ঢাকা ০২:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শান্তির সৈনিক আইনস্টাইন

  • আপডেট সময় : ১০:৫০:০০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২
  • ১০৯ বার পড়া হয়েছে

স্বপন কুমার গায়েন : বছরব্যাপী গবেষণা, মূল্যায়ণ ও বিচার-বিবেচনার পরে যুক্তরাষ্ট্রের টাইম (ঞরসব) ম্যাগাজিন তার বিশ শতকের শেষ সংখ্যায় (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৯) তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে (১৮৭৯ – ১৯৫৫) “শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব” হিসাবে মনোনীত করে। শতাব্দীর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, গণহত্যাকারী একনায়ক, নাগরিক অধিকার সংগ্রামী, সমরনায়ক, চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, আবিষ্কারক, দার্শনিক, সাহিত্যিক প্রমুখের কমতি ছিলনা। তাই সবচেয়ে প্রভাবশীল ব্যক্তিত্ব নির্বাচন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে “সান্নিধ্যের কুয়াশা” সত্ত্বেও টাইম ম্যাগাজিন শতাব্দীর তিনটি বৃহত্তর মূলভাব (থিম) সনাক্ত করে — স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গণতন্ত্রের বিজয়, প্রতিক্রিয়াশীল কর্তৃত্বের প্রতিরোধ করে নৈতিক শক্তিধারীর নাগরিক অধিকার অর্জন, এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বিস্ফোরণ যা “মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করেছে এবং মুক্ত মন এবং মুক্ত বাজারের শক্তি উন্মুক্ত করে স্বাধীনতার বিজয় সুনিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে।” তবে চূড়ান্ত বিচারে “বিশ শতক সবচেয়ে বেশী স্মরণীয় হবে দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির” জন্য।
আর বিজ্ঞানের আধিপত্যের এই শতাব্দীতে আইনস্টাইন ছিলেন “অগ্রগণ্য বিজ্ঞানী। যুগের সব কষ্টিপাথর- (পারমানবিক) বোমা, মহাবিস্ফোরণ (ইরম ইধহম) তত্ত্ব , কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা এবং ইলেকট্রনিক্স — সবই তাঁর ছাপ বহন করে।” বিজ্ঞানের জগতে তাঁর বিপ্লবাত্মক ও যুগান্তকারী তত্ত্বসমূহ আলোচনা করে; সাহিত্য, দর্শন, চিত্রশিল্প এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্বসমূহের প্রভাব উল্লেখ করে; এবং একজন মানবতন্ত্রী হিসেবে মানবাধিকার, অভিবাসী পুনর্বাসন, যুদ্ধ বিরোধিতা ও শান্তির সন্ধানে তাঁর প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে টাইম ম্যাগাজিন আইনস্টাইনকে “আমাদের যুগের মহত্তম মেধা ও প্রধানতম প্রতিমূর্তি” শিরোপা দিয়ে তাঁর “শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব” মনোনয়নের যথার্থতা প্রতিপাদন করে।
মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে আইনস্টাইন জীবনের শেষ স্বাক্ষর করেছিলেন একটি ইশতেহারে। ইশতেহারের প্রণেতা বর্তমানকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও মানবতাবাদী বার্ট্রান্ড রাসেল। ইশতেহারে এই বলে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল যে, যুদ্ধ ও যুদ্ধের প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্র প্রতিযোগিতা অচিরেই চিরতরে নির্মূল করা না গেলে মানুষ আর তার সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে। আর মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রিয় বন্ধু ও সাহিত্যবিষয়ক নির্বাহক অটো নাথানের সাথে আপেক্ষিক তত্ত্বের জনকের আলোচনার বিষয় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক স্বাধীনতা ও জার্মানির পুনঃঅস্ত্রসজ্জা। উল্লেখ্য জার্মানির এই অস্ত্রসজ্জাকে আইনস্টাইন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথে এক বড় অন্তরায় মনে করতেন। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ (সম্ভবত শ্রেষ্ঠতম) বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের চিন্তা-চেতনায় পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কামনা কত বড় জায়গা জুড়ে ছিল ওপরের দৃষ্টান্ত থেকে তার পরিচয় মিলবে।
খ্যাতি ও প্রভাব
১৯০৫ সালে অহহধষবহ ফবৎ চযুংরশ পত্রিকার সপ্তদশ খন্ডে নতুন দিগন্তের সূচনাকারী তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণাপত্র ২ প্রকাশ করে সুইস প্যাটেন্ট অফিসের এক অজ্ঞাত, অখ্যাত প্যাটেন্ট পরীক্ষক পদার্থবিদ্যার জগতে যে মহাবিস্ফোরণ ঘটালেন, আমূল বদলে দিলেন দেশ (ংঢ়ধপব), কাল (ঃরসব) আর যুগপত্তা (ংরসঁষঃধহবরঃু) সম্বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সব ধ্যানধারণা, তখন থেকেই বিজ্ঞানীমহলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। ১৯১৯ সালে সূর্যগ্রহণের সময় দূরবর্তী নক্ষত্রের আলোর বিসরণ পর্যবেক্ষণ করে যখন আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের (এবহবৎধষ ঞযবড়ৎু ড়ভ জবষধঃরারঃু) পরীক্ষাগত প্রমাণ পাওয়া গেল, তখন ঘটল আরেক মহাবিস্ফোরণ। সে বিস্ফোরণ আইনস্টাইনের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার। রাতারাতি সাধারণ্যে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে ওঠলেন তিনি। সেই থেকে খ্যাতি, প্রশংসা, সম্মান আর শ্রদ্ধা অঝোরে ঝরেছে তাঁর ওপর, বলা যায় তাড়িয়ে ফিরেছে তাঁকে।
আইনস্টাইন অবাক হয়েছেন। তাঁকে ঘিরে সাধারণ মানুষের কৌতূহল বিব্রত করেছে তাঁকে, সবকিছু প্রচ-রকম বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে তাঁর। এসবের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। নিরিবিলি গৃহকোণে বিশ্বপ্রকৃতির আত্যন্তিক রহস্য উন্মোচনে ব্রতী থাকতে চেয়েছেন তিনি। তবে জীবনে “প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান বিষয়” পদার্থবিদ্যার পরে যে ভাবনা তাঁর কাছে প্রাধান্য পেয়েছে সে হচ্ছে পৃথিবী থেকে যুদ্ধের বিভীষিকা চিরতরে নির্মূল করা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা। যে খ্যাতি থেকে আজীবন দূরে থাকতে চেয়েছেন, সেই খ্যাতি এবং খ্যাতির প্রসূন প্রভাবকে তিনি একমাত্র এই উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করেছেন, ব্যক্তিগত কোন প্রয়োজনে নয়। আইনস্টাইন ছিলেন শান্তিকামী। প্রকৃতির মৌল বলগুলির মধ্যে বৃহত্তর কোন ঐক্য রয়েছে, এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে আজীবন সেই ঐক্যের সন্ধান করেছেন তিনি। মহাকর্ষ ও তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রদ্বয়কে সমন্বিত করে “একীকৃত ক্ষেত্রতত্ত্ব” (টহরভরবফ ঋরবষফ ঞযবড়ৎু) আবিষ্কারের সাধনায় জীবনের শেষ দিনগুলি পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তেমনি বৃহত্তর ঐক্যের মধ্যে মানব সমাজের সত্যিকারের শান্তি ও নিরাপত্তা নিহিত মনে করে, সেই ঐক্যসাধনের চেষ্টায়ও সক্রিয় থেকেছেন। ছিয়াত্তর বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি ছিলেন এক অদম্য সাহসী শান্তির সৈনিক। চল্লিশ বছরের ব্যাপ্ত পরিসরে উদ্দেশ্য সাধনের উপায় সম্বন্ধে তার মতামতের পরিবর্তন ঘটেছে, পরিবেশ ও পরিস্থিতি কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর ধারণাকে বদলে দিয়েছে, বিবর্তন এসেছে পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কিত চিন্তাধারায়; কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যে তাঁর প্রত্যয় ছিল সুদৃঢ়, সদা অবিচল।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রত্যয়ের উৎস কোথায়? কোন প্রেরণা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সদা সক্রিয় রেখেছে?
