ঢাকা ০৪:১৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

তরলবর্জ্যের কবলে কৃষিজমি

  • আপডেট সময় : ০১:৩১:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২২
  • ৮৯ বার পড়া হয়েছে

গাজীপুর প্রতিনিধি : গাজীপুরের শ্রীপুরে মিল-কারখানার অপরিশোধিত বিষাক্ত তরলবর্জ্যে কৃষকের কয়েকশ একর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বিগত তিন বছর ধরে স্থানীয় কৃষকরা এ জমিতে না পারছে ধান ফলাতে, না পারছে সবজি চাষ করতে। এ অঞ্চলে যারা শুধুমাত্র কৃষিনির্ভর তাদের অবস্থা বেগতিক। ধান ফলিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে এখন উল্টো আরও ঋণগ্রস্ত। ভালুকা উপজেলার ক্ষীরু নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে শ্রীপুর উপজেলার উত্তর সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে লবনদহ নামের একটি নদ। উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের পূর্ব এবং পৌরসভার পশ্চিমপ্রান্ত ঘেষে কেওয়া পশ্চিম খন্ড, পাথারপাড়া, বহেরার চালা, বেলতলি, বেড়াইদেরচালা, শিরিরচালা, ইন্দ্রবপুর, বানিয়ারচালা, ভবানিপুর, পিরুজালী ও মনিপুর দিয়ে এঁকেবেঁকে তুরাগ নদীতে গিয়ে এ লবনদহ নদ সংযুক্ত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার। এ নদের উভয় পাশে যাদের জমি রয়েছে তারাই পড়েছে বিপাকে। শ্রীপুর পৌরসভা ও গাজীপুর সদরের অসংখ্য মিল-কারখানার অপরিশোধিত দূষিত তরলবর্জ্য মাটির নিচ দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় সরাসরি ছাড়া হচ্ছে এ নদে। দখল দূষণে মৃত প্রায় এ নদে পতিত এসব বিষাক্ত তরলবর্জ্য উপচে গিয়ে পড়ছে কৃষকের জমিতে। আর এতেই নষ্ট হচ্ছে এ অঞ্চলের প্রায় কয়েকশ একর ধানের জমি। শ্রীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বহেরার চালা গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় কৃষক মো. মফিজ উদ্দিনের সঙ্গে। তার ১০ বিঘা জমি বিষাক্ত বর্জ্যে তলিয়ে আছে। কেমন আছেন প্রশ্ন করতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এখন শুধু মরার বাকি’। জমিতে ধান ফলানো ছাড়া জীবিকা নির্বাহের অন্য কোনো উপায় নেই তাঁর। পরপর তিনবার ধান চাষ করেও খরচই তুলতে পারছেন না মফিজ উদ্দিন। সংসারের সবাইকে নিয়ে পথে বসার অবস্থা এখন তার। বিষাক্ত এ তরলবর্জ্য জমিকে নয় বরং তার জীবনকেই যেনো বিষাক্ত করে তুলেছে। প্রতিকার পেতে অনেকবার পৌর মেয়রের কাছে গিয়েও কোনো লাভ হয়নি। ৪০-৫০ জন কৃষক একসঙ্গেও গিয়েছেন মেয়রের কাছে। মেয়র আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। মফিজ উদ্দিন জানান, আশেপাশের কারখানার সব বর্জ্য, হাসপাতালের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি স্যালাইন প্যাকেট, ইনজেকশন ও বোতল সব এনে রাতের আঁধারে আমাদের জমিতে ফেলে রাখে। এমনকি পৌরসভার বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনাও