ঢাকা ০৪:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদেশিদের ভালোবাসা

  • আপডেট সময় : ০৯:৫৪:১১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ মার্চ ২০২২
  • ১১৬ বার পড়া হয়েছে

মো. জাকির হোসেন : গোপালগঞ্জের নিভৃত পল্লি টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া মুজিব এক ভুবনমোহিনী নাম। ব্রিটিশ সাংবাদিকের ভাষায় ‘মুজিব এক সম্মোহনী শক্তি’। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ‘শেখ মুজিব এক অলৌকিক ব্যক্তিত্ব’। বঙ্গবন্ধুর ভরাট কণ্ঠস্বর, বক্তব্যের প্রকাশভঙ্গি, শারীরিক উচ্চতা ও সুদর্শন চেহারা, দৃঢ়তা, অমিত সাহসিকতা, মানুষের প্রতি অতল ভালোবাসা– সবকিছুই তাকে অতি আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রনায়ক-সরকার প্রধানরা বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেতে ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবর পাওয়া মাত্র অবকাশযাপনে থাকা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ সব কর্মসূচি বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমান ‘কমেট’-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। বঙ্গবন্ধু রাশিয়া সফরে গেলে পরাশক্তিধর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী সব প্রটোকল ভেঙে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে একসঙ্গে বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন।

ফিলিপাইনের প্রয়াত শাসক মার্কোস বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাই যথার্থভাবেই বলেছেন ‘বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা ইতিহাসের চরিত্র আর বঙ্গবন্ধু নিজেই ইতিহাসের স্রষ্টা, নিয়ন্ত্রক’। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমায় মুগ্ধ ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন এভাবে– ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতা হিমালয়ের মতো। তাঁকে দেখার পর আমার সেরকম অভিজ্ঞতাই হয়েছে’। ভুটানের অভিজ্ঞ কূটনীতিক মেজর জেনারেল ভেতসপ নামগিয়েল বলেন, ‘গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন একজন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বা দূতাবাস স্থাপনের ক্ষেত্রে (স্বীকৃতি নয়) ভুটান ছিল দ্বিতীয় দেশ, ভারতের পরই। সেটা হওয়ার পর আমাদের রাজা যখন ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরে গেলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বৈঠকের সময় আমারও উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। অবশ্যই তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারিনি, তবে তার প্রতিটি কথা মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। এরপর সারা জীবনে বহু রাষ্ট্রপ্রধানকে, বহু দেশনায়ককে কাছ থেকে দেখেছি। কিন্তু ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব আজও আমার মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে, আজও সেই অভিজ্ঞতা ভুলতে পারিনি। শেখ মুজিবুর রহমান আজ এত বছর পরেও আমায় অভিভূত, আপ্লুত করে রেখেছেন।’

বাংলাদেশে আগত ফ্রান্সের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড. ডুভুশেলে। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে বিদায়ী ভাষণে ড. ডুভুশেলে বলেছিলেন, ‘যে যুদ্ধে বাংলাদেশের নিশ্চিত পরাজয় ধরে ইউরোপ-আমেরিকার রাজধানীগুলো ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডির দিন গুনছিল, সেই যুদ্ধে এই জাতি বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করে ইউরোপ-আমেরিকার রাজধানীগুলোর হিসাব-নিকাশ সব উল্টে-পাল্টে দিয়েছে। এই বিস্ময়কর বিজয়ের পশ্চাতে ছিল ‘শেখ মুজিবের জাদুকরী নাম’। বিশ্বে কোনও জাতির মধ্যে এমন কোনও ‘জাদুকরী নাম’ সৃষ্টি হয়নি, যার নাম মুখে নিয়ে, একটি জাতি যুদ্ধ করেছে, যার নাম মুখে নিয়ে ৩০ লাখ মানুষ হাসিমুখে জীবন দিয়েছে এবং এই পৃথিবীতে একটি দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন দেশ সৃষ্টি হয়েছে। ‘শেখ মুজিব’ জাদুকরী নামটি সূর্যের চেয়েও প্রবল, পরাক্রমশালী ও মহাশক্তিশালী ছিল বলে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার মাইল দূরের কারাগারে পাকিস্তানিরা তাঁকে বন্দি করে রেখেও তাঁর নামের রশ্মিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকিয়ে রাখতে পাকিস্তানের পক্ষে আণবিক শক্তিধর দেশগুলো পর্যন্ত সমর্থ হয়নি। সে সময় তাঁর নামের জাদুতে ফরাসি জাতিসহ বিশ্ববাসী বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে। সূর্যের রশ্মি যেমন কালো মেঘের আড়ালে বন্দি রাখা যায় না। তাঁর নামের রশ্মি ৭১ সালে সূর্য রশ্মিকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল।” (সূত্র: মুসা সাদিক, ১৫ই আগস্ট ট্র্যাজেডি ও বঙ্গভবনের অজানা অধ্যায়)।