নৃশংসতা ও বর্বরতাকে আইনস্টাইন ঘৃণা করতেন, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন নরহত্যার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু শুধুমাত্র এজন্যই যে তিনি পৃথিবী থেকে চিরতরে যুদ্ধ নির্মূল করার জন্য সংগ্রাম করেছেন তা নয়। আইনস্টাইন মনে করতেন ব্যক্তিমানুষের বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতা (রহঃবষষবপঃঁধষ ভৎববফড়স ড়ভ ঃযব রহফরারফঁধষ) হচ্ছে মানব সমাজ ও সভ্যতার মূল ভিত্তি। আর তাঁর বিশ্বাস ছিল যতদিন পর্যন্ত যুদ্ধ একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিরাজ করবে, ততদিন বুদ্ধিবৃত্তির এই স্বাধীনতা কখনোই নিশ্চিত হতে পারেনা। সামরিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অস্তিত্ব, যুদ্ধ করার মত অসামাজিক কাজের জন্য তরুণ সমাজকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের চিন্তাশক্তিহীন যন্ত্র করে গড়ে তোলা, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও জীবনাচরণের ওপর যুদ্ধাবস্থার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার মারাত্মক কুফল — এসবই আইনস্টাইন মুক্ত মানুষের মর্যাদার প্রতি অবমাননাকর মনে করতেন। তাঁর যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের পিছনে এ চিন্তা সব সময় কাজ করেছে।
তাঁর বিশ্বাস ও মূল্যবোধ
আইনস্টাইনের যুদ্ধবিরোধী ভূমিকাকে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে তাঁর মৌলিক মূল্যবোধ, জীবনদৃষ্টি, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মবিশ্বাস ও সমাজ চেতনার দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। চিন্তা ও চেতনায় আইনস্টাইন ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং মানবতন্ত্রী। তিনি নিজেই বলেছেন, “জন্মসূত্রে আমি একজন ইহুদী, নাগরিকত্বের পরিচয়ে সুইস, বিশ্বাসের দৃঢ়মূলে আমি একজন মানুষ, এবং শুধুমাত্র একজন মানুষ যার কোন রাষ্ট্র বা জাতিসত্তার প্রতি বিশেষ অনুরাগ নেই।” প্রথম যৌবনে “ঘনঘন জায়গা বদল” এবং “সর্বত্র এক অপরিচয়ের অনুভূতি” তাঁর মধ্যে এক সহজাত আন্তর্জাতিকতাবোধ সঞ্চার করেছিল। পদার্থবিদ্যা গবেষণার সার্বজনীন চরিত্র সে অনুভূতিকে আরো সম্প্রসারিত করেছিল। ফলে নিজেকে এক বিশ্ব নাগরিক হিসেবে দেখা, শান্তির প্রয়োজনে জাতীয় সার্বভৌমত্ব আংশিক সংকোচন করে হলেও এক বিশ্ব সরকারের নিয়ন্ত্রাধীনে জাতিতে-জাতিতে বিবাদ মীমাংসার ধারণা তাঁর কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
আইনস্টাইনের পরিণত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম আবর্তিত হয়েছে তিনটি মূলনীতিকে কেন্দ্র করে। প্রথমতঃ তিনি সব ধরণের স্বৈরাচার ও স্বৈরশাসন তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন, এবং বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতন্ত্রে আস্থা রেখেছেন। দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক রাষ্ট্র নয়, সৃজনশীল ব্যক্তিত্বকে তিনি সমাজের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলে গণ্য করতেন। তাই রাষ্ট্রযন্ত্র যখনি ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতা খর্ব করতে চেয়েছে, তখনি তিনি প্রতিবাদ করেছেন। তৃতীয়ত, সামরিক মানসিকতাকে তিনি আধুনিক সমাজে “যুথবদ্ধ মনের” নিকৃষ্টতম একক অভিব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই সামরিক শিক্ষা, বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে নিয়োগ, অস্ত্রসজ্জা, যুদ্ধাবস্থার জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি এবং সামরিক-শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রসারের কঠোর সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছেন তিনি।
সৃজনশীল মানুষের স্বাধীনতা ও মানবকল্যান তাঁর আধ্যাত্মিক ও ধর্মবিশ্বাসকেও প্রভাবিত করেছে। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ধর্মবিরোধী, আইনস্টাইন নাস্তিক ও কমিউনিস্ট ইত্যাকার প্রচারণার জবাবে তাঁর প্রায়শ উদ্ধৃত উক্তি, “আমি স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করি যিনি নিজেকে বিশ্বের নিয়মানুবর্তী ঐকতানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন, এমন ঈশ্বরে নয় যিনি মানবজাতির ভাগ্য এবং কাজ নিয়ে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন” প্রমাণ করে যে দ-দাতা বিধাতার প্রতিকৃতিতে তাঁর সামান্যই আস্থা ছিল। পাপ-পুণ্যের বিচার করে নিজ সৃষ্টিকে শাস্তি বা পুরস্কার দানে নিরত ঈশ্বরের চিত্রকল্পকে তিনি “মানুষের দুর্বলতার প্রতিফলন মাত্র” বলে মনে করতেন।
ক্ষমতাহীনের মর্যাদা নিশ্চিত করা আইনস্টাইনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। ইউরোপে ইহুদীদের প্রতি বৈষম্য এবং প্রান্তিককরণ সে প্রচেষ্টায় এক ব্যক্তিগত মাত্রা যোগ করেছিল। মানুষের সমতায় ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা। আর তাই ধনবাদী সমাজব্যবস্থা সৃষ্ট শ্রেণীবৈষম্যের তিনি ছিলেন তীব্র বিরোধী। শ্রেণী শোষণের কাজ ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যত নিপুণভাবে সম্পন্ন হয়েছে অন্য কোন সমাজ ব্যবস্থায় তা সম্ভব হয়নি। আর এসবই তাঁকে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বিচারে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল।৬ আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন ধনবাদী অর্থনীতি কখনোই সব মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না। বরং সমকালীন সমাজের অনেক কালিমা ও পঙ্কিলতার জন্য তিনি ধনবাদী ব্যবস্থাকে দায়ী মনে করতেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন, “ধনবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন করা হয় মুনাফার জন্য, ব্যবহারের জন্য নয়। যারা কাজ করতে ইচ্ছুক এবং সক্ষম তারা সবসময় কাজ পাবে, তেমন কোন বিধান নেই; [তাই] “বেকারদের একটি বাহিনী” প্রায় সবসময় মজুত থাকে।” ফলশ্রুতি, শ্রমিকের কম বেতন এবং কাজ হারানোর নিত্য আশঙ্কা। ধনবাদী ব্যবস্থার অপরিমিত প্রতিযোগিতায় একদিকে শ্রমশক্তির বিপুল অপচয় হয়, অন্যদিকে ব্যক্তির সামাজিক চেতনা পঙ্গু হয়ে যায়। “ব্যক্তির এই পঙ্গু করে দেয়াকে” আইনস্টাইন পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ মনে করতেন।