ঢাকা ০৭:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫

ল্যাংড়া মামুনের অপহরণ মিশন

  • আপডেট সময় : ০১:২৬:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ এপ্রিল ২০২২
  • ৯৪ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : পঙ্গুত্বের সুযোগ নিয়ে একের পর এক অপর্কম চালিয়ে যাচ্ছিল ল্যাংড়া মামুন। গত ১১ এপ্রিল রাতে ফিল্মি স্টাইলে পটুয়াখালীর ব্যবসায়ী শিবু লাল দাসকে অপহরণ করে মামুন বাহীনি।এই অপহরণের আগে বেশ কয়েকদিন রেকি করেন এই টিমের সদস্যরা ।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুর, ভাটারা ও গুলিস্তান এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার সহযোগীসহ অপহরণের মূলহোতা ল্যাংড়া মামুনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গ্রেপ্তাররা হলেন-মূলহোতা ল্যাংড়া মামুন মুফতি মামুন, সহযোগী পিচ্চি রানা, বিআরটিসির চালক জসীমউদ্দীন ও আশিকুর রহমান। এসময় তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ে ব্যবহৃত প্রাইভেটকার, মোবাইল ফোন, গামছা ও চার হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১২ টায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কে.এম হাফিজ আক্তার এ তথ্য জানান। ডিবি প্রধান বলেন, পটুয়াখালী শহরে মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক মামুন। তার অর্থের প্রধান উৎস মাদক ব্যবসা নানা অপরাধ। এলাকা বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাদের টাকায় নিজে বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এই লেংড়া মামুন।
অপহরণের আগে পরিকল্পনা: চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অপহরনের পরিকল্পনা করে তারা। সে অনুযায়ী পটুয়াখালী লঞ্চঘাটের কাছে ল্যাংড়া মামুনের গার্মেন্টসের অফিসে বসে এই পরিকল্পনা করা হয়। এতে অংশ নেয় ল্যাংড়া মামুন, পিচ্চি রানা, পাভেল ও বিআরটিসির চালক জসিম। এ নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে একাধিক বার মিটিং করে। মিটিংয়ে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে যোগ দেয় জসিম উদ্দিন মৃধা ও তার ভাই গাড়ির দালাল আশিক মৃধা।
অপহরনের জন্য আগাম দশ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে এক সপ্তাহের জন্য গাড়ি ভাড়া করা হয়। অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ কাজে ব্যবহারের জন্য ঢাকার সাভার থেকে পাঁচটি বাটন মোবাইল ফোন কেনা হয় । বেশি দাম দিয়ে অন্য জনের নামে নিবন্ধন করা সিমও কেনা হয়। এরপর একটি খেলনা পিস্তল, দুইটি সুইচ গিয়ার, তিনটি চাপাতি ও গরু জবাই করার একটি বড় ছুরি সংগ্রহ করে।পরে বেশ কয়েকদিন রেকি করে ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে আট টায় ফিল্মি স্টাইলে চালানো হয় রোমহর্ষক অপারেশন।
অপহরণ অপারেশন: ১১ এপ্রিল দুপুরে পটুয়াখালী এয়ারপোর্টের কাছে মিলিত হয়ে কার কোথায় কি দায়িত্ব তা নির্ধারণ করে দেয় ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা। ভুক্তভোগীর গতিবিধি জানানোর জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে গলাচিপা ঘাটে যায় পিচ্চি রানা ও ল্যাংড়া মামুন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ব্যারিকেড দেয়ার জন্য পটুয়াখালী-গলাচিপা হাইওয়ে রোডের শাঁখারিয়ার নির্জন জায়গায় একটা প্রাইভেট কার ও একটা ট্রলি নিয়ে অবস্থান নেয় তাদের পাঁচ সহযোগী।
