সাগুফতা শারমীন তানিয়া : জেকবের ফুসফুসের ভেতর শ্বাসের ছোট ছোট পুঁটুলিগুলোকে অসংখ্য হাতে চাপ দিচ্ছিল কে যেন, ঘরে নীলাভ অন্ধকার, পা-হড়কানো কাদা কাদা নীল, পচতে থাকা নীল, বৃষ্টিধোয়া পীচঢালা পথের মতো হিলহিলে নীল অন্ধকার, ঠিক ভোর হবার আগেকার আলোয় পিচ্ছিল নীল হয়ে আসা পাথুরে বাঁধাই রাস্তার মতো অন্ধকার, জেকব অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে শ্বাস কেড়ে নেবার ক্ষমতার সাথে লড়াই করতে করতে অপেক্ষা করছেন কখন সেই নীলের গর্ভ স্ফুরিত হবে. . . আর স্থলপদ্মের মতো মুচড়ে মুচড়ে পাপড়ি মেলবে গোলাপি, বৃন্তের মতো স্তনের মতো ফুলের মতো গোলাপি। সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। সেই গভীর গোলাপি আলোয় জেকব যেন সেই ছোট্ট অপরিসর ঘরটাতে পাবলোর সাথে শুয়ে আছেন, যমজ শিশুদের ভ্রুণের মতো অবিচ্ছেদ্য, গোলাপি। কে তাঁকে মিহি গলায় ডাকল, ‘ভুলোকাকু! ‘
জেকব ভীষণ শ্বাসকষ্টের ভেতরেও হাসলেন। গোলাপি আলোটা জাগছে যেন, এই গলার আওয়াজ কি তাঁর ভুল হতে পারে! একবার ভাবলেন, ফার্মাসিস্টের কাছ থেকে ইথারের বোতলটা কিনে এনে দুয়ার-এঁটে নেশা করছেন না তো! নাহ, উত্তাপময় সম্ভাবনাময় গোলাপি আঙুল তাঁর হাত ছুঁল, আবার ডাকল, ‘ভুলোকাকু? ‘ এবার জেকব সেই কচি কচি আঙুল জড়িয়ে ধরলেন। এই আঙুল আঁকড়ে পাহাড়ের পথ ধরে একদিন ভোরে অনাথাশ্রমে গেছিলেন, আশ্রমের নাম ‘দয়াময়ী সদন’। হেসে ডাকলেন, ‘কিরণময়ী! ‘
ওর নাম তো কিরণময়ী নয়, ওর শুভ নামটার মানে তো রক্ষাকর্ত্রী, শরণ্যা, কিন্তু ছোট করে দিলে কিরণ, কিরণময়ী, আলোয় আঁকা শিশু। সত্য ওঁর কাছে সতত নবীন বলে, প্রতিবার ভোলেন বলে তিনি ‘ভুলোকাকু’। কিরণ যেন সমস্ত গায়ের ভার ওঁর গায়ে ঢেলে ঘেঁষে বসল। শিশুর গায়ের গন্ধও যেন গোলাপি, সেই গায়ের ভারটুকুও গোলাপি। উষ্ণতাটুকুও। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘বাবা তোমায় বাঁচাতে এল না? প্রাণের বন্ধুকে বাঁচাতে একবারও এল না?
