ঢাকা ০৮:২৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫

করোনার করুণ কাহিনি : নজরুল, রবি, হিলসা ও কাকলি

  • আপডেট সময় : ১০:৩০:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুন ২০২১
  • ১০৪ বার পড়া হয়েছে

মাকসুদুল হক : ‘অসত্যের কাছে নাহি নত হয় শির,
ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর’ — বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম
এই ভয়াল মহামারিতে আমাদের সময় নষ্ট করার মতো আছে প্রচুর সময়-তাছাড়া চরম বিষণ্নতা ও একঘেয়ামি কাটিয়ে ওঠার জন্য নেই সুস্থ বিনোদন বা বিকল্প চিন্তার দৃশ্যমান কোনও স্রোত। ছাপা পত্রিকাসহ স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর অবস্থা বেগতিক। এই মহামারিতে জনগণ অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছে ঠিকই কিন্তু গণমাধ্যমের সৃষ্টিশীলতার এই দেউলিয়াপনার কারণ কী, তা অজানা। দায়সারাভাবে চলছে সবকিছু ও চলতেই থাকবে।
এমন অবস্থায় ফেসবুকে চলছে ‘বিনোদন’ নামের বিভিন্ন ধরনের রসিকতা, চুটকি, মেম ও ট্রলিং যা আপাতদৃষ্টিতে সবই যুক্তিসম্মত, কারণ জনগণ মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য এছাড়া আর অন্য কোনও অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগের বাড়তি সুবিধা এটি সম্পূর্ণ মিথষ্ক্রিয় বা রহঃবৎধপঃরাব, কিন্তু এখানেও অবস্থা বিভীষিকাময়।
সৃষ্টিশীলতার দুর্ভিক্ষের কারণে এরই মধ্যে সমস্ত রকম সস্তা, স্থূল ও অরুচিকর বিষয়গুলো হয়ে উঠছে জনগণের পছন্দের প্রধান উপকরণ। অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উঁচু কপালপনা ও ‘পরিমার্জিত রুচি’কে উৎখাত করে সকল শ্রেণি, জাত, স্তর, মিলেমিশে, জগাখিচুড়ি পাকিয়ে, এক বিপদজনক ‘হাইব্রিড’ শ্রোতা সৃষ্টি করেছে, যা এর আগে আমাদের ইতিহাসে কখনই পরিলক্ষিত হয়নি। বস্তিওয়ালা, কুশীলওয়ালা, সুশীলওয়ালা ও বারিধারাওয়ালা সমান্তরালে ‘সাম্যের ডিজিটাল তরীতে’ ভাসছে… অ্যামেজিং!
এখন সকল চিন্তা, রুচি এমনকি ধর্মীয় রাজনীতি এই ‘শ্রেণিহীন হাইব্রিড’ ভার্চুয়াল জনগোষ্ঠীর কব্জায়। ফলস্বরুপ মেনে নিতে হচ্ছে ‘আইসি’, ‘গেসি’, ‘খাইসি’, ‘ঘুরসি’, ‘ঘুমাইতাসি’, ‘উঠতাসি’, ‘মাম-ম্মা’, ‘পিনিক’, ‘উরা-ধুরা’, ইত্যাদি ভাষার সম্ভার ও যত রকমের ‘চ’ সূচক, ‘ব’ সুচক, ‘খ’ সুচক গালি-খিস্তি-যা ছাড়া নাকি কোনও কিছুই ‘জমে’ উঠে না ।
‘এখান থেকে খানিক, ওখান থেকে খানিক, লিখে যাও মানিক’ চৌর্যবৃত্তিও চলছে অবিরাম।’
খুব মিস করছি, দন্ত চিবিয়ে চিবিয়ে গদগদ প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলা স্বঘোষিত ‘জাতির বিবেক’- ধারী প-িতগণকে। এই বিপদের সময় আমাদের অনাথের মতো ফেলে দিয়ে যে কোথায় ওনারা হাওয়া হয়ে গেলেন— তার কোনও হদিস পাওয়া যাচ্ছে না!
মোদ্দা কথা- আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি ‘ভাইরাল’-তন্ত্রের মহা ঢেউয়ে। স্রোতের একমুখী চাপ এতটাই তীব্র যে তার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া সামাজিকভাবে আমাদের করবে ‘মূর্খ’, ‘খ্যাত’ নতুবা ‘বেরসিক’। এটাই বাস্তবতা।
ফেসবুক ‘ভয়ানক’ভাবে শক্তিশালী হওয়ার অন্যতম কারণ, গণমাধ্যমগুলো সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে, হারিয়েছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা। তার সাথে আছে ব্যবসা ও প্রচারের খরচ। ১৬ কোটি মানুষের দেশে কিছু পত্রিকার হাস্যকর ‘লক্ষ্য কাটতি’র ট্যাগলাইন তাদের বেহাল দশার ইঙ্গিত করে, বাহাদুরির নয়। আমরা কেউই ভালো নেই।
এই ডিজিটাল যুগে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নেগেটিভ বা নেতিবাচক প্রচার- সাধারণ অর্থে, মিথ্যা, ফেইক নিউজ, অপপ্রচার বা প্রোপাগান্ডা। এখন যেকোনও ব্যক্তি, যেকোনও স্বার্থ, যেকোনও প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যেতে পারে নির্দ্বিধায় তার নিজের সময়ে, তার নিজের সুবিধা মতো, যেকোনও জায়গা, এমনকি নিজের শয়নকক্ষ বা শৌচাগার থেকে। জনগণ এখন আর চিরাচরিত প্রচার মাধ্যম, বিজ্ঞাপন সংস্থা বা স্পনসর কোম্পানি ইত্যাদির মুখাপেক্ষী নন। জনগণ নিজেই এখন ড্রাইভিং সিটে!
