এম এম খালেকুজ্জামান : ঞযব যঁহমবৎ ড়ভ যবধৎঃ ধহফ ঃযব ভধসরহব ড়ভ নৎধরহ রং ংঃরষষ ঃযবৎব- হৃদয়ের ক্ষুধা আর চিন্তার দুর্ভিক্ষ মেটাতে বইমেলা হতে পারে উপযুক্ত দাওয়াই। কমার্শিয়াল রোড শো ট্রেড ফেয়ার আর সিনেপ্লেক্সের শহরে বইমেলা এখনো কিছু সংবেদী মানুষের মন মননের খোরাক।সাংবাৎসরিক অপেক্ষা নিয়ে বইমেলার অপেক্ষায় থাকেন অনেকে। সাদা জমিনে কালো নক্ষত্র ফুটে থাকা দুই মলাটের বইয়ের ইতিহাস সুপ্রাচীন নয়। ভারত-ইতিহাসের প্রেক্ষিতে পুঁথির ধারাবাহিকতায় বই উপনিবেশেরই এক অবদান। বই প্রযুক্তির ফসল আবার প্রযুক্তির নানা বিকল্পের উপস্থিতিতে বইয়ের ভবিষ্যত উজ্জল নয়। উমবার্তো একো গত শতকের শেষের দিকে বইয়ের ভবিষ্যত নিয়ে বলতে গিয়ে পাঁচটি প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন এর একটিই কেবল ছাপা বই নিয়ে, বাকি চারটি বইয়ের বিকল্প নিয়ে। আমাদের দেশেও বই নিয়ে আমাদের আলোচনা নিতান্তই মেলাকেন্দ্রিক।
দুই তরুণ প্রকাশক আয়োজনের অপেশাদারসুলভ শুরু দেখে সমালোচনা করতে উদ্যত হয়েও থেমে গেলেন- এসব একান্তই নিজেদের ঘরের কথা এই জ্ঞান করে। প্রথম দিন বিচারক (একই সাথে লেখক) বন্ধুর সাথে মেলায় গিয়ে এই অভিজ্ঞতা হলো। হাতুড়ি দিয়ে পেরেক পেটানোর শব্দ প্রথম দিনের চিরায়ত অভিজ্ঞতা মেনেই নিয়েছি কিন্তু প্রথমদিন সন্ধ্যায়ও বই শূন্য বিশাল প্যাভিলিয়ন (কারণ প্রকাশনীটি ব্যবসা বিবেচনায় প্রথম পাঁচের এক), স্তুপাকারে পড়ে থাকা ইট, কাঠ আর আততায়ী পেরেক যেকোনও বই অনুরক্তকে বিরক্ত করবে নিশ্চিত। তাও মানতে হবে? মেনে নিচ্ছেন সবাই কারণ বইমেলাহীন ফেব্রুয়ারিকে ঠিক ফেব্রুয়ারিই মনে হয় না। মাঝ ফেব্রুয়ারিতে এসে তাও যা ভাষার মাস বলে ঠাওর করা যায় এই মেলার কারণেই। গত দশকের প্রায় পুরোটাই বাংলা একাডেমির ছোট প্রাঙ্গণে ঠাসাঠাসি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে মেলা উল্টো পাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেলে প্রথম দিকে অস্বস্তি থাকলেও, পরে মেলার পরিসর বাড়ে। মেলার পরিসর বাড়লেও এর নান্দনিকতায় ঘাটতি রয়ে গেছে। স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের দেশীয় উপকরণে পরিবেশসম্মত নান্দনিক পরিবেশনা বইমেলার সৌন্দর্যে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিল। এবারের মেলায় নান্দনিকতার ঘাটতি পীড়াদায়ক। উল্লেখ করা দরকার মেলায় শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা উচিত। অনেক শিশু মেলায় আসুক, এদের অনেকেই বই কিনবে, হয়তো কিনবে না অনেকে কিন্তু মেলা নিয়ে আগ্রহ থাকুক। এবারকার মেলা দেখে মনে হয় আমলা-পোষিত কর্তারা নিতান্ত যান্ত্রিক প্রণালীতে ঢালাই করা চেনা ছাঁচে মেলা আয়োজন করেছেন। অথচ স্বাধীনতার পঞ্চাশ পূর্তি করে ভাষা আন্দোলনের বায়ান্নোর ৭০ পূর্তির এক মহার্ঘ্য উপলক্ষ ছিল তথাপি কেন এমন কেঠো প্রাণহীন আয়োজন? আস্তিত্বিক এ জিজ্ঞাসার মীমাংসা সহজ নয়।