জেকব অতটা শারীরিক কষ্টেও মতিচ্ছন্ন হননি, তিনি সান্ত¡নার সুরে বললেন, ‘বন্ধুত্ব ব্যাখ্যাতীত। ওর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গেলেই যে ওটা মরে যাবে! ‘
‘তোমার বন্ধুত্ব মরে যায়নি? ‘
‘কই না তো! আমি তো এখনো ওই ছোট্ট ঘরটায় মনে মনে থাকি। এত ছোট্ট যে ঘুমোতে হলেও পালা করে ঘুমোতে হয়, রাতে আমি ঘুমোই, তোর বাপ আঁকে সারারাত; দিনে আমি কাজে যাই আর সে পড়ে পড়ে ঘুমোয়! মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলি, আমাদের দশা হবে আলব্রেখট দুর্যা আর তাঁর সেই বন্ধুর মতো। জানিস তো, দুর্যা আর তাঁর বন্ধু এসেছিলেন আর্টস্কুলে আর্ট শিখবেন বলে। কিন্তু ওঁরা খুব গবিব। তাই ঠিক করলেন-একজনকে কাজ করতে হবে, আরেকজন তখন শিল্পী হবে, এভাবে পরের জনের পালা আসবে, তখন সে ছবি আঁকা শিখবে আর শিল্পী লোহারের কাছে কাজ করবে। প্রথম পালা এল দুর্যার, তিনি যাবেন আর্টস্কুলে। যদ্দিনে তিনি ফিরেছেন শিল্পী হয়ে তদ্দিনে লোহারের দোকানে কাজ করে করে বন্ধুর হাতগুলোয় কড়া পড়ে গেছে, ওই বেঁকে যাওয়া আঙুলে আর তুলি ধরে শিল্পী হওয়া হবে না! হা হা হা। ‘
‘কী কাজ করতে তুমি? ‘
‘কত্ত কাজ! তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজ-বড়লোক আর্ট-ডিলারের মতো সাজগোজ করে আর্ট মার্চেন্টের কাছে গিয়ে গিয়ে তোর বাপের আঁকা ছবি খুঁজবার ভান করা। নেই বললেই আকাশ থেকে পড়তাম! বলতাম-সে কী, দেশের সেরা শিল্পীর কাজ আপনারা রাখেন না! ফিরে এলে তোর বাপ শুধরে দিয়ে বলত, দেশের সেরা বললি কেন. . . বলবি জগতের সেরা, ওসব আর্ট ডিলাররা যাই বলুক। ‘
‘বাবার ছবি পথের ধুলোয় বাচ্চাদের চাকাবিহীন পুরনো প্র্যামের পাশে গড়াত! আর তোমার মন হায়-হায় করত। ‘
‘হ্যাঁ। লোকে তখন দোকানে এসে রেনোয়াঁর ছবি দরদাম করে, সেজানের আর্ট ডিলার বিরসবদনে এককোণে বসে থাকে, তোর বাপ তখন এল গ্রেকোর স্টাইলে মানুষ আঁকছে, বিকেলের দীঘল ছায়ার মতো তাদের আকার, দীর্ঘগ্রীব মানুষ, “ভুলো-না-আমায়”ফুলের মতো নীল। প্রিয়বন্ধু আত্মহত্যা করেছে বলে তোর বাপের ছবিতে কেমন মৃত্যুর ছায়া. . . মনোক্রোমে আঁকা ছবি. . . দুঃখ-দুর্দশার ছবি. . . ১৯০১ সালের মানুষ ও ছবির কী বুঝবে! আমি দোকানের ভেতর গিয়ে দেখি-ইনকাদের মতো গাট্টাগোট্টা একটা লোক গরিবগুর্বো লোকদের ভিড়ে বসে আছে, স্পেনীয়রা গিটারে বেঠোফেনের নবম সিম্ফনি বাজাচ্ছে। ছবি বেচা হয়নি তো কী, একটুও দমে যায়নি সে, কেমন আইবেরীয় প্রিমিটিভ আর্টের মতো তার তীক্ষ্ণ তীব্র চোখ, সেই চোখে কত আশা, কত অন্বেষা। গায়ে তার দস্তাখনির শ্রমিকদের জামা, সেদিন আমি পরেছিলাম জাদুকরদের মতো জোব্বা। সেই যে দেখা হলো, আমরা মিলে গেলাম একসাথে। সারারাত বাজনা বাজল-‘ওড টু জয়’। যেন সব দুঃখ-দুর্দশার বিপরীতে আমাদের ভবিষ্যতই বেজে উঠল ওই সব গরিব মানুষের গিটারে। ‘