১৯৮৯ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিঁতেরা বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি বঙ্গভবনে এলে সেখানকার হলরুমের প্রবেশ পথে কয়েকটি ছবি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাঁকে বাংলাদেশের জাতির জনকের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, ““ঊীপবষষবহপু, ঃযরং রং ঃযব ঢ়ড়ৎঃৎধরঃ ড়ভ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ, যব রং ড়ঁৎ সধরহ ষবধফবৎ ড়ভ রহফবঢ়বহফবহপব.” প্রেসিডেন্ট মিঁতেরা তৎক্ষণাৎ তাকে বললেন, “ঋৎবহপয ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ঃযব ড়িৎষফ শহড়ংি ধনড়ঁঃ যরস. ইঁঃ যিু হড়ঃ ুড়ঁ ঢ়ঁঃ ঃযব মৎবধঃ” ধভঃবৎ যরং হধসব? প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিব্রত হয়ে বললেন, “ঊীপবষষবহপু, যিড় রিষষ ৎবপড়মহরুব ঁং?” প্রেসিডেন্ট মিঁতেরা সরাসরি এরশাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডব ৎিরঃব ঃযব মৎবধঃ’ ধভঃবৎ ঃযব হধসব ড়ভ ড়ঁৎ হধঃরড়হধষ যবৎড় ঘধঢ়ড়ষবড়হ ইড়হধঢ়ধৎঃব, ংড় ধষংড় ইৎরঃরংয ৎিরঃব ‘মৎবধঃ’ ধভঃবৎ ঃযব হধসব ড়ভ ছঁববহ ঠরপঃড়ৎরধ. ঝড় ঃযধঃ, ংড় ঃযব এৎববশং ঢ়ঁঃ ‘মৎবধঃ’ ধভঃবৎ ঃযবরৎ ধিৎ যবৎড় অষবীধহফবৎ. ওহফরধহং ধষংড় ৎিরঃব “অশনধৎ ঃযব মৎবধঃ”. ঘড় হধঃরড়হ হববফং ঢ়বৎসরংংরড়হ ঃড় ধফফৎবংং ঃযবরৎ হধঃরড়হধষ যবৎড়বং যিধঃবাবৎ ধিু ঃযবু ষরশব.” (মুসা সাদিক, প্রাগুক্ত)। ইন্দিরা গান্ধীর মতে ‘মুজিব ছিলেন নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক’। পশ্চিমবঙ্গের বিমান বসু বলেছেন, ‘যতদিন প্রতিবাদী মানুষ বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে, ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ইতিহাস হয়ে থাকবে’।

শুধু রাষ্ট্র প্রধান, সরকার প্রধানগণই নন, সাধারণ বিদেশিরাও গভীর মমতায় ভালোবেসেছেন বঙ্গবন্ধুকে। সাবেক রাষ্ট্রদূত এটিএম নজরুল ইসলাম ‘ফরেন সার্ভিসে ৩৫ বছর- টক মিষ্টি ঝাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্যারিসে সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায় দুপুরের খাবার ট্রেতে উঠিয়ে একটি টেবিলে বসলাম। কিছুক্ষণ পর এক সুঠামদেহী ভদ্রলোক এসে একটি চেয়ার টেনে আমার টেবিলে খেতে বসলেন। উজ্জ্বল ফর্সা, মুখে ঘন কালো গোঁফ। আমি ভাবলাম ইউরোপের কোন দেশের নাগরিক হবেন। আমি তাঁকে শুধু হ্যালো (ইড়ঁলড়ঁৎ) বলে খেতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন আমি কোন দেশের নাগরিক। পরিচয় জেনে নিজের পরিচয় দিলেন তিনি তুরস্কের নাগরিক এবং বামপন্থী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের হুলিয়া জারি হয়েছে। তাই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন । এটুকু বলে ভদ্রলোক যে কা-টি করলেন তা আমার আমৃত্যু মনে থাকবে।ফরাসি ভাষায় আমাকে বললেন, তিনি আমার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে ঘৃণাবোধ করেন। আমি হতভম্ব ও বিস্মিত হয়ে এর কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন বাংলাদেশিরা অকৃতজ্ঞ জাতি, স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় যে জাতি তাঁদের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারে সেই জাতি একটা কলঙ্কিত জাতি এবং সে দেশের কারও সঙ্গে বসে খেতে তিনি লজ্জাবোধ করছেন। এটা বলেই তিনি আমার কোনও জবাবের অপেক্ষা না করেই অন্য টেবিলে চলে গেলেন। লজ্জায় আমার মাথা নত হয়ে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম।’

বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জার্মান নেতা হেলমুট স্মিথ। তিনি বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোনও জঘন্য কাজ করতে পারে’। রাষ্ট্রদূত এটিএম নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ বিদেশির গভীর মমত্বের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘দক্ষিণ ইয়েমেনের তিন জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও আমাদের সঙ্গে একই কোর্স (ফরাসি সরকারের বৃত্তিতে ফরাসি ভাষা ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যয়ন) করছিলেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তাঁরা জানালেন, তাদেরই একজন (আলী) বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ শুনে ইয়েমেনের একটি রেস্তোরাঁয় একটি রেডিও (যেটাতে মৃত্যুর সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছিল) আছাড় মেরে ভেঙে টুকরো টুকরো করায় জরিমানা দিতে হয়েছিল। ঘটনার সময় তিনি সেখানে চা নাশতা খাচ্ছিলেন, খবরটি শোনার পর তিনি এতটাই উত্তেজিত হয়েছিলেন যে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। পাকিস্তানি মালিকানার পত্রিকা ‘মর্নিং নিউজ’-এর সম্পাদক এস জি এস বদরুদ্দিন অহর্নিশ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করতেন। আগরতলা মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি দাবি করেছিলেন বদরুদ্দিন। অথচ স্বাধীনতার পর বদরুদ্দিনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বঙ্গবন্ধু বিহারি হিসেবে পরিত্যক্ত বদরুদ্দিনের বাড়ি বিশেষ ব্যবস্থায় বিক্রির ব্যবস্থা করে বিক্রীত অর্থ বিদেশি মুদ্রায় রূপান্তর করে নেপাল হয়ে পাকিস্তান ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসা তাঁর ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পঁচাত্তরের অনেক বছর পর লাহোরে বদরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আল্লাহর শোকর, শেখ সাহেব ফিরে এসেছিলেন। তাই তো বেঁচে আছি। এখনও বহাল তবিয়তে আছি।’ তারপরই মাথা থাবড়াতে থাকলেন, ‘ইয়ে ফেরেশতা কো তোমলোক খুন কিয়া?’

রশীদ হায়দার ‘রেহমান, মুজিবুর রেহমান’ শিরোনামে এক লেখায় বলেছেন– ‘১৯৭৯ সালে নিউ ইয়র্কে আশি বছরের এক বৃদ্ধা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: কোন দেশ থেকে এসেছো? দেশের নাম, মহাদেশের নাম বলেও বৃদ্ধাকে দেশ চেনানো গেলো না, পরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হলে মহিলা স্মৃতি হাতড়িয়ে বললেন: “ঙয! ুবং, ুবং, ও ৎবসবসনবৎ, ও ৎবসবসনবৎ, ণড়ঁৎ মৎবধঃ ষবধফবৎ ধিং জবসধহ, গঁলরনঁৎ জবসধহ.’

বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে শুধু স্বদেশের শত শত শিল্পী-সাহিত্যিকই নয়, অসংখ্য বিদেশি লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক তাঁকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। বিদেশি পত্রপত্রিকা ছাড়াও বিদেশি লেখকদের গল্প, উপন্যাস, কবিতায় বঙ্গবন্ধু উপস্থাপিত হয়েছেন। মার্কিন লেখক রবার্ট পেইনের ‘দ্য টর্চার্ড অ্যান্ড দ্য ডেমড, সালমান রুশদীর ‘মিড নাইট’স চিলড্রেন’ এবং ‘শেইম’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম, জাপানি কবি মাৎসুও শুকাইয়া, গবেষক ড. কাজুও আজুমা, প্রফেসর নারা, মার্কিন কবি লোরি অ্যান ওয়ালশ, জার্মান কবি গিয়ার্ড লুইপকে, বসনিয়ান কবি ইভিকা পিচেস্কি, ব্রিটিশ কবি টেড হিউজের কবিতায় বঙ্গবন্ধু উপজীব্য হয়েছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে আরও যে বিদেশিরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থ, প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখেছেন, স্মৃতিচারণ করেছেন, তাদের মধ্যে আছেন মার্কিন অধ্যাপক স্ট্যানলি উলপার্ট, ব্রিটিশ লেখক-সাংবাদিক মার্ক টালি, মাইকেল বার্নস, মার্কিন লেখক জেমস জে. নোভাক, লরেন্স জারিং, সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস, সাংবাদিক-ঔপন্যাসিক অ্যানি লোপা, ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরোসহ আরও অনেকে।

