গাজীপুর সংবাদদাতা : শীতপ্রধান দেশের ফুল টিউলিপ। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশে প্রথম টিউলিপের হাসি ফুটিয়েছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া পূর্ব খ-গ্রামের ফুলচাষি দেলোয়ার হোসেন ও সেলিনা আক্তার। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে টিউলিপ ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়েছেন ওই দম্পতি। এবারই প্রথম নয়, এ নিয়ে টানা তৃতীয়বার। এবার তাদের বাগানে ফুটেছে প্রায় ১৩ রঙের টিউলিপ। গত বছর তাদের বাগানের টিউলিপ ফুল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজর কেড়েছিল। ওই বছর বাগান পরিদর্শনে এসেছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর ফুলচাষি দেলোয়ার হোসেন ও সেলিনা আক্তার দম্পতির টিউলিপ ফোটানোর খবর বাংলাদেশের সব মিডিয়ায় প্রচার হয়েছিল। বাদ যায়নি ডাচ মিডিয়ায়ও। এ ছাড়া, চলতি মাসের ৩ তারিখে ফুলচাষি দেলোয়ারের টিউলিপ বাগান ঘুরে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত (ভারপ্রাপ্ত) পাওলা রোস সিনড্রেলা। বাংলাদেশে এমন একটি নান্দনিক টিউলিপ ফুলের বাগান দেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্য নিজের দেশের পরিচিত টিউলিপ রাজ্যে হারিয়ে যান বলে মন্তব্য করেন এবং দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী সেলিনা হোসেন শেলীর পরিশ্রম ও সাফল্যের প্রশংসা করেন। তবে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে টিউলিপ ফুল চাষে তার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানাবিধ সহযোগিতার ব্যাপারেও কথা বলেন। নেদারল্যান্ডস থেকে খুব সহজেই যেন বীজ আমদানি করা যায়, সে ব্যাপারেও সহায়তা করা হবে বলেও সিনড্রেলা আশ্বাস দেন। দেলোয়ার হোসেন ও সেলিনা আক্তার দম্পতির প্রতিষ্ঠানের নাম মৌমিতা ফ্লাওয়ার। এর আগে জার্বেরা, চায়না গোলাপ ও বিদেশি বিভিন্ন ফুল চাষে সফল হয়েছেন তিনি। সফল ফুলচাষি হিসেবে ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক পান দেলোয়ার। প্রথমবার ২০২০ সালে নেদারল্যান্ড থেকে ২০ হাজার বাল্ব (বীজ) আমদানি করে সীমিত পরিসরে কৃষক দেলোয়ার তার বাগানে টিউলিপের চাষ করেন। এরপর ২০২১ সালে ৩০ হাজার এবং এ বছর ৭০ হাজার বাল্ব আমদানি করেছেন তিনি। তবে করোনার কারণে প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হচ্ছে দেলোয়ারকে। দেলোয়ার হোসেন বলেন, দেশে টিউলিপের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। আমার বাগানে পরপর দুবার টিউলিপ ফোটায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। সেই চিন্তা থেকে এবার নেদারল্যান্ডস থেকে হলুদ ও লাল, চার ধরনের গোলাপি, কমলা, সাদা, পার্পেল রঙেরসহ ১০ ধরনের ৭০ হাজার টিউলিপের বাল্ব (বীজ) আমদানি করেছি। ১৩ রঙের টিউলিপ নিয়ে কাজ করছি। তার মধ্যে ৬টিতে সাফল্য এসেছে। আমদানি করা বাল্বগুলো থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ৪০ হাজার, রাজশাহীতে ১ হাজার ও যশোরের গদখালিতে ৫ হাজার বাল্ব দিয়ে বাগান তৈরি করে দেশের টিউলিপের এলাকা নির্ধারণে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সব জায়গায় টিউলিপ ফুল ফোটায় এ নিয়ে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে পঞ্চগড়ে। কারণ সেখানকার তাপমাত্রা তুলনামূলক দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে কম। তিনি আরও বলেন, কৃষি সম্প্রসারণের লোকজন আমাদের সবসময় সহযোগিতা করেন। তবে আমাদের দরকার অবকাঠামোগত সহযোগিতা। বাগান তৈরিতে যেসব নেট ব্যবহার করা হয়, সেসবের উপর ভ্যাট-ট্যাক্স কমানো প্রয়োজন। নেদারল্যান্ডস থেকে বাল্ব (বীজ) আনতে অনেক টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে যদি সহযোগিতা করা হয়, তাহলে শুধু টিউলিপ নয়, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফুল ও সবজি চাষ করা সম্ভব দেশে। মৌসুমে বাগান থেকে যে কেউ চাইলে টিউলিপ ফুল নিতে পারেন। একটি ফুল বিক্রি করা হচ্ছে ১০০টাকায়। আর টবে করে ফুল নিতে পারবে ২০০ টাকায়। এ ছাড়াও, যারা ফুল দেখতে আসছেন, তাদের জন্য প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা বাগানে এসে ফুলের সঙ্গে ছবি তুলতে পারবেন। দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাগান করতে আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেছেন আমার স্ত্রী সেলিনা আক্তার। সেলিনা আক্তার বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ফুল চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠলেও আমরা পিছিয়ে। অর্থনীতি ও চাহিদার কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিদেশি ফুল দিয়ে আমাদের স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়। এরই মধ্যে জার্বেরা, চায়না গোলাপের পর বিদেশি টিউলিপ ফুল ফুটিয়ে এসেছে একের পর এক সফলতা। এখন হলো সম্প্রসারণের কাজ করে যাওয়া। তিনি আরও বলেন, নেদারল্যান্ডস টিউলিপ ফুল উৎপাদনকারী প্রধান দেশ। টিউলিপকে নিয়েই সেখানে গড়ে উঠেছে শিল্প। সেখানে প্রতি বছর পালন করা হয় টিউলিপ উৎসব। সাধারণত মার্চ-এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসে টিউলিপ ফুল ফোটে। তবে বিস্ময়ের বিষয় বাংলাদেশে এই ফুল ফুটছে দু’মাস আগেই। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের টিউলিপ ফুল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির আশা জাগাচ্ছে। এ ছাড়াও, দেশের শীতপ্রধান জেলাগুলোতে যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে টিউলিপ চাষ করা যায়, তাহলে যেমন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। তেমনই টিউলিপ চাষে আগ্রহী হবে মানুষ। কৃষি অধিদপ্তর ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক বশির আহমেদ সরকার বলেন, শ্রীপুরের দেলোয়ার হোসেনকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টিউলিপের চাষ বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, টিউলিপের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যত রকম প্রযুক্তিগত পরামর্শ আছে, তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। সরকারও এ ব্যাপারে অবগত।