এখন আমাদের ফসলি জমিতে এনে ফেলছে। দেখার কেউ নেই। কথা হয় ভুক্তভোগী কৃষক শফি কামাল, জালাল মিয়া, মুক্তার, সিরাজ উদ্দিন মাস্টার, মুখলেস মোল্লা, আক্রাম হোসেন, সাইফুল ইসলামসহ আরো অনেকের সঙ্গে। শফি কামাল জানান, এ গ্রামে মিতালি, এক্স সিরামিক্স, ক্রাউন, হরাইজনসহ অসংখ্য মিল-ফ্যাক্টরি রয়েছে। এগুলোর বর্জ্য আমাদের জমির পানিতে এসে পড়ে। এখানে শুধু ধান কেনো, কোনো ফসলই হবে না। জমির আইলে মৃতপ্রায় তালগাছ দেখিয়ে শফি বললেন, দেখুন এখানে ধান কেনো, কোনো কিছুই হবে না। মাটি বিষাক্ত হয়ে গেছে। ক্ষেতে নেমে আর কাজ করা যায় না। শরীরে ঘা হয়। তরুণ লেখক ও পরিবেশকর্মী মিশকাত রাসেল জানান, লবনদহ নদের শাখা গড়গড়িয়া খালের দুই পাড় দখল করে কংক্রিটের ঢালাই করে ফ্যাক্টরির দুই অংশের সংযোগ করা হয়েছে। এতে করে উজানে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বিপাকে পড়েছে দুই পাড়ের সাধারণ মানুষ। বিস্তার ঘটছে নানা ধরণের জটিল রোগ বালাই। এতে গৃহপালিত পশুপাখিও আক্রান্ত হতে বাদ পড়ছে না। বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের শ্রীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ আলম বলেন, গত বছর নদটি পুনঃখননের কাজ শুরু হয়। ১৮ কিলোমিটার খননের কথা থাকলেও অদৃশ্য কারণে মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটার খনন করার পর হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পরে আর খনন হয়নি। স্থানীয় প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ১১ কিলোমিটার খনন করার কথা, তবে ছয় কিলোমিটার ৬০০ মিটার হয়েছে। পরে বর্ষায় পানি উঠে যাওয়ায় ঠিকাদার মেশিন উঠিয়ে নেয়। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দিচ্ছি কাজটি পুনরায় করার জন্য। শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম জানান, বিষয়টি খুব বেদনাদায়ক। কৃষিজমিতে ধান না ফলাতে পারলে আমরা খাবো কি! কৃষক বাঁচলেই আমরা বাঁচবো। মিল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে পরিবেশ অধিদপ্তর। উপজেলা প্রশাসন পাশে থেকে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে। গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া জানান, শ্রীপুর প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা হওয়ার পরও কোনো ডাম্পিং স্টেশন নেই। যে কারণে যে যার ইচ্ছেমত ময়ালা আবর্জনা ফেলছে। ইটিপি প্লান ব্যবহারে অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ইচ্ছে দেখি না। তবে আমরা অনলাইন নজরদারির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। আশা করছি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম মেনেই পরিচালিত হবে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সংগঠনের প্রতি উমামার কমিটমেন্ট ছিল কি না, প্রশ্ন রিফাতের