ভারত ও পাকিস্তানের অগণিত লেখক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা, গান, ছড়া নাটক, সাহিত্য, প্রবন্ধ, ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বনফুল, বুদ্ধদের বসু, অমিয় চক্রবর্তী, অন্নদা শংকর রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রাজলক্ষ্মী দেবী, মনীষ ঘটক, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, বিমল চন্দ্র ঘোষ, দীনেশ দাস, দক্ষিণা রঞ্জন বসু, করুণা রঞ্জন ভট্টাচার্য, অমিয় মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র কুমার গুপ্ত, নলিনীকান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মল আচার্য, বিভূতি বেরা, অমিত বসু, শান্তিময় মুখোপাধ্যায়, শান্তিকুমার ঘোষ, গোলাম রসুল, অমিতাভ দাশগুপ্ত, তরুণ সান্যাল, দেবেশ রায়, গৌরী ঘটক, রাম বসু, তারাপদ রায়, মনীন্দ্র রায়, বিনোদ বেরা, অমিতাভ চৌধুরী, অমরেন্দ্র কুমার ঘোষ, অমিতাভ গুপ্ত, মনোজ দত্ত, কালাহান, কৃত্তিবাস ওঝা, নিরঞ্জন মজুমদার, পরেশ সাহা, শ্যামল বসু, এ. এল খতিব, আই. এল. তিওয়ারী, অতিন্দ্র ভাটনগর, মৃণাল কর, এলাংবম নীলকান্ত, রাম প্রসাদ দত্ত, ভারতের উর্দু কবি কাইফি আজমি, পাকিস্তানি কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও কবি আহমেদ সালিম। দেশ ছাড়াও বিদেশের অনেক গীতিকার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লিখেছেন, সুরকার সুর দিয়েছেন, শিল্পীরা কণ্ঠ দিয়েছেন এবং চিত্রশিল্পীরা ছবি এঁকেছেন।

বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক ক্ষণজন্মা পুরুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের স্বীকৃতি ও ভালোবাসা অনন্য। আমেরিকার বিখ্যাত সাময়িকী নিউজউইক বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি (পোয়েট অব পলিটিকস) বলে আখ্যায়িত করেছে। দ্য টাইমসের মতে, ‘তিনি এক মহান ব্যক্তিত্ব। শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এজন্য যে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনও বাস্তবে রূপলাভ করতে পারতো না।’ আর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের স্পষ্ট উচ্চারণ, ‘মুজিব যদি না থাকতেন বাংলাদেশ জন্ম হতো না।’ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরদিন ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমা অনুষ্ঠানে মন্তব্য করা হয়, ‘যীশু নিহত হয়েছিলেন। এখন কোটি কোটি মানুষ ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করেন। মুজিবও হয়তো একদিন তাই হবে।’ ১৯৭৫-এর ২৮ আগস্ট বিবিসি টেলিভিশনের সাংবাদিক ব্রায়ান বারন আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমার অনুরূপ এক সংবাদ বিবরণীতে লেখেন, ‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তাঁর বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্ন এবং কবরস্থান পুণ্যতীর্থে পরিণত হবে।’
বঙ্গবন্ধুকে বাঙালিরা ভালোবেসেছে হৃদয় উজাড় করে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির কাছে নেতা নয়, পরম আত্মীয় ছিলেন। তাই তো বাঙালি বঙ্গবন্ধুর কল্যাণ কামনা করে রোজা রেখেছে, নামাজ পড়েছে, পূজা-প্রার্থনা করেছে। ইতিহাস বিমুখ, বীরত্ব বিস্মৃত বাঙালি জাতি আজও বঙ্গবন্ধুকে ‘শেখ মুজিব দ্য গ্রেট’ অভিধায় আখ্যায়িত করতে পারেনি। কিন্তু বিশ্ববাসীর হৃদয়ের আসনে বঙ্গবন্ধু ‘শেখ মুজিব দ্য গ্রেট’। ‘জ্যোতির্ময় শেখ মুজিব’ তাঁর নামের জ্যোতিতে বিশ্বকে উদ্ভাসিত করে মানবতার পথ প্রদর্শক নক্ষত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বিশ্ববাসী তাই বঙ্গবন্ধুকে গভীর মমতায় আলিঙ্গন করেছে, অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন । লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদেশিদের ভালোবাসা