অত কথা বলে হাঁপিয়ে উঠলেন জেকব। তিনবছরের মাথায় জুটে গেছিলেন আরেক কবি। পরে কিরণময়ী সেই কবিকে ডাকত ভালোকাকু, আর তিনি ছিলেন ভুলোকাকু। হাহ, ভালোকাকু! ভালোকাকু তখন পয়সার জন্য চটিপুস্তিকা লিখছেন, ‘সস্তার ছোট-গর্ত’। তিনজনের সেই সব গলাগলির দিন, ঘরের সেই পচা কাঠের মেঝে, তিসির তেল আর কালো তামাকের গন্ধ, একখানা লোহার পুরনো চুল্লি আর একটিমাত্র তোশক। সাদা ইঁদুর দৌড়ত সেই মেঝেয়। সেখানে এসে জুটলেন দেরাঁ, এলেন ব্রাক। শুধু দেখে কি আর আঁকা যায়, ছুঁয়ে-ছেনে না দেখলে আঁকা হয় না, বলেই হো হো হাসি। সার্কাসে যেতেন, বেশ্যালয়ে যেতেন, মানুষ দেখতে, আর মানুষ আঁকতে।
‘তোর ছোট্টবেলার কথা মনে আছে? ‘
কিরণময়ী মৃদু হাসে, এইটুকুন কথার ফাঁকেই যেন সে আরেকটু বড় হয়ে উঠেছে, সে নিজের চুলের বিনুনিতে আলতো করে আঙুল সেঁধিয়ে দেয় যেন খুলে নেবে পাক। (ইস্কুলে যাবার আগে এমনি করে রঙিন ফিতেয় বিনুনি বেঁধে দিত কিরণের পাতানো মা। ) বলে, ‘সন্ন্যাসিনীরা ছোট্টবেলায় আমাদের অনাথাশ্রমে বলত, অক্লেশে জীবনের বোঝা বইতে হবে। তপ্ত লোহার ছ্যাঁকা খেয়েও গরুতে যেমন মাঠের মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তেমন করে গরুর মতো অবিচলভাবে জীবন বইতে জানতে হবে। ‘
‘তোর মায়ের কথা তোর মনে আছে? ‘
‘আমার মা ছিল পথের মেয়ে। খরিদ্দারের আশায় আমায় ফেলে. . . ‘
‘সেই মা নয়। পাতানো মা। ‘
‘দিনেমার বুড়ি? বেহালা শিখতে পারিনি বলে যে আমায় ফিরিয়ে দিয়ে গেছিল আশ্রমে? ‘
কিরণময়ী ইচ্ছে করে খেলছে! জেকব বুঝতে পারেন। ক্লান্ত গলায় বলেন, না, সেই মা নয়। অন্য মা। যে মা মডেল হিসেবে কাজ করত। তোর সেই মা আর সেই বাপ। যারা আফিম খেত। একে অন্যকে ভীষণ সন্দেহ করত। মারপিট করত। দুজনই খুব অস্থির, একে অন্যের নিষ্ঠুর প্রবৃত্তিও খুব চিনত। এক বৃষ্টির রাতে তোর সেই বাপ বাড়ি ফিরল তাকে প্রথম দেখে, চুলগুলো লাল, হাতে পথে কুড়িয়ে পাওয়া বেড়ালছানা। ‘
কিরণ তবু ধরা দিল না। জেকবের শ্বাস কমে আসা বুকে নরম হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তোমাদের সেই বাড়ির কথা বলো ভুলোকাকু। তুমি যার নাম দিয়েছিলে “ধোপাডিঙা”। ‘ জেকব চুপচাপ শুয়ে অন্ধকারে ‘ধোপাডিঙা’ বাড়িটা দেখতে থাকেন, ঘুপচিমতো সব সস্তার ঘর, ঝড়ের দিনে ঘরগুলো বাতাসের ঝাপটায় দোলে, শীতে হাড়কাঁপানো শীত সে বাড়িতে আর গরমকালে তীব্র গরম, একটিমাত্র জলের কল। একদিন ওই বাসা ছেড়ে সব পাখি উড়ে যাবে, নীড়ের সেই খড়কুটো আর চোরাই চামচ অব্দি। প্রথম উড়াল দেবে কে? . . . সে বাড়িতে পাবলোর পর্দাহীন ঘরের এককোণে চারপাই, বেতের