এটা কি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের অঘোষিত বিপ্লবের সূত্রপাত? বিজ্ঞাপন ও স্পনসর কোম্পানিগুলোর ধস নামার প্রক্রিয়া কি ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে? হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই।
যেকোনও ধরনের প্রচার ও প্রসার ব্যয়বহুল এবং ঃধৎমবঃ ধঁফরবহপব এর কাছে পৌঁছানোর জন্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানদের খরচ করতে হয় প্রচুর অর্থ। এছাড়া বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও এজেন্সির পেছনে খরচের কোনও সীমারেখা নেই।
কিন্তু, চলমান ‘ট্রেন্ড’ মাথায় রেখে চটুল বিষয়াদি ওপরে নির্ভর করে ‘নেতিবাচক প্রচারে ইতিবাচক সাফল্য’ বিক্রয় ও বিপণনের নতুন কৌশল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অপ্রত্যক্ষ বাজারজাতকরণ এখন স্বল্প পয়সায় বা বিনে পয়সায় করা একেবারেই সম্ভব।
এই মহামারির সময়ে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে পণ্য বাজারজাত করার প্রয়াস নতুনত্বের ছাপ রাখছে যা সত্যি প্রশংসনীয়। তবে করুণ বাস্তবতা থেকে জনগণ কিছু সময়ের জন্য পালাতে পারলেও, ল্যাপটপ বা ফোন স্ক্রিনের ওপরে যাপিত জীবনে বহু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটবে বা ঘটছে।
অতিসম্প্রীতি ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা নিয়ে আলাপ করা যাক-
প্রথমত-বিদ্রোহী কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে একটি বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানির (এর পর থেকে টেলকো) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ছবি অপব্যবহার প্রসঙ্গে পাঠকরা নিশ্চয়ই ওয়াকেবহাল। এটা কি ভুল নাকি ইচ্ছাকৃত ভুল-সে তর্কে আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই।
আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়-
এই ঘটনার পর, কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার বিশেষত তার নাতনি খিলখিল কাজী’র ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে মানহানির মামলা দায়ের করার পরিপ্রেক্ষিতে, এই বেনিয়া টেলিকম কোম্পানির প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
টেলকো-টি অতি সাধারণ একটা ‘দুঃখপ্রকাশ’ করে বহুল বিতর্কিত পোস্টটি ফেসবুক থেকে প্রত্যাহার করা ছাড়া তেমন কিছুই করলো না। ইতিমধ্যে যে অবর্ণনীয় ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেলো। এই অসাধু কীর্তির পর টেলকো নজরুলের পরিবারের সদস্যদের কাছে কোনোরকম যোগাযোগ করার বা ক্ষমা চাওয়ার সৌজন্যটুকু দেখানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
উল্টো, টেলকো’র এক কর্মকর্তার ‘যে কোনও ব্যক্তি আইনের আশ্রয় নিতেই পারে’ উপহাসকর বক্তব্য বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাটা অবমাননাকর কেবল নয়, তাদের দাম্ভিকতা ও অস্পর্শকাতরতার চরম প্রদর্শনী জনগণ দেখলো। ভাবখানা এমন যে ‘মামলা করলে করেন, আমরাও দেখে নেবো’। এই চুরির পরে সিনাজোরি, এই ‘দেখে নেওয়ার’ সাহস আসে কোথা থেকে?
খুবই দুঃখজনক নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ জাতীয় এই দুই কবিকে নিয়ে তামাশার জোরালো কোনও প্রতিবাদ নজরে পড়েনি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ৬ জুন ২০২১ পাঠানো শোকজ নোটিস যার উত্তর সরকার চেয়েছিলো ৭ কার্যদিবসের ভেতরে-তা আজ ১২ জুন ২০২১ এই লেখাটা যখন শেষ করছি, টেলকো তার উত্তর দেয়নি, সম্ভবত দেবে না। আরও দুঃখজনক, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় বা দেশের রাজনৈতিক নেতৃবর্গ এই বিষয়ে ছিলেন একেবারেই নীরব।
যে বেনিয়া, ভিনদেশি রক্তচোষা শত্রুদের বিরুদ্ধে নজরুল আজীবন লড়াই করে, এই উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, যে কবির গান, পাঠ্য ও কবিতা আমাদের মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস ছিল-সেই শোষণমূলক ধনতন্ত্রের কাছে এই জাতি আত্মসমর্পন করে নতজানু হলো কী করে?