আপডেট সময় : ০৯:৫৪:১১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ মার্চ ২০২২

মো. জাকির হোসেন : গোপালগঞ্জের নিভৃত পল্লি টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া মুজিব এক ভুবনমোহিনী নাম। ব্রিটিশ সাংবাদিকের ভাষায় ‘মুজিব এক সম্মোহনী শক্তি’। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ‘শেখ মুজিব এক অলৌকিক ব্যক্তিত্ব’। বঙ্গবন্ধুর ভরাট কণ্ঠস্বর, বক্তব্যের প্রকাশভঙ্গি, শারীরিক উচ্চতা ও সুদর্শন চেহারা, দৃঢ়তা, অমিত সাহসিকতা, মানুষের প্রতি অতল ভালোবাসা– সবকিছুই তাকে অতি আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রনায়ক-সরকার প্রধানরা বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেতে ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবর পাওয়া মাত্র অবকাশযাপনে থাকা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ সব কর্মসূচি বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমান ‘কমেট’-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। বঙ্গবন্ধু রাশিয়া সফরে গেলে পরাশক্তিধর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী সব প্রটোকল ভেঙে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে একসঙ্গে বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন।

ফিলিপাইনের প্রয়াত শাসক মার্কোস বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাই যথার্থভাবেই বলেছেন ‘বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা ইতিহাসের চরিত্র আর বঙ্গবন্ধু নিজেই ইতিহাসের স্রষ্টা, নিয়ন্ত্রক’। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমায় মুগ্ধ ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন এভাবে– ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতা হিমালয়ের মতো। তাঁকে দেখার পর আমার সেরকম অভিজ্ঞতাই হয়েছে’। ভুটানের অভিজ্ঞ কূটনীতিক মেজর জেনারেল ভেতসপ নামগিয়েল বলেন, ‘গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন একজন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বা দূতাবাস স্থাপনের ক্ষেত্রে (স্বীকৃতি নয়) ভুটান ছিল দ্বিতীয় দেশ, ভারতের পরই। সেটা হওয়ার পর আমাদের রাজা যখন ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরে গেলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বৈঠকের সময় আমারও উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। অবশ্যই তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারিনি, তবে তার প্রতিটি কথা মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। এরপর সারা জীবনে বহু রাষ্ট্রপ্রধানকে, বহু দেশনায়ককে কাছ থেকে দেখেছি। কিন্তু ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব আজও আমার মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে, আজও সেই অভিজ্ঞতা ভুলতে পারিনি। শেখ মুজিবুর রহমান আজ এত বছর পরেও আমায় অভিভূত, আপ্লুত করে রেখেছেন।’

বাংলাদেশে আগত ফ্রান্সের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড. ডুভুশেলে। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে বিদায়ী ভাষণে ড. ডুভুশেলে বলেছিলেন, ‘যে যুদ্ধে বাংলাদেশের নিশ্চিত পরাজয় ধরে ইউরোপ-আমেরিকার রাজধানীগুলো ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডির দিন গুনছিল, সেই যুদ্ধে এই জাতি বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করে ইউরোপ-আমেরিকার রাজধানীগুলোর হিসাব-নিকাশ সব উল্টে-পাল্টে দিয়েছে। এই বিস্ময়কর বিজয়ের পশ্চাতে ছিল ‘শেখ মুজিবের জাদুকরী নাম’। বিশ্বে কোনও জাতির মধ্যে এমন কোনও ‘জাদুকরী নাম’ সৃষ্টি হয়নি, যার নাম মুখে নিয়ে, একটি জাতি যুদ্ধ করেছে, যার নাম মুখে নিয়ে ৩০ লাখ মানুষ হাসিমুখে জীবন দিয়েছে এবং এই পৃথিবীতে একটি দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন দেশ সৃষ্টি হয়েছে। ‘শেখ মুজিব’ জাদুকরী নামটি সূর্যের চেয়েও প্রবল, পরাক্রমশালী ও মহাশক্তিশালী ছিল বলে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার মাইল দূরের কারাগারে পাকিস্তানিরা তাঁকে বন্দি করে রেখেও তাঁর নামের রশ্মিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকিয়ে রাখতে পাকিস্তানের পক্ষে আণবিক শক্তিধর দেশগুলো পর্যন্ত সমর্থ হয়নি। সে সময় তাঁর নামের জাদুতে ফরাসি জাতিসহ বিশ্ববাসী বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে। সূর্যের রশ্মি যেমন কালো মেঘের আড়ালে বন্দি রাখা যায় না। তাঁর নামের রশ্মি ৭১ সালে সূর্য রশ্মিকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল।” (সূত্র: মুসা সাদিক, ১৫ই আগস্ট ট্র্যাজেডি ও বঙ্গভবনের অজানা অধ্যায়)।