তরলবর্জ্যের কবলে কৃষিজমি

আপডেট সময় : ০১:৩১:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২২

গাজীপুর প্রতিনিধি : গাজীপুরের শ্রীপুরে মিল-কারখানার অপরিশোধিত বিষাক্ত তরলবর্জ্যে কৃষকের কয়েকশ একর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বিগত তিন বছর ধরে স্থানীয় কৃষকরা এ জমিতে না পারছে ধান ফলাতে, না পারছে সবজি চাষ করতে। এ অঞ্চলে যারা শুধুমাত্র কৃষিনির্ভর তাদের অবস্থা বেগতিক। ধান ফলিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে এখন উল্টো আরও ঋণগ্রস্ত। ভালুকা উপজেলার ক্ষীরু নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে শ্রীপুর উপজেলার উত্তর সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে লবনদহ নামের একটি নদ। উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের পূর্ব এবং পৌরসভার পশ্চিমপ্রান্ত ঘেষে কেওয়া পশ্চিম খন্ড, পাথারপাড়া, বহেরার চালা, বেলতলি, বেড়াইদেরচালা, শিরিরচালা, ইন্দ্রবপুর, বানিয়ারচালা, ভবানিপুর, পিরুজালী ও মনিপুর দিয়ে এঁকেবেঁকে তুরাগ নদীতে গিয়ে এ লবনদহ নদ সংযুক্ত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার। এ নদের উভয় পাশে যাদের জমি রয়েছে তারাই পড়েছে বিপাকে। শ্রীপুর পৌরসভা ও গাজীপুর সদরের অসংখ্য মিল-কারখানার অপরিশোধিত দূষিত তরলবর্জ্য মাটির নিচ দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় সরাসরি ছাড়া হচ্ছে এ নদে। দখল দূষণে মৃত প্রায় এ নদে পতিত এসব বিষাক্ত তরলবর্জ্য উপচে গিয়ে পড়ছে কৃষকের জমিতে। আর এতেই নষ্ট হচ্ছে এ অঞ্চলের প্রায় কয়েকশ একর ধানের জমি। শ্রীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বহেরার চালা গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় কৃষক মো. মফিজ উদ্দিনের সঙ্গে। তার ১০ বিঘা জমি বিষাক্ত বর্জ্যে তলিয়ে আছে। কেমন আছেন প্রশ্ন করতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এখন শুধু মরার বাকি’। জমিতে ধান ফলানো ছাড়া জীবিকা নির্বাহের অন্য কোনো উপায় নেই তাঁর। পরপর তিনবার ধান চাষ করেও খরচই তুলতে পারছেন না মফিজ উদ্দিন। সংসারের সবাইকে নিয়ে পথে বসার অবস্থা এখন তার। বিষাক্ত এ তরলবর্জ্য জমিকে নয় বরং তার জীবনকেই যেনো বিষাক্ত করে তুলেছে। প্রতিকার পেতে অনেকবার পৌর মেয়রের কাছে গিয়েও কোনো লাভ হয়নি। ৪০-৫০ জন কৃষক একসঙ্গেও গিয়েছেন মেয়রের কাছে। মেয়র আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। মফিজ উদ্দিন জানান, আশেপাশের কারখানার সব বর্জ্য, হাসপাতালের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি স্যালাইন প্যাকেট, ইনজেকশন ও বোতল সব এনে রাতের আঁধারে আমাদের জমিতে ফেলে রাখে। এমনকি পৌরসভার বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনাও এখন আমাদের ফসলি জমিতে এনে ফেলছে। দেখার কেউ নেই। কথা হয় ভুক্তভোগী কৃষক শফি কামাল, জালাল মিয়া, মুক্তার, সিরাজ উদ্দিন মাস্টার, মুখলেস মোল্লা, আক্রাম হোসেন, সাইফুল ইসলামসহ আরো অনেকের সঙ্গে। শফি কামাল জানান, এ গ্রামে মিতালি, এক্স সিরামিক্স, ক্রাউন, হরাইজনসহ অসংখ্য মিল-ফ্যাক্টরি রয়েছে। এগুলোর বর্জ্য আমাদের জমির পানিতে এসে পড়ে। এখানে শুধু ধান কেনো, কোনো ফসলই হবে না। জমির আইলে মৃতপ্রায় তালগাছ দেখিয়ে শফি বললেন, দেখুন এখানে ধান কেনো, কোনো কিছুই হবে না। মাটি বিষাক্ত হয়ে গেছে। ক্ষেতে নেমে আর কাজ করা যায় না। শরীরে ঘা হয়। তরুণ লেখক ও পরিবেশকর্মী মিশকাত রাসেল জানান, লবনদহ নদের শাখা গড়গড়িয়া খালের দুই পাড় দখল করে কংক্রিটের ঢালাই করে ফ্যাক্টরির দুই অংশের সংযোগ করা হয়েছে। এতে করে উজানে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বিপাকে পড়েছে দুই পাড়ের সাধারণ মানুষ। বিস্তার ঘটছে নানা ধরণের জটিল রোগ বালাই। এতে গৃহপালিত পশুপাখিও আক্রান্ত হতে বাদ পড়ছে না। বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের শ্রীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ আলম বলেন, গত বছর নদটি পুনঃখননের কাজ শুরু হয়। ১৮ কিলোমিটার খননের কথা থাকলেও অদৃশ্য কারণে মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটার খনন করার পর হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পরে আর খনন হয়নি। স্থানীয় প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ১১ কিলোমিটার খনন করার কথা, তবে ছয় কিলোমিটার ৬০০ মিটার হয়েছে। পরে বর্ষায় পানি উঠে যাওয়ায় ঠিকাদার মেশিন উঠিয়ে নেয়। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দিচ্ছি কাজটি পুনরায় করার জন্য। শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম জানান, বিষয়টি খুব বেদনাদায়ক। কৃষিজমিতে ধান না ফলাতে পারলে আমরা খাবো কি! কৃষক বাঁচলেই আমরা বাঁচবো। মিল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে পরিবেশ অধিদপ্তর। উপজেলা প্রশাসন পাশে থেকে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে। গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া জানান, শ্রীপুর প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা হওয়ার পরও কোনো ডাম্পিং স্টেশন নেই। যে কারণে যে যার ইচ্ছেমত ময়ালা আবর্জনা ফেলছে। ইটিপি প্লান ব্যবহারে অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ইচ্ছে দেখি না। তবে আমরা অনলাইন নজরদারির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। আশা করছি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম মেনেই পরিচালিত হবে।