নিজস্ব প্রতিবেদক : নির্বাচন কমিশনে বিএনপির ‘মুখপাত্র’ হয়ে কথা বলার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা করেন, সেই মাহবুব তালুকদার বিদায় বেলায় বললেন, বিএনপির ভাষা তিনি ‘বোঝেন না’।
এই নির্বাচন কমিশনারের ভাষায়, মেয়াদের পাঁচটি বছর তিনি কেবল ‘নীরব জনগোষ্ঠীর’ মুখপাত্র হয়েই কথা বলে গেছেন। কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের উত্তরসূরি হয়ে ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নেয় কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। গতকাল সোমবার নিজেদের মেয়াদের শেষ দিনটি তারা নির্বাচন ভবনে পার করলেন। দায়িত্বের শেষ দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা এবং দুই নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম ও কবিতা খানম নির্বাচন ভবনে বিদায়ী ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন।
আরেক নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী অসুস্থতার কারণে ব্রিফিংয়ে ছিলেন না। আর সহকর্মীদের সাথে বার বার মতবিরোধে জড়ানো মাহবুব তালুকদার সেই ব্রিফিংয়ে না গিয়ে নিজের কক্ষে আলাদাভাবে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন।
নানা ঘটনায় কমিশনের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে আলোচনায় থাকা এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “আমি যে বিএনপির মুখপাত্র, এটা আমি প্রথম জেনেছি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের প্রেস বিফিং থেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে- আমি যখনই দৃঢ়ভাবে কোনো বক্তব্য পেশ করি, তখনই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোক সমালোচনা করে বলে যে ‘সে তো বিএনপির সুরে কথা বলে’।
“বিএনপির যে কী সুর, সেটা আমি বুঝি না। যারা এ ধরনের কথা বলেন, তারা হয়ত বা জানেন, আমি তো জানি না।”
নিজেদের মেয়াদের ইসির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ নিয়ে বিব্রত বোধ না হলেও গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে ‘হেরে যাওয়ার’ হতাশার কথা বলেছেন মাহবুব তালুকদার।
নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার অভিযোগ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব তালুদার বলেন, “বিব্রত বোধ করার… আমি এ কথা বলেছি সব সময়, নীরব জনগোষ্ঠীর ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। যাদের কথা সারফেসে আসে না, রাজনৈতিক দল বলে না, সেসব অশ্রুত ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি আমি তাদের মুখপাত্র। তাদের কাছ থেকে জেনে বুঝে বলার চেষ্টা করেছি।
সাবেক আমলা মাহবুব তালুকদারের দাবি, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সভায় সব সময় ‘নিগৃহীত’ হতে হয়েছে তাকে।
“আমি পাঁচজনের একজন। গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে, গণতন্ত্রের জন্য সংখ্যালঘু হিসেবে আমি হেরে গেলাম। এমনও ঘটনা রয়েছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের কমিশনে কথা বলতে গিয়ে আমাকে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হয়নি। কেন? আমাকে বলা হল, সংবিধানবিরোধী… সংবিধান রক্ষার জন্য যা কিছু করার করতে হবে।”
শেষ ব্রিফিংয়ে কেন সিইসির সঙ্গে উপস্থিত হলেন না, সেই প্রশ্ন মাহবুব তালুকদারের সামনে রেখেছিলেন সাংবাদিকরা। উত্তরে তিনি বললেন, “কারণ, এটাই যে, আমি মুক্তভাবে কথাগুলো বলতে পারলাম। আমার এ কথাগুলো ওখানে মানানসই বলে আমি মনে করি না। পাঁচ বছরে যা কিছু বলেছি, ফলোদয় হয়নি।”
বরাবরের মত শেষ ব্রিফিংয়েও ‘আমার কথা’ শীর্ষক লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেন বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার। তবে এদিন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও তিনি দেন, যা বিরল ঘটনা।
লিখিত বক্তব্যে মাহবুব তালুকদার বলেন, “নির্বাচন কমিশন গঠন আইনটি সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে সংকটের সমাধান হবে না। এখন পর্যন্ত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণের কোনো পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে না। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।” তবে ‘আশাবাদী’ মানুষ হিসেবে সব সংকটের সমাধান দেখতে চাওয়ার কথা বলেছেন মাহবুব তালুকদার।
ভোটের সহিংসতা নিয়ে তিনি বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, ওই নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে। এই লাশ সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে? কথাটা রূপকার্থে বলা হলেও এটাই সত্য। নির্বাচনের নামে সারা দেশে এমন অরাজকতা কখনো কাঙ্ক্ষিত ছিল না।”
তার মতে, তৃণমূল পর্যায়ে এই নির্বাচন ‘দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচন বলা যায় কি-না, তা নিয়েও তার প্রশ্ন আছে।
বিদায়বেলার আত্মবিশ্লেষণে মাহবুব তালুকদার বলেন, “নির্বাচন কমিশনের বড় দুর্বলতা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, জালিয়াতি- ইত্যাদি সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা যে সকল অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। লিখিতভাবে যে সব অভিযোগ পাঠানো হয়, তারও যথাযথ নিষ্পত্তি হয় না। অধিকাংশ অভিযোগই আমলে না নিয়ে নথিভুক্ত করা হয় বা অনেক ক্ষেত্রে নথিতেও তার ঠাঁই হয় না। আমাদের কার্যকালের শেষ পর্যায়ে এসে বিগত কয়েক মাসে অবশ্য এর কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে।” নির্বাচনে জনমানসের প্রতিফলন ‘একান্ত অপরিহার্য’ মন্তব্য করে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্র জনমানসের প্রতিফলন একান্ত অনুপস্থিত। এতে বিশেষভাবে টাকার খেলাই প্রতিভাত হয়। রাজনীতি ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের করতলগত হয়ে যাচ্ছে।”
অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাগুলো দূর করতে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন বলেও মত দেন মাহবুব তালুকদার।
বিএনপির কী সুর, সে তো আমি বুঝি না: মাহবুব তালুকদার
ট্যাগস :
বিএনপির কী সুর
জনপ্রিয় সংবাদ