ঢাকা ১০:৪৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

টিপ উপলক্ষ মাত্র, সমস্যা তো আরও গভীরে

  • আপডেট সময় : ১০:১৮:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ এপ্রিল ২০২২
  • ২৩৩ বার পড়া হয়েছে

সাজ্জাদ জাহিদ : ভালোবাসা স্বর্গীয় থাকে ততদিন, যতদিন তা পুরুষতান্ত্রিক হেজিমনি বা কর্তৃত্বের প্রভাবমুক্ত থাকে। সাম্প্রতিক টিপকা- আবারও একবার তাই প্রমাণ করলো। অবাক করা বিষয় হলো, বাঙালি নারীদের টিপ পরা যে বিতর্কের কোনও বিষয় হতে পারে, সেটিই অচিন্তনীয়; অথচ গত কয়েক দিন ধরে সারা দেশ যেন টিপ বিতর্কের নিচে চাপা পড়ে গেলো। একটু গভীরে দৃষ্টি ফেললে দেখা যায়, এখানে টিপ আসলে উপলক্ষ মাত্র। আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা হলো, অনেক অনিষ্টের মূলেই নারী; তা সে সেলিব্রেটি হোক বা সাধারণ কোনও নারী। নারীদের অবস্থান আমরা এমনভাবে দেখতে অভ্যস্ত যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে একজন নারীকে যা খুশি তাই বলে দেওয়া যায়। প্রশ্ন হলো, একজন পুরুষের কল্পনায়, বাস্তবে, ভাবনাজুড়ে জীবনের নানান স্তরে যখন নারী বিচরণ করে, নারীর ভালোবাসা পেতে চাতক পাখির মতো কত পুরুষ দিনাতিপাত করে, সেই নারীকে নিয়ে সুযোগ পেলেই তারা কুমন্তব্য করতে দ্বিধাবোধ করে না। এক্ষেত্রে তার ভালোবাসা কোথায় হারিয়ে যায় বা কেন হারিয়ে যায়?
কবি সুকান্ত যদিও তার কবিতায় অভাবে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালানোর কথা বলেছিলেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে সুকান্তের কাছে ভালোবাসা বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণ ছিল আর্থিক অভাব; তবে বর্তমান বাস্তবতায় নারী-পুরুষের সম্পর্কে ভালোবাসার ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ ‘পরিচর্যা’র অভাব। পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী দানবের সবচেয়ে বড় বলি পুরুষ নিজেই, যা সে অনুধাবন করতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে; পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসী তা-বে একজন চমৎকার রোমান্টিক, ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে সৎ, সজ্জন ব্যক্তিটিও নিজের স্ত্রী-সন্তানের কাছে ত্রাস হয়ে ওঠে। এমনকি ভালোবাসার সম্পর্কের সফল পরিণতি বিয়েতে গড়ালেও অনেক ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক ভূতের কারসাজিতে যেন পূর্বের একান্ত বাধ্য, নিরীহ, অতিশয় আবেগী প্রেমিক জবরদস্তিমূলক স্বামীতে রূপান্তরিত হয়। প্রকারান্তরে সেই পুরুষ একজন স্বৈরাচার, নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবে স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে চলে গিয়ে ভয়ংকর এক অসহনীয় ভালোবাসাহীন জীবনযাপন করে। এভাবেই একজন পুরুষ নিজেই পুরুষতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের অহমের বলি হয়। এর চেয়ে বরং পরিণতিহীন সম্পর্কগুলোর স্মৃতি ও ভালোবাসা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনুভূতিতে বেশি দিন বেঁচে থাকে; এর কারণ হলো এখানে প্রেমিক-প্রেমিকা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে জড়ায় না। তাই দুঃখজনক হলেও সত্য যে পুরুষতন্ত্রের কুপ্রভাবে ‘সফল’ ভালোবাসার একপ্রকার মৃত্যুই ঘটে এবং তা বিয়ের মাধ্যমে। জবরদস্তিমূলক পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রেমিক-প্রেমিকা কখনও স্বামী-স্ত্রী হতে পারে না; বিয়েতেই সমস্ত প্রেমের সাফল্য নিহিত, এমন তথাকথিত সফল প্রেমের গল্পগুলো আসলে ভালোবাসার সাথে একপ্রকার প্রতারণাই। যার মূল কারণ সমাজ ও পরিবারে যুগ যুগ ধরে জারি থাকা পুরুষতন্ত্রের বিষ।
