নিজস্ব প্রতিবেদক : ছয় মাসের ব্যবধানে ফের অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে। গতকাল সোমবার রাত সোয়া ৪টার দিকে আগুন লাগার পর প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিসের দেড় ডজন ইউনিট। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (ঢাকা) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে বস্তির প্রায় একশ ঘর পুড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সংখ্যা বাড়াতে পারে।’
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ‘১৮টি ইউনিট প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল পৌনে ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।’
বনানী থানার ওসি নূরে আজম বলেন, এই বস্তিতে হাজারখানেকের বেশি ঘর আছে। ‘আগুন লাগার পর প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট কাজ শুরু করে। পরে আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে আরও বাড়ানো হয় ইউনিটের সংখ্যা।’
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা দেবাশীষ বর্ধন জানান, কিভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে।
‘এখানে অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুতের লাইন আছে, গ্যাসের সিলিন্ডার আছে, দোকান আছে। কিভাবে এবং কোথা থেকে আগুন লেগেছে তা অনুসন্ধানে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে জানান তিনি। সবশেষ গতবছর ২৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ভয়াবহ আগুনে এই বস্তির প্রায় আড়াই শতাধিক ঘর পুড়ে গিয়েছিল। ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালেও আগুনে পুড়েছিল সাততলা বস্তি। মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে ৫০ একর জমি বেহাত হয়েছিল, তার বড় অংশ জুড়ে এই সাততলা বস্তি। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ৮ একর জমি দখল করে সাততলা বস্তি গড়ে উঠেছে। হাসপাতালের দুই পাশ ঘিরে বস্তির অবস্থান।
নিজের ঘরটাও চিনতে পারছেন না অনেকে : আগুনে পুড়ে গেছে মহাখালীর সাততলা বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক রফিকুল ইসলামের ভাড়া করা ঘর। যে ঘরে ছিল একখানা খাট, একটি টিভি, একটি ফ্রিজসহ সংসারের আরও অনেক কিছু। আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল, তখন চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে পড়েন রফিকুল। একমুহূর্ত দেরি না করে দুই ছেলে সুমন আর সজীব এবং স্ত্রীকে নিয়ে দৌড়ে চলে যান রাস্তায়। ঘণ্টা তিনেক পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে ঘরের সামনে আসেন রফিকুল। ততক্ষণে সব পুড়ে ছাই।
দিনের পর দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকায় সাজানো ঘর হারিয়ে রফিকুল এখন নির্বাক। কোথায় থাকবেন, সন্তানদের মুখে কীভাবে খাবার তুলে দেবেন, এমন সব চিন্তা তাঁকে ঘিরে ধরেছে। ঘরে নগদ পাঁচ হাজার টাকা ছিল। তা-ও পুড়ে ছাই। হাতে একটি পয়সা না থাকায় কিছুই ভাবতে পারছেন না রংপুরের রফিকুল। রফিকুল বলেন, ‘আমার ঘরের একটা জিনিসও নিতে পারিনি। গায়ে একটা গেঞ্জি ছিল। সে অবস্থায় বেরিয়ে গেছি। আমি রিসকা চালাই। রিসকা চালিয়ে যা জিনিস কিনছিলাম, সব পোড়া শেষ।’
কেবল রফিকুল নয়, তাঁর মতো সাততলা বস্তির আরও বহু মানুষ তিন ঘণ্টার ব্যবধানে পথে বসে গেছেন। মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুন লাগে গতকাল সোমবার ভোররাত ৪টায়। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে সাতটার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে কেউ মারা না গেলেও পুড়েছে কয়েক শ ঘর। ভোররাতে আগুন থেকে বাঁচতে যে যেভাবে পেরেছেন ঘর ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আবার যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, তখন ছুটে আসেন নিজের ঘরটি কী অবস্থায় আছে তা দেখতে। আগুনে এতটাই পুড়েছে যে অনেকে তাঁর নিজের ঘরও চিনতে পারছিলেন না। সেখানে ছিল শুধু আহাজারি।
গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শহিদুল ইসলাম নিজের ঘরে এসে দেখেন, সব পুড়ে গেছে। ঘরে ছিল স্ত্রীর কানের দুল, হাতের বালা। পোড়া ঘরের জিনিসপত্রের ভেতর সেগুলো খুঁজছিলেন। হঠাৎ করে তাঁর চোখ যায় পোষা পাখির খাঁচার দিকে। আগুন লাগলে নিজেরা বের হয়ে গেলেও পাখির কথা ভুলে গিয়েছিলেন। শহিদুল দেখতে পান, পাখি দুটি আগুনে পুড়ে গেছে। সালমা খাতুন নামের এক নারী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের সবকিছু তো আগুনে পুড়ে গেছে। অবলা পাখি দুটিও মারা গেল।’
