মহানগর প্রতিবেদন : ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডেটেইল এরিয়ে প্ল্যান (ড্যাপ)-এর গেজেট চূড়ান্ত হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই প্রকাশ করা হবে। আবাসন ব্যবসায়ীদের আপত্তি আর খসড়া ড্যাপে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে এতদিন প্রকাশ করতে পারেনি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ড্যাপ পর্যালোচনা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ড্যাপ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি জানান। এদিকে ড্যাপের গেজেট প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আগেই আবেদন করেছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। সংগঠনটির দাবি, প্রস্তাবিত ড্যাপ আবাসন শিল্প ধ্বংসের অশনি সংকেত। এটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটের দাম ন্যূনতম ৫০ শতাংশ বাড়বে। যা ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এতে আবাসন শিল্প ক্রেতাশূন্য হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে।
তবে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা অনেক নি¤œ অবস্থানে। এর প্রধান কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অধিক জনঘনত্ব। তাই নাগরিক সুবিধা ও পরিষেবার বিপরীতে জনসংখ্যা নির্ধারণ করেই ড্যাপ প্রণয়ন করছে রাজউক। প্রস্তাবিত ড্যাপে জনঘনত্ব বিবেচনা করে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এখন রিহ্যাবের যৌক্তিক কোনো দাবি থাকলে রাজউককে তা আমলে নিতে হবে।
রাজউক সূত্র জানায়, ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে প্রথমে (১৯৯৫-২০১৫) একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালের জুনে ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ হলেও তাতে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। পরে ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য সাতজন মন্ত্রীকে নিয়ে একটি ‘মন্ত্রিসভা কমিটি’ গঠন করে সরকার। তখন আবারও ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে বাস্তবে রূপ পায়নি ওই পরিকল্পনা।
২০১৫ সালের মার্চে আগের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন এবং স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে একটি জনবান্ধব ও বাস্তবসম্মত ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) প্রণয়নের কাজ শুরু করে রাজউক। এরই মধ্যে এই ড্যাপের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ড্যাপ চূড়ান্ত করতে জাতীয় সেমিনার করে রাজউক।
সেমিনারে ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সেসময় জানান, ঢাকাকে আর কোনোভাবেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে দেওয়া হবে না। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বসবাসের অযোগ্য নগরীতে রূপান্তর করতে পারি না। তাই সব আর্থ-সামাজিক শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রয়োজন, জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও মৌলিক বিষয়গুলো এবারের ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া পরিকল্পনা তৈরির সময় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উচ্চপর্যায়ে নীতিমালার পরিকল্পনাগুলো।
বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার মিটিং শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আজ ড্যাপ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ড্যাপে কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কারো ওপর যদি অবিচার করা হয়েছে বলে মনে হয় তবে সেসব সংশোধন করা হবে। কোনো পক্ষের ক্ষতি করার জন্য ড্যাপ পাস করা হচ্ছে না। ড্যাপ চূড়ান্ত হওয়ায় এখন এটি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করা হবে।