খুব বেশি পেছনে যাবার প্রয়োজন নেই-
‘সাংস্কৃতিক মুক্তি ছাড়া অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক মুক্তি অসম্ভব’- এই কথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদা বললেও আজকের বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি জাতীয় সংস্কৃতিকে আপাদমস্তক অবমূল্যায়ন করছে ও তা যুগ যুগ ধরে করেই এসেছে।
এবার বাজেটের সংস্কৃতির খাতে .০৯৭ ভাগ বরাদ্দ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। রাষ্ট্র নিজেই যদি জাতীয় সংস্কৃতিকে এতটা স্থূল, এতটা মূল্যহীন, এতটা ভঙ্গুর ও অপ্রয়োজনীয় মনে করে, বিদেশিরা যে তার চেয়েও বেশি অবমূল্যায়ন করবে-এটাই তো ধরাবাঁধা কথা?
অথচ রাষ্ট্র খুব ভালো জানে এই বিদেশি কোম্পানিগুলো সরকারের ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকা কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের যোগসাযশে শিল্পীদেরকে কী পরিমাণ ঠকাচ্ছে। প্রতি বছর কত হাজার কোটি টাকা কেবল গানের শিল্পীদের কনটেন্ট অবৈধভাবে বেচাকেনা করে বিদেশে পাচার হচ্ছে, সেই বিষয়েও আজ অবধি রাষ্ট্রের কোনও শক্ত হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি। যেখানে জীবিত শিল্পীদের গান নিয়ে এই ‘হরিলুট’ চলছে, আমরা কোন যুক্তিতে বিশ্বাস করবো যে, বিদেশিরা মৃত ব্যক্তিদের গান, সম্মান বা জাতীয় সংস্কৃতিতে তাদের অভাবনীয় অবদানের বিষয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করবে?
আমরাই খাল কেটে কুমির এনেছি, আমরাই বিদেশিদের সুযোগ করে দিয়েছি, এখন তারা আর কোনও কিছুরই পরোয়া করে না। ‘কিসের নজরুল! আর কিসের রবীন্দ্রনাথ’ ? ওদের কাছে সবই ‘পণ্য’ ও সবই তারা ভক্ষণ করে হজম করার ক্ষমতা রাখে।
আজ নজরুল-রবীন্দ্রনাথ না হয়ে এই অপমান এই মানহানি ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত কোনও ব্যক্তি করতো, রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রের তৈলমর্দন করা ‘বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী’ বা ‘সংস্কৃতজন’এর বিরুদ্ধে-তবে একেবারে নির্ঘাত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে পাকড়াও করে তাদের জেলের ভাত খাইয়ে দেওয়া হতো-এতে কোনই সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয়ত-খুবই অপ্রত্যাশিত একটা টর্নেডো বয়ে গেলো ফেসবুকের আকাশে।
বাঙালিয়ানায় ভরপুর ‘দেশপ্রেমী’ হাইব্রিড জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ‘জাতীয় মাছ’ ইলিশের ‘অমার্জনা’কে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। হুমম…কার এত দুঃসাহস ইলিশকে ‘হিলসা’ বলার? শুরু হলো ‘কে কার চেয়ে কত বড় বাঙালি’ প্রমাণ করার উছিলায় ‘বাম্বুইং’য়ের প্রক্রিয়া। খোঁজ নিয়ে যা জানলাম এই ‘অমার্জনীয় পাপ’ করেছে মাওয়া ঘাটে অবস্থিত ‘প্রজেক্ট হিলসা’ নামের ঢাউস সাইজের এক নবনির্মিত রেস্টুরেন্ট। দাবি করা হচ্ছে এটাই বাংলাদেশে আয়তনের দিক দিয়ে সব চাইতে বৃহৎ রেস্টুরেন্ট। হতেও পারে।
সবই ঠিক আছে, তাহলে সমস্যা কোথায়?
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এটা একটি যরময বহফ ঢ়ৎড়ফঁপঃ এবং নিঃসন্দেহে এর নির্মাণের পেছনে প্রচুর অর্থ খরচ করা হলেও, তাদের কোনও বিজ্ঞাপন কোথাও লক্ষ্য করা যায়নি, এমনকি ফেসবুকেও না। স্পষ্টত ইলিশের পরিবর্তে ‘হিলসা’ শব্দটাকে অপব্যবহার করে, এই মূর্খ বিতর্ক সুকৌশলে ভাইরাল করে রেস্টুরেন্টটি যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তা অর্জন করতে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ হতো।
একটা ঢ়ৎড়ফঁপঃ নৎধহফরহম এর জন্য এরচেয়ে স্মার্ট ধাপ্পাবাজি আর কী হতে পারে?
