ঢাকা ১১:৪৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এমনি এমনি কেউ কাঁদে?

  • আপডেট সময় : ০৯:৫২:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ এপ্রিল ২০২২
  • ৭৩ বার পড়া হয়েছে

ইমতিয়াজ মেহেদী হাসান : রাত ১টা বেজে ৪৭ মিনিট। ফেরিতে পদ্মা পার হচ্ছি। সামনেই স্বপ্নের সেতু। ইশ্ যদি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারতাম। স্বপ্ন ছোঁয়ার অনুভূতি বুঝি এমনই। নির্ভেজাল আর নিষ্পাপ। মায়ের ফোন। কতদূর বাপ? আর কতক্ষণ লাগবে? গরুর মাংস কি গরম করব? তোর পছন্দের কচুর লতি আর চিংড়ির মালাইকারিও কিন্তু রান্না করেছি। তুমি এখনও ঘুমাওনি কেন মা? ঘড়িতে দেখেছো কয়টা বাজে? আমি বাড়ির কাছাকাছি এসে তোমায় ফোন করব, কেমন? তুমি ততক্ষণে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। শুকনো গলায় ‘আচ্ছা’ বলে মা ফোন রেখে দিল। ফেরি ঘাটে লাগবে আর কিছুক্ষণ বাদেই। আদা দিয়ে এক কাপ রংচা খেলে কেমন হয়?
ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতার দিকে এগেচ্ছিলাম। দেখলাম অলৌকিকভাবে পাশাপাশি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি ও বিয়ের গাড়ি।
ক্ষণিকের জন্য কোথায় যেন ভিসা ছাড়াই হারিয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, আহা জীবন। এক গাড়ি থেকে ভেসে আসছে লাশের গন্ধ, অপর গাড়ি থেকে ফুলেল ঘ্রাণ।
একইভাবে দুই বাড়িতেই চলছে আয়োজন। একটি বিচ্ছেদের, অপরটি মিলনের। দুনিয়া কত অদ্ভুত, তাই না! তবুও আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি না, আল্লাহর শোকরগুজার করিনা। মেতে আছি রংধনু রঙের স্বপ্নীল নেশায়। কে কাকে টপকাবে, কত টাকার মালিক হবে, এই নিয়ে চলছে সে কি প্রাণান্ত চেষ্টা! রাত নেই, দিন নেই সবাই মিলে কেমন যেন প্রতীকী দিগম্বরের মতই চলছি। মিথ্যে কথা বলাকে তো রীতিমত নিয়ে গিয়েছি শিল্পের পর্যায়ে।
আর শোঅফের কথা কি বলব, বাব্বা। দামি গাড়ি, ব্র্যান্ডের ফোন, জামা-জুতা-বেল্ট-পারফিউম-গৃহস্থালির আসবাব আমাদের চাই-ই চাই। তাই পেটে ভাত থাক আর না থাক।
রেলগাড়ির মতো ছুটতে ছুটতে স্টেশন বদলের মতো কথারাও প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছে। বান্দরবানের চাঁদের গাড়ি নিয়ে মুখে সদরঘাটের পান ভরে পুনরায় ফিরতে চায়। কথার মতো সবাইকেই একটা সময় ফিরতে হয়, সালমান শাহ্’র মতো মাথায় কাপড় বেঁধে, আপন নীড়ে। দু’ দ- শান্তির খোঁজে।
ঝালমুড়ি বিক্রেতার ফোনে বাজছে, পথের ক্লান্তি ভুলে গানটা। মামা, এই গান শুনছো যে, তাও এত রাতে! কি করমু মামা কন, মায়ের কথা মনে পড়তাছে খুব। সতের দিন হইলো, মায়েরে দেহি না। হেতি হসপিটালে ভর্তি। তার চিকিৎসার খরচ যোগাইনার লাইগাই তো টানা শিফটে ডিউটি করতাছি। ঘুমাই সব মিলায়ে এই ধরেন ঘন্টা তিনেক।
কথাগুলো বলতে বলতে নিজের অজান্তেই নয়ন ভেজালো ২৩/২৪ বয়সী এই তরুণ। বাম হাতে চোখ মুছে বললো, ঝাল বেশি হইবো না কম? কম-বেশি দু’টোই খেতে পারি। আজ তুমি যেটা দেবে, সেটাই খাব। এরপর ওর মনের মাধুরী মিশিয়ে বানানো মুড়ি নিয়ে রওনা হলাম ফেরির দ্বিতীয় তলার দিকে।
ফোন সাইলেন্ট ছিলো, তাই টের পাইনি। টু মিসডকল। মায়ের ফোন। কলব্যাক করলাম। আবারও অপেক্ষাভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা, আর কতক্ষণ লাগবে বাপ? এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, কেঁদে ফেললাম। ওপাশ থেকে মা ঠিকই বুঝে গেলেন, আর বুঝবেন নাইবা কেন, নাড়ির বন্ধন যে। তোর কি মন খারাপ? না মা, এমনি। এমনি এমনি কেউ কাঁদে?
কাঁদে মা। এই কান্না খুশির। তুমি আরেকটু অপেক্ষা করো, প্রায় এসেই পড়েছি। আর এখন যে দেরিটুকু হচ্ছে, সেটা ক’দিন পরেই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর কর্পূরের মতো মিলিয়ে যাবে। তাই যেন হয় বাপ। তাই যেন হয়…
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও গীতিকার

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

এমনি এমনি কেউ কাঁদে?