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ ও অভিশাপ মোচনের একমাত্র উপায় হিসেবে তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা এবং একটি সহযোগী সমাজমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়েছেন। পদ্ধতিগত পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে আইনস্টাইনের সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী অর্জিত হয়নি। মতাদর্শগত কোন গ-ীর মধ্যেও সে দৃষ্টিভঙ্গী সীমিত ছিল না। স্ব-সমাজ ও পরিবেশে বিদ্যমান বৈষম্য, বিভেদ ও অর্থনৈতিক শোষণের ফলে উদ্ভূত মানবিক সমস্যাসমূহের সাথে তাঁর সংবেদনশীল মনের সংঘাত আইনস্টাইনকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী করে তুলেছিল। তিনি মনে করতেন সমাজের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন যা উৎপাদন প্রক্রিয়া ও বন্টন ব্যবস্থার শৃঙ্খলা বিধান করবে এবং মানুষের শ্রমশক্তিকে সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য ব্যবহার করবে। তবে পুরোপুরি পরিকল্পিত অর্থনীতির সম্ভাব্য কুফল “ব্যক্তিমানুষের পূর্ণ দাসত্ব বন্ধন”৬ সম্বন্ধেও তিনি সচেতন ছিলেন।
ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ সম্পর্কে আইনস্টাইন সবসময় শঙ্কিত ছিলেন, তা’ যেকোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ই হোক না কেন। তাই সত্যিকার রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার বলেছেন। অর্থনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারকে তিনি সমাজকল্যাণের পথে এক বড় অন্তরায় মনে করতেন। আর এই অপব্যবহার রোধ করার জন্য সত্যিকারের গণতন্ত্রকে অপরিহার্য মনে করতেন।
কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আর এ দু’য়ে মিলে প্রাধান্য বিস্তারের মোহ যে আগ্রাসী তৎপরতার জন্ম দিতে পারে তার প্রতি প্রবল ভীতি থেকেই আইনস্টাইন সমাজতন্ত্রকে যুদ্ধ বন্ধ করার নিশ্চয়তা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারেনা, অন্যান্য সমাজতন্ত্রীর মত সে বিশ্বাস তাঁর ছিল না। তাঁর আশঙ্কা ছিল ক্ষমতার মোহ পুঁজিবাদী দেশের মত সমাজতান্ত্রিক দেশেও যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। আর তাই এক সমাজতান্ত্রিক বিশ্বেও শান্তির অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসেবে অস্ত্র ও যুদ্ধ নির্মূল করা অবশ্য প্রয়োজন বলে আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন।
বিজ্ঞান গবেষণা ও শান্তির সাধনা
তবে এসব যুক্তির আশ্রয়ে যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিভীষিকা মুক্ত এক শান্তির পৃথিবী প্রতিষ্ঠার জন্য আইনস্টাইনের চিন্তা ও আকুতিকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা বোধহয় সম্ভব নয়। তাঁর এই আকুতি ছিল আভ্যন্তরীণ প্রেরণাসঞ্জাত, অন্তরের জিনিস। আইনস্টাইন নিজেই বলেছেন, তাঁর বিশ্বজনীন শান্তিবাদ বুদ্ধিবৃত্তিগত কোন তত্ত্ব থেকে জন্ম নেয়নি, এর মূল নিহিত ছিল সব ধরনের নৃশংসতা ও ঘৃণার প্রতি তাঁর সুতীব্র বিতৃষ্ণায়। প্রশ্ন জাগে কিভাবে এই বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছিল যা চার দশক ধরে তাঁকে যুদ্ধবিরোধী সংগ্রামে নিয়োজিত রেখেছে, ছিনিয়ে নিয়েছে তাঁর মূল্যবান সময়ের এক উল্লেখযোগ্য অংশ, যে সময় তিনি যেকোন মূল্যে বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত করার পক্ষপাতী ছিলেন। কোন কোন আইনস্টাইন গবেষক ও জীবনীকার প্রশ্ন তুলেছেন, যুদ্ধের প্রতি বিতৃষ্ণার সাথে তাঁর বিজ্ঞান সাধনার কি কোন যোগাযোগ আছে? আরো প্রত্যক্ষ প্রশ্ন তুলেছেন অটো নাথান, এও কি সম্ভব যে তাঁর যুদ্ধবিরোধী মনোভাব তাঁর বিজ্ঞান সাধনা থেকেই জন্ম নিয়েছে, এবং উত্তরোত্তর শক্তি সংগ্রহ করেছে?৭ আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাঁর সাহিত্যবিষয়ক নির্বাহক, অর্থনীতির অধ্যাপক এবং আইনস্টাইন গবেষক নাথান নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দেয়ার চেষ্টা করেছেন, “অসম্ভব নয়” বলে। আর সেই সম্ভাবনা নির্দেশে তাঁর অনুধ্যান এরকম।৭
ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত আইনস্টাইনও ছিলেন প্রকৃতি-পূজারী, প্রকৃতি-প্রেমিক। গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে বারবার তিনি প্রকৃতির দিকে তাকিয়েছেন। প্রকৃতির অসংখ্য, অগণ্য বস্তু ও ঘটনারাজির মধ্যে এক সমন্বয়ের রাগিনী অন্তর্নিহিত রয়েছে অনুভব করেছেন। প্রকৃতির রাজ্যে এই শৃঙ্খলা ও প্রকৃতির নিয়ম-কানুনের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় সম্বন্ধে তাঁর প্রত্যয় এত দৃঢ় ছিল যে স্বয়ং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম পথিকৃত হয়েও কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্তর্নিহিত অনির্দেশ্যতাকে আজীবন অস্বীকার করে গেছেন, বলেছেন “ঈশ্বর সৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলেন না।” সম্ভবত যুদ্ধের ধংস ও তা-বকে তিনি বিশ্বপ্রকৃতির মহান শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী বিবেচনা করেছেন, নরহত্যাকে মনে করেছেন প্রকৃতি নির্ধারিত পথ থেকে বিচ্যুতি। বিজ্ঞানী হিসেবে প্রকৃতির নিয়ম কানুন যিনি সন্ধান করে ফিরেছেন শ্রদ্ধাভরে, এই বিচ্যুতি ঘটানোর চেষ্টা তাঁকে প্রতিবাদী করে তুলেছে। হতে পারে বর্বরতা ও নৃশংসতার প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণার মূলে এই-ই ছিল অন্যতম প্রধান কারণ, যুদ্ধ তথা যুদ্ধের প্রতিষ্ঠানকে চিরতরে নির্মূল করার সংগ্রামের পেছনে এই-ই ছিল তাঁর মূল চালিকা শক্তি। পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি সাধনা করেছেন প্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করার, তাই সম্ভবত তাগিদ অনুভব করেছেন মানুষকে বোঝানোর, তারা যেন প্রকৃতির ইচ্ছাকে বিকৃত না করে, অবজ্ঞা না করে; সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা ও সৃষ্টিশীল পূর্ণতা অর্জনের স্বপক্ষে সংগ্রাম করার। অবশ্য এসব যুক্তিসিদ্ধ অনুমান মাত্র।