চেয়ার, ঢালাই লোহার সেই স্টোভটা আর হলদে চিনেমাটির পাত্রখানি-ওতে মুখ ধোয় ওরা। কাঠের টেবিলে একচিলতে খয়া সাবান আর তোয়ালে। তোয়ালে কীসের, ওটা ন্যাকড়া। একটা পোষা সাদা ইঁদুর ছিল ওদের, আর একটা কুকুর। কালো ট্রাঙ্কের ওপর বসে থাকত কিরণের অন্য মা, অন্যরকম মা, লালচুলো ঝলমলে মডেল। ছবিতে দেবীর মতো ফটফটে আকর্ণবিস্তৃত চাউনি তার। আড্ডায় সে ছিল রাণী।
‘অন্য মা আমাকে স্টু থেকে তুলে মশলার পুঁটুলিটা চুষতে দিত। ‘ বলে কিরণ। মনে আছে জেকবের, রান্নার সময় লালচুলো গলগল করে মদের বোতল উপুড় করে দিত হাঁড়িতে। অন্য শিল্পীর সামনে বুক বের করে মডেলিং করেছিল বলে পাবলো তাকে চড় মেরেছে. . . সেই গল্প করে সে হেসে লুটিয়ে পড়ত। তার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকত জেকব, মনে ভাবত-কী আছে ওর ভেতর? পাবলোর দুঃসময়ের রাজসাক্ষী, পাবলোর গোলাপি আমলের ইন্ধনদাত্রী। ক্যানভাসে সকালের নরম রোদের মতন হলুদাভ গোলাপি পটভূমিতে একেবারে ন্যাংটো হয়ে আছে সেই অন্য মা।
‘তার ওপর রাগ রাখিস না সোনা। বড় দুঃখী ছিল সে। ‘
দুঃখের কথায়, নাকি অন্য কোনো কথা মনে পড়ে গেল বলে হেসে উঠল কিরণময়ী।
‘শিল্পীকে লোকে ছারপোকার মতন, উকুনের মতন দুই নখের ফলকে চেপে টিপে মারে। শুধু সমাজের সাথে সমাজে প্রচলিত বিধির সাথে অতটা তফাতের কারণে এত বড় শাস্তি আর কেউ পায় না। . . . এই সব কথা মা আর লরা কাকি বলত, আড়ালে। এসব কথার অর্থ সাদা ইঁদুরটা, বাদামি কুকুরটা আর আমি সমানভাবে বুঝতাম! ‘
হাসলেন জেকব। মাথা নেড়ে বললেন, ‘উকুনের মতো শিল্পীকে মারে বলেই শিল্প হতে হবে সমাজ-বিরোধী, লড়াকু। তোর বাপ বলত। তোর অন্য বাপ। পাবলো। একবার হলো কী, মাতিস ওর ছবিকে ‘সমাজবিরোধী’ বলেছিল বলে তোর বাপ বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মাতিসের মেয়ের ছবিতে চাঁদমারি করলো। ভাবতে পারিস! ‘
‘তবু তুমি সেই অদ্ভূত নিষ্ঠুর লোকটাকে অত ভালবাসতে! কেন ভুলোকাকু? ‘
কাশি উঠছিল জেকবের, গোলাপি কিরণময়ী যতœ করে ওঁর মুখের কোণ থেকে শ্লেষ্মা মুছে দিল রুমালে। রুমালটা সোনালি রেশমের। জেকব অন্ধকারে পবিত্র জলের ধারে চুপটি করে বসে থাকা কোনো দেবদূতের চোখ দিয়ে বিভোর হয়ে কিরণের অন্য মাকেই দেখছিলেন। কী ছিল মেয়েটির ভেতর? নিজের খসড়ার অজস্র কাটাকুটির ভেতর দিয়ে যেমন অনায়াসে বের করে নেওয়া যায় নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য, তেমন করে সেই মেয়েটির ভেতর সাঁতরে পাবলো কোন অন্বিষ্টকে পেতেন? ও মেয়ে তো শুয়ে-বসে দিন কাটায়, আর পাবলো দিনমান তার খেদমত করেন, ছবি বেচা টাকায় বেড়াতে নিয়ে যান পিরেনীজ পর্বতমালার কোনো গ্রামে।