এই প্রাণহীন মেট্রোপলিসের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নিজ অস্তিত্বের সম্প্রসারণ হিসেবে মেলা পার্বনগুলোর জন্য অধীর হয়ে থাকেন। বাস্তবিক নানা কারণে ক্রমবর্ধমান পারষ্পারিক সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাবোধ অটল পর্বতের আকার ধারণ করেছে। এই সব নেতির বিপরীতে এমন মেলা ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দেয়। জন্ম থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বেড়ে ওঠার পরিক্রমা অনন্যসাধারণ এক যাত্রার গল্প। কারও কাছে এই গল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিস্ময় বা সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি আর বহু মানুষের যূথবদ্ধতায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র তৈরির প্রচেষ্টা আবার কেউ খারিজ করে দিতে চায় কতটা টেকসই সেই প্রশ্ন তুলে। সব মিলে এক প্যারাডক্স সঙ্গী করে বাংলাদেশ যাত্রা।দেশের অনেক কিছুই বিশ্বমানের হয়েছে তবে প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে বইমেলা সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। মহামারীর চোখ রাঙানিতে মাঝ ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় বইমেলা। ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রথম দিন থেকেই প্রকাশক ও মেলায় আসা গ্রন্থানুরাগীরা অভিযোগ করে আসছেন। একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি থামছেই না। ‘ওঠ ছুড়ি, তোর বিয়ে’ ধরনের হুড়োহুড়িতে মেলা আয়োজন যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেলার অগোছালো আর অপেশাদেরি ভাব দেখে সময় প্রকাশন এর ফরিদ আহমেদ আর অন্যপ্রকাশ এর প্রধান নির্বাহী, মাজহারুল ইসলাম, যিনি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতির সহসভাপতি, উভয়েই একটি দৈনিক পত্রিকায় মতামত দিয়েছেন যে- সুষ্ঠুভাবে মেলা করার জন্য একটি ব্যবস্থাপনা সেল থাকা দরকার। সারা বছর তারা পরিকল্পনা করে মেলার মান উন্নয়নের কাজ করবে। একাডেমির প্রধান কাজ গবেষণা করা। তারা মেলায় কী ধরনের বই প্রকাশ হয়, মান কেমন এসব নিয়ে গবেষণার জন্য গবেষক নিয়োগ দিতে পারে। সেসব কিছুই হয় না। মেলার উদ্যোগ শুরু হয় জানুয়ারি থেকে। এক মাসের পরিকল্পনায় এত বড় মেলার আয়োজন কখনোই ভালো হতে পারে না। প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বলেন, “সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে প্রকাশনাশিল্পে আমাদের পেশাদারি মনোভাব এখনো গড়ে ওঠেনি। সম্পাদনা বিষয়টি অনেক প্রকাশনীতেই নেই। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। সরকারের তরফে প্রকাশকদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই, এটা একটা কারণ। তবে বড় কারণ হলো, যারা প্রকাশনা ব্যবসায় আসছেন, এ পেশায় আসার জন্য তাদের অনেকের তেমন প্রস্তুতি নেই। সুসম্পাদিত বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনার আগাগোড়া তো আগে জানতে হবে, শিখতে হবে। সুসম্পাদিত বই প্রকাশের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো জরুরি। আর এ শিল্পের উন্নতিকল্পে সরকারকেও প্রকাশকদের পাশে থাকতে হবে, তাদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। তবেই সুসম্পাদিত, নির্ভুল বইয়ের প্রকাশ নিষ্কণ্টক করা সম্ভব হবে।”
ণবংঃবৎফধু’ং ৎড়ংব বহফঁৎবং রহ রঃং হধসব, বি যড়ষফ বসঢ়ঃু হধসবং- উমবার্তো একো-র ‘দ্য নেইম অব দ্য রোজ’ উপন্যাসে বলা কথাটার মতো, ‘গতকালের গোলাপে কেবল নামটাই রয়ে যায়’, তেমনি আমাদের বই মেলাও কি কেবল (মেলার) ভিড় আয়োজনের উপলক্ষ কিনা, এ আত্মবিশ্লেষণের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
বইমেলা- চিন্তা দুর্ভিক্ষের দাওয়াই
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