ল্যাংড়া মামুনের নির্দেশে আগে থেকেই একটি ট্রাক্টর ভাড়া করে চালক বিল্লাল। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া প্রাইভেটকারটি নিয়ে চালক আশিক মৃধা, পাভেল, হাবিব, সোহাগ এই চারজন অবস্থান নেয়। ল্যাংড়া মামুনের সংকেত পাওয়ার পরপরই সন্ধ্যা সাড়ে আটটার দিকে ড্রাইভার বিল্লাল ট্রলিটি নিয়ে সুকৌশলে ভুক্তভোগী শিবু দাসের জিপের সামনে আড়াআড়ি করে অবস্থান নেয়। পিছন থেকে অনুসরণ করতে থাকা চালক আশিক তার প্রাইভেট গাড়িটি দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির পিছনে অবস্থান নিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলেন।
পরে আশিক প্রাইভেটকার ছেড়ে ভুক্তভোগী শিবু দাসের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। গাড়িতে উঠেই বিল্লাল, পাভেল, সোহাগ, আশিক বেঁধে ফেলা হয় শিবু দাস ও তার গাড়ি চালককে। পরে তাদের গামছা, টিস্যু পেপার ও স্কচ টেপ দিয়ে মুখ, হাত-পা বেঁধে চালাতে থাকে শারীরিক নির্যাতন। এছাড়া খেলনা পিস্তল ও ছোরা- চাকু দিয়ে ভয় দেখানো হয়।
বরগুনার আমতলী এলাকার গাজিপুরায় গিয়ে ভুক্তভোগীর জিপ গাড়ি থেকে তাদেরকে তোলা হয় ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া কারটিতে। সেখানে ভিকটিমসহ দুইজনকে আরো ভালোভাবে বেঁধে প্লাস্টিকের বস্তায় ঢুকানো হয়। আর ভুক্তভোগীর জীপটিকে আমতলীর একটি ফিলিং স্টেশনে ফেলে আসে। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা পটুয়াখালীর বাঁধ ঘাট এলাকায় ভিকটিমদের বহনকারী গাড়ি বুঝে নেয়। গাড়ি চালাতে থাকে ল্যাংড়া মামুন নিজেই। ল্যাংড়া মামুন সোজা নিয়ে যায় তার এইচডি রোডের নিজস্ব মেশিন ঘর কাম টর্চার সেলে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় এসপি কমপ্লেক্স সুপার মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডের অস্থায়ী সেলে। রাতভর চলে নির্যাতন। পরের দিন রানার নির্দেশে বিল্লাল ভুক্তভোগীর সিম থেকে ভিকটিমের স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিতে বলে। মুক্তিপণের টাকা না দিলে এবং বিষয়টি পুলিশকে জানালে শিবু লালকে হত্যা করে সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হবে বলেও সতর্ক করে দেয় অপহরণকারীরা।
ভিকটিম উদ্ধার: শিবু লাল দাস পটুয়াখালী জেলা শহরের পরিচিত ঠিকাদার, ইজারাদার, আড়তদার এবং বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত। অপর ভিকটিম মিরাজ মিয়া পাজেরো জিপের ড্রাইভার। গত ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে আটটার দিকে শিবু লাল দাস গলাচিপা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিজস্ব পাজেরো জীপ করে পটুয়াখালী শহরের বাসায় ফেরার পথে ড্রাইভারসহ নিখোঁজ হন। পরে দূরের একটি পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি পরিত্যক্ত অবস্থায় তার পাজেরো জীপটিকে উদ্ধার করে জেলা পুলিশ। অপহরণের পরের দিন ১২ এপ্রিল রাতে হাত-পা ও মুখ বাঁধা বস্তাবন্দি মুমূর্ষ অবস্থায় ভুক্তভোগীর এসপি কমপ্লেক্স শপিং সেন্টারের আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে উদ্ধার করে পটুয়াখালী জেলা পুলিশ।
অপহরণকারী সদস্যদের স্বপ্ন: গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে ল্যাংড়া মামুন পঙ্গু। এর আগে অপরাধ করতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার ডান পা উরু পর্যন্ত কাঁটা পড়ে। মামুন অল্প বয়সে জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতে। আপন ভগ্নিপতির টাকা মেরে দিয়ে পটুয়াখালী জেলা শহরে মালিক হয়েছে একাধিক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশার মানুষদের টর্চার সেলে আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তুলে হাতিয়ে নেওয়া হত টাকা। তিনি বলেন, মাওলানা হিসেবে তার বাবার সুখ্যাতি এবং পঙ্গুত্বের কারণে এই ক্যাডারের ভয়ে মুখ খুলে নাই অনেকেই। এবার ও ভেবেছিল শিবু লালকে অপহরণ করে মুক্তিপণ হিসেবে যে কোটি টাকা অর্জিত হবে তা দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে বড় গার্মেন্টসের ব্যবসা শুরু করবে মামুন। লেংড়া মামুনের সহযোগী পিচ্চি রানা বিভিন্ন টোলপ্লাজায় টোল কালেকশনের কাজ করেছে। কখনো কাজ করেছে ট্রাকের মিডিয়াম্যান হিসেবে। এছাড়া রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকায় সে ভেবেছিলে অপহরণ করে বড় অঙ্কের টাকা মারতে পারলে তা দিয়ে একাধিক ট্রাক কিনে ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে পরিবহনের ব্যবসা শুরু করবে। আর বিআরটিসির চালক জসিম উদ্দিন মৃধার পরিকল্পনা অপরের গাড়ি না চালিয়ে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে নিজস্ব বাস কিনে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে পটুয়াখালী রুটে চালাবে সে। আরেক সহযোগী আসামি আশিক দীর্ঘদিন ধরে রেন্ট-এ-কারের দালালি করে। তার পরিকল্পনা ছিলো মুক্তিপণের টাকা দিয়ে একাধিক গাড়ি কিনে বড় পরিসরে রেন্ট-এ-কারের বিজনেস শুরু করবে। আসামিদের বিরুদ্ধে মারামারি, মাদক এবং অপহরণের একাধিক মামলা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ, ডিবি গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান, অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহবুবুল হক সজীব ও অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) হাফিজ আল আসাদ ও সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) আবু তালিব।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ভারতের কোচ গম্ভীরের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ সাবেক ওপেনারের

ল্যাংড়া মামুনের অপহরণ মিশন

আপডেট সময় : ০১:২৬:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ এপ্রিল ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক : পঙ্গুত্বের সুযোগ নিয়ে একের পর এক অপর্কম চালিয়ে যাচ্ছিল ল্যাংড়া মামুন। গত ১১ এপ্রিল রাতে ফিল্মি স্টাইলে পটুয়াখালীর ব্যবসায়ী শিবু লাল দাসকে অপহরণ করে মামুন বাহীনি।এই অপহরণের আগে বেশ কয়েকদিন রেকি করেন এই টিমের সদস্যরা ।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুর, ভাটারা ও গুলিস্তান এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার সহযোগীসহ অপহরণের মূলহোতা ল্যাংড়া মামুনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গ্রেপ্তাররা হলেন-মূলহোতা ল্যাংড়া মামুন মুফতি মামুন, সহযোগী পিচ্চি রানা, বিআরটিসির চালক জসীমউদ্দীন ও আশিকুর রহমান। এসময় তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ে ব্যবহৃত প্রাইভেটকার, মোবাইল ফোন, গামছা ও চার হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১২ টায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কে.এম হাফিজ আক্তার এ তথ্য জানান। ডিবি প্রধান বলেন, পটুয়াখালী শহরে মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক মামুন। তার অর্থের প্রধান উৎস মাদক ব্যবসা নানা অপরাধ। এলাকা বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাদের টাকায় নিজে বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এই লেংড়া মামুন।