আজ ‘প্রজেক্ট হিলসা’ ঘরে ঘরে যেভাবে পরিচিতি পেয়েছে, জনগণের অত্যন্ত দুর্বল ইমোশনের জায়গা তার মাতৃভাষার ওপরে ভর করে, এই প্রতারণামূলক প্রচারের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এই নেতিবাচক ভাইরাল ক্যাম্পেইনের কারণে রেস্টুরেন্টটির ংড়ভঃ ড়ঢ়বহরহম-এর দিন থেকে এই অব্দি চলছে জনগণের উপচেপড়া ভিড়। ড্রোন ক্যামেরা দ্বারা তোলা পার্কিং লট-এ রাখা গাড়ির বহরের ছবি এই প্রতিষ্ঠানের বাম্পার সাফল্যের প্রমাণ রাখে। হাইব্রিড জনগণ তাতেও ‘লাভ’, ‘ওয়াও’ রিঅ্যাক্ট পাঠাচ্ছে,আবারও বলছি, প্রচারের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা অপ্রয়োজনীয়। বাঙালির হুজুগে স্বভাবের ওপরে কড়া নাড়লেই এই ডিজিটাল যুগে, সকল অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।
তৃতীয়ত– এবার ষড়ি বহফ ঢ়ৎড়ফঁপঃ ক্যাম্পেইনিং-এ আসা যাক।
দামে বেশি অথচ মানে খুব খারাপ-এই বাস্তবিক ডিজিটাল ভাওতাবাজির যুগে ‘দামে কম মানে ভালো- কাকলি ফার্নিচার’ বিজ্ঞাপনটি অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব সুবাতাস বয়ে নিয়ে আসলো বাঙালি বলয়ের সমগ্র সামাজিক যোগাযোগের পৃথিবীতে।
এই ভাইরাল ভিডিওটা কত লক্ষ বা কোটিবার শেয়ার হয়েছে, বা এর সাফল্যের পিঠে সওয়ার হয়ে কত হাজার নতুন ভিডিও, গান, টিকটক, মেম বা ট্রল হয়েছে তার হিসাব দেওয়া অসম্ভব। তবে তা নিয়ে প্রচুর হাসি-তামাশা হলেও প্রকৃত অর্থে এখানে হাস্যরসের কোনও আলামত নেই। যা আছে, তা হলো বহু ব্যবহৃত প্রাচীন একটা ট্যাগলাইন, এবং একটি একান্ত পারিবারিক ভিডিও -ব্যস এটুকুই!
নেপথ্যের গল্পটা খুবই ইন্টারেস্টিং কারণ এতে দেখা যায় একজন নি¤œ-মধ্যবিত্ত ব্যক্তির তার প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামসহ হাড়ভাঙ্গা খাটুনির চিত্র। ২১ বছর পুরনো গাজীপুরে অবস্থিত এই ফার্নিচারের দোকান ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। প্রচারের জন্য যে বিজ্ঞাপন দরকার, তা তৈরি করার টাকা এই ব্যক্তির ছিল না।
৬ বছর আগে সম্পূর্ণ তার মেধা, মনন এবং রুচির উপরে নির্ভর করে নিজেই তৈরি করলেন এই ভিডিও যার জন্য তার সময় ও ধৈর্য ছাড়া এর বেশি অন্য কিছুই বিনিয়োগ করা সম্ভব ছিল না। এমনকি, মহল্লার ক্যাবল নেটওয়ার্কগুলোতে এই বিজ্ঞাপন চালানোর সামর্থ কাকলি ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারীর ছিল না। একরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় ভিডিওটি ফেলে রেখেছিলেন তার ইউটিউব চ্যানেলে- সেখানেও ৫ বছরের অধিক সময়ে ছিল না কোনোরকম সাড়া।
এরপর, বাকি সবকিছুই ঘটেছে কাকতালীয়ভাবে। এই ভিডিওটি বাংলাদেশে ভাইরাল হবার অনেক আগে ভারতে ট্রেন্ডিং করা শুরু করলো। বিপুল কৌতূহলের কারণে ভারতীয় গণমাধ্যম বিশেষ করে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাসহ দিল্লি, মুম্বাইয়ের পত্রিকাগুলো ফলাও করে করলো প্রচার। বাকিটা ইতিহাস।
শেষ খবর পাওয়া অব্দি কাকলি ফার্নিচারের এই ভিডিও বাংলা ভাষাভাষী জনগণ ছাড়া সমগ্র বিশ্বে ৩০ কোটির উপরে লোক দেখেছে-এবং এই ট্রেন্ড এখনও চলমান। এক পয়সা খরচ না করেও এই ভিডিওর সাফল্য প্রমাণ করে যে বিজ্ঞাপন ও বিপণনের জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। পয়সা দিয়ে সব কিছু কেনা গেলেও সৃষ্টিশীলতা কেনা যায় না। রুচি সম্পূর্ণ আপেক্ষিক বিষয়। ‘হাইব্রিড’ জনগণকে মুষ্টিমেয় কিছু শহুরে বিজ্ঞাপনপ-িত ও স্পনসর কোম্পানির রুচির মাপকাঠিতে বিচার করে ধান্দা-ফিকির করার শেষদিন ঘনিয়ে আসছে। এ মুহূর্তে এটাই নজরকাড়া বিষয়,বাকিটা সময় তার নিজের সময়ে উত্তর দেবে। এই মহামারির সময়ে কাকলি ফার্নিচারের মষড়নধষ ড়ঁঃৎবধপয সবাইকে মুগ্ধ করেছে। নেতিবাচক খবরের ভিড়ে এটাই সবচাইতে ইতিবাচক খবর।
প্রকারান্তরে, এই ভিডিওটাই স্বয়ং ‘দামে কম, মানে ভালো’-তা না হলে এই সাফল্যের গল্পগাথা সম্পর্কে আমরা কি আদৌ কিছু জানতাম?
‘আর!! আর!! আর!! আর!! ?’
