রাশেদ খান মেনন : ৩. বাংলাদেশ যে রাষ্ট্রটিকে ভেঙে বেরিয়ে এসেছে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সেই পাকিস্তান রাষ্ট্র উপমহাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির বাহক হিসেবে এখনও টিকে আছে কেবল নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধর্মীয় জঙ্গিবাদী তৎপরতা পাশের দেশ ভারত, এমনকি দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে ভারতের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী তৎপরতা সে দেশের শাসকগোষ্ঠীকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা সৃষ্টির সুযোগ দিচ্ছে, অপরদিকে বাংলাদেশেও গত তিন দশক থেকে যে জঙ্গিবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটিয়েছে তারও সূত্র পাওয়া যায় পাকিস্তানে। পাকিস্তানের মাদ্রাসায় যেমন আফগানিস্তানের তালেবান তৈরি করেছে তেমনি বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মবাদী দলের অর্থ ও মৌলবাদী ধ্যানধারণার সূত্র পাকিস্তানি এই সব মাদ্রাসা ও তাদের ইসলামি জঙ্গিবাদী সংগঠনসমূহ।
সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানকে সর্বধর্মের মানুষের রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করলেও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ তাদের পূর্বতন রাজনীতি হিসাবে পাকিস্তানকে মুসলিমদের আলাদা আবাসভূমি হিসাবে বিবেচনা করত। আর তাই জিন্নাহর মৃত্যুর অল্প পরেই রাজনীতির খেলায় সামরিক-বেসামরিক আমলারা পাকিস্তান শাসনের নির্ধারক হয়ে উঠলে তারা এই ইসলামি ঝা-াকে ক্ষমতার মূল হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করে। পাকিস্তানে পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক তার মধ্যে তারা ইসলামকেই ঐক্যের সূত্র হিসাবে হাজির করে পাকিস্তানের উভয় অংশে এই তাহাজিব তমদ্দুন প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়। তারপরও পঞ্চাশের প্রথমভাগ পর্যন্ত ইসলামের এই জিগির থাকার পরও কাদিয়ানী দাঙ্গার সময় পাকিস্তান জামায়াতের মওদুদীকে পর্যন্ত ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল। কিন্তু নয় বছর পর ১৯৫৬ সালে গৃহীত সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধান পদে কোনও অমুসলিম নাগরিককে নিয়োগ দেওয়া হবে না বলে বিধান করা হয়।
পাকিস্তানের এই ইসলামি প্রজাতন্ত্রই সেনা শাসকদের হাতে পড়ে বাংলাদেশকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষায় তাদের একমাত্র শ্লোগান ছিল ‘ইসলাম’ যা বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করেনি। ১৯৭১ এর পাকিস্তান ক্রমাগত কট্টর ইসলামি দেশে রূপান্তর লাভ করতে থাকে। জুলফিকার আলীর ভুট্টোর হাত দিয়ে আহমদীয়া (কাদিয়ানী) সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে ব্লাসফেমি আইন কেবল পাসই করা হয়নি, অমুসলিম তো বটেই, এমনকি মুক্তমনা মুসলিমদের এই আইনে বিচার করে ফাঁসি পর্যন্ত দেওয়া হয়। জেনারেল জিয়াউল হকই পাকিস্তানকে তালেবান মুজাহিদদের ট্রেনিং অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা প্রদান করে যার পরিণামে আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান ছিল মার্কিনিদের মিত্র।
সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো বহুদিন ধরেই রাষ্ট্রীয় পোষকতা পেয়ে এসেছে। বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরীফ, সেনা শাসক মোশাররফ ও সর্বশেষ ইমরান খান কেউই এই বৃত্ত থেকে বেরুতে পারেনি। পাকিস্তান কার্যত এখন একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হিসাবে অবস্থান করছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেও সে দেশের শাসনে অঘোষিত সেনা নিয়ন্ত্রণ তাকে দাঁড়াতে দেয়নি, এখনও দিচ্ছে না। উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিস্তারের ক্ষেত্র হিসাবে অবস্থান করছে পাকিস্তান।