আজকে যে পুরুষ নারীর প্রতি অসম্মান দেখায়, কথায় কথায় খাটো করে, মূলত এটি সে পরিবার থেকে দেখে শিখেছে। তার বাবা বা পুরুষ সদস্যরা, মা ও অন্য নারীদের প্রতিও অনুরূপ ব্যবহার করতো। নারীর প্রতি ছোট থেকে বড় প্রতিটি সহিংসতার আসল কারণ এটিই। এমনকি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা একজন নারীকেও নারীর নির্যাতনকারী হিসেবেও তৈরি করে থাকে। ফলে আজ যে পুরুষ বা নারী, নারীর প্রতি যে ব্যবহার করছে, তার পুরো দায় তার না; পারিবারিক শিক্ষা ও যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। তার দায় তখনই হবে, যখন সে একজন স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে, সচেতনভাবে চরিত্র ও চিন্তার এই দীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার কোনও চেষ্টা না করে।
আমরা আজ যদি আমাদের পূর্ব পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও অনগ্রসরতার চর্চা নিজেদের জীবনেও অব্যাহত রাখি, আমাদের সন্তানেরাও সেই একই বিষমন নিয়ে বড় হবে। কোথাও না কোথাও, কাউকে না কাউকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতেই হবে; সকল নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের চর্চা শুরু করতে হবে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারীর প্রতি বৈষম্যের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। চর্চার শুরুটা নিজের জীবন ও পরিবার থেকে হওয়াটা জরুরি, এবং তা সচেতনভাবেই। একমাত্র তাহলেই আমাদের সন্তানেরা সুস্থ মন নিয়ে বেড়ে উঠবে। তাদের ব্যক্তিগত জীবন, বন্ধুত্ব-প্রেম-ভালোবাসা-সংসার-কর্মক্ষেত্র স্বাভাবিক, সুন্দর হবে। আর তা না হলে, পুরুষতন্ত্রের ভীতিমূলক সংসারে বড় হওয়া একজন শিশু অস্বাভাবিক মনন নিয়ে বেড়ে উঠবে, নিজের জীবনেও একই ঘটনার প্রতিফলন ঘটাবে; যা কেবলই অন্তহীন এক চক্রের আবর্তে ঘুরতে থাকবে।
আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় পুরুষশাসিত পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসন, বিধি-নিষেধের প্রায় সিংহভাগই চর্চা হয় নারীদের ওপর। আপাতদৃষ্টিতে বা লিখিত, স্বীকৃত আইন কোনও পার্থক্য না করলেও বাস্তব জীবনে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন নারী নানাভাবে বঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার হয়। মোটাদাগে একজন মানুষের জীবনের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ধাপগুলো শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন, পতিত যৌবন, বার্ধক্য ও শেষ পরিণতি মৃত্যু হলেও প্রায় প্রতিটি স্তরে একজন পুরুষ নারীর তুলনায় সব দিক বিবেচনায়, সবার কাছ থেকে বেশি সুবিধা ভোগ করে ও একজন নারী সেসব ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়।
একজন পুরুষের বেড়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়ায়ই বিশৃঙ্খলা আর হেজিমনিতে ঠাসা। উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার সব ধরনের উপকরণ উপস্থিত থাকার পরও যারা সভ্য, সুস্থ, স্বাভাবিক ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে আচরণ করার চর্চা ও চেষ্টা করেন, অনেক ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, সেসব পুরুষের এই বৈশিষ্ট্যসমূহকে শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি ও পৌরুষের ঘাটতি হিসেবে সমালোচনা করা হয়। সাম্প্রতিক টিপকা-ে কিছু সুস্থ, সংবেদনশীল পুরুষের নেওয়া/দেখানো প্রতিবাদকে অনেকে সেভাবেই দেখেছেন। এটি একটি উদাহরণ মাত্র।
পরিবার ও সমাজে একজন ছেলেশিশুর প্রাপ্ত অস্বাভাবিক, একপাক্ষিক ও ক্ষেত্রবিশেষে দৃষ্টিকটু সুবিধা পাওয়ার পরও কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত বেশিরভাগ পুরুষের নিপীড়ক না হওয়াটা এক ধরনের অস্বাভাবিকতাই; ঠিক একইভাবে একজন নারীর পক্ষে স্বাভাবিক আচরণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে বেড়ে ওঠাটাও কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত অত্যন্ত কঠিন।