লেখক : সংগীতশিল্পী

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

করোনার করুণ কাহিনি : নজরুল, রবি, হিলসা ও কাকলি

আপডেট সময় : ১০:৩০:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুন ২০২১

মাকসুদুল হক : ‘অসত্যের কাছে নাহি নত হয় শির,
ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর’ — বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম
এই ভয়াল মহামারিতে আমাদের সময় নষ্ট করার মতো আছে প্রচুর সময়-তাছাড়া চরম বিষণ্নতা ও একঘেয়ামি কাটিয়ে ওঠার জন্য নেই সুস্থ বিনোদন বা বিকল্প চিন্তার দৃশ্যমান কোনও স্রোত। ছাপা পত্রিকাসহ স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর অবস্থা বেগতিক। এই মহামারিতে জনগণ অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছে ঠিকই কিন্তু গণমাধ্যমের সৃষ্টিশীলতার এই দেউলিয়াপনার কারণ কী, তা অজানা। দায়সারাভাবে চলছে সবকিছু ও চলতেই থাকবে।
এমন অবস্থায় ফেসবুকে চলছে ‘বিনোদন’ নামের বিভিন্ন ধরনের রসিকতা, চুটকি, মেম ও ট্রলিং যা আপাতদৃষ্টিতে সবই যুক্তিসম্মত, কারণ জনগণ মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য এছাড়া আর অন্য কোনও অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগের বাড়তি সুবিধা এটি সম্পূর্ণ মিথষ্ক্রিয় বা রহঃবৎধপঃরাব, কিন্তু এখানেও অবস্থা বিভীষিকাময়।
সৃষ্টিশীলতার দুর্ভিক্ষের কারণে এরই মধ্যে সমস্ত রকম সস্তা, স্থূল ও অরুচিকর বিষয়গুলো হয়ে উঠছে জনগণের পছন্দের প্রধান উপকরণ। অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উঁচু কপালপনা ও ‘পরিমার্জিত রুচি’কে উৎখাত করে সকল শ্রেণি, জাত, স্তর, মিলেমিশে, জগাখিচুড়ি পাকিয়ে, এক বিপদজনক ‘হাইব্রিড’ শ্রোতা সৃষ্টি করেছে, যা এর আগে আমাদের ইতিহাসে কখনই পরিলক্ষিত হয়নি। বস্তিওয়ালা, কুশীলওয়ালা, সুশীলওয়ালা ও বারিধারাওয়ালা সমান্তরালে ‘সাম্যের ডিজিটাল তরীতে’ ভাসছে… অ্যামেজিং!
এখন সকল চিন্তা, রুচি এমনকি ধর্মীয় রাজনীতি এই ‘শ্রেণিহীন হাইব্রিড’ ভার্চুয়াল জনগোষ্ঠীর কব্জায়। ফলস্বরুপ মেনে নিতে হচ্ছে ‘আইসি’, ‘গেসি’, ‘খাইসি’, ‘ঘুরসি’, ‘ঘুমাইতাসি’, ‘উঠতাসি’, ‘মাম-ম্মা’, ‘পিনিক’, ‘উরা-ধুরা’, ইত্যাদি ভাষার সম্ভার ও যত রকমের ‘চ’ সূচক, ‘ব’ সুচক, ‘খ’ সুচক গালি-খিস্তি-যা ছাড়া নাকি কোনও কিছুই ‘জমে’ উঠে না ।
‘এখান থেকে খানিক, ওখান থেকে খানিক, লিখে যাও মানিক’ চৌর্যবৃত্তিও চলছে অবিরাম।’
খুব মিস করছি, দন্ত চিবিয়ে চিবিয়ে গদগদ প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলা স্বঘোষিত ‘জাতির বিবেক’- ধারী প-িতগণকে। এই বিপদের সময় আমাদের অনাথের মতো ফেলে দিয়ে যে কোথায় ওনারা হাওয়া হয়ে গেলেন— তার কোনও হদিস পাওয়া যাচ্ছে না!
মোদ্দা কথা- আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি ‘ভাইরাল’-তন্ত্রের মহা ঢেউয়ে। স্রোতের একমুখী চাপ এতটাই তীব্র যে তার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া সামাজিকভাবে আমাদের করবে ‘মূর্খ’, ‘খ্যাত’ নতুবা ‘বেরসিক’। এটাই বাস্তবতা।
ফেসবুক ‘ভয়ানক’ভাবে শক্তিশালী হওয়ার অন্যতম কারণ, গণমাধ্যমগুলো সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে, হারিয়েছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা। তার সাথে আছে ব্যবসা ও প্রচারের খরচ। ১৬ কোটি মানুষের দেশে কিছু পত্রিকার হাস্যকর ‘লক্ষ্য কাটতি’র ট্যাগলাইন তাদের বেহাল দশার ইঙ্গিত করে, বাহাদুরির নয়। আমরা কেউই ভালো নেই।
এই ডিজিটাল যুগে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নেগেটিভ বা নেতিবাচক প্রচার- সাধারণ অর্থে, মিথ্যা, ফেইক নিউজ, অপপ্রচার বা প্রোপাগান্ডা। এখন যেকোনও ব্যক্তি, যেকোনও স্বার্থ, যেকোনও প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যেতে পারে নির্দ্বিধায় তার নিজের সময়ে, তার নিজের সুবিধা মতো, যেকোনও জায়গা, এমনকি নিজের শয়নকক্ষ বা শৌচাগার থেকে। জনগণ এখন আর চিরাচরিত প্রচার মাধ্যম, বিজ্ঞাপন সংস্থা বা স্পনসর কোম্পানি ইত্যাদির মুখাপেক্ষী নন। জনগণ নিজেই এখন ড্রাইভিং সিটে!
