নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রনের কারণেই’ সংক্রমণ বাড়ছে জানিয়ে তা ঠেকাতে ‘ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন’ চূড়ান্ত করে ‘স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোতে’ পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গতকাল বুধবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে এসব তথ্য জানান অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। তিনি জানান, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআর, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষণা থেকে জানা গেছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রন বেশি মাত্রায় শনাক্ত হচ্ছে। অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, “গবেষকরা মনে করছেন ওমিক্রনের কারণে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এটি নিয়ে ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন চুড়ান্ত হয়ে গেছে।
“নতুন নতুন তথ্য নিয়েই এই গাইডলাইন সাজানো হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ গাইডলাইন পাঠিয়ে দিয়েছি।”
মহামারীর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় গত নভেম্বরের শেষে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক নতুন ধরন ওমিক্রনের আবির্ভাবের পর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশেও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। ওমিক্রনের বিস্তারের মধ্যে বুধবার টানা দ্বিতীয় দিনের মত ১৫ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঢাকার পর চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগেও সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, “ওমিক্রনের যে উপসর্গ আছে সেই উপসর্গগুলো এতে (ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন) যোগ করা হয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনো উপসর্গ রয়েছে কিনা সেটি খুঁজে দেখা হচ্ছে।”
এর আগে গত রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ওমিক্রন সংক্রমিতদের ৭৩ শতাংশেরই নাক দিয়ে পানি ঝরছে; সেই সঙ্গে মাথাব্যথা, অবসন্নতা, ক্লান্তিবোধ ও হাঁচির মতো উপসর্গও দেখা যাচ্ছে। দেশে নতুন করে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. নাজমুল ইসলাম।
“সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। সঠিক নিয়মে মাস্ক পড়া, সাবান-পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি তাহলে এই অতিমারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।” স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার সকাল পর্যন্ত নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৫২৪ জনে। মৃত্যু হয়েছে ২৮ হাজার ২৭৩ জনের। এর মধ্যে গত ১২ জানুয়ারির পর ১৩ দিনেই এক লাখের বেশি কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে।
দেশে টানা দ্বিতীয় দিন ১৫ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত : করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তারের মধ্যে টানা দ্বিতীয় দিনের মত ১৫ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে দেশে; ঢাকার পর চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগেও সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করে ১৫ হাজার ৫২৭ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃত্যু হয়েছে আরও ১৭ জনের। আগের দিন সাড়ে ৪৯ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে ১৬ হাজার ৩৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল, যা মহামারীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ; সেই সঙ্গে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর এসেছিল। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের সময়, গত বছরের ২৮ জুলাই ১৬ হাজার ২৩০ জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছিল, মহামারীর মধ্যে সেটাই সর্বোচ্চ। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৫২৪ জনে। তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ২৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসে।
গত ১২ জানুয়ারি শনাক্ত রোগীর মোট সংখ্যা ১৬ লাখের ঘরে পৌঁছেছিল। মাত্র ১৩ দিনে আরও এক লাখ রোগী শনাক্ত হওয়ায় মঙ্গলবার মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ লাখ ছাড়ায়। সরকারি হিসাবে গত এক দিনে দেশে সেরে উঠেছেন এক হাজার ৫২ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৬০ হাজার ছয় জন সুস্থ হয়ে উঠলেন।