পরিবার ও সমাজের প্রতিষ্ঠিত এমন একচক্ষু কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত শিক্ষা-সংস্কৃতি-চিত্রকলাসহ অন্যান্য সেক্টর। কবি-সাহিত্যিকদের রচনা-চলচ্চিত্র-চিত্রকলার প্রায় প্রতিটি শাখা, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিজ্ঞাপন, সুন্দরী প্রতিযোগিতা ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রগুলো নারীর দেহ ও যৌনতাকে উপজীব্য করে কৃত্রিমভাবে পুরুষের দ্বারা ও ইচ্ছানুসারে সৃষ্টি হয়েছে। নারী-পুরুষের চিরন্তন সম্পর্ক ও সৃষ্টির মূলে পারস্পরিক আকর্ষণ ও যৌনতা যে স্বাভাবিক নিয়ম, সেটিকে কিছু কিছু শিল্প ও সাহিত্যে কিছু মাত্রায় প্রাধান্য দেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে এসব সম্পর্ককে নারীর প্রতি পুরুষের আধিপত্য হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে, যা প্রকারান্তরে নারীর প্রতি ছোট-বড় নানান মাত্রার সহিংসতাকে সমর্থন জোগায় ও অনেক ক্ষেত্রে উসকে দেয়।
বাংলা-হিন্দিসহ নানান সিনেমা-নাটকে অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে যেখানে একজন বখাটে ছেলে বা সাধারণ ছেলে একা অথবা বন্ধু/ সাঙ্গোপাঙ্গ মিলে একটি মেয়েকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে, বিরক্ত করে এবং শেষ পর্যন্ত দেখানো হয় মেয়েটি ছেলেটির প্রেমে পড়ে; এমন নানা প্রক্রিয়ায় নারীর প্রতি পুরুষের অধিপত্যকে সমর্থন ও উৎসাহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ভিলেন বা ক্ষমতাবান দুশ্চরিত্রের পুরুষ দ্বারা ধর্ষণসহ নানা যৌন সন্ত্রাস উপস্থাপন ও প্রচারের বিরূপ প্রভাব সমাজে নারী-পুরুষের সামগ্রিক সম্পর্কের ওপর পড়ে, যেখানে একজন পুরুষ নিজেকে অধিকতর ক্ষমতাবান ও একজন নারী নিজেকে অসহায় হিসেবে ভাবতে শিখে। সমাজপতিরা যুগ যুগ ধরে এমন ব্যবস্থা চালু ও পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে যেখানে একজন পুরুষের সাবালকত্ব বা পৌরুষ যৌনাঙ্গের অগ্রভাগ কর্তন ও সেটি বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়, অপরদিকে সব ধর্মে সে ব্যবস্থা না থাকলেও নারীর পিরিয়ড বা ঋতুচক্রের বিষয়টিকে অত্যন্ত গোপনীয়, লজ্জাজনক, অপবিত্র ও অস্বাস্থ্যকর হিসেবে দেখানো হয়। ফলশ্রুতিতে একজন পুরুষ সেই জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নিজেকে তার যৌনাঙ্গের কারণে আগ্রাসী, অহংকারী হিসেবে ভাবতে শিখে এবং নারী নিজেকে ঠিক বিপরীত অবস্থায় বিবেচনা করে; পুরো পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই ঘটনাটি ঘটায় ও নিরাপত্তা দেয়। এই অহংবোধ এতটাই তীব্র যে তা একজন ছেলে সন্তানের বাবা-মা বা পুরো গোষ্ঠীকে আচ্ছন্ন করে রাখে এক ধরনের অশ্লীল ‘ব্যাটাগিরি’র হেজিমনিতে; একজন নারীর নিজের ও পরিবারের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই চিত্রটি একদম বিপরীত।
যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে চলমান পুরুষতন্ত্র আর একসময় বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের অবিশ্বাস্য রকমের সাদৃশ্য রয়েছে। ফ্রেন্স ক্যারিবীয় কবি, বুদ্ধিজীবী এমে সেজায়ার তাঁর ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজমে ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষিতের সম্পর্ক সম্বন্ধে বলেছেন, ‘ঔপনিবেশিক শাসক আর শোষিতের মধ্যে যে ধরনের সম্পর্ক হতে পারে, তা কেবল জবরদস্তিমূলক শ্রম, ভীতি প্রদর্শন, চাপ প্রয়োগ, পুলিশি অত্যাচার, লুটপাট, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ফসল উৎপাদন, ঘৃণা, অবিশ্বাস, দাম্ভিক ব্যবহার, আত্মতুষ্টি, পশুর মতো আচরণ, নির্বোধ অভিজাত শ্রেণি আর স্বেচ্ছা দাসত্বকারী জনতা, এসবের মধ্য দিয়েই হতে পারে’। এই সম্পর্ক ও এর প্রভাব সম্বন্ধে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি সেই সব মানুষের কথা বলছি, যাদের অন্তরে চতুরতার সাথে ভয় প্রবেশ করানো হয়েছে। যাদের হীনম্মন্যতায় ভুগতে শেখানো হয়েছে, শেখানো হয়েছে ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতে, হাঁটু গেড়ে বসে হতাশায় ডুবে থেকে দাসত্ব বরণ করতে’।
পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতা সেভাবেই পুরুষকে অসভ্য করে তোলে, যেমনি ঔপনিবেশিকতা উপনিবেশবাদীকে করে। সেজায়ারের কথায়, ‘প্রথমত আমাদের ভালোভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে ঔপনিবেশিকতা কীভাবে উপনিবেশবাদীকে অসভ্য করে তোলে। শব্দটির সঠিক অর্থ করলে এভাবে বলা যায়, ঔপনিবেশিকতা তাকে নৃশংস করে তোলে ও অধঃপতিত করে- তার সুপ্ত পাশবিক বোধগুলোকে জাগিয়ে তোলে, লোলুপতাকে জাগিয়ে তোলে, জাগিয়ে তোলে তার হিংস্রতা, জাতিবিদ্বেষ আর নৈতিক বৈষম্যবোধ’। এমে সেজায়ারের ছাত্র, নিজ দেশ মার্তিনিকের একজন জগৎবিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী, বিপ্লবী দার্শনিক তাঁর ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক বইয়ে নিজ শিক্ষাগুরুরই প্রতিধ্বনি করেছেন। তাঁর মতে, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় একজন ‘নিগ্রো তার নিজের হীনম্মন্যতার কাছে যেমন বন্দি, ঠিক একইভাবে একজন শ্বেতাঙ্গ তার শ্রেষ্ঠত্বের অহমবোধের দাস এবং উভয় শ্রেণিই এক ধরনের বিকারগ্রস্ততায় ভোগে’।
ওপরে ঔপনিবেশিক শাসক ও ব্যবস্থা এবং তার প্রভাব নিয়ে সেজায়ারের বলা প্রতিটি কথাই পুরুষতন্ত্রের বেলায় দ্বিধাহীনভাবে সত্য। সেজায়ার তাঁর লেখার শুরুতেই ঔপনিবেশিক দম্ভের ওপর গড়ে ওঠা ইউরোপীয় সভ্যতার মুখোশ উন্মোচন করে বলেছেন, ‘যে সভ্যতা প্রতারণা আর শঠতাপূর্ণ কাজে তার নীতি ও আদর্শকে ব্যবহার করে, তা একটি মৃতপ্রায় সভ্যতা’, ঠিক একইভাবে নানা পদ্ধতিতে একজন পুরুষ নিরীহ ও অতিশয় রোমান্টিক প্রেমিক হিসেবে প্রেমিকার হৃদয় জয় করে পরবর্তীতে নানারকম শঠতা, প্রতারণা আর জবরদস্তি নিয়ে বিয়ের পর সাবেক প্রেমিকা ও বর্তমান স্ত্রীর ওপর নতুন চেহারা নিয়ে হাজির হয়।
অপরদিকে পরিবার ও সমাজের নানা পুরুষতান্ত্রিক জবরদস্তি ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা নারী প্রেমিকের মনভোলানো আচরণের ফাঁদে পড়ে ও নানা প্রলোভনে এবং নতুন এক স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে/পেতে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে ও বহুক্ষেত্রে এটিকেই জীবনের সেরা সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করে। প্রেমের সফলতায় বিভোর হয়ে অনেকেই নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয় ও বহু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক চাপে ‘হাঁটু গেড়ে বসে হতাশায় ডুবে থেকে দাসত্ব বরণ’ করে বাকি জীবন অতিবাহিত করে। আর যারা স্বেচ্ছা দাসত্ববরণ করতে পারে না, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত নারীরা, তাঁদের সাথে স্বামীদের দ্বন্দ্বের জেরে সেসব সংসার টিকে না; ফলে ইদানীং উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী নারীদের মধ্যে ডিভোর্সের হার বাড়ছে, যার দায়ও আবার তাদেরই নিতে হচ্ছে।
পরিশেষে একথা বলতেই হয়, নারীদের যত উন্নয়ন হচ্ছে, ততই পুরুষের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার কারণেই ভীত হয়ে তাদের ওপর পুরুষের ও পুরুষশাসিত সমাজের নিপীড়ন বাড়ছে। পাশাপাশি এও সত্য, স্বাধীনতার পর গ্রামীণ ও শ্রমিক শ্রেণির নারীর যে উন্নয়ন হয়েছে, যতটা তারা সমাজের শৃঙ্খল ভাঙতে পেরেছে, শিক্ষিত নারীরা পারেনি। শিক্ষিত নারীদের এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। অনেক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এখনও ভ- প্রেমিকের জন্য জান বাজি রেখে প্রেম করাকেই স্বাধীনতা লাভ বলে মনে করে এবং কখনও সেই প্রেমিককে বিয়ে করতে পারাকেই জীবনের সর্বোচ্চ সফলতা হিসেবে গণ্য করে। পুরুষের অন্যায় ক্ষমতা প্রদর্শনের সাথে জিততে হলে স্বাবলম্বী হওয়ার কোনও বিকল্প নেই।
আর একটা কথা; সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখে নারীদের ভীত ও হতাশ হলে চলবে না; বরং নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার প্রশ্ন, সেলফ ডিফেন্স, পাল্টা আঘাতের বিষয়গুলো সামনে আসছে; যা দেখে অনুপ্রাণিত না হয়ে পারা যায় না!
