প্রত্যাশা ডেস্ক : পৃথিবীর অন্তত এক ডজন দেশে ৯২ জনের বেশি মানুষের দেহে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এদিকে দেশের সবগুলো বিমানবন্দরে এ বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর জানিয়েছেন।
রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আরো অন্তত ২৮ জনের মধ্যে এ রোগের উপসর্গ থাকায় তাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর বাইরেও আরও মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। আক্রান্তরা কোন কোন দেশের নাগরিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তা প্রকাশ করেনি। তবে বিবিসি লিখেছে, যেসব দেশে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, তার মধ্যে ইউরোপের নয়টি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া রয়েছে।
মাঙ্কিপক্স এমনিতে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দুর্গম এলাকার মানুষের মধ্যে দেখা যায়। ভাইরাসজনিত এ রোগ সাধারণত মৃদু অসুস্থতার কারণ ঘটায় এবং অধিকাংশ রোগী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যান। সাধারণ ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ থেকে এ ভাইরাস ছড়ায়। ফলে আইসোলেশন ও পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনে সহজেই এর বিস্তার ঠেকানো সম্ভব বলে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের ভাষ্য। এ ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো টিকা নেই। তবে গুটিবসন্তের ভাইরাসের সঙ্গে মাঙ্কিপক্সের জীবাণুর মিল রয়েছে। ফলে গুটিবসন্তের টিকা নেওয়া থাকলে তা মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধেও ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে।
“তবে এখন যেটা ঘটছে বলে মনে হচ্ছে, মানুষের দেহে এ ভাইরাস ছড়াচ্ছে যৌনতার মাধ্যমে। যৌনরোগের মতই যৌনাঙ্গের মাধ্যমে সংক্রমিত করছে। এটা এর বিস্তার বাড়িয়ে দিয়েছে,” বলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডেভিড হেম্যান। ইউরোপের জনস্বাস্থ্য বিভাগগুলো এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও সুইডেনে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ধরা পড়ার খবর দিয়েছে। এক বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মাঙ্কিপক্সের এবারের প্রাদুর্ভাব অস্বাভাবিক, কারণ যে এলাকায় সাধারণত এ রোগ হয়, তার বাইরে এবার সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। যেসব দেশে ইতোমধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, সেসব দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা জানিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, নজরদারি আরও বাড়ানো হচ্ছে, যাতে আরও কেউ সংক্রমিত হলে তাদের শনাক্ত করা যায়। এ ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে কী করা উচিত সে বিষয়ে সামনের দিনগুলোতে বিস্তরিত পরামর্শ ও নীতিমালা দেওয়া হবে।
নতুন এলাকায় হঠাৎ করে এ রোগ কেন ছড়াতে শুরু করল, সে প্রশ্নের উত্তর এখনও পাননি বিজ্ঞানীরা। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, ভাইরাসটির জিন কাঠামোতে হয়ত কোনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। তবে এটাকে নতুন ভ্যারিয়েন্ট বলার মত তথ্য প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ অঞ্চলের পরিচালক হ্যান্স ক্লুজ বলছেন, এখানে এখন গ্রীষ্ম শুরু হচ্ছে। উৎসব, অনুষ্ঠান, পার্টি, লোক সমাগম বাড়বে। তাতে সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে আমি আশঙ্কা করছি।”
তিনি জানান, যাদের মধ্যে গত কিছুদিনে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, তাদের মধ্যে একজন বাদে অন্য কেউ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার সেসব দেশে যাননি, যেখানে মাঙ্কিপক্স এনডেমিক বা সাধারণ রোগে পরিণত হয়েছে। মাঙ্কিপক্সের প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, হাড়ের জোড়া ও মাংসপেশিতে ব্যথা এবং অবসাদ। জ্বর শুরু হওয়ার পর দেহে গুটি দেখা দেয়। এসব গুটি শুরুতে দেখা দেয় মুখে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে হাত এবং পায়ের পাতাসহ দেহের অন্যান্য জায়গায়। এই গুটির জন্য রোগী দেহে খুব চুলকানি হয়। পরে গুটি থেকে ক্ষত