১৯৮৯ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিঁতেরা বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি বঙ্গভবনে এলে সেখানকার হলরুমের প্রবেশ পথে কয়েকটি ছবি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাঁকে বাংলাদেশের জাতির জনকের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, ““ঊীপবষষবহপু, ঃযরং রং ঃযব ঢ়ড়ৎঃৎধরঃ ড়ভ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ, যব রং ড়ঁৎ সধরহ ষবধফবৎ ড়ভ রহফবঢ়বহফবহপব.” প্রেসিডেন্ট মিঁতেরা তৎক্ষণাৎ তাকে বললেন, “ঋৎবহপয ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ঃযব ড়িৎষফ শহড়ংি ধনড়ঁঃ যরস. ইঁঃ যিু হড়ঃ ুড়ঁ ঢ়ঁঃ ঃযব মৎবধঃ” ধভঃবৎ যরং হধসব? প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিব্রত হয়ে বললেন, “ঊীপবষষবহপু, যিড় রিষষ ৎবপড়মহরুব ঁং?” প্রেসিডেন্ট মিঁতেরা সরাসরি এরশাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডব ৎিরঃব ঃযব মৎবধঃ’ ধভঃবৎ ঃযব হধসব ড়ভ ড়ঁৎ হধঃরড়হধষ যবৎড় ঘধঢ়ড়ষবড়হ ইড়হধঢ়ধৎঃব, ংড় ধষংড় ইৎরঃরংয ৎিরঃব ‘মৎবধঃ’ ধভঃবৎ ঃযব হধসব ড়ভ ছঁববহ ঠরপঃড়ৎরধ. ঝড় ঃযধঃ, ংড় ঃযব এৎববশং ঢ়ঁঃ ‘মৎবধঃ’ ধভঃবৎ ঃযবরৎ ধিৎ যবৎড় অষবীধহফবৎ. ওহফরধহং ধষংড় ৎিরঃব “অশনধৎ ঃযব মৎবধঃ”. ঘড় হধঃরড়হ হববফং ঢ়বৎসরংংরড়হ ঃড় ধফফৎবংং ঃযবরৎ হধঃরড়হধষ যবৎড়বং যিধঃবাবৎ ধিু ঃযবু ষরশব.” (মুসা সাদিক, প্রাগুক্ত)। ইন্দিরা গান্ধীর মতে ‘মুজিব ছিলেন নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক’। পশ্চিমবঙ্গের বিমান বসু বলেছেন, ‘যতদিন প্রতিবাদী মানুষ বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে, ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ইতিহাস হয়ে থাকবে’।

শুধু রাষ্ট্র প্রধান, সরকার প্রধানগণই নন, সাধারণ বিদেশিরাও গভীর মমতায় ভালোবেসেছেন বঙ্গবন্ধুকে। সাবেক রাষ্ট্রদূত এটিএম নজরুল ইসলাম ‘ফরেন সার্ভিসে ৩৫ বছর- টক মিষ্টি ঝাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্যারিসে সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায় দুপুরের খাবার ট্রেতে উঠিয়ে একটি টেবিলে বসলাম। কিছুক্ষণ পর এক সুঠামদেহী ভদ্রলোক এসে একটি চেয়ার টেনে আমার টেবিলে খেতে বসলেন। উজ্জ্বল ফর্সা, মুখে ঘন কালো গোঁফ। আমি ভাবলাম ইউরোপের কোন দেশের নাগরিক হবেন। আমি তাঁকে শুধু হ্যালো (ইড়ঁলড়ঁৎ) বলে খেতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন আমি কোন দেশের নাগরিক। পরিচয় জেনে নিজের পরিচয় দিলেন তিনি তুরস্কের নাগরিক এবং বামপন্থী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের হুলিয়া জারি হয়েছে। তাই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন । এটুকু বলে ভদ্রলোক যে কা-টি করলেন তা আমার আমৃত্যু মনে থাকবে।ফরাসি ভাষায় আমাকে বললেন, তিনি আমার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে ঘৃণাবোধ করেন। আমি হতভম্ব ও বিস্মিত হয়ে এর কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন বাংলাদেশিরা অকৃতজ্ঞ জাতি, স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় যে জাতি তাঁদের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারে সেই জাতি একটা কলঙ্কিত জাতি এবং সে দেশের কারও সঙ্গে বসে খেতে তিনি লজ্জাবোধ করছেন। এটা বলেই তিনি আমার কোনও জবাবের অপেক্ষা না করেই অন্য টেবিলে চলে গেলেন। লজ্জায় আমার মাথা নত হয়ে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম।’

বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জার্মান নেতা হেলমুট স্মিথ। তিনি বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোনও জঘন্য কাজ করতে পারে’। রাষ্ট্রদূত এটিএম নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ বিদেশির গভীর মমত্বের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘দক্ষিণ ইয়েমেনের তিন জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও আমাদের সঙ্গে একই কোর্স (ফরাসি সরকারের বৃত্তিতে ফরাসি ভাষা ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যয়ন) করছিলেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তাঁরা জানালেন, তাদেরই একজন (আলী) বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ শুনে ইয়েমেনের একটি রেস্তোরাঁয় একটি রেডিও (যেটাতে মৃত্যুর সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছিল) আছাড় মেরে ভেঙে টুকরো টুকরো করায় জরিমানা দিতে হয়েছিল। ঘটনার সময় তিনি সেখানে চা নাশতা খাচ্ছিলেন, খবরটি শোনার পর তিনি এতটাই উত্তেজিত হয়েছিলেন যে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। পাকিস্তানি মালিকানার পত্রিকা ‘মর্নিং নিউজ’-এর সম্পাদক এস জি এস বদরুদ্দিন অহর্নিশ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করতেন। আগরতলা মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি দাবি করেছিলেন বদরুদ্দিন। অথচ স্বাধীনতার পর বদরুদ্দিনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বঙ্গবন্ধু বিহারি হিসেবে পরিত্যক্ত বদরুদ্দিনের বাড়ি বিশেষ ব্যবস্থায় বিক্রির ব্যবস্থা করে বিক্রীত অর্থ বিদেশি মুদ্রায় রূপান্তর করে নেপাল হয়ে পাকিস্তান ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসা তাঁর ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পঁচাত্তরের অনেক বছর পর লাহোরে বদরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আল্লাহর শোকর, শেখ সাহেব ফিরে এসেছিলেন। তাই তো বেঁচে আছি। এখনও বহাল তবিয়তে আছি।’ তারপরই মাথা থাবড়াতে থাকলেন, ‘ইয়ে ফেরেশতা কো তোমলোক খুন কিয়া?’

রশীদ হায়দার ‘রেহমান, মুজিবুর রেহমান’ শিরোনামে এক লেখায় বলেছেন– ‘১৯৭৯ সালে নিউ ইয়র্কে আশি বছরের এক বৃদ্ধা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: কোন দেশ থেকে এসেছো? দেশের নাম, মহাদেশের নাম বলেও বৃদ্ধাকে দেশ চেনানো গেলো না, পরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হলে মহিলা স্মৃতি হাতড়িয়ে বললেন: “ঙয! ুবং, ুবং, ও ৎবসবসনবৎ, ও ৎবসবসনবৎ, ণড়ঁৎ মৎবধঃ ষবধফবৎ ধিং জবসধহ, গঁলরনঁৎ জবসধহ.’

বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে শুধু স্বদেশের শত শত শিল্পী-সাহিত্যিকই নয়, অসংখ্য বিদেশি লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক তাঁকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। বিদেশি পত্রপত্রিকা ছাড়াও বিদেশি লেখকদের গল্প, উপন্যাস, কবিতায় বঙ্গবন্ধু উপস্থাপিত হয়েছেন। মার্কিন লেখক রবার্ট পেইনের ‘দ্য টর্চার্ড অ্যান্ড দ্য ডেমড, সালমান রুশদীর ‘মিড নাইট’স চিলড্রেন’ এবং ‘শেইম’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম, জাপানি কবি মাৎসুও শুকাইয়া, গবেষক ড. কাজুও আজুমা, প্রফেসর নারা, মার্কিন কবি লোরি অ্যান ওয়ালশ, জার্মান কবি গিয়ার্ড লুইপকে, বসনিয়ান কবি ইভিকা পিচেস্কি, ব্রিটিশ কবি টেড হিউজের কবিতায় বঙ্গবন্ধু উপজীব্য হয়েছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে আরও যে বিদেশিরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থ, প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখেছেন, স্মৃতিচারণ করেছেন, তাদের মধ্যে আছেন মার্কিন অধ্যাপক স্ট্যানলি উলপার্ট, ব্রিটিশ লেখক-সাংবাদিক মার্ক টালি, মাইকেল বার্নস, মার্কিন লেখক জেমস জে. নোভাক, লরেন্স জারিং, সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস, সাংবাদিক-ঔপন্যাসিক অ্যানি লোপা, ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরোসহ আরও অনেকে।