অপহরণের আগে পরিকল্পনা: চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অপহরনের পরিকল্পনা করে তারা। সে অনুযায়ী পটুয়াখালী লঞ্চঘাটের কাছে ল্যাংড়া মামুনের গার্মেন্টসের অফিসে বসে এই পরিকল্পনা করা হয়। এতে অংশ নেয় ল্যাংড়া মামুন, পিচ্চি রানা, পাভেল ও বিআরটিসির চালক জসিম। এ নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে একাধিক বার মিটিং করে। মিটিংয়ে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে যোগ দেয় জসিম উদ্দিন মৃধা ও তার ভাই গাড়ির দালাল আশিক মৃধা।
অপহরনের জন্য আগাম দশ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে এক সপ্তাহের জন্য গাড়ি ভাড়া করা হয়। অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ কাজে ব্যবহারের জন্য ঢাকার সাভার থেকে পাঁচটি বাটন মোবাইল ফোন কেনা হয় । বেশি দাম দিয়ে অন্য জনের নামে নিবন্ধন করা সিমও কেনা হয়। এরপর একটি খেলনা পিস্তল, দুইটি সুইচ গিয়ার, তিনটি চাপাতি ও গরু জবাই করার একটি বড় ছুরি সংগ্রহ করে।পরে বেশ কয়েকদিন রেকি করে ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে আট টায় ফিল্মি স্টাইলে চালানো হয় রোমহর্ষক অপারেশন।
অপহরণ অপারেশন: ১১ এপ্রিল দুপুরে পটুয়াখালী এয়ারপোর্টের কাছে মিলিত হয়ে কার কোথায় কি দায়িত্ব তা নির্ধারণ করে দেয় ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা। ভুক্তভোগীর গতিবিধি জানানোর জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে গলাচিপা ঘাটে যায় পিচ্চি রানা ও ল্যাংড়া মামুন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ব্যারিকেড দেয়ার জন্য পটুয়াখালী-গলাচিপা হাইওয়ে রোডের শাঁখারিয়ার নির্জন জায়গায় একটা প্রাইভেট কার ও একটা ট্রলি নিয়ে অবস্থান নেয় তাদের পাঁচ সহযোগী।
ল্যাংড়া মামুনের নির্দেশে আগে থেকেই একটি ট্রাক্টর ভাড়া করে চালক বিল্লাল। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া প্রাইভেটকারটি নিয়ে চালক আশিক মৃধা, পাভেল, হাবিব, সোহাগ এই চারজন অবস্থান নেয়। ল্যাংড়া মামুনের সংকেত পাওয়ার পরপরই সন্ধ্যা সাড়ে আটটার দিকে ড্রাইভার বিল্লাল ট্রলিটি নিয়ে সুকৌশলে ভুক্তভোগী শিবু দাসের জিপের সামনে আড়াআড়ি করে অবস্থান নেয়। পিছন থেকে অনুসরণ করতে থাকা চালক আশিক তার প্রাইভেট গাড়িটি দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির পিছনে অবস্থান নিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলেন।
পরে আশিক প্রাইভেটকার ছেড়ে ভুক্তভোগী শিবু দাসের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। গাড়িতে উঠেই বিল্লাল, পাভেল, সোহাগ, আশিক বেঁধে ফেলা হয় শিবু দাস ও তার গাড়ি চালককে। পরে তাদের গামছা, টিস্যু পেপার ও স্কচ টেপ দিয়ে মুখ, হাত-পা বেঁধে চালাতে থাকে শারীরিক নির্যাতন। এছাড়া খেলনা পিস্তল ও ছোরা- চাকু দিয়ে ভয় দেখানো হয়।
বরগুনার আমতলী এলাকার গাজিপুরায় গিয়ে ভুক্তভোগীর জিপ গাড়ি থেকে তাদেরকে তোলা হয় ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া কারটিতে। সেখানে ভিকটিমসহ দুইজনকে আরো ভালোভাবে বেঁধে প্লাস্টিকের বস্তায় ঢুকানো হয়। আর ভুক্তভোগীর জীপটিকে আমতলীর একটি ফিলিং স্টেশনে ফেলে আসে। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা পটুয়াখালীর বাঁধ ঘাট এলাকায় ভিকটিমদের বহনকারী গাড়ি বুঝে নেয়। গাড়ি চালাতে থাকে ল্যাংড়া মামুন নিজেই। ল্যাংড়া মামুন সোজা নিয়ে যায় তার এইচডি রোডের নিজস্ব মেশিন ঘর কাম টর্চার সেলে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় এসপি কমপ্লেক্স সুপার মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডের অস্থায়ী সেলে। রাতভর চলে নির্যাতন। পরের দিন রানার নির্দেশে বিল্লাল ভুক্তভোগীর সিম থেকে ভিকটিমের স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিতে বলে। মুক্তিপণের টাকা না দিলে এবং বিষয়টি পুলিশকে জানালে শিবু লালকে হত্যা করে সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হবে বলেও সতর্ক করে দেয় অপহরণকারীরা।
