং অ-সুন্নী এই সব শুনেটুনে ভাবে, সত্যিই তো, এই দেশ তো ওদের মতো আমারও। সংখ্যাগুরুর ঘৃণাকে সে অমূলক মনে করতে থাকে, ক-দিনের মতো সংখ্যালঘুর দেশত্যাগে কিছুটা ভাটা পড়ে।
ত্রিশের দশকের জার্মানিতে কোনো ইহুদি উচ্চপদে ছিল না। হয় তারা পালিয়ে বেঁচেছিল কিংবা তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। ইহুদিরা সেই সময়ে ইউরোপে সরকারি পদে নিয়োগ পাবার আশা করত না। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিজ যোগ্যতায় উচ্চপদে আছে বটে, কিন্তু সেটা নিয়ে সংখ্যাগুরুর একাংশের মনে অসন্তোষ এবং ঈর্ষাও আছে, যারা মনে করে, সংখ্যালঘু হবার কারণেই বেশ কিছু লোককে উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের মেধা ও যোগ্যতার কারণে নয়। এটা অনেকটা জিয়ল মাছের জীবন, বাঁচিয়েও রাখা হবে, কিন্তু জীবনের নিত্য ঝুঁকিও থাকবে। ভেজাল ঘৃণার এটাও এক উদাহরণ বটে।
ভাটির দেশের ঘৃণা দৃশ্যত উজানের দেশের ঘৃণার চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভেজাল। নাৎসি জার্মানির মতো পাকিস্তান-আফগানিস্তানে সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হয়, কিন্তু স্বদেশে নিজের অবস্থান নিয়ে বিন্দুমাত্র বিভ্রান্তি নেই তাদের মনে। কেউ যদি নিশ্চিত জানে একবার বাগে পেলে সুন্দর বনের বাঘে তাকে ছাড়বে না, তবে বাঘের সহবাস সে যথাসাধ্য পরিহার করবে। মানুষের প্রতি বাঘের আচরণের মতো উজানের নির্ভেজাল ঘৃণা নিষ্ঠুর, তাতে সন্দেহ কী, কিন্তু বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ তাতে নেই।
খাঁটি কিংবা ভেজাল, সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ দেশ ও জাতির দীর্ঘমেয়াদী এবং অপূরণীয় ক্ষতি করে। দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান ও সহজাত ঘৃণা দূর করা জাতিরাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই লক্ষ্য অর্জনে যে রাষ্ট্র যতটা ব্যর্থ, সেই রাষ্ট্র ততটাই অসফল। পঞ্চাশের দশকে হিন্দু শিক্ষকেরা ভারতে চলে গিয়ে পূর্ববঙ্গের কী ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে কোনো গবেষণা কখনো হয়নি। ‘আমরা মুসলমান বিজ্ঞানী চাই!’ পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের এই ঘোষণার পর সত্যেন বোস, অমিয় চক্রবর্তীর মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিরাই দেশে থাকতে সাহস করেননি। সাধারণ শিক্ষকেরা প্রাণ বাঁচাতে শিয়ালদহের প্ল্যাটফর্মকেই শ্রেয়তর বাসস্থান মনে করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বাংলাদেশে থেকে সংখ্যালঘু পালাচ্ছে জীবন ও সম্মান বাঁচাতে। সংখ্যাগুরুদের মধ্যে যারা মুক্তমনা এবং বুদ্ধিমান, তারা জানে, এর পর আসবে তাদের ‘পালা’। সুতরাং তারাও ‘পালা’-নোর পথ দেখছে। যারা টাকা চুরি করে বেগমপাড়ায় পলায়নপর, তারা চুপ থাকে, কারণ চোরের মায়ের বড় গলা হওয়া শোভন নয়। যারা স্বদেশে নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে পালায়, তারা বলে, লেখে: ‘আই হেট বিডি!’ এই লেখা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। অনেকে সাহস করে মুখে বলে না, লেখে না, কিন্তু মনে মনে ভাবে তো ঠিকই। বিখ্যাত নায়ক শাকিব খানও নাকি মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। ক্ষমতাসীনদের অতি কাছের আত্মীয়-স্বজনেরও মার্কিন-কানাডিয়ান নাগরিকত্ব নেই কি? বাংলাদেশ যদি বাসযোগ্য দেশ হতো, তবে ক্ষমতাবানদেরও কেন আগে থেকে বিদেশে পালাবার রাস্তা পরিষ্কার রাখতে হয়?