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, কুষ্টিয়া।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

টিপ উপলক্ষ মাত্র, সমস্যা তো আরও গভীরে

আপডেট সময় : ১০:১৮:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ এপ্রিল ২০২২

সাজ্জাদ জাহিদ : ভালোবাসা স্বর্গীয় থাকে ততদিন, যতদিন তা পুরুষতান্ত্রিক হেজিমনি বা কর্তৃত্বের প্রভাবমুক্ত থাকে। সাম্প্রতিক টিপকা- আবারও একবার তাই প্রমাণ করলো। অবাক করা বিষয় হলো, বাঙালি নারীদের টিপ পরা যে বিতর্কের কোনও বিষয় হতে পারে, সেটিই অচিন্তনীয়; অথচ গত কয়েক দিন ধরে সারা দেশ যেন টিপ বিতর্কের নিচে চাপা পড়ে গেলো। একটু গভীরে দৃষ্টি ফেললে দেখা যায়, এখানে টিপ আসলে উপলক্ষ মাত্র। আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা হলো, অনেক অনিষ্টের মূলেই নারী; তা সে সেলিব্রেটি হোক বা সাধারণ কোনও নারী। নারীদের অবস্থান আমরা এমনভাবে দেখতে অভ্যস্ত যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে একজন নারীকে যা খুশি তাই বলে দেওয়া যায়। প্রশ্ন হলো, একজন পুরুষের কল্পনায়, বাস্তবে, ভাবনাজুড়ে জীবনের নানান স্তরে যখন নারী বিচরণ করে, নারীর ভালোবাসা পেতে চাতক পাখির মতো কত পুরুষ দিনাতিপাত করে, সেই নারীকে নিয়ে সুযোগ পেলেই তারা কুমন্তব্য করতে দ্বিধাবোধ করে না। এক্ষেত্রে তার ভালোবাসা কোথায় হারিয়ে যায় বা কেন হারিয়ে যায়?
কবি সুকান্ত যদিও তার কবিতায় অভাবে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালানোর কথা বলেছিলেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে সুকান্তের কাছে ভালোবাসা বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণ ছিল আর্থিক অভাব; তবে বর্তমান বাস্তবতায় নারী-পুরুষের সম্পর্কে ভালোবাসার ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ ‘পরিচর্যা’র অভাব। পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী দানবের সবচেয়ে বড় বলি পুরুষ নিজেই, যা সে অনুধাবন করতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে; পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসী তা-বে একজন চমৎকার রোমান্টিক, ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে সৎ, সজ্জন ব্যক্তিটিও নিজের স্ত্রী-সন্তানের কাছে ত্রাস হয়ে ওঠে। এমনকি ভালোবাসার সম্পর্কের সফল পরিণতি বিয়েতে গড়ালেও অনেক ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক ভূতের কারসাজিতে যেন পূর্বের একান্ত বাধ্য, নিরীহ, অতিশয় আবেগী প্রেমিক জবরদস্তিমূলক স্বামীতে রূপান্তরিত হয়। প্রকারান্তরে সেই পুরুষ একজন স্বৈরাচার, নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবে স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে চলে গিয়ে ভয়ংকর এক অসহনীয় ভালোবাসাহীন জীবনযাপন করে। এভাবেই একজন পুরুষ নিজেই পুরুষতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের অহমের বলি হয়। এর চেয়ে বরং পরিণতিহীন সম্পর্কগুলোর স্মৃতি ও ভালোবাসা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনুভূতিতে বেশি দিন বেঁচে থাকে; এর কারণ হলো এখানে প্রেমিক-প্রেমিকা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে জড়ায় না। তাই দুঃখজনক হলেও সত্য যে পুরুষতন্ত্রের কুপ্রভাবে ‘সফল’ ভালোবাসার একপ্রকার মৃত্যুই ঘটে এবং তা বিয়ের মাধ্যমে। জবরদস্তিমূলক পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রেমিক-প্রেমিকা কখনও স্বামী-স্ত্রী হতে পারে না; বিয়েতেই সমস্ত প্রেমের সাফল্য নিহিত, এমন তথাকথিত সফল প্রেমের গল্পগুলো আসলে ভালোবাসার সাথে একপ্রকার প্রতারণাই। যার মূল কারণ সমাজ ও পরিবারে যুগ যুগ ধরে জারি থাকা পুরুষতন্ত্রের বিষ।