ড্যাপ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, আদর্শগতভাবে পরিকল্পনা ও নগরশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে একটি রাস্তার প্রশস্ততার অনুপাতে নির্দিষ্ট উচ্চতার ভবন নির্মাণ করলে তা পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলা যেতে পারে। ফলে ৪০ ফুট প্রশস্ততার রাস্তার পাশে চারতলা উচ্চতার ভবন নির্মাণ করলে তা নগরের নান্দনিকতার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং মানবিক স্কেলের শহর তৈরি করতে ভূমিকা রাখে। তাই সার্বিক বিবেচনায় ঢাকাকে বসবাস অযোগ্যতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। বর্তমানে ড্যাপ প্রণয়নে জনঘনত্ব পরিকল্পনার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যা বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মহাপরিকল্পনায় ব্লক-ভিত্তিক উন্নয়ন, মেট্রো স্টেশনের আশপাশে ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে জনঘনত্বের ইনসেনটিভ দেওয়ার প্রবিধান রয়েছে। শহরের বৃহৎ স্বার্থে জনঘনত্ব শিথিল করা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে জনঘনত্ব হিসাব করা হয়েছে এলাকাভিত্তিক নাগরিক সুবিধার অনুপাতে। এ বিষয়ে এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়নি।
জানতে চাইলে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, নগর বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, রিহ্যাবের যুক্তিসঙ্গত মতামতের ভিত্তিতে ড্যাপের খসড়া তৈরি হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর হোটেল সোনারগাঁওয়ের ওই সেমিনারে তা উপস্থাপন করা হয়। সেখানে সবাই মতামত দিয়েছেন। তাদের যৌক্তিক মতামত ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আশা করি জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ড্যাপ গেজেট হবে।
আপত্তি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে রিহ্যাবের চিঠি : গত ৫ ডিসেম্বর ড্যাপের গেজেট বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আবেদন করেছে রিহ্যাব। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ মোতাবেক নির্মাণযোগ্য ভবনে যে পরিমাণ আয়তন (স্কয়ার ফুট) পাওয়া যায় প্রস্তাবিত ড্যাপে তা অনেক কমে গেছে। বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রেও আশঙ্কাজনক হারে আয়তন কমানো হয়েছে। ফলে ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটের দাম ন্যূনতম ৫০ শতাংশ বাড়বে, যা ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এতে আবাসন শিল্প ক্রেতাশূন্য হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে এবং এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৬৯টি লিংকেজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ৪০ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, এই ড্যাপের কারণে জমির মূল্য কমে আসবে। যার সামান্য এক টুকরা পরিমাণও জমির মালিকানা আছে সেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তার সম্পদের পরিমাণ ও মূল্য হ্রাস পাবে। এছাড়া ঢাকা শহরের জনঘনত্ব ড্যাপে নির্ধারিত মাত্রায় আনতে হলে এই শহরে আর কোনো নতুন মানুষ অভিবাসিত হতে পারবে না। উল্টো ঢাকা শহর থেকে প্রায় অর্ধকোটি মানুষকে চলে যেতে হবে। মানুষ তার আবাসন চাহিদা মেটাতে ফসলি বা কৃষি জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ শুরু করবে। যা খাদ্য নিরাপত্তার পরিপন্থি এবং জাতির জন্য বড় বিপর্যয়।
জানতে চাইলে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) বলেন, জাতীয় সেমিনারের মাত্র ১৫ থেকে ১৬ দিন আগে ড্যাপের পূর্ণাঙ্গ খসড়া আমাদের হাতে দিয়েছে রাজউক। এই সময় ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য খুবই অপ্রতুল। এই ড্যাপে ভবনের স্থাপত্য নির্দেশনা ও অন্যান্য বিষয় স্ববিরোধী ও ত্রুটিপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ড্যাপে বড় রাস্তা এলাকাতেও ভবনে ৫০ হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তন করা যাবে না বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে সাততলার বেশি ভবন করতে পারবেন না ভবন মালিকরা। তাই রাজউকের পরিকল্পিত এলাকায় এই বিধি বাদ দিতে হবে। আরও ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ড্যাপকে পরিশুদ্ধ করতে হবে।