দেড় দশক অনেক লম্বা সময়, অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল ইত্যাদি অবকাঠামো করে দেখাতে চেষ্টা করা হচ্ছে, দেশের শরীর ঠিক আছে, হাত-পা বেশ সুন্দর, শক্তপোক্ত হয়েছে। কিন্তু মনের খবর কি জানি আমরা? প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় সব পরিবেশ যথাসাধ্য নষ্ট হয়েছে। মানুষ এতটাই অসহিষ্ণু এবং হতাশ হয়ে পড়েছে যে সে পাগলামী এবং সুস্থ আচরণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছে না। প্রথম সুযোগেই সে পদ্মা সেতুর উপর প্রশ্রাব করছে, মারা যাচ্ছে, নাটবল্টু খুলে নিচ্ছে, কারণ আর কিছু নয়, সে সুস্থ নেই। ভুললে চলবে না যে গত পনেরো বছরেই এদের বেশির ভাগ সাবালক হয়েছে। এর জন্যে কিছুটা দায়ী জনগণ, অনেকটা দায়ী আমলাতন্ত্র এবং সবচেয়ে বেশি দায়ী অপরিণামদর্শী রাজনীতিকেরা।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রয়োজনীয় খবর এখন প্রথমে সামাজিক মিডিয়ায় আগে আসে। কয়েকদিন পর সরকারের ইঙ্গিত বুঝে বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করে, তারপর সরকার ব্যবস্থা নেয়, তারপর বুনিয়াদি মিডিয়া খবরটা প্রকাশ করে। ততদিনে ক্ষতি যা হবার তা হয়ে যায়। এই ঢাক ঢাক গুড়গুড় আর কত দিন? ঘা হলে ঘায়ের তড়িৎ চিকিৎসা করতে হয়। ঘা লুকালে কি ঘা সারবে? এই সামাজিক মিডিয়ার যুগে তো বটেই, কোনো কালেই দুরারোগ্য রোগ লুকানো যেত না। ঢোলের বাড়ি কাপড় দিয়ে ঢেকে আটকানো যায় না, কাপড় যত পুরুই হোক না কেন।
২০২১ সালে বাংলাদেশের কুড়ি হাজার লোক ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছে। সারা পৃথিবীতে এই সংখ্যা কয়েক গুণ হবে। যারা পালাচ্ছে, তারা বিদেশে মানবেতর জীবন যাপন করছে। যারা পালাতে পারছে না, তারা হতাশায় ভুগছে। কেন এই পালানোর পরিবেশ সৃষ্টি হলো স্বাধীনতার পর? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তো ছিল ‘সোনার’ বাংলা! সেটা কেন ‘শোনার’ বাংলা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন? মানুষকে সুখে রাখার জন্যেই তো ত্রিশ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল, নাকি? আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এখনও সময় আছে, মানুষের মনের যতœ নিন। মন নষ্ট হলে সবই শেষ। মেঘনাদবধ কাব্যে ‘সমুদ্রের প্রতি রাবণ’ অংশের একটি প্যারোডি দিয়ে লেখা শেষ করি:
“কী সুন্দর মালা আজি পরায়েছ গুরুগলে!
হা ধিক্, ওহে বঙ্গজনপদবাসী। এই কি সাজে তোমারে?
শ্রদ্ধেয়, পূজ্য যিনি, হায়! এই কি হে তাহার ভূষণ?
মুঢ়মতি, কহ শুনি, কি কারণে, কি দোষে অপমানিছ তুমি তাহারে?
সত্য বটে, ঝাড়েবংশে মূর্খ যেবা, চতুর্দশ পুরুষেতে
জ্ঞান, চিন্তা ও যুক্তির লেশমাত্র নাই, তোতাপক্ষীসম আবৃত্তি করিতে পারে,
পারে না, চাহে না বুঝিতে, পদুমাসেতুর বুকে আষাঢ়স্য প্রশম দিবসে
মুত্রধারা দিয়া উদ্বোধনী আলপনা আঁকে যে মর্কট,
উহা দ্বারা কি না সম্ভবে?
অধম ভালুকে শৃঙ্খলিয়া যাদুকর, খেলে তারে লয়ে।
হে মহামদন! নিজস্বার্থ উদ্ধারিতে অদৃশ্য কেহবা তোমারে লয়ে
খেলিছে তেমতি। পথপ্রদর্শক গুরু, তাহারে পরাও তুমি পাদুকার মালা!
ওহে বঙ্গজন, মণি হয়ে শোভে যেবা তব বক্ষঃস্থলে,
কৌস্তুভ-রতন যথা মাধবের বুকে, কেন তারে নিক্ষেপিছ
বৃথা কুশবনে? গুরুহীন, বৈচিত্র্যহীন, সংখ্যালঘুহীন, সংস্কৃতিহীন
একশৈলিক বঙ্গভূমি বৃথা কেন আকাঙ্ক্ষিছ তুমি?
উঠ, বাছা, অকৃতকারক! বীরবলে এ জাঙাল ভাঙি,
দূর কর অপবাদ। ক্ষমা চাহ গুরুপদতলে পড়ি, অনতিবিলম্বে!
খুলিয়া পাদুকামালা, গুরুগলে পঙ্কজ-মালিকা দেহ শ্রদ্ধাভরে,
পদুমা নদীর বুকে তব অতি আহ্লাদের সেতুসম।
গুরুগলে পাদুকা, গুরু নহে, শিষ্যের নিজেরই অপমান!