শান্তির সৈনিক
আইনস্টাইনের জীবন ও কাজের প্রতি সন্ধানী দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে অনেকটা যেন বদ্ধসংস্কারগ্রস্থের মতই তিনি, তাঁর ভাষায়, “সব উদ্দেশ্যের মধ্যে মহত্ত্বম — মানুষে-মানুষে সদ্ভাব ও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার” জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করে গেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে, কোন ভূমিকায়? মহত্তম সেই উদ্দেশ্য সাধনে আইনস্টাইনের ভূমিকা ছিল বুদ্ধিজীবীর। তাঁর দৃঢ়মূল বিশ্বাস ছিল যে আন্তর্জাতিক সংহতির জন্য সংগ্রাম করা এবং জাতিতে-জাতিতে শত্রুতার মূল কারণসমূহ অনুধাবন ও উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা করা বুদ্ধিজীবীদের এক বাধ্যতামূলক নৈতিক দায়িত্ব।৮ শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি ছিলেন সমকালীন বিশ্বের বিবেক। কি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে তিনি প্রতিষ্ঠিত সে সম্বন্ধে আইনস্টাইন সচেতন ছিলেন। তিনি নিজে কখনো এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি, মনে করতেন এসব তাঁর যথার্থ প্রাপ্য নয়। শ্রদ্ধা ও সম্মানের আধিক্যে বিব্রত বোধ করলেও সময়ে তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে বিজ্ঞানী সমাজে তথা সমগ্র বিশ্বে তাঁর এই অদ্বিতীয় অবস্থান স্বতন্ত্রভাবে ব্যক্তি ও সার্বিকভাবে সমাজের পক্ষে কাজ করার জন্য তাঁকে এক অভূতপূর্ব সুযোগ দিয়েছে। আর এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি পুরোমাত্রায়।
শ্রদ্ধায় নির্মিত সেই পাদপীঠ থেকে শান্তির সপক্ষে যে কোন আন্দোলন, যেকোন প্রয়াসকে তিনি সৎ ও যথার্থ মনে করেছেন, তাকেই আগ্রহের সাথে সহযোগিতা দান করেছেন। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেকোন তরফ থেকেই হোক না কেন, কোন উদ্যোগ তাঁর কাছে আশাপ্রদ মনে হলে তাকে সমর্থন করা, তার পক্ষে দাঁড়ান তিনি নিজের নৈতিক দায়িত্ব মনে করতেন। যেকোন সময়ে, এমনকি যে গবেষণার কাজে নিত্য নিমগ্ন থাকতেন তাকে বিঘিœত করেও তিনি ব্যক্তি বা সমষ্টির স্বার্থে নিজের মূল্যবান সময় ও শ্রম নিয়োগ করেছেন। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাথে দেখা করা, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা, সমস্যা সংক্রান্ত কাগজপত্র অধ্যয়ন, বিবৃতিতে স্বাক্ষরদান, অনেক সময় নিজে বিবৃতি রচনা, আন্দোলনের পক্ষে সহযোগী বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের মতামত গড়ে তোলা ও তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা ইত্যাকার কাজের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ভূমিকা পালন করেছেন। বুদ্ধিজীবীর স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ইহুদী সমস্যা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, সৃষ্টিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য শিক্ষা, নিগ্রোদের অধিকার প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য সাধনে তিনি তাঁর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন। কিন্তু সময় যত অগ্রসর হয়েছে যুদ্ধ নির্মূল করার প্রয়োজনীয়তা আইনস্টাইনের কাছে তত বড় হয়ে উঠেছে। শেষ জীবনে যেন অনেকটা অধৈর্য হয়েই তিনি সে উদ্দেশ্য সাধনে তৎপর হয়েছেন।
মানবতা ও শান্তির সপক্ষে আইনস্টাইনের চার দশকব্যাপী কর্মধারার সংক্ষিপ্ত আলেখ্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে পরবর্তী অধ্যায়সমূহে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

শান্তির সৈনিক আইনস্টাইন

আপডেট সময় : ১০:৫০:০০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২

স্বপন কুমার গায়েন : বছরব্যাপী গবেষণা, মূল্যায়ণ ও বিচার-বিবেচনার পরে যুক্তরাষ্ট্রের টাইম (ঞরসব) ম্যাগাজিন তার বিশ শতকের শেষ সংখ্যায় (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৯) তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে (১৮৭৯ – ১৯৫৫) “শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব” হিসাবে মনোনীত করে। শতাব্দীর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, গণহত্যাকারী একনায়ক, নাগরিক অধিকার সংগ্রামী, সমরনায়ক, চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, আবিষ্কারক, দার্শনিক, সাহিত্যিক প্রমুখের কমতি ছিলনা। তাই সবচেয়ে প্রভাবশীল ব্যক্তিত্ব নির্বাচন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে “সান্নিধ্যের কুয়াশা” সত্ত্বেও টাইম ম্যাগাজিন শতাব্দীর তিনটি বৃহত্তর মূলভাব (থিম) সনাক্ত করে — স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গণতন্ত্রের বিজয়, প্রতিক্রিয়াশীল কর্তৃত্বের প্রতিরোধ করে নৈতিক শক্তিধারীর নাগরিক অধিকার অর্জন, এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বিস্ফোরণ যা “মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করেছে এবং মুক্ত মন এবং মুক্ত বাজারের শক্তি উন্মুক্ত করে স্বাধীনতার বিজয় সুনিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে।” তবে চূড়ান্ত বিচারে “বিশ শতক সবচেয়ে বেশী স্মরণীয় হবে দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির” জন্য।