আজকে যে পুরুষ নারীর প্রতি অসম্মান দেখায়, কথায় কথায় খাটো করে, মূলত এটি সে পরিবার থেকে দেখে শিখেছে। তার বাবা বা পুরুষ সদস্যরা, মা ও অন্য নারীদের প্রতিও অনুরূপ ব্যবহার করতো। নারীর প্রতি ছোট থেকে বড় প্রতিটি সহিংসতার আসল কারণ এটিই। এমনকি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা একজন নারীকেও নারীর নির্যাতনকারী হিসেবেও তৈরি করে থাকে। ফলে আজ যে পুরুষ বা নারী, নারীর প্রতি যে ব্যবহার করছে, তার পুরো দায় তার না; পারিবারিক শিক্ষা ও যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। তার দায় তখনই হবে, যখন সে একজন স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে, সচেতনভাবে চরিত্র ও চিন্তার এই দীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার কোনও চেষ্টা না করে।
আমরা আজ যদি আমাদের পূর্ব পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও অনগ্রসরতার চর্চা নিজেদের জীবনেও অব্যাহত রাখি, আমাদের সন্তানেরাও সেই একই বিষমন নিয়ে বড় হবে। কোথাও না কোথাও, কাউকে না কাউকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতেই হবে; সকল নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের চর্চা শুরু করতে হবে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারীর প্রতি বৈষম্যের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। চর্চার শুরুটা নিজের জীবন ও পরিবার থেকে হওয়াটা জরুরি, এবং তা সচেতনভাবেই। একমাত্র তাহলেই আমাদের সন্তানেরা সুস্থ মন নিয়ে বেড়ে উঠবে। তাদের ব্যক্তিগত জীবন, বন্ধুত্ব-প্রেম-ভালোবাসা-সংসার-কর্মক্ষেত্র স্বাভাবিক, সুন্দর হবে। আর তা না হলে, পুরুষতন্ত্রের ভীতিমূলক সংসারে বড় হওয়া একজন শিশু অস্বাভাবিক মনন নিয়ে বেড়ে উঠবে, নিজের জীবনেও একই ঘটনার প্রতিফলন ঘটাবে; যা কেবলই অন্তহীন এক চক্রের আবর্তে ঘুরতে থাকবে।
আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় পুরুষশাসিত পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসন, বিধি-নিষেধের প্রায় সিংহভাগই চর্চা হয় নারীদের ওপর। আপাতদৃষ্টিতে বা লিখিত, স্বীকৃত আইন কোনও পার্থক্য না করলেও বাস্তব জীবনে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন নারী নানাভাবে বঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার হয়। মোটাদাগে একজন মানুষের জীবনের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ধাপগুলো শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন, পতিত যৌবন, বার্ধক্য ও শেষ পরিণতি মৃত্যু হলেও প্রায় প্রতিটি স্তরে একজন পুরুষ নারীর তুলনায় সব দিক বিবেচনায়, সবার কাছ থেকে বেশি সুবিধা ভোগ করে ও একজন নারী সেসব ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়।
একজন পুরুষের বেড়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়ায়ই বিশৃঙ্খলা আর হেজিমনিতে ঠাসা। উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার সব ধরনের উপকরণ উপস্থিত থাকার পরও যারা সভ্য, সুস্থ, স্বাভাবিক ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে আচরণ করার চর্চা ও চেষ্টা করেন, অনেক ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, সেসব পুরুষের এই বৈশিষ্ট্যসমূহকে শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি ও পৌরুষের ঘাটতি হিসেবে সমালোচনা করা হয়। সাম্প্রতিক টিপকা-ে কিছু সুস্থ, সংবেদনশীল পুরুষের নেওয়া/দেখানো প্রতিবাদকে অনেকে সেভাবেই দেখেছেন। এটি একটি উদাহরণ মাত্র।
পরিবার ও সমাজে একজন ছেলেশিশুর প্রাপ্ত অস্বাভাবিক, একপাক্ষিক ও ক্ষেত্রবিশেষে দৃষ্টিকটু সুবিধা পাওয়ার পরও কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত বেশিরভাগ পুরুষের নিপীড়ক না হওয়াটা এক ধরনের অস্বাভাবিকতাই; ঠিক একইভাবে একজন নারীর পক্ষে স্বাভাবিক আচরণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে বেড়ে ওঠাটাও কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত অত্যন্ত কঠিন।