এই হিসাবে দেশে এখন সক্রিয় কোভিড রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৪৩ হাজার ২৪৫ জন। অর্থাৎ এই সংখ্যক রোগী নিশ্চিতভাবে সংক্রমিত অবস্থায় রয়েছে। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল এক লাখ ২৮ হাজার ৭৮৭ জন। গত ১৯ জানুয়ারি ছিল ৫৯ হাজার ৮৫০ জন। অর্থাৎ, মাত্র এক সপ্তাহে সক্রিয় রোগী বেড়েছে ১৩৯ শতাংশের বেশি।
ডেল্টার সেই ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের মহামারী পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল গত বছরের শেষে। ডিসেম্বরে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ঘোরাফেরা করছিল ২০০ থেকে ৩০০ এর ঘরে। শনাক্তের হার নেমে এসেছিল ২ শতাংশের নিচে। কিন্তু বিশ্বে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার শুরুর পর জানুয়ারির শুরু থেকে বাংলাদেশেরও আবার দ্রুত উঠতে থাকে সংক্রমণের গ্রাফ।
জানুয়ারির প্রথম দিনও শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল চারশর নিচে, এখন তা ১৫ হাজারের বেশি থাকছে। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হারও থাকছে ৩০ শতাংশের উপরে।
গতকাল বুধবার শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৬৪ শতাংশে। মহামারীর মধ্যে সার্বিক শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ। আর মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত বছরের ২৪ জুলাই শনাক্তের হার ছিল ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর ২০২০ সালের ১২ জুলাই শনাক্তের হার ছিল ৩৩ দশমিক ০৪ শতাংশ, যা এ মাহামারীকালের রেকর্ড।
গত এক দিনে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে নয় হাজার ৪৫৬ জনই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা, যা মোট আক্রান্তের ৬০ দশমিক ৯০ শতাংশ। আগের দিন এ বিভাগে ১০ হাজার ৪৭৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল, যা ছিল দিনের মোট শনাক্তের ৬৫ শতাংশের বেশি। গত কয়েক মাস ধরেই দৈনিক শনাক্ত রোগীর একটি বড় অংশ থাকে ঢাকার। তবে গত সপ্তাহখানেক ধরে দেশের অন্যান্য জেলাতেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চট্টগ্রাম বিভাগে এক দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আগের দিনের ২ হাজার ৩২৫ জন থেকে বেড়ে ২ হাজার ৪৪৪ জন হয়েছে। রাজশাহী বিভাগে এক দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮৮২ জন থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৮৮ জন। অন্যান্য বিভাগেও রোগী বাড়ছে। গত এক দিনে ঢাকা বিভাগের মধ্যে ঢাকা জেলায় ৮২৫৯ জন, ফরিদপুরে ১২৪ জন, গাজীপুরে ২২৪ জন, নারায়ণগঞ্জে ২০৪ জন এবং নরসিংদীতে ১৫২ জনের কোভিড শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় ১৪৫৫ জন, কক্সবাজারে ২৫২ জন, নোয়াখালীতে ১৪৬ এবং কুমিল্লায় ১৯৩ জন; রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী জেলায় ৪৩৬ জন, পাবনায় ২০৭ জন, বগুড়ায় ১৭৭ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া খুলনা বিভাগের মধ্যে খুলনা জেলায় ১৮৯ জন, যাশোরে ২২৯ জন, কুষ্টিয়ায় ১২০ জন; সিলেট বিভাগের সিলেট জেলায় ৪৩৪ জন, মৌলভীবাজারে ১২৩ জন; বরিশাল জেলায় ১২৯ জন এবং ময়মনসিংহে ২০০ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে গত এক দিনে।
যে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ১৩ জন পুরুষ, চার জন নারী। তাদের মধ্যে ১০ জন ছিলেন ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের চারজন, রাজশাহী বিভাগের একজন জন, খুলনা বিভাগের একজন, এবং ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন একজন। তাদের মধ্যে ১১ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি, তিনজনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, দুইজনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর এবং একজনের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ছিল।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এ বছর ২৫ জানুয়ারি তা ১৭ লাখ পেরিয়ে যায়। তার আগে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক বিস্তারের মধ্যে গত বছরের ২৮ জুলাই দেশে রেকর্ড ১৬ হাজার ২৩০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়।
প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ২০২০ সালের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত বছর ৫ ডিসেম্বর কোভিডে মোট মৃত্যু ২৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তার আগে ৫ অগাস্ট ও ১০ অগাস্ট ২৬৪ জন করে মৃত্যুর খবর আসে, যা মহামারীর মধ্যে এক দিনের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
ওমিক্রন ঠেকাতে ‘ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন’
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