আর বিজ্ঞানের আধিপত্যের এই শতাব্দীতে আইনস্টাইন ছিলেন “অগ্রগণ্য বিজ্ঞানী। যুগের সব কষ্টিপাথর- (পারমানবিক) বোমা, মহাবিস্ফোরণ (ইরম ইধহম) তত্ত্ব , কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা এবং ইলেকট্রনিক্স — সবই তাঁর ছাপ বহন করে।” বিজ্ঞানের জগতে তাঁর বিপ্লবাত্মক ও যুগান্তকারী তত্ত্বসমূহ আলোচনা করে; সাহিত্য, দর্শন, চিত্রশিল্প এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্বসমূহের প্রভাব উল্লেখ করে; এবং একজন মানবতন্ত্রী হিসেবে মানবাধিকার, অভিবাসী পুনর্বাসন, যুদ্ধ বিরোধিতা ও শান্তির সন্ধানে তাঁর প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে টাইম ম্যাগাজিন আইনস্টাইনকে “আমাদের যুগের মহত্তম মেধা ও প্রধানতম প্রতিমূর্তি” শিরোপা দিয়ে তাঁর “শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব” মনোনয়নের যথার্থতা প্রতিপাদন করে।
মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে আইনস্টাইন জীবনের শেষ স্বাক্ষর করেছিলেন একটি ইশতেহারে। ইশতেহারের প্রণেতা বর্তমানকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও মানবতাবাদী বার্ট্রান্ড রাসেল। ইশতেহারে এই বলে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল যে, যুদ্ধ ও যুদ্ধের প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্র প্রতিযোগিতা অচিরেই চিরতরে নির্মূল করা না গেলে মানুষ আর তার সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে। আর মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রিয় বন্ধু ও সাহিত্যবিষয়ক নির্বাহক অটো নাথানের সাথে আপেক্ষিক তত্ত্বের জনকের আলোচনার বিষয় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক স্বাধীনতা ও জার্মানির পুনঃঅস্ত্রসজ্জা। উল্লেখ্য জার্মানির এই অস্ত্রসজ্জাকে আইনস্টাইন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথে এক বড় অন্তরায় মনে করতেন। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ (সম্ভবত শ্রেষ্ঠতম) বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের চিন্তা-চেতনায় পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কামনা কত বড় জায়গা জুড়ে ছিল ওপরের দৃষ্টান্ত থেকে তার পরিচয় মিলবে।
খ্যাতি ও প্রভাব
১৯০৫ সালে অহহধষবহ ফবৎ চযুংরশ পত্রিকার সপ্তদশ খন্ডে নতুন দিগন্তের সূচনাকারী তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণাপত্র ২ প্রকাশ করে সুইস প্যাটেন্ট অফিসের এক অজ্ঞাত, অখ্যাত প্যাটেন্ট পরীক্ষক পদার্থবিদ্যার জগতে যে মহাবিস্ফোরণ ঘটালেন, আমূল বদলে দিলেন দেশ (ংঢ়ধপব), কাল (ঃরসব) আর যুগপত্তা (ংরসঁষঃধহবরঃু) সম্বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সব ধ্যানধারণা, তখন থেকেই বিজ্ঞানীমহলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। ১৯১৯ সালে সূর্যগ্রহণের সময় দূরবর্তী নক্ষত্রের আলোর বিসরণ পর্যবেক্ষণ করে যখন আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের (এবহবৎধষ ঞযবড়ৎু ড়ভ জবষধঃরারঃু) পরীক্ষাগত প্রমাণ পাওয়া গেল, তখন ঘটল আরেক মহাবিস্ফোরণ। সে বিস্ফোরণ আইনস্টাইনের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার। রাতারাতি সাধারণ্যে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে ওঠলেন তিনি। সেই থেকে খ্যাতি, প্রশংসা, সম্মান আর শ্রদ্ধা অঝোরে ঝরেছে তাঁর ওপর, বলা যায় তাড়িয়ে ফিরেছে তাঁকে।
আইনস্টাইন অবাক হয়েছেন। তাঁকে ঘিরে সাধারণ মানুষের কৌতূহল বিব্রত করেছে তাঁকে, সবকিছু প্রচ-রকম বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে তাঁর। এসবের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। নিরিবিলি গৃহকোণে বিশ্বপ্রকৃতির আত্যন্তিক রহস্য উন্মোচনে ব্রতী থাকতে চেয়েছেন তিনি। তবে জীবনে “প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান বিষয়” পদার্থবিদ্যার পরে যে ভাবনা তাঁর কাছে প্রাধান্য পেয়েছে সে হচ্ছে পৃথিবী থেকে যুদ্ধের বিভীষিকা চিরতরে নির্মূল করা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা। যে খ্যাতি থেকে আজীবন দূরে থাকতে চেয়েছেন, সেই খ্যাতি এবং খ্যাতির প্রসূন প্রভাবকে তিনি একমাত্র এই উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করেছেন, ব্যক্তিগত কোন প্রয়োজনে নয়। আইনস্টাইন ছিলেন শান্তিকামী। প্রকৃতির মৌল বলগুলির মধ্যে বৃহত্তর কোন ঐক্য রয়েছে, এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে আজীবন সেই ঐক্যের সন্ধান করেছেন তিনি। মহাকর্ষ ও তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রদ্বয়কে সমন্বিত করে “একীকৃত ক্ষেত্রতত্ত্ব” (টহরভরবফ ঋরবষফ ঞযবড়ৎু) আবিষ্কারের সাধনায় জীবনের শেষ দিনগুলি পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তেমনি বৃহত্তর ঐক্যের মধ্যে মানব সমাজের সত্যিকারের শান্তি ও নিরাপত্তা নিহিত মনে করে, সেই ঐক্যসাধনের চেষ্টায়ও সক্রিয় থেকেছেন। ছিয়াত্তর বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি ছিলেন এক অদম্য সাহসী শান্তির সৈনিক। চল্লিশ বছরের ব্যাপ্ত পরিসরে উদ্দেশ্য সাধনের উপায় সম্বন্ধে তার মতামতের পরিবর্তন ঘটেছে, পরিবেশ ও পরিস্থিতি কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর ধারণাকে বদলে দিয়েছে, বিবর্তন এসেছে পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কিত চিন্তাধারায়; কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যে তাঁর প্রত্যয় ছিল সুদৃঢ়, সদা অবিচল।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রত্যয়ের উৎস কোথায়? কোন প্রেরণা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সদা সক্রিয় রেখেছে?
