ঢাকা ১০:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

পুঁজির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে শীতলপাটি

  • আপডেট সময় : ১২:৫৭:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ এপ্রিল ২০২২
  • ৮৬ বার পড়া হয়েছে

সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা : সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের শীতল পাটির চাহিদা দেশব্যাপী সমাদৃত থাকলেও সময়ের ব্যবধানে পুঁজির অভাবে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের প্রায়ই অর্থনৈতিক সংকট আর টানাপড়েনে চলছে জীবন। জীবিকার তাগিদে তারা কোনোমতো আঁকড়ে ধরে আছেন বাপ-দাদার পুরনো এই পেশা। কামারখন্দের ঝাঐল ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের পুরুষরা জমি থেকে পাটি তৈরির বেত কেটে বাড়ি নিয়ে আসেন। পরে সেগুলো বেতী সুতা বানিয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হয়। বেতী সুতাগুলো শুকানোর পর তাতে বাহারী রঙ দেওয়ার পর আবারও রোদে শুকানো হয়। তারপর নারী শিল্পীরা নিপূণ হাতে তৈরি করেন এই শীতলপাটি। কামারখন্দ ছাড়াও সদর ও রায়গঞ্জ উপজেলায় শীতলপাটি হস্তশিল্প রয়েছে। বিশেষ করে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হিন্দু সম্প্রদায়ের দাসগোত্র। বর্তমানে এ পেশায় মুসলমানদের কুটির শিল্পে দক্ষ ব্যক্তিরাও জড়িত রয়েছেন। জানা যায়, ৯০ দশকে শীতলপাটি সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে ব্যবহার হতো। বর্তমানে উন্নতমানের মাদুর ও প্লাস্টিকের রেক্সিন আবিষ্কারের কারণে মানুষের জীবন-মানের পরিবর্তনের সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে শীতলপাটি শিল্প। শীতলপাটির বুনন ও চাহিদা কমলেও কামারখন্দের চাঁদপুর গ্রামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নারীরা শত কষ্টেও তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। বর্তমানে চাঁদপুর গ্রামের ৩০০ পরিবারের প্রায় ৮০০ নারী-পুরুষ তাদের জাত পেশা হিসেবে এখনো টিকিয়ে রেখেছেন এ শিল্প। বর্তমানে প্রতিটি শীতলপাটি প্রকারভেদে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রায়গঞ্জের মথুরাপুর গ্রামের রাজুবালা দত্ত (৪৮) বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে পাটি তৈরি করছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো লাভ নেই, বেতও পাওয়া যায় না। বেতের দাম দিয়ে পাটি তৈরি করে সংসার চালানো যায় না। অন্য কোনো কাজ জানি না, তাই এই কাজ করি। যারা কাজ পারেন, লেখাপড়া শিখেছেন, তারা কেউ চাকরি করছেন এবং অন্য পেশায় গিয়ে জড়িত হয়ে পরিবারে এনেছেন সচ্ছলতা। কামারখন্দের চাঁদপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা পাটি তৈরির শিল্পী রানি দত্ত বলেন, একসময়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে শীতলপাটি বাধ্যতামূলক কিনতো। বিয়ে ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে শীতল পাটি উপহার দিতো। কি দিন এসেছে। আমাদের আর সেদিন নেই। বর্তমানে শীতলপাটির কদর অনেকটা কমে গেছে। পাটির দাম কিছুটা বাড়লেও আমাদের মজুরি বাড়েনি। পাটি ক্ষেত্রে ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত পাই। একটি পাটি বুনতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগে। একটা পাটি বুনতে যে পরিশ্রম আর সময় লাগে, সে হিসেবে আমাদের মজুরি অনেক কম। পাটিশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিল্লু চন্দ্র দাস বলেন, পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প আজ পুঁজির অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। করোনার আগে সোনালী ব্যাংক থেকে লোন দেওয়া হলেও করোনার সময়ে কেনা-বেচা না থাকায় পুঁজি ভেঙে খাওয়ায় আমরা এখন দেউলিয়া হয়ে গেছি। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারাও আছেন, তারা ঋণে জড়িয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় সরকারি উদ্যোগ না নিলে এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে। বিল্লু চন্দ্র আরও বলেন, শীতলপাটি তৈরির প্রধান কাঁচামাল বেতের দাম বাজারে অন্যান্য ফসলের তুলনায় দাম কম হওয়ায় অনেকে বেতের ক্ষেত ভেঙে অন্য ফসল আবাদ করছেন। এতে বেতের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে আধুনিক মানের শীতলপাটি তৈরির প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা হলে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেরিনা সুলতানা বলেন, পাটি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এর সঙ্গে জড়িতদের গত বছরে দুইবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এক্সপোর্ট মার্কেটে যেতে পারে, সে লক্ষ্যে আগামীতে আরও উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কীভাবে শীতল পাটির বাজারজাত বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে শিল্পটাকে ধরে রাখে। তাই তরুণদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