৪. উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ দেশ ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে দ্রুততার সাথে যে সংবিধান গ্রহণ করে, তাতে ধর্মনিরপ্রেক্ষতার বিধান সংযুক্ত না করা হলেও জওহরলাল নেহেরু প্রথম থেকেই ভারতকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে ব্রতী হন। উপমহাদেশের বিভক্তি, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও বাংলার বিভক্তি যে সাম্প্রদায়িক ক্ষতি ও শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করে তাতে রাজনীতিতে একটি অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করা দুরূহ ছিল। তারপরও নেহেরুর কংগ্রেসসহ বাম প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক অপর সকল রাজনৈতিক দলসমূহ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পতাকাই তুলে ধরে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ ও রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ। তারা কট্টর হিন্দুত্ববাদের কথা বলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত করতে সক্ষম হলেও রাজনৈতিকভাবে ভারতের জনগণ তাকে কখনও গ্রহণ করেনি। কিন্তু আশির দশক থেকে, হিন্দুত্ববাদের আবরণে যে সাম্প্রদায়িক উত্থান ঘটতে থাকে তার থেকে এমনকি নেহেরুর ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেসও এই প্রভাবের বাইরে থাকেনি।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদের যে জয়যাত্রা শুরু হয় তাই এখন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারতে ধর্মীয় বিভাজন রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত করেছে। সিএএ ও এনআরসি ইতিমধ্যে এই ধর্মীয় বিভাজনকে আইনি রূপ দিয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমবাংলা ও আসাম রাজ্যে যে নির্বাচন হলো তা হয়েছে এই ধর্মীয় বিভাজন নীতির ভিত্তিতে। পশ্চিম বাংলায় এই নীতি জয় লাভ করতে না পারলেও বড় মাঠ দখল করেছে। আর আসাম রাজ্যে কেবল মুসলিমরা নয় বাঙালি হিন্দুরাও চরম অনিশ্চয়তায়। ভারতের উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, কর্নাটকে গো-মাংস নিষিদ্ধ করণের পাশাপাশি তাকে কেন্দ্র করে হামলা-হত্যা, ভারতের গৌরব বিরোধী ধর্মবর্ণের বিয়েকে ‘লাভ জিহাদ’-এ নিষিদ্ধ করার মধ্যে দিয়ে ভারতের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন করেছে।
এটা স্বস্তির বিষয় যে শাহীনবাগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সক্রিয় সমর্থন, ছয় মাস ব্যাপী চলা কৃষকের আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষক, পেশাজীবী মানুষের অভূতপূর্ব ঐক্য, করোনার ভয়াবহতার মধ্যে এক ধর্মের মানুষের প্রতি আরেক ধর্মের মানুষের সহনাভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া, ভারতের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াইকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ও ধর্মবাদী রাজনীতির উত্থান এখনও রুদ্ধ হয় নাই। ভারতকে তার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক পথে ফিরিয়ে আনা সে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে উপস্থিত। সেটা তারা কতখানি এগিয়ে নিতে সক্ষম হবেন তা তাদের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের উপর নির্ভর করছে।
৫. উপমহাদেশের এই সাম্প্রদায়িক উত্থানের অভিঘাত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর উপর রয়েছে। এক দেশের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি জোরদার হওয়া পাশ্ববর্তী দেশগুলোর সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোকে আরও উৎসাহিত ও শক্তিশালী করে। এদের বিরোধী ধর্মীয় অবস্থানের পরও সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী রাজনীতির প্রশ্নে একটি ঐক্যসূত্র আছে। উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোও তাই একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, পারস্পরিক ওই ঐক্যের সূত্র খুঁজে বের করে তাকে সংগঠিত রূপ দিতে হবে।
বাংলাদেশ তার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত করেছে। ভারত-পাকিস্তানও স্বাধীন দেশ হিসাবে তাদের অস্তিত্বের ৭৫ বছর পূর্ণ করতে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী যখন তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে তখন উপমহাদেশে এই সাম্প্রদায়িক পরিচিতিকে দূর করে নতুন বিশ্বের আধুনিকতম দেশ ও সভ্যতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
লেখক: সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