নৃশংসতা ও বর্বরতাকে আইনস্টাইন ঘৃণা করতেন, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন নরহত্যার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু শুধুমাত্র এজন্যই যে তিনি পৃথিবী থেকে চিরতরে যুদ্ধ নির্মূল করার জন্য সংগ্রাম করেছেন তা নয়। আইনস্টাইন মনে করতেন ব্যক্তিমানুষের বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতা (রহঃবষষবপঃঁধষ ভৎববফড়স ড়ভ ঃযব রহফরারফঁধষ) হচ্ছে মানব সমাজ ও সভ্যতার মূল ভিত্তি। আর তাঁর বিশ্বাস ছিল যতদিন পর্যন্ত যুদ্ধ একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিরাজ করবে, ততদিন বুদ্ধিবৃত্তির এই স্বাধীনতা কখনোই নিশ্চিত হতে পারেনা। সামরিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অস্তিত্ব, যুদ্ধ করার মত অসামাজিক কাজের জন্য তরুণ সমাজকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের চিন্তাশক্তিহীন যন্ত্র করে গড়ে তোলা, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও জীবনাচরণের ওপর যুদ্ধাবস্থার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার মারাত্মক কুফল — এসবই আইনস্টাইন মুক্ত মানুষের মর্যাদার প্রতি অবমাননাকর মনে করতেন। তাঁর যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের পিছনে এ চিন্তা সব সময় কাজ করেছে।
তাঁর বিশ্বাস ও মূল্যবোধ
আইনস্টাইনের যুদ্ধবিরোধী ভূমিকাকে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে তাঁর মৌলিক মূল্যবোধ, জীবনদৃষ্টি, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মবিশ্বাস ও সমাজ চেতনার দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। চিন্তা ও চেতনায় আইনস্টাইন ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং মানবতন্ত্রী। তিনি নিজেই বলেছেন, “জন্মসূত্রে আমি একজন ইহুদী, নাগরিকত্বের পরিচয়ে সুইস, বিশ্বাসের দৃঢ়মূলে আমি একজন মানুষ, এবং শুধুমাত্র একজন মানুষ যার কোন রাষ্ট্র বা জাতিসত্তার প্রতি বিশেষ অনুরাগ নেই।” প্রথম যৌবনে “ঘনঘন জায়গা বদল” এবং “সর্বত্র এক অপরিচয়ের অনুভূতি” তাঁর মধ্যে এক সহজাত আন্তর্জাতিকতাবোধ সঞ্চার করেছিল। পদার্থবিদ্যা গবেষণার সার্বজনীন চরিত্র সে অনুভূতিকে আরো সম্প্রসারিত করেছিল। ফলে নিজেকে এক বিশ্ব নাগরিক হিসেবে দেখা, শান্তির প্রয়োজনে জাতীয় সার্বভৌমত্ব আংশিক সংকোচন করে হলেও এক বিশ্ব সরকারের নিয়ন্ত্রাধীনে জাতিতে-জাতিতে বিবাদ মীমাংসার ধারণা তাঁর কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
আইনস্টাইনের পরিণত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম আবর্তিত হয়েছে তিনটি মূলনীতিকে কেন্দ্র করে। প্রথমতঃ তিনি সব ধরণের স্বৈরাচার ও স্বৈরশাসন তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন, এবং বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতন্ত্রে আস্থা রেখেছেন। দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক রাষ্ট্র নয়, সৃজনশীল ব্যক্তিত্বকে তিনি সমাজের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলে গণ্য করতেন। তাই রাষ্ট্রযন্ত্র যখনি ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতা খর্ব করতে চেয়েছে, তখনি তিনি প্রতিবাদ করেছেন। তৃতীয়ত, সামরিক মানসিকতাকে তিনি আধুনিক সমাজে “যুথবদ্ধ মনের” নিকৃষ্টতম একক অভিব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই সামরিক শিক্ষা, বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে নিয়োগ, অস্ত্রসজ্জা, যুদ্ধাবস্থার জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি এবং সামরিক-শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রসারের কঠোর সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছেন তিনি।
সৃজনশীল মানুষের স্বাধীনতা ও মানবকল্যান তাঁর আধ্যাত্মিক ও ধর্মবিশ্বাসকেও প্রভাবিত করেছে। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ধর্মবিরোধী, আইনস্টাইন নাস্তিক ও কমিউনিস্ট ইত্যাকার প্রচারণার জবাবে তাঁর প্রায়শ উদ্ধৃত উক্তি, “আমি স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করি যিনি নিজেকে বিশ্বের নিয়মানুবর্তী ঐকতানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন, এমন ঈশ্বরে নয় যিনি মানবজাতির ভাগ্য এবং কাজ নিয়ে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন” প্রমাণ করে যে দ-দাতা বিধাতার প্রতিকৃতিতে তাঁর সামান্যই আস্থা ছিল। পাপ-পুণ্যের বিচার করে নিজ সৃষ্টিকে শাস্তি বা পুরস্কার দানে নিরত ঈশ্বরের চিত্রকল্পকে তিনি “মানুষের দুর্বলতার প্রতিফলন মাত্র” বলে মনে করতেন।