রিহ্যাবের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাজউক সুউচ্চ ভবনের বিপক্ষে নয়। এখন একটি স্বার্থান্বেষী মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে, রাজউক এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এমন তথ্য মিথ্যা ও বানোয়াট। বরং ঢাকাকে বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক রাস্তা চওড়া করা, স্কুল, কলেজ ও নাগরিক সুবিধা বাড়াতে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব জোনিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা নির্ধারিত হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মাহমুদ খান বলেন, ড্যাপের সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা ডেভেলপারদের খুব বেশি পছন্দ হচ্ছে না। মূল কারণ হচ্ছে, ছোট ছোট প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণের বিধি। তবে যে কোনো শহরের একটা নির্দিষ্ট মানদ- আছে। যেখানে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কথা বলা আছে। কিন্তু ডেভেলপাররা চিন্তা করে ছোট প্লটে বেশি ব্যবহার। এটা নিয়ে চিরন্তন দ্বন্দ্ব আছে। তিনি বলেন, শহরে জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সে বাড়তি জনসংখ্যা শহর আর কতটুকু ধারণ করতে পারবে, সেটা ড্যাপে বলা হয়েছে। কিন্তু দেশে এখনো অধিকাংশ জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। সরকারের পক্ষেও চাইলে বড় বড় ব্লক করে পরিকল্পনার সুযোগ কম। তাই দুই কাঠা-তিন কাঠা প্লটে ভবন হবে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু এখন এই অল্প পরিমাণ জায়গায় যেভাবে বহুতল ভবন হচ্ছে, সেটা চলতে থাকলে বাংলাদেশে কোনো পরিকল্পনাই কাজ করবে না। তাই ব্যক্তিগত জমিতে ভবন নির্মাণে আরও বেশি যাতে বিধি মানা হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
ড. আদিল আরও বলেন, ছোট প্লটে বহুতল ভবন হতে থাকলে তখন ভবনের আশপাশে খোলা জায়গা থাকে না। বরং সেখানে আলো-বাতাসও ঢোকে না। ব্যক্তি মালিক যখন দেখবেন, তার ছোট প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে পারছেন তখন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সরকারের কোনো উদ্যোগে জমি ছাড়ার প্রবণতা থাকে না। এজন্য সারাবিশ্বেই নিজ ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, যখন ছোট প্লটে ১০ তলা ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন বাণিজ্য হয়। বাসা ভাড়া দিয়ে লাভ করেন ভবন মালিক। এতে সমাজে বৈষম্য বাড়ে। যার জমি আছে সে ধনী হতে থাকে, যার জমি নেই তাকে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। তাই আমরা চাই প্ল্যানিংয়ের মূল জায়গায় কাজ করতে।-
ড্যাপ চূড়ান্ত হলেও রিহ্যাবের আপত্তি
মহানগর প্রতিবেদন : ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডেটেইল এরিয়ে প্ল্যান (ড্যাপ)-এর গেজেট চূড়ান্ত হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই প্রকাশ করা হবে। আবাসন ব্যবসায়ীদের আপত্তি আর খসড়া ড্যাপে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে এতদিন প্রকাশ করতে পারেনি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ড্যাপ পর্যালোচনা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ড্যাপ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি জানান। এদিকে ড্যাপের গেজেট প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আগেই আবেদন করেছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। সংগঠনটির দাবি, প্রস্তাবিত ড্যাপ আবাসন শিল্প ধ্বংসের অশনি সংকেত। এটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটের দাম ন্যূনতম ৫০ শতাংশ বাড়বে। যা ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এতে আবাসন শিল্প ক্রেতাশূন্য হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে।
তবে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা অনেক নি¤œ অবস্থানে। এর প্রধান কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অধিক জনঘনত্ব। তাই নাগরিক সুবিধা ও পরিষেবার বিপরীতে জনসংখ্যা নির্ধারণ করেই ড্যাপ প্রণয়ন করছে রাজউক। প্রস্তাবিত ড্যাপে জনঘনত্ব বিবেচনা করে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এখন রিহ্যাবের যৌক্তিক কোনো দাবি থাকলে রাজউককে তা আমলে নিতে হবে।
রাজউক সূত্র জানায়, ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে প্রথমে (১৯৯৫-২০১৫) একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালের জুনে ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ হলেও তাতে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। পরে ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য সাতজন মন্ত্রীকে নিয়ে একটি ‘মন্ত্রিসভা কমিটি’ গঠন করে সরকার। তখন আবারও ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে বাস্তবে রূপ পায়নি ওই পরিকল্পনা।