পাবলোর চিত্রসখা হয়ে গেলেন ব্রাক, কবিতার সঙ্গী হয়ে উঠলেন কিরণময়ীর ভালোকাকু, আর প্রেম কিরণময়ীর অন্য মা। জেকব কোথায়? বুলেভার্দ ভলতেয়ারের সেই ছোট্ট কামরার সহবাসী জেকব? লোহারের দোকানে কাজ করে বাঁকা হয়ে ওঠা পরিত্যক্ত হয়ে ওঠা আঙুলের মতো শিল্পসহায় বন্ধু জেকব? সে না প্রেম, না সান্নিধ্য।
‘ভুলোকাকু? ‘
‘উঁ? ‘
‘অন্য মা যখন আমাকে অনাথাশ্রমে ফিরিয়ে দিতে গেল তখন মাদার সুপিরিয়র আমাকে কিছুতেই ফেরত নিতে চাইলেন না জানো! বললেন, “যখন দত্তক নিয়েছিলে তখন কি জানতে না এই মেয়ে একদিন ডাঁসা যুবতী হতে শুরু করবে? ”এই সব শুনেটুনে অন্য মা আমাকে নিয়ে আবার ধোপাডিঙায় ফিরে এল। ‘
‘অন্য মা যখন আমাকে অনাথাশ্রমে ফিরিয়ে দিতে গেল তখন মাদার সুপিরিয়র আমাকে কিছুতেই ফেরত নিতে চাইলেন না জানো! বললেন, “যখন দত্তক নিয়েছিলে তখন কি জানতে না এই মেয়ে একদিন ডাঁসা যুবতী হতে শুরু করবে? ”এই সব শুনেটুনে অন্য মা আমাকে নিয়ে আবার ধোপাডিঙায় ফিরে এল। ‘
‘ডাঁসা বলেছিল? উফফ। কী বিশ্রী কথা। ‘ জেকবের চোখে ভাসে চাষাদের মুখের মতো অভিব্যক্তিহীন প্রায়-মুখোশ পাবলোর মুখ, চৌকো কাঁধ, পেশল হাতপা। তাঁকে গোলাপির দিকে ফিরিয়ে আনবার সময় কিরণের অন্য মা বুঝতে পারেনি এই গোলাপিতে এসে মিশবে আরও কত রক্তিম, পানসে নীল মৃত্যুময় নীল থেকে ফিরে এসে আকন্ঠ গোলাপি গিলে মানুষ স্থির থাকতে পারে না, আরও কত উর্বরতার দিকে তার যাত্রা শুরু হয়। পাবলোর ক্যানভাসে কোমলতমা কিশোরীরা কাঁকই দিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকল, তাদের শীর্ণ নাজুক পা দুফাঁক করে উঁকি মেরে আবিষ্কার করতে চাইলো ঝিনুকের মাংসল রাজত্ব। ইন্ডিয়ান ইংকে আঁকা আঁচড়কাটা ছবিতে ফুটে উঠছে কিরণময়ীর নির্ভুল মুখ। পাবলোর ছবিতে অন্য মায়ের দেবীর মতো ফটফটে চাউনি আস্তে আস্তে সরু রেখার মতো হয়ে উঠছে, সত্যিকার জগতেও অন্য মায়ের চোখ সরু হচ্ছে, সেই চোখে অবসাদ, রাগ, ঘৃণা, বিরক্তি।
‘প্রথম যৌবনে তোর অন্য মার পেটে বাচ্চা এসেছিল, স্বামী মেরেধরে সেই বাচ্চা খসিয়ে ফেলল। বিয়ে হয়েছে বলে আর বিয়ে হলো না। প্রথম বাচ্চা মেরে ফেলেছে বলে আর বাচ্চাও হলো না। অথচ তোর বাপকে মানে অন্য বাপকে ভালোবাসবার পর ওর খুব ইচ্ছে হয়েছিল একটা সংসারের। সেখানে প্রেম থাকবে, সন্তান থাকবে। অস্থায়ী সেই ধোপাডিঙার বাড়িতেই হোক না কেন সেই সংসার। তোকে নিয়ে এল অনাথাশ্রম থেকে। প্রথমদিকে কী ভালোই না বাসত তোকে! কত রংবেরঙের ফিতে দিয়ে বিনুনি করে দিত তোর চুল। মনে আছে তোর? আমরা কেউ না কেউ তোকে ইস্কুলে নিয়ে যেতাম, ভালোকাকুর পিঠে চড়তি তুই আর কয়লার ট্রেনের মতো চুরুটের ধোঁয়া ছাড়ত কাকু। তোর বাপ তোকে বসিয়ে বসিয়ে হোমওয়ার্ক করাতো। ‘