ভারত ও পাকিস্তানের অগণিত লেখক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা, গান, ছড়া নাটক, সাহিত্য, প্রবন্ধ, ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বনফুল, বুদ্ধদের বসু, অমিয় চক্রবর্তী, অন্নদা শংকর রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রাজলক্ষ্মী দেবী, মনীষ ঘটক, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, বিমল চন্দ্র ঘোষ, দীনেশ দাস, দক্ষিণা রঞ্জন বসু, করুণা রঞ্জন ভট্টাচার্য, অমিয় মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র কুমার গুপ্ত, নলিনীকান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মল আচার্য, বিভূতি বেরা, অমিত বসু, শান্তিময় মুখোপাধ্যায়, শান্তিকুমার ঘোষ, গোলাম রসুল, অমিতাভ দাশগুপ্ত, তরুণ সান্যাল, দেবেশ রায়, গৌরী ঘটক, রাম বসু, তারাপদ রায়, মনীন্দ্র রায়, বিনোদ বেরা, অমিতাভ চৌধুরী, অমরেন্দ্র কুমার ঘোষ, অমিতাভ গুপ্ত, মনোজ দত্ত, কালাহান, কৃত্তিবাস ওঝা, নিরঞ্জন মজুমদার, পরেশ সাহা, শ্যামল বসু, এ. এল খতিব, আই. এল. তিওয়ারী, অতিন্দ্র ভাটনগর, মৃণাল কর, এলাংবম নীলকান্ত, রাম প্রসাদ দত্ত, ভারতের উর্দু কবি কাইফি আজমি, পাকিস্তানি কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও কবি আহমেদ সালিম। দেশ ছাড়াও বিদেশের অনেক গীতিকার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লিখেছেন, সুরকার সুর দিয়েছেন, শিল্পীরা কণ্ঠ দিয়েছেন এবং চিত্রশিল্পীরা ছবি এঁকেছেন।

বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক ক্ষণজন্মা পুরুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের স্বীকৃতি ও ভালোবাসা অনন্য। আমেরিকার বিখ্যাত সাময়িকী নিউজউইক বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি (পোয়েট অব পলিটিকস) বলে আখ্যায়িত করেছে। দ্য টাইমসের মতে, ‘তিনি এক মহান ব্যক্তিত্ব। শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এজন্য যে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনও বাস্তবে রূপলাভ করতে পারতো না।’ আর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের স্পষ্ট উচ্চারণ, ‘মুজিব যদি না থাকতেন বাংলাদেশ জন্ম হতো না।’ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরদিন ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমা অনুষ্ঠানে মন্তব্য করা হয়, ‘যীশু নিহত হয়েছিলেন। এখন কোটি কোটি মানুষ ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করেন। মুজিবও হয়তো একদিন তাই হবে।’ ১৯৭৫-এর ২৮ আগস্ট বিবিসি টেলিভিশনের সাংবাদিক ব্রায়ান বারন আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমার অনুরূপ এক সংবাদ বিবরণীতে লেখেন, ‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তাঁর বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্ন এবং কবরস্থান পুণ্যতীর্থে পরিণত হবে।’
বঙ্গবন্ধুকে বাঙালিরা ভালোবেসেছে হৃদয় উজাড় করে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির কাছে নেতা নয়, পরম আত্মীয় ছিলেন। তাই তো বাঙালি বঙ্গবন্ধুর কল্যাণ কামনা করে রোজা রেখেছে, নামাজ পড়েছে, পূজা-প্রার্থনা করেছে। ইতিহাস বিমুখ, বীরত্ব বিস্মৃত বাঙালি জাতি আজও বঙ্গবন্ধুকে ‘শেখ মুজিব দ্য গ্রেট’ অভিধায় আখ্যায়িত করতে পারেনি। কিন্তু বিশ্ববাসীর হৃদয়ের আসনে বঙ্গবন্ধু ‘শেখ মুজিব দ্য গ্রেট’। ‘জ্যোতির্ময় শেখ মুজিব’ তাঁর নামের জ্যোতিতে বিশ্বকে উদ্ভাসিত করে মানবতার পথ প্রদর্শক নক্ষত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বিশ্ববাসী তাই বঙ্গবন্ধুকে গভীর মমতায় আলিঙ্গন করেছে, অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন । লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।