এটা কি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের অঘোষিত বিপ্লবের সূত্রপাত? বিজ্ঞাপন ও স্পনসর কোম্পানিগুলোর ধস নামার প্রক্রিয়া কি ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে? হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই।
যেকোনও ধরনের প্রচার ও প্রসার ব্যয়বহুল এবং ঃধৎমবঃ ধঁফরবহপব এর কাছে পৌঁছানোর জন্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানদের খরচ করতে হয় প্রচুর অর্থ। এছাড়া বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও এজেন্সির পেছনে খরচের কোনও সীমারেখা নেই।
কিন্তু, চলমান ‘ট্রেন্ড’ মাথায় রেখে চটুল বিষয়াদি ওপরে নির্ভর করে ‘নেতিবাচক প্রচারে ইতিবাচক সাফল্য’ বিক্রয় ও বিপণনের নতুন কৌশল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অপ্রত্যক্ষ বাজারজাতকরণ এখন স্বল্প পয়সায় বা বিনে পয়সায় করা একেবারেই সম্ভব।
এই মহামারির সময়ে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে পণ্য বাজারজাত করার প্রয়াস নতুনত্বের ছাপ রাখছে যা সত্যি প্রশংসনীয়। তবে করুণ বাস্তবতা থেকে জনগণ কিছু সময়ের জন্য পালাতে পারলেও, ল্যাপটপ বা ফোন স্ক্রিনের ওপরে যাপিত জীবনে বহু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটবে বা ঘটছে।
অতিসম্প্রীতি ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা নিয়ে আলাপ করা যাক-
প্রথমত-বিদ্রোহী কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে একটি বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানির (এর পর থেকে টেলকো) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ছবি অপব্যবহার প্রসঙ্গে পাঠকরা নিশ্চয়ই ওয়াকেবহাল। এটা কি ভুল নাকি ইচ্ছাকৃত ভুল-সে তর্কে আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই।
আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়-
এই ঘটনার পর, কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার বিশেষত তার নাতনি খিলখিল কাজী’র ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে মানহানির মামলা দায়ের করার পরিপ্রেক্ষিতে, এই বেনিয়া টেলিকম কোম্পানির প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
টেলকো-টি অতি সাধারণ একটা ‘দুঃখপ্রকাশ’ করে বহুল বিতর্কিত পোস্টটি ফেসবুক থেকে প্রত্যাহার করা ছাড়া তেমন কিছুই করলো না। ইতিমধ্যে যে অবর্ণনীয় ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেলো। এই অসাধু কীর্তির পর টেলকো নজরুলের পরিবারের সদস্যদের কাছে কোনোরকম যোগাযোগ করার বা ক্ষমা চাওয়ার সৌজন্যটুকু দেখানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
উল্টো, টেলকো’র এক কর্মকর্তার ‘যে কোনও ব্যক্তি আইনের আশ্রয় নিতেই পারে’ উপহাসকর বক্তব্য বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাটা অবমাননাকর কেবল নয়, তাদের দাম্ভিকতা ও অস্পর্শকাতরতার চরম প্রদর্শনী জনগণ দেখলো। ভাবখানা এমন যে ‘মামলা করলে করেন, আমরাও দেখে নেবো’। এই চুরির পরে সিনাজোরি, এই ‘দেখে নেওয়ার’ সাহস আসে কোথা থেকে?
খুবই দুঃখজনক নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ জাতীয় এই দুই কবিকে নিয়ে তামাশার জোরালো কোনও প্রতিবাদ নজরে পড়েনি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ৬ জুন ২০২১ পাঠানো শোকজ নোটিস যার উত্তর সরকার চেয়েছিলো ৭ কার্যদিবসের ভেতরে-তা আজ ১২ জুন ২০২১ এই লেখাটা যখন শেষ করছি, টেলকো তার উত্তর দেয়নি, সম্ভবত দেবে না। আরও দুঃখজনক, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় বা দেশের রাজনৈতিক নেতৃবর্গ এই বিষয়ে ছিলেন একেবারেই নীরব।
যে বেনিয়া, ভিনদেশি রক্তচোষা শত্রুদের বিরুদ্ধে নজরুল আজীবন লড়াই করে, এই উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, যে কবির গান, পাঠ্য ও কবিতা আমাদের মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস ছিল-সেই শোষণমূলক ধনতন্ত্রের কাছে এই জাতি আত্মসমর্পন করে নতজানু হলো কী করে?