মাতৃত্বের স্বল্পমেয়াদী বাসনা একদিন ফুরল। পাবলোর পিতৃত্ব বিচিত্র হয়ে উঠল বলেই ফুরলো। তার ভুলোকাকুর হাত ধরে কিরণময়ী আবার একদিন ফিরে গেল অনাথাশ্রমে, দয়াময়ী সদনে। মাসপয়লা রবিবারে তাকে দেখতে যেত অন্য মা, পোস্টকার্ড পাঠাত। তারপর সবাই তাকে ভুলে গেল। সে কি বেঁচে ছিল? ডাঁসা যুবতী হওয়ার বয়েস অব্দি? সেবারের মৌসুমে প্যারিসের মেয়েরা বাহারী কবরী বেঁধে গ্রীবার শুরুতে এঁটে রাখছিল, খোলা পিঠে স্থলপদ্মের পাপড়ির মতো উড়ু উড়ু কাপড়. . . সে-ও কি তেমন? তবে এই ডিটেনশন ক্যাম্পের অন্ধকার ঘরে সে কোথা থেকে এল? জেকবের অস্থির মন এবং দুর্বল শরীর আর নিতে পারলো না। শুয়ে শুয়ে দম নেবার বৃথা চেষ্টা করতে করতে তিনি দেখতে লাগলেন অন্ধকারে আরও কালো অন্ধকারের মতো এসে দাঁড়িয়েছে কনভয়, ওঁকে মরণকলের মুখে ফেলে দিয়ে আসবে বলে।
কিরণময়ী তখনো তাঁর শরীরের কাছটিতে পোষা প্রাণীর মতো করে বসে আছে, বসে বসে দুলছে। আর বলছে, ‘তুমি যেমন শখের বান্ধব, আমি তেমনি শখের পুতুল। খেলা ফুরলে পাবলো আমাদের মাঝপথে ভুলে গেছে। . . . তুমি লিখেছিলে ভুলোকাকু, “তুমি আমায় মারতে পারো, মারতেই পারো, আমারও সময় আসবে? ”কই, সময় তো এল না! ‘
বুকের ব্যথাটা একটা প্রমত্ত দানবের আকার নিচ্ছে। কে দেখেছে ব্যাঙকে বেতো রুগীর মতো করে রাস্তা পেরোতে, রাস্তা পেরোনো ব্যাঙের মতো জেকবও কি পথে একটা পা ফেলে আসেন, পরে সেটা টেনে নিয়ে আসেন সচল পায়ের গন্তব্য অব্দি। কেউ দেখে না তাঁকে। ‘আমায়ও দেখত না, যদ্দিন হলদে তারা পরতে হয়নি আমার, এখন হয়। এঁদো নালার ব্যাঙের কী ভাগ্যি, তাকে হলদে তারা পরতে হয় না! ‘ পেছনের জীবনটাকে ব্যাঙের সেই পায়ের মতো করে টেনে কাছে আনতে গিয়ে ম্যাক্স জেকব দেখলেন, ঘরের দেয়ালটা উবে গেছে, সেখানে নিশুতি রাত্রির আকাশ, মর্টারের গোলা তুবড়ির মতো উড়ে যাচ্ছে সেই আকাশে, আর সমাধি থেকে বিভোর চোখে সেদিকে চেয়ে আছেন কিরণময়ীর ভালোকাকু কবি আপোলিনেয়ার, ভাবছেন-আহা যুদ্ধ কী চমৎকার! কী অস্তিত্বময়! আকাশের তারাগুলো বাজির মতো পুড়ছে আর পাবলোর ক্যানভাস ফুঁড়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে গোয়ের্নিকার ঘোড়া-ষাঁড় আর পেছন পেছন অনাথাশ্রমের ছোট ছোট মেয়েরা।
কে যেন বলে গেছিল, জীবন হ্রস্ব, আর শিল্প সুদীর্ঘ? ল্যাটিনটা যেন কী?
(পাবলো পিকাসোর চিরবন্ধু ম্যাক্স জেকব ১৯৪৪-এ গেস্টাপো বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। জেকব ছিলেন সমকামী ইহুদি, আউস্উইশে চালান হয়ে যাবার আগে ইনিমোনিয়ায় ভুগে বন্ধুহীন সহায়হীন দশায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পিকাসো তাঁকে বাঁচাবার কোনো চেষ্টাই করেননি।)
অকালপীরিতি
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