ক্ষমতাহীনের মর্যাদা নিশ্চিত করা আইনস্টাইনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। ইউরোপে ইহুদীদের প্রতি বৈষম্য এবং প্রান্তিককরণ সে প্রচেষ্টায় এক ব্যক্তিগত মাত্রা যোগ করেছিল। মানুষের সমতায় ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা। আর তাই ধনবাদী সমাজব্যবস্থা সৃষ্ট শ্রেণীবৈষম্যের তিনি ছিলেন তীব্র বিরোধী। শ্রেণী শোষণের কাজ ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যত নিপুণভাবে সম্পন্ন হয়েছে অন্য কোন সমাজ ব্যবস্থায় তা সম্ভব হয়নি। আর এসবই তাঁকে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বিচারে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল।৬ আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন ধনবাদী অর্থনীতি কখনোই সব মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না। বরং সমকালীন সমাজের অনেক কালিমা ও পঙ্কিলতার জন্য তিনি ধনবাদী ব্যবস্থাকে দায়ী মনে করতেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন, “ধনবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন করা হয় মুনাফার জন্য, ব্যবহারের জন্য নয়। যারা কাজ করতে ইচ্ছুক এবং সক্ষম তারা সবসময় কাজ পাবে, তেমন কোন বিধান নেই; [তাই] “বেকারদের একটি বাহিনী” প্রায় সবসময় মজুত থাকে।” ফলশ্রুতি, শ্রমিকের কম বেতন এবং কাজ হারানোর নিত্য আশঙ্কা। ধনবাদী ব্যবস্থার অপরিমিত প্রতিযোগিতায় একদিকে শ্রমশক্তির বিপুল অপচয় হয়, অন্যদিকে ব্যক্তির সামাজিক চেতনা পঙ্গু হয়ে যায়। “ব্যক্তির এই পঙ্গু করে দেয়াকে” আইনস্টাইন পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ মনে করতেন।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ ও অভিশাপ মোচনের একমাত্র উপায় হিসেবে তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা এবং একটি সহযোগী সমাজমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়েছেন। পদ্ধতিগত পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে আইনস্টাইনের সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী অর্জিত হয়নি। মতাদর্শগত কোন গ-ীর মধ্যেও সে দৃষ্টিভঙ্গী সীমিত ছিল না। স্ব-সমাজ ও পরিবেশে বিদ্যমান বৈষম্য, বিভেদ ও অর্থনৈতিক শোষণের ফলে উদ্ভূত মানবিক সমস্যাসমূহের সাথে তাঁর সংবেদনশীল মনের সংঘাত আইনস্টাইনকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী করে তুলেছিল। তিনি মনে করতেন সমাজের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন যা উৎপাদন প্রক্রিয়া ও বন্টন ব্যবস্থার শৃঙ্খলা বিধান করবে এবং মানুষের শ্রমশক্তিকে সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য ব্যবহার করবে। তবে পুরোপুরি পরিকল্পিত অর্থনীতির সম্ভাব্য কুফল “ব্যক্তিমানুষের পূর্ণ দাসত্ব বন্ধন”৬ সম্বন্ধেও তিনি সচেতন ছিলেন।
ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ সম্পর্কে আইনস্টাইন সবসময় শঙ্কিত ছিলেন, তা’ যেকোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ই হোক না কেন। তাই সত্যিকার রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার বলেছেন। অর্থনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারকে তিনি সমাজকল্যাণের পথে এক বড় অন্তরায় মনে করতেন। আর এই অপব্যবহার রোধ করার জন্য সত্যিকারের গণতন্ত্রকে অপরিহার্য মনে করতেন।
কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আর এ দু’য়ে মিলে প্রাধান্য বিস্তারের মোহ যে আগ্রাসী তৎপরতার জন্ম দিতে পারে তার প্রতি প্রবল ভীতি থেকেই আইনস্টাইন সমাজতন্ত্রকে যুদ্ধ বন্ধ করার নিশ্চয়তা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারেনা, অন্যান্য সমাজতন্ত্রীর মত সে বিশ্বাস তাঁর ছিল না। তাঁর আশঙ্কা ছিল ক্ষমতার মোহ পুঁজিবাদী দেশের মত সমাজতান্ত্রিক দেশেও যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। আর তাই এক সমাজতান্ত্রিক বিশ্বেও শান্তির অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসেবে অস্ত্র ও যুদ্ধ নির্মূল করা অবশ্য প্রয়োজন বলে আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন।
বিজ্ঞান গবেষণা ও শান্তির সাধনা
তবে এসব যুক্তির আশ্রয়ে যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিভীষিকা মুক্ত এক শান্তির পৃথিবী প্রতিষ্ঠার জন্য আইনস্টাইনের চিন্তা ও আকুতিকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা বোধহয় সম্ভব নয়। তাঁর এই আকুতি ছিল আভ্যন্তরীণ প্রেরণাসঞ্জাত, অন্তরের জিনিস। আইনস্টাইন নিজেই বলেছেন, তাঁর বিশ্বজনীন শান্তিবাদ বুদ্ধিবৃত্তিগত কোন তত্ত্ব থেকে জন্ম নেয়নি, এর মূল নিহিত ছিল সব ধরনের নৃশংসতা ও ঘৃণার প্রতি তাঁর সুতীব্র বিতৃষ্ণায়। প্রশ্ন জাগে কিভাবে এই বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছিল যা চার দশক ধরে তাঁকে যুদ্ধবিরোধী সংগ্রামে নিয়োজিত রেখেছে, ছিনিয়ে নিয়েছে তাঁর মূল্যবান সময়ের এক উল্লেখযোগ্য অংশ, যে সময় তিনি যেকোন মূল্যে বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত করার পক্ষপাতী ছিলেন। কোন কোন আইনস্টাইন গবেষক ও জীবনীকার প্রশ্ন তুলেছেন, যুদ্ধের প্রতি বিতৃষ্ণার সাথে তাঁর বিজ্ঞান সাধনার কি কোন যোগাযোগ আছে? আরো প্রত্যক্ষ প্রশ্ন তুলেছেন অটো নাথান, এও কি সম্ভব যে তাঁর যুদ্ধবিরোধী মনোভাব তাঁর বিজ্ঞান সাধনা থেকেই জন্ম নিয়েছে, এবং উত্তরোত্তর শক্তি সংগ্রহ করেছে?৭ আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাঁর সাহিত্যবিষয়ক নির্বাহক, অর্থনীতির অধ্যাপক এবং আইনস্টাইন গবেষক নাথান নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দেয়ার চেষ্টা করেছেন, “অসম্ভব নয়” বলে। আর সেই সম্ভাবনা নির্দেশে তাঁর অনুধ্যান এরকম।৭
ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত আইনস্টাইনও ছিলেন প্রকৃতি-পূজারী, প্রকৃতি-প্রেমিক। গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে বারবার তিনি প্রকৃতির দিকে তাকিয়েছেন। প্রকৃতির অসংখ্য, অগণ্য বস্তু ও ঘটনারাজির মধ্যে এক সমন্বয়ের রাগিনী অন্তর্নিহিত রয়েছে অনুভব করেছেন। প্রকৃতির রাজ্যে এই শৃঙ্খলা ও প্রকৃতির নিয়ম-কানুনের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় সম্বন্ধে তাঁর প্রত্যয় এত দৃঢ় ছিল যে স্বয়ং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম পথিকৃত হয়েও কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্তর্নিহিত অনির্দেশ্যতাকে আজীবন অস্বীকার করে গেছেন, বলেছেন “ঈশ্বর সৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলেন না।” সম্ভবত যুদ্ধের ধংস ও তা-বকে তিনি বিশ্বপ্রকৃতির মহান শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী বিবেচনা করেছেন, নরহত্যাকে মনে করেছেন প্রকৃতি নির্ধারিত পথ থেকে বিচ্যুতি। বিজ্ঞানী হিসেবে প্রকৃতির নিয়ম কানুন যিনি সন্ধান করে ফিরেছেন শ্রদ্ধাভরে, এই বিচ্যুতি ঘটানোর চেষ্টা তাঁকে প্রতিবাদী করে তুলেছে। হতে পারে বর্বরতা ও নৃশংসতার প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণার মূলে এই-ই ছিল অন্যতম প্রধান কারণ, যুদ্ধ তথা যুদ্ধের প্রতিষ্ঠানকে চিরতরে নির্মূল করার সংগ্রামের পেছনে এই-ই ছিল তাঁর মূল চালিকা শক্তি। পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি সাধনা করেছেন প্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করার, তাই সম্ভবত তাগিদ অনুভব করেছেন মানুষকে বোঝানোর, তারা যেন প্রকৃতির ইচ্ছাকে বিকৃত না করে, অবজ্ঞা না করে; সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা ও সৃষ্টিশীল পূর্ণতা অর্জনের স্বপক্ষে সংগ্রাম করার। অবশ্য এসব যুক্তিসিদ্ধ অনুমান মাত্র।
শান্তির সৈনিক
আইনস্টাইনের জীবন ও কাজের প্রতি সন্ধানী দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে অনেকটা যেন বদ্ধসংস্কারগ্রস্থের মতই তিনি, তাঁর ভাষায়, “সব উদ্দেশ্যের মধ্যে মহত্ত্বম — মানুষে-মানুষে সদ্ভাব ও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার” জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করে গেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে, কোন ভূমিকায়? মহত্তম সেই উদ্দেশ্য সাধনে আইনস্টাইনের ভূমিকা ছিল বুদ্ধিজীবীর। তাঁর দৃঢ়মূল বিশ্বাস ছিল যে আন্তর্জাতিক সংহতির জন্য সংগ্রাম করা এবং জাতিতে-জাতিতে শত্রুতার মূল কারণসমূহ অনুধাবন ও উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা করা বুদ্ধিজীবীদের এক বাধ্যতামূলক নৈতিক দায়িত্ব।৮ শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি ছিলেন সমকালীন বিশ্বের বিবেক। কি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে তিনি প্রতিষ্ঠিত সে সম্বন্ধে আইনস্টাইন সচেতন ছিলেন। তিনি নিজে কখনো এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি, মনে করতেন এসব তাঁর যথার্থ প্রাপ্য নয়। শ্রদ্ধা ও সম্মানের আধিক্যে বিব্রত বোধ করলেও সময়ে তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে বিজ্ঞানী সমাজে তথা সমগ্র বিশ্বে তাঁর এই অদ্বিতীয় অবস্থান স্বতন্ত্রভাবে ব্যক্তি ও সার্বিকভাবে সমাজের পক্ষে কাজ করার জন্য তাঁকে এক অভূতপূর্ব সুযোগ দিয়েছে। আর এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি পুরোমাত্রায়।
শ্রদ্ধায় নির্মিত সেই পাদপীঠ থেকে শান্তির সপক্ষে যে কোন আন্দোলন, যেকোন প্রয়াসকে তিনি সৎ ও যথার্থ মনে করেছেন, তাকেই আগ্রহের সাথে সহযোগিতা দান করেছেন। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেকোন তরফ থেকেই হোক না কেন, কোন উদ্যোগ তাঁর কাছে আশাপ্রদ মনে হলে তাকে সমর্থন করা, তার পক্ষে দাঁড়ান তিনি নিজের নৈতিক দায়িত্ব মনে করতেন। যেকোন সময়ে, এমনকি যে গবেষণার কাজে নিত্য নিমগ্ন থাকতেন তাকে বিঘিœত করেও তিনি ব্যক্তি বা সমষ্টির স্বার্থে নিজের মূল্যবান সময় ও শ্রম নিয়োগ করেছেন। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাথে দেখা করা, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা, সমস্যা সংক্রান্ত কাগজপত্র অধ্যয়ন, বিবৃতিতে স্বাক্ষরদান, অনেক সময় নিজে বিবৃতি রচনা, আন্দোলনের পক্ষে সহযোগী বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের মতামত গড়ে তোলা ও তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা ইত্যাকার কাজের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ভূমিকা পালন করেছেন। বুদ্ধিজীবীর স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ইহুদী সমস্যা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, সৃষ্টিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য শিক্ষা, নিগ্রোদের অধিকার প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য সাধনে তিনি তাঁর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন। কিন্তু সময় যত অগ্রসর হয়েছে যুদ্ধ নির্মূল করার প্রয়োজনীয়তা আইনস্টাইনের কাছে তত বড় হয়ে উঠেছে। শেষ জীবনে যেন অনেকটা অধৈর্য হয়েই তিনি সে উদ্দেশ্য সাধনে তৎপর হয়েছেন।
মানবতা ও শান্তির সপক্ষে আইনস্টাইনের চার দশকব্যাপী কর্মধারার সংক্ষিপ্ত আলেখ্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে পরবর্তী অধ্যায়সমূহে।