পুঁজির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে শীতলপাটি

আপডেট সময় : ১২:৫৭:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ এপ্রিল ২০২২

সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা : সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের শীতল পাটির চাহিদা দেশব্যাপী সমাদৃত থাকলেও সময়ের ব্যবধানে পুঁজির অভাবে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের প্রায়ই অর্থনৈতিক সংকট আর টানাপড়েনে চলছে জীবন। জীবিকার তাগিদে তারা কোনোমতো আঁকড়ে ধরে আছেন বাপ-দাদার পুরনো এই পেশা। কামারখন্দের ঝাঐল ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের পুরুষরা জমি থেকে পাটি তৈরির বেত কেটে বাড়ি নিয়ে আসেন। পরে সেগুলো বেতী সুতা বানিয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হয়। বেতী সুতাগুলো শুকানোর পর তাতে বাহারী রঙ দেওয়ার পর আবারও রোদে শুকানো হয়। তারপর নারী শিল্পীরা নিপূণ হাতে তৈরি করেন এই শীতলপাটি। কামারখন্দ ছাড়াও সদর ও রায়গঞ্জ উপজেলায় শীতলপাটি হস্তশিল্প রয়েছে। বিশেষ করে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হিন্দু সম্প্রদায়ের দাসগোত্র। বর্তমানে এ পেশায় মুসলমানদের কুটির শিল্পে দক্ষ ব্যক্তিরাও জড়িত রয়েছেন। জানা যায়, ৯০ দশকে শীতলপাটি সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে ব্যবহার হতো। বর্তমানে উন্নতমানের মাদুর ও প্লাস্টিকের রেক্সিন আবিষ্কারের কারণে মানুষের জীবন-মানের পরিবর্তনের সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে শীতলপাটি শিল্প। শীতলপাটির বুনন ও চাহিদা কমলেও কামারখন্দের চাঁদপুর গ্রামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নারীরা শত কষ্টেও তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। বর্তমানে চাঁদপুর গ্রামের ৩০০ পরিবারের প্রায় ৮০০ নারী-পুরুষ তাদের জাত পেশা হিসেবে এখনো টিকিয়ে রেখেছেন এ শিল্প। বর্তমানে প্রতিটি শীতলপাটি প্রকারভেদে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রায়গঞ্জের মথুরাপুর গ্রামের রাজুবালা দত্ত (৪৮) বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে পাটি তৈরি করছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো লাভ নেই, বেতও পাওয়া যায় না। বেতের দাম দিয়ে পাটি তৈরি করে সংসার চালানো যায় না। অন্য কোনো কাজ জানি না, তাই এই কাজ করি। যারা কাজ পারেন, লেখাপড়া শিখেছেন, তারা কেউ চাকরি করছেন এবং অন্য পেশায় গিয়ে জড়িত হয়ে পরিবারে এনেছেন সচ্ছলতা। কামারখন্দের চাঁদপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা পাটি তৈরির শিল্পী রানি দত্ত বলেন, একসময়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে শীতলপাটি বাধ্যতামূলক কিনতো। বিয়ে ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে শীতল পাটি উপহার দিতো। কি দিন এসেছে। আমাদের আর সেদিন নেই। বর্তমানে শীতলপাটির কদর অনেকটা কমে গেছে। পাটির দাম কিছুটা বাড়লেও আমাদের মজুরি বাড়েনি। পাটি ক্ষেত্রে ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত পাই। একটি পাটি বুনতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগে। একটা পাটি বুনতে যে পরিশ্রম আর সময় লাগে, সে হিসেবে আমাদের মজুরি অনেক কম। পাটিশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিল্লু চন্দ্র দাস বলেন, পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প আজ পুঁজির অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। করোনার আগে সোনালী ব্যাংক থেকে লোন দেওয়া হলেও করোনার সময়ে কেনা-বেচা না থাকায় পুঁজি ভেঙে খাওয়ায় আমরা এখন দেউলিয়া হয়ে গেছি। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারাও আছেন, তারা ঋণে জড়িয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় সরকারি উদ্যোগ না নিলে এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে। বিল্লু চন্দ্র আরও বলেন, শীতলপাটি তৈরির প্রধান কাঁচামাল বেতের দাম বাজারে অন্যান্য ফসলের তুলনায় দাম কম হওয়ায় অনেকে বেতের ক্ষেত ভেঙে অন্য ফসল আবাদ করছেন। এতে বেতের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে আধুনিক মানের শীতলপাটি তৈরির প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা হলে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেরিনা সুলতানা বলেন, পাটি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এর সঙ্গে জড়িতদের গত বছরে দুইবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এক্সপোর্ট মার্কেটে যেতে পারে, সে লক্ষ্যে আগামীতে আরও উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কীভাবে শীতল পাটির বাজারজাত বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে শিল্পটাকে ধরে রাখে। তাই তরুণদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।