রেখো না গো তব ভালে এ কলঙ্ক-রেখা!
হেন ক্রান্তিকালে বঙ্গজ জনের কানে, সখে, সখারীতে,
মধুছন্দে, জন্মদিনে এ মম মিনতি।”
লেখক : অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শুধু আইনি লড়াই নয়, আইনি সহায়তার রাষ্ট্র হোক
ফারজানা কাশেমী
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বা আইন দ্বারা বাধ্যগত বাক্যসমূহ শুধুমাত্র পুঁথিগত সমাচারমাত্র। আইনের যথাযথ প্রয়োগ উপরোক্ত বাক্যের ভাবগত অর্থ সুনিশ্চিত করতে পারে। প্রচলিত আইনে অপরাধের ধরন, শাস্তি, ব্যাখ্যা স্পষ্টত থাকলেও সর্বজনবিদিত হয়ত নয়। যদিও, রমহড়ৎধহপব ড়ভ ষধি রং হড় বীপঁংব. আইনসিদ্ধ উপায়ে সকল অপরাধের শাস্তি যথাযথ সময়ে কার্যকর করা সম্ভব হলে হয়ত মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কিছু অংশে হ্রাস পেতো।
বাংলাদেশে প্রচলিত চবহধষ ঈড়ফব, ১৮৬০ এ মারামারিকে তুচ্ছ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ও শাস্তি উল্লেখ আছে। তেমনি গণধোলাইকে ও চবহধষ ঈড়ফব, ১৮৬০ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যদিও গণধোলাই-এর আসামী চিহ্নিতকরণ এক জটিল সমীকরণ। বেশকিছু বছর আগে সাভারের আমিন বাজারে শবেবরাত-এর রাতে কিছু সংখ্যক ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে গণধোলাই দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে সেই ছাত্রদের প্রাণহানি হয়। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়েরর মধ্যে আইনের প্রয়োগ সীমাবদ্ধতার চক্করে আইনের উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে খুলনা বিভাগে ডাঃ রাকিব নামের এক চিকিৎসক গণধোলাইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এই নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিত হত্যার বিচার সুনিশ্চিতকরণ সময়োপযোগী দাবি। প্রতিটি পেশাজীবীর নিরাপদ
কর্মস্থল হয়ত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিতকরণ কিছু অংশে সম্ভবপর। তাই বাস্তবিক অর্থে আইনের প্রয়োগ কার্যত অর্থে অপরাধ নির্মূলে সহায়ক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
রাজধানীর স্বনামধন্য বেসরকারি হাসপাতাল টহরঃবফ ঐড়ংঢ়রঃধষ এ সাইফুল নামের এক কর্মচারি কর্তৃক আইসিউতে এক নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। উক্ত ঘটনার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করেছিল। মহামারির সময়ে খুলনায় এক হাসপাতালের কর্মচারি দ্বারা করোনা আক্রান্ত নারীর যৌন হয়রানির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
ঝবীঁধষ ঙভভবহফবৎ ও ঝবীঁধষ উরংড়ৎফবৎ -এর মধ্যকার পার্থক্য নিশ্চিতকরণ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়। মানসিক বিকারগ্রস্ত, মানসিক ভারসাম্যহীনসহ সকল মানসিক রোগীর চিকিৎসা আশু প্রয়োজন। গড়ে ২৮ জন ব্যক্তি প্রতিদিন আতœহত্যা করেন। আতœহত্যা বা অপমৃত্যু রোধে আইনের প্রয়োগ বিদ্যমান। ১৮ বছরের নিচে কোনো অপরাধীর শাস্তির পরির্বতে তাকে আইনগতভাবে সংশোধন কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
ঈৎরসড়মবহরপ ঐরংঃড়ৎু ও অপরাধের বিচার করার জন্য প্রয়োজন। ঐশী নামের এক কিশোরী নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তার বাবা, মাকে খুন করেছিল। আলোচিত সেই ঘটনায় এই কিশোরীর সর্বোচ্চ শাস্তি রহিত হয়েছে তার ঈৎরসড়মবহরপ ঐরংঃড়ৎু বিবেচনায়। তাই অপরাধ বিবেচনায় ব্যক্তির বয়স, মানসিক অবস্থা, অপরাধের ধরন, প্রকৃত কারণ নির্ধারণের নিমিত্তে অপরাধীর শাস্তি সুনিশ্চিতকরণ প্রয়োজন। আইনের বাস্তবিক দিক বিবেচনায়, আইনের কার্যত প্রয়োগে অপরাধীর বিচার হোক। মানবিক হোক মানুষ। অপরাধের নৃসংশতা দূরীকরণে আইন হোক সহায়ক। বেড়াজালের আইন নয়, সকলের বোধ্যগম্য আইন। তাই শুধু আইনি লড়াই নয়, আইনি সহায়তার রাষ্ট্র হোক।
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