ভিকটিম উদ্ধার: শিবু লাল দাস পটুয়াখালী জেলা শহরের পরিচিত ঠিকাদার, ইজারাদার, আড়তদার এবং বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত। অপর ভিকটিম মিরাজ মিয়া পাজেরো জিপের ড্রাইভার। গত ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে আটটার দিকে শিবু লাল দাস গলাচিপা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিজস্ব পাজেরো জীপ করে পটুয়াখালী শহরের বাসায় ফেরার পথে ড্রাইভারসহ নিখোঁজ হন। পরে দূরের একটি পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি পরিত্যক্ত অবস্থায় তার পাজেরো জীপটিকে উদ্ধার করে জেলা পুলিশ। অপহরণের পরের দিন ১২ এপ্রিল রাতে হাত-পা ও মুখ বাঁধা বস্তাবন্দি মুমূর্ষ অবস্থায় ভুক্তভোগীর এসপি কমপ্লেক্স শপিং সেন্টারের আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে উদ্ধার করে পটুয়াখালী জেলা পুলিশ।
অপহরণকারী সদস্যদের স্বপ্ন: গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে ল্যাংড়া মামুন পঙ্গু। এর আগে অপরাধ করতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার ডান পা উরু পর্যন্ত কাঁটা পড়ে। মামুন অল্প বয়সে জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতে। আপন ভগ্নিপতির টাকা মেরে দিয়ে পটুয়াখালী জেলা শহরে মালিক হয়েছে একাধিক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশার মানুষদের টর্চার সেলে আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তুলে হাতিয়ে নেওয়া হত টাকা। তিনি বলেন, মাওলানা হিসেবে তার বাবার সুখ্যাতি এবং পঙ্গুত্বের কারণে এই ক্যাডারের ভয়ে মুখ খুলে নাই অনেকেই। এবার ও ভেবেছিল শিবু লালকে অপহরণ করে মুক্তিপণ হিসেবে যে কোটি টাকা অর্জিত হবে তা দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে বড় গার্মেন্টসের ব্যবসা শুরু করবে মামুন। লেংড়া মামুনের সহযোগী পিচ্চি রানা বিভিন্ন টোলপ্লাজায় টোল কালেকশনের কাজ করেছে। কখনো কাজ করেছে ট্রাকের মিডিয়াম্যান হিসেবে। এছাড়া রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকায় সে ভেবেছিলে অপহরণ করে বড় অঙ্কের টাকা মারতে পারলে তা দিয়ে একাধিক ট্রাক কিনে ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে পরিবহনের ব্যবসা শুরু করবে। আর বিআরটিসির চালক জসিম উদ্দিন মৃধার পরিকল্পনা অপরের গাড়ি না চালিয়ে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে নিজস্ব বাস কিনে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে পটুয়াখালী রুটে চালাবে সে। আরেক সহযোগী আসামি আশিক দীর্ঘদিন ধরে রেন্ট-এ-কারের দালালি করে। তার পরিকল্পনা ছিলো মুক্তিপণের টাকা দিয়ে একাধিক গাড়ি কিনে বড় পরিসরে রেন্ট-এ-কারের বিজনেস শুরু করবে। আসামিদের বিরুদ্ধে মারামারি, মাদক এবং অপহরণের একাধিক মামলা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ, ডিবি গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান, অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহবুবুল হক সজীব ও অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) হাফিজ আল আসাদ ও সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) আবু তালিব।