আপডেট সময় : ০৯:৫২:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ এপ্রিল ২০২২

ইমতিয়াজ মেহেদী হাসান : রাত ১টা বেজে ৪৭ মিনিট। ফেরিতে পদ্মা পার হচ্ছি। সামনেই স্বপ্নের সেতু। ইশ্ যদি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারতাম। স্বপ্ন ছোঁয়ার অনুভূতি বুঝি এমনই। নির্ভেজাল আর নিষ্পাপ। মায়ের ফোন। কতদূর বাপ? আর কতক্ষণ লাগবে? গরুর মাংস কি গরম করব? তোর পছন্দের কচুর লতি আর চিংড়ির মালাইকারিও কিন্তু রান্না করেছি। তুমি এখনও ঘুমাওনি কেন মা? ঘড়িতে দেখেছো কয়টা বাজে? আমি বাড়ির কাছাকাছি এসে তোমায় ফোন করব, কেমন? তুমি ততক্ষণে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। শুকনো গলায় ‘আচ্ছা’ বলে মা ফোন রেখে দিল। ফেরি ঘাটে লাগবে আর কিছুক্ষণ বাদেই। আদা দিয়ে এক কাপ রংচা খেলে কেমন হয়?
ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতার দিকে এগেচ্ছিলাম। দেখলাম অলৌকিকভাবে পাশাপাশি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি ও বিয়ের গাড়ি।
ক্ষণিকের জন্য কোথায় যেন ভিসা ছাড়াই হারিয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, আহা জীবন। এক গাড়ি থেকে ভেসে আসছে লাশের গন্ধ, অপর গাড়ি থেকে ফুলেল ঘ্রাণ।
একইভাবে দুই বাড়িতেই চলছে আয়োজন। একটি বিচ্ছেদের, অপরটি মিলনের। দুনিয়া কত অদ্ভুত, তাই না! তবুও আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি না, আল্লাহর শোকরগুজার করিনা। মেতে আছি রংধনু রঙের স্বপ্নীল নেশায়। কে কাকে টপকাবে, কত টাকার মালিক হবে, এই নিয়ে চলছে সে কি প্রাণান্ত চেষ্টা! রাত নেই, দিন নেই সবাই মিলে কেমন যেন প্রতীকী দিগম্বরের মতই চলছি। মিথ্যে কথা বলাকে তো রীতিমত নিয়ে গিয়েছি শিল্পের পর্যায়ে।
আর শোঅফের কথা কি বলব, বাব্বা। দামি গাড়ি, ব্র্যান্ডের ফোন, জামা-জুতা-বেল্ট-পারফিউম-গৃহস্থালির আসবাব আমাদের চাই-ই চাই। তাই পেটে ভাত থাক আর না থাক।
রেলগাড়ির মতো ছুটতে ছুটতে স্টেশন বদলের মতো কথারাও প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছে। বান্দরবানের চাঁদের গাড়ি নিয়ে মুখে সদরঘাটের পান ভরে পুনরায় ফিরতে চায়। কথার মতো সবাইকেই একটা সময় ফিরতে হয়, সালমান শাহ্’র মতো মাথায় কাপড় বেঁধে, আপন নীড়ে। দু’ দ- শান্তির খোঁজে।
ঝালমুড়ি বিক্রেতার ফোনে বাজছে, পথের ক্লান্তি ভুলে গানটা। মামা, এই গান শুনছো যে, তাও এত রাতে! কি করমু মামা কন, মায়ের কথা মনে পড়তাছে খুব। সতের দিন হইলো, মায়েরে দেহি না। হেতি হসপিটালে ভর্তি। তার চিকিৎসার খরচ যোগাইনার লাইগাই তো টানা শিফটে ডিউটি করতাছি। ঘুমাই সব মিলায়ে এই ধরেন ঘন্টা তিনেক।
কথাগুলো বলতে বলতে নিজের অজান্তেই নয়ন ভেজালো ২৩/২৪ বয়সী এই তরুণ। বাম হাতে চোখ মুছে বললো, ঝাল বেশি হইবো না কম? কম-বেশি দু’টোই খেতে পারি। আজ তুমি যেটা দেবে, সেটাই খাব। এরপর ওর মনের মাধুরী মিশিয়ে বানানো মুড়ি নিয়ে রওনা হলাম ফেরির দ্বিতীয় তলার দিকে।
ফোন সাইলেন্ট ছিলো, তাই টের পাইনি। টু মিসডকল। মায়ের ফোন। কলব্যাক করলাম। আবারও অপেক্ষাভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা, আর কতক্ষণ লাগবে বাপ? এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, কেঁদে ফেললাম। ওপাশ থেকে মা ঠিকই বুঝে গেলেন, আর বুঝবেন নাইবা কেন, নাড়ির বন্ধন যে। তোর কি মন খারাপ? না মা, এমনি। এমনি এমনি কেউ কাঁদে?
কাঁদে মা। এই কান্না খুশির। তুমি আরেকটু অপেক্ষা করো, প্রায় এসেই পড়েছি। আর এখন যে দেরিটুকু হচ্ছে, সেটা ক’দিন পরেই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর কর্পূরের মতো মিলিয়ে যাবে। তাই যেন হয় বাপ। তাই যেন হয়…
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও গীতিকার