সালেক উদ্দিন : দেশে করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দ্রুত বিস্তারের আশঙ্কা অনেক দিন ধরেই ছিল। সে আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে এখন। শুরুতে এই ভ্যারিয়েন্টে একজন মারা গেলে দেশজুড়ে বেশ তোলপাড় উঠেছিল। ভারতের সঙ্গে সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করার দাবি উঠেছিল। সময় উপযোগী এই দাবি মেনে সরকার প্রথমে বিমানবন্দর, পরে নৌ ও স্থলবন্দর বন্ধ রাখে। কিন্তু এই বন্ধ রাখাটা ছিল ঢিলেঢালা। ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা জেলাগুলোর সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা একেবারেই কম এবং রোগী ব্যবস্থাপনাও কম থাকার কারণে এসব জেলায় বর্তমানে করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়েছে। বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যা। এর মূল কারণ হলো, আমরা সীমান্ত বন্ধ করেছি অতি ঢিলেঢালাভাবে এবং মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলেছি, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করতে পারিনি। শুধু এই কারণেই করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশময় ছড়াচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এটি ভারতের মতো বাংলাদেশেও একটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগের বিস্তারের হার এবং রোগীর মৃত্যুর হার স্বাভাবিক করোনার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো করোনার ভ্যারিয়েন্ট বা বিটা ভ্যারিয়েন্ট, যুক্তরাজ্যের আলফা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ও মৃত্যু দেখে ভয় পেয়েছিলাম। ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যুক্তরাজ্যের আলফা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও ৪০ গুণ বেশি সংক্রমণশীল বলে গবেষকরা বলেছেন। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারতে যখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মহামারি আকার ধারণ করেছে তখন এ দেশের সরকারকে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে তুলনায় সরকার ইতোমধ্যে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা মোটেই যথেষ্ট ছিল না।
যে কথাটি বলতে বড় ইচ্ছে করছে তা হলো, আলোচ্য ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তিস্থল বা ব্যাপক বিস্তৃতি এবং ভারতের মতো মৃত্যুর মিছিল যদি আমাদের দেশে হতো । যদি একে বাংলাদেশি ভ্যারিয়েন্ট বলা যেত এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এর অস্তিত্ব না থাকতো তবে ভারতের সঙ্গে যেভাবে আমরা সীমান্ত বন্ধ করে পার পেয়ে যাবো ভেবেছিলাম, ভারত কি তাই করতো! আমার তো মনে হয়, ভারত সীমান্ত এমনভাবে বন্ধ করতো, এমন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতো যে বাংলাদেশ থেকে কোনও পাখি ভারতের সীমানায় উড়ে গেলেও তাকে গুলি করে ভূপাতিত করা হতো।
ভারত সেটা পারতো। আমরা পারিনি। গ্রামগঞ্জে একটি প্রবাদ বাক্য চালু আছে, তা হলো ‘গরিবের বউ নাকি সবারই ভাবি’। তার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা, রং তামাশা এ আর এমন কি?
যাহোক, আবার মূল প্রসঙ্গে আসি। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে তার ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরাত দিয়ে বলা যেতে পারে ‘ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বাড়ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনায় আক্রান্তদের অধিকাংশের মধ্যেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।’ উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, গত ৫ জুন শনিবার করোনায় যে ৪৩ জন মারা গেছেন তার অধিকাংশই রাজশাহী এবং তার আশপাশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ। এর একদিন আগে আইইডিসিআর ও আইডিএসএইচআই সংস্থা দুটি জানায়, সীমান্তবর্তী এলাকায় ৫০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪০টিতেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে।
তথ্যগুলো এ কারণেই এখানে তুলে ধরলাম যে এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সীমান্তবর্তী এলাকায় যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে দেশময় এই মারাত্মক ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার লাভ খুব একটি বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না। অবশ্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কিছু দিন আগে থেকেই এ ধরনের সতর্কবাণী করে আসছিলেন। তারা কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের কথাও বলে আসছিলেন। সেই কারণেই হবে হয়তো সরকার এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে ১৬ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত বিধিনিষেধ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সারাদেশে পর্যটনস্থল, রিসোর্ট কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
মাস্ক পরার কথা বলা হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কোনোটাতেই কোনও কাজ হচ্ছে না। নিষিদ্ধ ফল যেমন সুস্বাদু মনে করে মানুষ নিষিদ্ধের প্রতি ছোটে তেমনি প্রবর্তিত নিয়ম ভাঙার প্রবণতা এ দেশের মানুষের পরীক্ষিত একটি স্বভাব। এই কথাটি প্রমাণের জন্য বেশিদূর যেতে হয় না, ঘর থেকে বের হয়ে এদিক-ওদিক তাকালেই প্রমাণ মেলে।
যাহোক, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এ নিয়ে আর পচা ঘেঁটে লাভ নেই। এখন আমরা যে অবস্থায় আছি সেখান থেকে উৎরানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের মানবিক অধিকার। আমরা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের হাত থেকে বাঁচতে চাই। দেশের সরকার আমাদের অভিভাবক। সে কারণেই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায় বর্তায় সরকারের ওপর। আমরা দেখতে চাই সরকার এমনভাবে সীমান্তসহ নৌ ও বিমানবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ করুক যাতে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ করোনার মারাত্মক অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর প্রবেশ ঠেকানো যায়। বেসামরিক প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন এই কাজে যথেষ্ট হলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের এমন বিস্তার এ দেশে হতো না। এর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংযুক্তি অপরিহার্য বলে মনে করছি। জনপ্রতিনিধি এমপিদের নিজ নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যাতে এই মহামারির সময় তারা নিজ নির্বাচনি এলাকায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। এমন আইন প্রবর্তন ও প্রয়োগ যেতে পারে যেন করোনার বিস্তার রোধে মাস্ক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা মানুষ ভুলে যাওয়া তো দূরের কথা, প্রতিনিয়ত স্বপ্নেও দেখে। শুধু তা-ই নয়, অতিসম্প্রতি যারা ভারতে গেছেন বা ভারত থেকে এসেছেন তাদের সবার তালিকা করে অতিসত্বর বাধ্যতামূলক কোভিড টেস্ট করানো অত্যাবশ্যক। যাদের পজিটিভ পাওয়া যাবে আইসোলেশন চিকিৎসা এবং তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের টেস্টের ব্যবস্থা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এগুলো নাগরিক হিসেবে আমার নাগরিক অধিকারের কথা বললাম, আমার ভাবনার কথা বললাম, স্বপ্নের কথা বললাম। প্রত্যাশায় রইলাম খুব সহসাই আমরা করোনামুক্ত হবো।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ছোবল
                                 ট্যাগস :  
                                                            
							
                            
                                      জনপ্রিয় সংবাদ                                
                                
																			
										

