পরিবার ও সমাজের প্রতিষ্ঠিত এমন একচক্ষু কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত শিক্ষা-সংস্কৃতি-চিত্রকলাসহ অন্যান্য সেক্টর। কবি-সাহিত্যিকদের রচনা-চলচ্চিত্র-চিত্রকলার প্রায় প্রতিটি শাখা, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিজ্ঞাপন, সুন্দরী প্রতিযোগিতা ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রগুলো নারীর দেহ ও যৌনতাকে উপজীব্য করে কৃত্রিমভাবে পুরুষের দ্বারা ও ইচ্ছানুসারে সৃষ্টি হয়েছে। নারী-পুরুষের চিরন্তন সম্পর্ক ও সৃষ্টির মূলে পারস্পরিক আকর্ষণ ও যৌনতা যে স্বাভাবিক নিয়ম, সেটিকে কিছু কিছু শিল্প ও সাহিত্যে কিছু মাত্রায় প্রাধান্য দেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে এসব সম্পর্ককে নারীর প্রতি পুরুষের আধিপত্য হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে, যা প্রকারান্তরে নারীর প্রতি ছোট-বড় নানান মাত্রার সহিংসতাকে সমর্থন জোগায় ও অনেক ক্ষেত্রে উসকে দেয়।
বাংলা-হিন্দিসহ নানান সিনেমা-নাটকে অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে যেখানে একজন বখাটে ছেলে বা সাধারণ ছেলে একা অথবা বন্ধু/ সাঙ্গোপাঙ্গ মিলে একটি মেয়েকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে, বিরক্ত করে এবং শেষ পর্যন্ত দেখানো হয় মেয়েটি ছেলেটির প্রেমে পড়ে; এমন নানা প্রক্রিয়ায় নারীর প্রতি পুরুষের অধিপত্যকে সমর্থন ও উৎসাহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ভিলেন বা ক্ষমতাবান দুশ্চরিত্রের পুরুষ দ্বারা ধর্ষণসহ নানা যৌন সন্ত্রাস উপস্থাপন ও প্রচারের বিরূপ প্রভাব সমাজে নারী-পুরুষের সামগ্রিক সম্পর্কের ওপর পড়ে, যেখানে একজন পুরুষ নিজেকে অধিকতর ক্ষমতাবান ও একজন নারী নিজেকে অসহায় হিসেবে ভাবতে শিখে। সমাজপতিরা যুগ যুগ ধরে এমন ব্যবস্থা চালু ও পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে যেখানে একজন পুরুষের সাবালকত্ব বা পৌরুষ যৌনাঙ্গের অগ্রভাগ কর্তন ও সেটি বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়, অপরদিকে সব ধর্মে সে ব্যবস্থা না থাকলেও নারীর পিরিয়ড বা ঋতুচক্রের বিষয়টিকে অত্যন্ত গোপনীয়, লজ্জাজনক, অপবিত্র ও অস্বাস্থ্যকর হিসেবে দেখানো হয়। ফলশ্রুতিতে একজন পুরুষ সেই জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নিজেকে তার যৌনাঙ্গের কারণে আগ্রাসী, অহংকারী হিসেবে ভাবতে শিখে এবং নারী নিজেকে ঠিক বিপরীত অবস্থায় বিবেচনা করে; পুরো পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই ঘটনাটি ঘটায় ও নিরাপত্তা দেয়। এই অহংবোধ এতটাই তীব্র যে তা একজন ছেলে সন্তানের বাবা-মা বা পুরো গোষ্ঠীকে আচ্ছন্ন করে রাখে এক ধরনের অশ্লীল ‘ব্যাটাগিরি’র হেজিমনিতে; একজন নারীর নিজের ও পরিবারের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই চিত্রটি একদম বিপরীত।
যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে চলমান পুরুষতন্ত্র আর একসময় বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের অবিশ্বাস্য রকমের সাদৃশ্য রয়েছে। ফ্রেন্স ক্যারিবীয় কবি, বুদ্ধিজীবী এমে সেজায়ার তাঁর ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজমে ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষিতের সম্পর্ক সম্বন্ধে বলেছেন, ‘ঔপনিবেশিক শাসক আর শোষিতের মধ্যে যে ধরনের সম্পর্ক হতে পারে, তা কেবল জবরদস্তিমূলক শ্রম, ভীতি প্রদর্শন, চাপ প্রয়োগ, পুলিশি অত্যাচার, লুটপাট, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ফসল উৎপাদন, ঘৃণা, অবিশ্বাস, দাম্ভিক ব্যবহার, আত্মতুষ্টি, পশুর মতো আচরণ, নির্বোধ অভিজাত শ্রেণি আর স্বেচ্ছা দাসত্বকারী জনতা, এসবের মধ্য দিয়েই হতে পারে’। এই সম্পর্ক ও এর প্রভাব সম্বন্ধে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি সেই সব মানুষের কথা বলছি, যাদের অন্তরে চতুরতার সাথে ভয় প্রবেশ করানো হয়েছে। যাদের হীনম্মন্যতায় ভুগতে শেখানো হয়েছে, শেখানো হয়েছে ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতে, হাঁটু গেড়ে বসে হতাশায় ডুবে থেকে দাসত্ব বরণ করতে’।
পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতা সেভাবেই পুরুষকে অসভ্য করে তোলে, যেমনি ঔপনিবেশিকতা উপনিবেশবাদীকে করে। সেজায়ারের কথায়, ‘প্রথমত আমাদের ভালোভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে ঔপনিবেশিকতা কীভাবে উপনিবেশবাদীকে অসভ্য করে তোলে। শব্দটির সঠিক অর্থ করলে এভাবে বলা যায়, ঔপনিবেশিকতা তাকে নৃশংস করে তোলে ও অধঃপতিত করে- তার সুপ্ত পাশবিক বোধগুলোকে জাগিয়ে তোলে, লোলুপতাকে জাগিয়ে তোলে, জাগিয়ে তোলে তার হিংস্রতা, জাতিবিদ্বেষ আর নৈতিক বৈষম্যবোধ’। এমে সেজায়ারের ছাত্র, নিজ দেশ মার্তিনিকের একজন জগৎবিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী, বিপ্লবী দার্শনিক তাঁর ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক বইয়ে নিজ শিক্ষাগুরুরই প্রতিধ্বনি করেছেন। তাঁর মতে, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় একজন ‘নিগ্রো তার নিজের হীনম্মন্যতার কাছে যেমন বন্দি, ঠিক একইভাবে একজন শ্বেতাঙ্গ তার শ্রেষ্ঠত্বের অহমবোধের দাস এবং উভয় শ্রেণিই এক ধরনের বিকারগ্রস্ততায় ভোগে’।
ওপরে ঔপনিবেশিক শাসক ও ব্যবস্থা এবং তার প্রভাব নিয়ে সেজায়ারের বলা প্রতিটি কথাই পুরুষতন্ত্রের বেলায় দ্বিধাহীনভাবে সত্য। সেজায়ার তাঁর লেখার শুরুতেই ঔপনিবেশিক দম্ভের ওপর গড়ে ওঠা ইউরোপীয় সভ্যতার মুখোশ উন্মোচন করে বলেছেন, ‘যে সভ্যতা প্রতারণা আর শঠতাপূর্ণ কাজে তার নীতি ও আদর্শকে ব্যবহার করে, তা একটি মৃতপ্রায় সভ্যতা’, ঠিক একইভাবে নানা পদ্ধতিতে একজন পুরুষ নিরীহ ও অতিশয় রোমান্টিক প্রেমিক হিসেবে প্রেমিকার হৃদয় জয় করে পরবর্তীতে নানারকম শঠতা, প্রতারণা আর জবরদস্তি নিয়ে বিয়ের পর সাবেক প্রেমিকা ও বর্তমান স্ত্রীর ওপর নতুন চেহারা নিয়ে হাজির হয়।
অপরদিকে পরিবার ও সমাজের নানা পুরুষতান্ত্রিক জবরদস্তি ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা নারী প্রেমিকের মনভোলানো আচরণের ফাঁদে পড়ে ও নানা প্রলোভনে এবং নতুন এক স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে/পেতে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে ও বহুক্ষেত্রে এটিকেই জীবনের সেরা সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করে। প্রেমের সফলতায় বিভোর হয়ে অনেকেই নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয় ও বহু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক চাপে ‘হাঁটু গেড়ে বসে হতাশায় ডুবে থেকে দাসত্ব বরণ’ করে বাকি জীবন অতিবাহিত করে। আর যারা স্বেচ্ছা দাসত্ববরণ করতে পারে না, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত নারীরা, তাঁদের সাথে স্বামীদের দ্বন্দ্বের জেরে সেসব সংসার টিকে না; ফলে ইদানীং উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী নারীদের মধ্যে ডিভোর্সের হার বাড়ছে, যার দায়ও আবার তাদেরই নিতে হচ্ছে।
পরিশেষে একথা বলতেই হয়, নারীদের যত উন্নয়ন হচ্ছে, ততই পুরুষের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার কারণেই ভীত হয়ে তাদের ওপর পুরুষের ও পুরুষশাসিত সমাজের নিপীড়ন বাড়ছে। পাশাপাশি এও সত্য, স্বাধীনতার পর গ্রামীণ ও শ্রমিক শ্রেণির নারীর যে উন্নয়ন হয়েছে, যতটা তারা সমাজের শৃঙ্খল ভাঙতে পেরেছে, শিক্ষিত নারীরা পারেনি। শিক্ষিত নারীদের এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। অনেক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এখনও ভ- প্রেমিকের জন্য জান বাজি রেখে প্রেম করাকেই স্বাধীনতা লাভ বলে মনে করে এবং কখনও সেই প্রেমিককে বিয়ে করতে পারাকেই জীবনের সর্বোচ্চ সফলতা হিসেবে গণ্য করে। পুরুষের অন্যায় ক্ষমতা প্রদর্শনের সাথে জিততে হলে স্বাবলম্বী হওয়ার কোনও বিকল্প নেই।
আর একটা কথা; সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখে নারীদের ভীত ও হতাশ হলে চলবে না; বরং নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার প্রশ্ন, সেলফ ডিফেন্স, পাল্টা আঘাতের বিষয়গুলো সামনে আসছে; যা দেখে অনুপ্রাণিত না হয়ে পারা যায় না!
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, কুষ্টিয়া।