২০১৫ সালের মার্চে আগের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন এবং স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে একটি জনবান্ধব ও বাস্তবসম্মত ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) প্রণয়নের কাজ শুরু করে রাজউক। এরই মধ্যে এই ড্যাপের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ড্যাপ চূড়ান্ত করতে জাতীয় সেমিনার করে রাজউক।
সেমিনারে ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সেসময় জানান, ঢাকাকে আর কোনোভাবেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে দেওয়া হবে না। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বসবাসের অযোগ্য নগরীতে রূপান্তর করতে পারি না। তাই সব আর্থ-সামাজিক শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রয়োজন, জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও মৌলিক বিষয়গুলো এবারের ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া পরিকল্পনা তৈরির সময় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উচ্চপর্যায়ে নীতিমালার পরিকল্পনাগুলো।
বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার মিটিং শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আজ ড্যাপ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ড্যাপে কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কারো ওপর যদি অবিচার করা হয়েছে বলে মনে হয় তবে সেসব সংশোধন করা হবে। কোনো পক্ষের ক্ষতি করার জন্য ড্যাপ পাস করা হচ্ছে না। ড্যাপ চূড়ান্ত হওয়ায় এখন এটি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করা হবে।
ড্যাপ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, আদর্শগতভাবে পরিকল্পনা ও নগরশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে একটি রাস্তার প্রশস্ততার অনুপাতে নির্দিষ্ট উচ্চতার ভবন নির্মাণ করলে তা পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলা যেতে পারে। ফলে ৪০ ফুট প্রশস্ততার রাস্তার পাশে চারতলা উচ্চতার ভবন নির্মাণ করলে তা নগরের নান্দনিকতার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং মানবিক স্কেলের শহর তৈরি করতে ভূমিকা রাখে। তাই সার্বিক বিবেচনায় ঢাকাকে বসবাস অযোগ্যতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। বর্তমানে ড্যাপ প্রণয়নে জনঘনত্ব পরিকল্পনার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যা বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মহাপরিকল্পনায় ব্লক-ভিত্তিক উন্নয়ন, মেট্রো স্টেশনের আশপাশে ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে জনঘনত্বের ইনসেনটিভ দেওয়ার প্রবিধান রয়েছে। শহরের বৃহৎ স্বার্থে জনঘনত্ব শিথিল করা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে জনঘনত্ব হিসাব করা হয়েছে এলাকাভিত্তিক নাগরিক সুবিধার অনুপাতে। এ বিষয়ে এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়নি।
জানতে চাইলে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, নগর বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, রিহ্যাবের যুক্তিসঙ্গত মতামতের ভিত্তিতে ড্যাপের খসড়া তৈরি হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর হোটেল সোনারগাঁওয়ের ওই সেমিনারে তা উপস্থাপন করা হয়। সেখানে সবাই মতামত দিয়েছেন। তাদের যৌক্তিক মতামত ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আশা করি জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ড্যাপ গেজেট হবে।
আপত্তি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে রিহ্যাবের চিঠি : গত ৫ ডিসেম্বর ড্যাপের গেজেট বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আবেদন করেছে রিহ্যাব। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ মোতাবেক নির্মাণযোগ্য ভবনে যে পরিমাণ আয়তন (স্কয়ার ফুট) পাওয়া যায় প্রস্তাবিত ড্যাপে তা অনেক কমে গেছে। বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রেও আশঙ্কাজনক হারে আয়তন কমানো হয়েছে। ফলে ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটের দাম ন্যূনতম ৫০ শতাংশ বাড়বে, যা ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এতে আবাসন শিল্প ক্রেতাশূন্য হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে এবং এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৬৯টি লিংকেজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ৪০ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, এই ড্যাপের কারণে জমির মূল্য কমে আসবে। যার সামান্য এক টুকরা পরিমাণও জমির মালিকানা আছে সেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তার সম্পদের পরিমাণ ও মূল্য হ্রাস পাবে। এছাড়া ঢাকা শহরের জনঘনত্ব ড্যাপে নির্ধারিত মাত্রায় আনতে হলে এই শহরে আর কোনো নতুন মানুষ অভিবাসিত হতে পারবে না। উল্টো ঢাকা শহর থেকে প্রায় অর্ধকোটি মানুষকে চলে যেতে হবে। মানুষ তার আবাসন চাহিদা মেটাতে ফসলি বা কৃষি জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ শুরু করবে। যা খাদ্য নিরাপত্তার পরিপন্থি এবং জাতির জন্য বড় বিপর্যয়।
জানতে চাইলে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) বলেন, জাতীয় সেমিনারের মাত্র ১৫ থেকে ১৬ দিন আগে ড্যাপের পূর্ণাঙ্গ খসড়া আমাদের হাতে দিয়েছে রাজউক। এই সময় ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য খুবই অপ্রতুল। এই ড্যাপে ভবনের স্থাপত্য নির্দেশনা ও অন্যান্য বিষয় স্ববিরোধী ও ত্রুটিপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ড্যাপে বড় রাস্তা এলাকাতেও ভবনে ৫০ হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তন করা যাবে না বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে সাততলার বেশি ভবন করতে পারবেন না ভবন মালিকরা। তাই রাজউকের পরিকল্পিত এলাকায় এই বিধি বাদ দিতে হবে। আরও ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ড্যাপকে পরিশুদ্ধ করতে হবে।
রিহ্যাবের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাজউক সুউচ্চ ভবনের বিপক্ষে নয়। এখন একটি স্বার্থান্বেষী মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে, রাজউক এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এমন তথ্য মিথ্যা ও বানোয়াট। বরং ঢাকাকে বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক রাস্তা চওড়া করা, স্কুল, কলেজ ও নাগরিক সুবিধা বাড়াতে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব জোনিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা নির্ধারিত হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মাহমুদ খান বলেন, ড্যাপের সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা ডেভেলপারদের খুব বেশি পছন্দ হচ্ছে না। মূল কারণ হচ্ছে, ছোট ছোট প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণের বিধি। তবে যে কোনো শহরের একটা নির্দিষ্ট মানদ- আছে। যেখানে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কথা বলা আছে। কিন্তু ডেভেলপাররা চিন্তা করে ছোট প্লটে বেশি ব্যবহার। এটা নিয়ে চিরন্তন দ্বন্দ্ব আছে। তিনি বলেন, শহরে জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সে বাড়তি জনসংখ্যা শহর আর কতটুকু ধারণ করতে পারবে, সেটা ড্যাপে বলা হয়েছে। কিন্তু দেশে এখনো অধিকাংশ জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। সরকারের পক্ষেও চাইলে বড় বড় ব্লক করে পরিকল্পনার সুযোগ কম। তাই দুই কাঠা-তিন কাঠা প্লটে ভবন হবে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু এখন এই অল্প পরিমাণ জায়গায় যেভাবে বহুতল ভবন হচ্ছে, সেটা চলতে থাকলে বাংলাদেশে কোনো পরিকল্পনাই কাজ করবে না। তাই ব্যক্তিগত জমিতে ভবন নির্মাণে আরও বেশি যাতে বিধি মানা হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
ড. আদিল আরও বলেন, ছোট প্লটে বহুতল ভবন হতে থাকলে তখন ভবনের আশপাশে খোলা জায়গা থাকে না। বরং সেখানে আলো-বাতাসও ঢোকে না। ব্যক্তি মালিক যখন দেখবেন, তার ছোট প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে পারছেন তখন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সরকারের কোনো উদ্যোগে জমি ছাড়ার প্রবণতা থাকে না। এজন্য সারাবিশ্বেই নিজ ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, যখন ছোট প্লটে ১০ তলা ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন বাণিজ্য হয়। বাসা ভাড়া দিয়ে লাভ করেন ভবন মালিক। এতে সমাজে বৈষম্য বাড়ে। যার জমি আছে সে ধনী হতে থাকে, যার জমি নেই তাকে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। তাই আমরা চাই প্ল্যানিংয়ের মূল জায়গায় কাজ করতে।-