খুব বেশি পেছনে যাবার প্রয়োজন নেই-
‘সাংস্কৃতিক মুক্তি ছাড়া অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক মুক্তি অসম্ভব’- এই কথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদা বললেও আজকের বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি জাতীয় সংস্কৃতিকে আপাদমস্তক অবমূল্যায়ন করছে ও তা যুগ যুগ ধরে করেই এসেছে।
এবার বাজেটের সংস্কৃতির খাতে .০৯৭ ভাগ বরাদ্দ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। রাষ্ট্র নিজেই যদি জাতীয় সংস্কৃতিকে এতটা স্থূল, এতটা মূল্যহীন, এতটা ভঙ্গুর ও অপ্রয়োজনীয় মনে করে, বিদেশিরা যে তার চেয়েও বেশি অবমূল্যায়ন করবে-এটাই তো ধরাবাঁধা কথা?
অথচ রাষ্ট্র খুব ভালো জানে এই বিদেশি কোম্পানিগুলো সরকারের ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকা কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের যোগসাযশে শিল্পীদেরকে কী পরিমাণ ঠকাচ্ছে। প্রতি বছর কত হাজার কোটি টাকা কেবল গানের শিল্পীদের কনটেন্ট অবৈধভাবে বেচাকেনা করে বিদেশে পাচার হচ্ছে, সেই বিষয়েও আজ অবধি রাষ্ট্রের কোনও শক্ত হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি। যেখানে জীবিত শিল্পীদের গান নিয়ে এই ‘হরিলুট’ চলছে, আমরা কোন যুক্তিতে বিশ্বাস করবো যে, বিদেশিরা মৃত ব্যক্তিদের গান, সম্মান বা জাতীয় সংস্কৃতিতে তাদের অভাবনীয় অবদানের বিষয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করবে?
আমরাই খাল কেটে কুমির এনেছি, আমরাই বিদেশিদের সুযোগ করে দিয়েছি, এখন তারা আর কোনও কিছুরই পরোয়া করে না। ‘কিসের নজরুল! আর কিসের রবীন্দ্রনাথ’ ? ওদের কাছে সবই ‘পণ্য’ ও সবই তারা ভক্ষণ করে হজম করার ক্ষমতা রাখে।
আজ নজরুল-রবীন্দ্রনাথ না হয়ে এই অপমান এই মানহানি ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত কোনও ব্যক্তি করতো, রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রের তৈলমর্দন করা ‘বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী’ বা ‘সংস্কৃতজন’এর বিরুদ্ধে-তবে একেবারে নির্ঘাত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে পাকড়াও করে তাদের জেলের ভাত খাইয়ে দেওয়া হতো-এতে কোনই সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয়ত-খুবই অপ্রত্যাশিত একটা টর্নেডো বয়ে গেলো ফেসবুকের আকাশে।
বাঙালিয়ানায় ভরপুর ‘দেশপ্রেমী’ হাইব্রিড জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ‘জাতীয় মাছ’ ইলিশের ‘অমার্জনা’কে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। হুমম…কার এত দুঃসাহস ইলিশকে ‘হিলসা’ বলার? শুরু হলো ‘কে কার চেয়ে কত বড় বাঙালি’ প্রমাণ করার উছিলায় ‘বাম্বুইং’য়ের প্রক্রিয়া। খোঁজ নিয়ে যা জানলাম এই ‘অমার্জনীয় পাপ’ করেছে মাওয়া ঘাটে অবস্থিত ‘প্রজেক্ট হিলসা’ নামের ঢাউস সাইজের এক নবনির্মিত রেস্টুরেন্ট। দাবি করা হচ্ছে এটাই বাংলাদেশে আয়তনের দিক দিয়ে সব চাইতে বৃহৎ রেস্টুরেন্ট। হতেও পারে।
সবই ঠিক আছে, তাহলে সমস্যা কোথায়?
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এটা একটি যরময বহফ ঢ়ৎড়ফঁপঃ এবং নিঃসন্দেহে এর নির্মাণের পেছনে প্রচুর অর্থ খরচ করা হলেও, তাদের কোনও বিজ্ঞাপন কোথাও লক্ষ্য করা যায়নি, এমনকি ফেসবুকেও না। স্পষ্টত ইলিশের পরিবর্তে ‘হিলসা’ শব্দটাকে অপব্যবহার করে, এই মূর্খ বিতর্ক সুকৌশলে ভাইরাল করে রেস্টুরেন্টটি যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তা অর্জন করতে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ হতো।
একটা ঢ়ৎড়ফঁপঃ নৎধহফরহম এর জন্য এরচেয়ে স্মার্ট ধাপ্পাবাজি আর কী হতে পারে?