ছাইয়ের ভেতর পয়সা খুঁজে ফেরা : পোশাককর্মী নাসরিন কল্পনাও করেননি, অনেক কষ্ট করে জমানো ১৫ হাজার টাকা মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সোমবার ভোরের আগুনে নাসরিনের ১৫ হাজার টাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সময়ের ব্যবধানে আগুন যখন নিয়ন্ত্রণে আসে, তখন নাসরিন ফিরে আসেন তাঁর ঘরে। দেখেন, ঘরের সবকিছু পুড়ে গেছে। তবু নাসরিন ছাইয়ের মধ্যে পয়সা খুঁজতে থাকেন। নাসরিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘টাকা কন, পয়সা কন, সব পুড়ে গেছে। শুধু গায়ের কাপড়টুকু পোড়া বাকি আছে। সংসার করতি যা লাগে, তার সবই আমাদের ছিল। কিন্তু এখন কিছুই নেই। আমাদের এমন কোনো পরিস্থিতি নেই যে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াব।’ নাসরিনের মতো আরও বহু নারী পোড়া ঘর দেখে কাঁদতে থাকেন। মুহূর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার বেদনা তাঁদের চোখে-মুখে। বস্তির নি¤œ আয়ের এসব মানুষের বেশির ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে যুক্ত। কেউ রিকশা চালান, কেউবা হকারি করেন। পুরুষের পাশাপাশি বেশির ভাগ নারী গৃহকর্মীর কাজে যুক্ত।
ফেন্সি খাতুন নামের এক নারী বলেন, ‘আমার স্বামী গেছিল কাজে। এহলা (একলা) এহলা (একলা) তো আর মালসামানা (মালামাল) নিয়ে যাবার পারিনি। আবার আমার ঠ্যাং ভাঙা। দুনিয়ার জিনিস ছিল ঘরে। মানসের বাসায় কাজ করে এসব জিনিস কিনেছিলাম। রাতেরে রাত কইছি না, দিনেরে দিন কইছি না। এই জিনিসগুলো আমি কষ্ট করে করছি।’ সংসারের সব জিনিসপত্র পুড়ে যাওয়ায় সাততলা বস্তির শত শত মানুষ মুহূর্তের মধ্যে পথে বসে গেছেন। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এসব মানুষ সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। আগুনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া লিটন মিয়া বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের দিকে একটু তাকাই, তাহলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াইতে পারমু। আমরা সরকারের একটু সহযোগিতা চাই।’
বস্তিবাসীর জন্য বহুতল ভবনের কাজ চলছে : মেয়র আতিক : ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, কড়াইল বস্তিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে বাসিন্দাদের বসবাসের উপযোগী করা হবে। ক্রমান্বয় রাজধানীর সব বস্তিতে এইভাবে ভবন নির্মাণ করা হবে। এটা ছাড়া আগুনসহ অন্যান্য দুর্যোগ থেকে বস্তিবাসীকে স্থায়ীভাবে বাঁচানো যাবে না। বস্তির বাসিন্দারা এখনো ভাড়া দিয়ে থাকে। তারা যদি একই টাকায় একটি বহুতল ফ্ল্যাটে থাকতে পারে, তাহলে তাদের জীবনমানও উন্নত হবে। বস্তিবাসী আমাদের এই শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
গতকাল সোমবার বেলা ১টায় মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুনের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে এসে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। মেয়র বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনিও নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী বুধবার আমি আইসিটি মন্ত্রণালয়সহ তিনটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসব। ভবনগুলো কেমন হবে, পরিবেশ কেমন হবে, এসব নিয়ে কথা বলব। আশা করছি শিগগিরই একটি সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। মিরপুরের রূপনগরের বস্তিবাসীর জন্য বাউনিয়াবাদ প্রজেক্ট স্থানান্তরের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে বলেও জানান মেয়র। মেয়র বলেন, রূপনগরর বস্তিতে ৭৮০টি পরিবার রয়েছে। তাদেরও নেয়া হবে। গাবতলিতে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।
সাততলা বস্তিবাসীকে ৫ হাজার করে টাকা দেবে ডিএনসিসি : সাততলা বস্তিতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পাঁচ হাজার করে নগদ টাকা, টিন, শুকনা খাবার এবং প্রতি বেলায় ভারি খাবার রান্না করে দেয়া হবে বলে জানান মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগুন লাগার পরপরই ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও অন্যান্যদের সঙ্গে আমার কথা হয়। আগুন লাগার পরে আমাদের করনীয় কী? এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তা সম্ভব নয়। কীভাবে আমাদের এখন ধাপে ধাপে কাজগুলো করতে হবে সেটিই আমাদের দায়িত্ব। উত্তরা একটি খালের কাজ চলছিল এবং অনেক জটলা ছিল এ কারণে এখানে আসতে দেরি হয়েছে। তবে সার্বক্ষণিক দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ডিএনসিসি মেয়র বলেন, আমি পুড়ে যাওয়া বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলেছি। আপাতত তাদের ঘরের জন্য টিন দিতে হবে এবং এই মুহূর্তে খাদ্য লাগবে। ইতোমধ্যে কাউন্সিলর খাবার রান্নার কাজ শুরু করেছেন। প্রতিটি পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দুপুর থেকে খাবার চালু হবে এবং রাতেও বস্তিবাসীকে খাওয়ানো হবে। যতক্ষণ ত্রাণ না এসে পৌঁছাবে ততক্ষণ খাবার বিতরণ করা হবে। এছাড়াও শুকনা খাবার প্যাকেট বিতরণ করা হবে। একটি মানুষও অভুক্ত থাকবে না।
ভোর রাতে পুড়লো সাততলা বস্তি
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