দেখা দেয়। জল বসন্তের মতই রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও দেহে সেই ক্ষত চিহ্ন রয়ে যায়। রোগ দেখা দেওয়ার ১৪ থেকে ২১ দিনের মধ্যে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। যেহেতু এ রোগ সাধারণভাবে প্রাণঘাতী নয়, তাই এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মাংকিপক্স নিয়ে সতর্ক করলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা : করোনা মহামারির মধ্যেই ইউরোপে মাংকিপক্স ভাইরাসে শনাক্ত হচ্ছেন অনেকে। গত কয়েকদিনে যে হারে শনাক্ত হয়েছে, তা নিয়ে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, সামনে নতুন করে আরও সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হতে পারেন। ইউরোপে ইতোমধ্যে ৯০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনেও মাংকিপক্স রোগী শনাক্ত। এটি আগে পশ্চিম আফ্রিকার মধ্যেই ছিল। হঠাৎ আফ্রিকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ায় স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না চিকিৎসকরা। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগ বিশেষজ্ঞ শার্লট হ্যামার বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে সামনে আরও শনাক্ত দেখতে যাচ্ছি। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সক্রিয়ভাবে সংক্রিমতদের খুঁজছেন। মাংকিপক্সের ইনকিউবেশনের সময়কাল এক থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে হয়ে থাকে। যারা প্রাদুর্ভাবের প্রথমদিকে আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের মধ্যে সংক্রমণ দেখতে পাবো। তবে নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিথ নিল বলেন, ভাইরাসটিকে আপাতত প্রাণঘাতী মনে হচ্ছে না। গত কয়েক সপ্তাহে ব্রিটেন,ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন, সুইডেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এবং সবশেষ ইসরায়েলে মাংকিপক্সে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রোগটি বিভিন্ন দেশে হয়ত ছড়িয়ে পড়ছে।
উপসর্গ ও চিকিৎসা : স্মলপক্সের মতোই উপসর্গ দেখা যায় মাংকিপক্স আক্রান্তদের মধ্যে। যদিও এই রোগের ভয়াবহতা স্মলপক্সের তুলনায় কম। উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে, জ্বর, মাথাব্যথা, পেশির ব্যথা, পিঠে ব্যথা, ক্লান্তি, কাঁপুনি। মাংকিপক্সে আক্রান্তদের নির্দিষ্ট ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। পরিসংখ্যান অনুসারে, স্মলপক্সের টিকা ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে মাংকিপক্সের বিরুদ্ধে কাজ করে। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।
দেশের সব বন্দরে সতর্কতা : উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অন্তত এক ডজন দেশে ভাইরাসজনিত বিরল রোগ মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।
দেশের সবগুলো বিমানবন্দরে এ বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর জানিয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে তিনি বলেন, “নতুন কোনো রোগের তথ্য পাওয়া গেলে আমাদের বন্দরগুলোতে সতর্কতা জারি করা একটা রুটিন ওয়ার্ক। সে হিসেবে আমরা সবগুলো বন্দরকে সতর্কতা নেওয়ার জন্য বলেছি। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে।”
সাধারণত পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সর্বপ্রথম বানরের দেহে শনাক্ত হওয়া এ রোগটি ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায় এবং এর আগে আফ্রিকার বাইরে দেখা যায়নি। ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও সুইডেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রলিয়া এ পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সের রোগী পাওয়ার কথা জানিয়েছে।
বাংলাদেশ কী ধরনের সতর্কতা নিচ্ছে জানতে চাইলে ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, “এটা সংক্রামক রোগ। এ কারণে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। প্রাথমিকভাবে মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হয়েছে। কোনো রোগী পাওয়া গেলে সেখানে আইসোসেশনে রাখা হবে।”
মাঙ্কিপক্স ছড়িয়েছে ১২ দেশে, সব বন্দরে সতর্কতা
ট্যাগস :
মাঙ্কিপক্স ছড়িয়েছে ১২ দেশে
জনপ্রিয় সংবাদ