আজ ‘প্রজেক্ট হিলসা’ ঘরে ঘরে যেভাবে পরিচিতি পেয়েছে, জনগণের অত্যন্ত দুর্বল ইমোশনের জায়গা তার মাতৃভাষার ওপরে ভর করে, এই প্রতারণামূলক প্রচারের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এই নেতিবাচক ভাইরাল ক্যাম্পেইনের কারণে রেস্টুরেন্টটির ংড়ভঃ ড়ঢ়বহরহম-এর দিন থেকে এই অব্দি চলছে জনগণের উপচেপড়া ভিড়। ড্রোন ক্যামেরা দ্বারা তোলা পার্কিং লট-এ রাখা গাড়ির বহরের ছবি এই প্রতিষ্ঠানের বাম্পার সাফল্যের প্রমাণ রাখে। হাইব্রিড জনগণ তাতেও ‘লাভ’, ‘ওয়াও’ রিঅ্যাক্ট পাঠাচ্ছে,আবারও বলছি, প্রচারের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা অপ্রয়োজনীয়। বাঙালির হুজুগে স্বভাবের ওপরে কড়া নাড়লেই এই ডিজিটাল যুগে, সকল অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।
তৃতীয়ত– এবার ষড়ি বহফ ঢ়ৎড়ফঁপঃ ক্যাম্পেইনিং-এ আসা যাক।
দামে বেশি অথচ মানে খুব খারাপ-এই বাস্তবিক ডিজিটাল ভাওতাবাজির যুগে ‘দামে কম মানে ভালো- কাকলি ফার্নিচার’ বিজ্ঞাপনটি অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব সুবাতাস বয়ে নিয়ে আসলো বাঙালি বলয়ের সমগ্র সামাজিক যোগাযোগের পৃথিবীতে।
এই ভাইরাল ভিডিওটা কত লক্ষ বা কোটিবার শেয়ার হয়েছে, বা এর সাফল্যের পিঠে সওয়ার হয়ে কত হাজার নতুন ভিডিও, গান, টিকটক, মেম বা ট্রল হয়েছে তার হিসাব দেওয়া অসম্ভব। তবে তা নিয়ে প্রচুর হাসি-তামাশা হলেও প্রকৃত অর্থে এখানে হাস্যরসের কোনও আলামত নেই। যা আছে, তা হলো বহু ব্যবহৃত প্রাচীন একটা ট্যাগলাইন, এবং একটি একান্ত পারিবারিক ভিডিও -ব্যস এটুকুই!
নেপথ্যের গল্পটা খুবই ইন্টারেস্টিং কারণ এতে দেখা যায় একজন নি¤œ-মধ্যবিত্ত ব্যক্তির তার প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামসহ হাড়ভাঙ্গা খাটুনির চিত্র। ২১ বছর পুরনো গাজীপুরে অবস্থিত এই ফার্নিচারের দোকান ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। প্রচারের জন্য যে বিজ্ঞাপন দরকার, তা তৈরি করার টাকা এই ব্যক্তির ছিল না।
৬ বছর আগে সম্পূর্ণ তার মেধা, মনন এবং রুচির উপরে নির্ভর করে নিজেই তৈরি করলেন এই ভিডিও যার জন্য তার সময় ও ধৈর্য ছাড়া এর বেশি অন্য কিছুই বিনিয়োগ করা সম্ভব ছিল না। এমনকি, মহল্লার ক্যাবল নেটওয়ার্কগুলোতে এই বিজ্ঞাপন চালানোর সামর্থ কাকলি ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারীর ছিল না। একরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় ভিডিওটি ফেলে রেখেছিলেন তার ইউটিউব চ্যানেলে- সেখানেও ৫ বছরের অধিক সময়ে ছিল না কোনোরকম সাড়া।
এরপর, বাকি সবকিছুই ঘটেছে কাকতালীয়ভাবে। এই ভিডিওটি বাংলাদেশে ভাইরাল হবার অনেক আগে ভারতে ট্রেন্ডিং করা শুরু করলো। বিপুল কৌতূহলের কারণে ভারতীয় গণমাধ্যম বিশেষ করে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাসহ দিল্লি, মুম্বাইয়ের পত্রিকাগুলো ফলাও করে করলো প্রচার। বাকিটা ইতিহাস।
শেষ খবর পাওয়া অব্দি কাকলি ফার্নিচারের এই ভিডিও বাংলা ভাষাভাষী জনগণ ছাড়া সমগ্র বিশ্বে ৩০ কোটির উপরে লোক দেখেছে-এবং এই ট্রেন্ড এখনও চলমান। এক পয়সা খরচ না করেও এই ভিডিওর সাফল্য প্রমাণ করে যে বিজ্ঞাপন ও বিপণনের জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। পয়সা দিয়ে সব কিছু কেনা গেলেও সৃষ্টিশীলতা কেনা যায় না। রুচি সম্পূর্ণ আপেক্ষিক বিষয়। ‘হাইব্রিড’ জনগণকে মুষ্টিমেয় কিছু শহুরে বিজ্ঞাপনপ-িত ও স্পনসর কোম্পানির রুচির মাপকাঠিতে বিচার করে ধান্দা-ফিকির করার শেষদিন ঘনিয়ে আসছে। এ মুহূর্তে এটাই নজরকাড়া বিষয়,বাকিটা সময় তার নিজের সময়ে উত্তর দেবে। এই মহামারির সময়ে কাকলি ফার্নিচারের মষড়নধষ ড়ঁঃৎবধপয সবাইকে মুগ্ধ করেছে। নেতিবাচক খবরের ভিড়ে এটাই সবচাইতে ইতিবাচক খবর।
প্রকারান্তরে, এই ভিডিওটাই স্বয়ং ‘দামে কম, মানে ভালো’-তা না হলে এই সাফল্যের গল্পগাথা সম্পর্কে আমরা কি আদৌ কিছু জানতাম?
‘আর!! আর!! আর!! আর!! ?’
লেখক : সংগীতশিল্পী