ঢাকা ০২:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

বিদায় ঘটনাবহুল ২০২১ মহামারি আর কত দিন?

  • আপডেট সময় : ০২:৫১:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১
  • ১১৫ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি ঃ আজ বিদায় নিচ্ছে ২০২১ সাল। বৈশ্বিক মহামারি করোনাসহ নানা কারণে ঘটনাবহুল ছিল বছরটি। সব বিদায়ের সঙ্গেই লুকিয়ে থাকে আনন্দ-বেদনার কাব্য। বিশেষ করে মহামারির কারণে বহুল আলোচিত ঘটনার জন্য মানুষের কাছে বিদায়ী বছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বছরজুড়ে ছিল প্রাণঘাতী করোনা মহামারির খবর।
কোভিড-১৯ মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক মন্দা-২০২১ সালে বিশ্ব অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। আবার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পৃথিবীর মানুষ সাফল্যও পেয়েছে, যা আশার কথা। ২০২২ সালেও এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। মহামারি সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, যতক্ষণ না ঐক্যবদ্ধ হবো, ততক্ষণ মহামারির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শতভাগ সফলতা মিলবে না। ২০২১ সালের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ইস্যু নিয়েই এই প্রতিবেদন।
সারা বিশ্বের মতো দেশের মানুষও লকডাউনের বিধি-নিষেধ মধ্যে ছিলো। সংক্রমণ ঠেকাতে অভাবনীয় লকডাউনে জীবনযাত্রা থমকে যাওয়ার এমন দিন আর দেখেনি বাংলাদেশ; সে কারণে বড় একটা সময় ঘরবন্দি করে রাখার মহামারির দ্বিতীয় বছরে স্বাস্থ্য খাতই ছিল আলোচনায়, যার সর্বাগ্রে ছিল ডেল্টা, রেকর্ড সংক্রমণ, মৃত্যুর ভয়াবহতা আর ভ্যাকসিন ইস্যু।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে দেশে ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম লকডাউনে ১৮ দফা বিধিনিষেধ দেয় সরকার। পরে তা দুই দিন বাড়িয়ে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। সে সময় সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানা, গণপরিবহন চালু ছিল।
এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ সব অফিস ও পরিবহন বন্ধের পাশাপাশি বাজার-মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ হয়। বছরের মাঝামাঝি সময়ে সংক্রমণের তীব্রতায় শনাক্ত ও মৃত্যুর মিছিলের দিনের পর দিন রেকর্ড ভেঙে দেশজুড়ে ভয়াল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
জুনের শুরু থেকে এটি দ্রুতই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ভয়াবহ দাপট দেখে বাংলাদেশ। এ সময় শনাক্ত ও মৃত্যুর সব রেকর্ড ভেঙে যায়।
২৮ জুলাই সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন আক্রান্ত হয়। ৫ ও ১০ অগাস্ট সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়, যা দেশে এক দিনে মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড। করোনায় লাগামহীন এমন বিস্তার ও গুরুতর অসুস্থতার ভয়াবহতার আগে প্রতিষেধক হিসেবে টিকাদান শুরুর কার্যক্রমে যে আশা জেগেছিল, তা হতাশায় পরিণত হয় ভারত ভ্যাকসিনদান বন্ধ করে দিলে।
তবে মহামারি প্রতিরোধে ভ্যাকসিনদান আবারও গতি পায় সরকারের বিকল্প টিকা সংগ্রহের পদক্ষেপে। দুই মাসের বিরতির রেশ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশের ১১ কোটি মানুষকে অন্তত এক ডোজ দেয়া এবং সবাইকে ভ্যাকসিন দিতে মজুদ বাড়ানোর ব্যবস্থাও হয়েছে এ বছরেই। এছাড়া কয়েক দফায় নজিরবিহীন কঠোর লকডাউন ও নানা বিধিনিষেধের মধ্যে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার ইতিবাচক ফলও মিলেছে। হুহু করে বাড়তে থাকা করোনা সংক্রমণ অবশেষে অগাস্টের শেষ দিক থেকে নি¤œমুখী হতে থাকে।তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা থাকে উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানা। আর লকডাউনের মধ্যে ব্যাংকে লেনদেনের সময় নির্ধারণ করা সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। এরপর দফায় দফায় বাড়ানো হয় লকডাউনের বিধিনিষেধ।
এতে বিপাকে পড়ে নি¤œ আয়ের মানুষ। পরিবহন, হাট-বাজার-মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বন্ধ হওয়ায় কাজ হারায় অনেকেই। কাজ না থাকায় রাজধানী ছেড়ে অনেক মানুষ চলে যায় গ্রামে। তবে লকডাউনের শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি জন জীবনে স্বস্তি ফেরাতে রাজনৈতিক সহ নানা মহল থেকে দাবি ওঠে লকডাউন প্রত্যাহারের। এরপর ১১ আগস্ট থেকে কঠোর লকডাউন তুলে নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা দেয় সরকার। গণপরিবহনসহ সমস্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট সব খুলে দেয়া হয়। স্বাভাবিক হয় জীবন যাত্রা। তবে বছরের শেষের দিকে বিশ্বজুড়েপরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হচ্ছিল ঠিক তখনই আবার শনাক্ত হয় নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’। এ নিয়ে নতুন করে সবাই উদ্বিগ্ন। তবে ইতিমধ্যে ভাইরাসটি প্রাদুর্ভাবের প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ৩০ হাজারের বেশি ও বিশে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়েও এর প্রকোপ শেষ হয়নি। এর মধ্যে নতুন এক ধরন শনাক্ত হওয়ায় আবার বেড়েছে উদ্বেগ। তবে এই করোনা পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে, আরও কত সংক্রমণ ও কত প্রাণ কাড়বে, সেটা অজানা।
কয়েকটি আলোচিত ঘটনা : ১. টিকা : ২০২১ সালে কোভিড-১৯ টিকার ব্যবহার হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এ পর্যন্ত বিশ্বে মোট ৮০০ কোটি ডোজ কোভিড-১৯ টিকা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এক্ষেত্রে ব্যবধান ছিল আকাশ-পাতাল। এরই মধ্যে চীনসহ অনেক দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকার ন্যায্য বন্টন নিয়ে কাজ করেছে এবং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ বাড়াতে সচেষ্ট থেকেছে। চীন গোটা বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করেছে এবং নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে।
ফিলিপিন্সের মহামারি প্রতিরোধ কার্যালয়ের জেনারেল কো-অর্ডিনেটর বলেন, ‘আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, চীনা বিমানটি জীবন রক্ষাকারী ভ্যাকসিন নিয়ে ফিলিপিন্সে আসতে দেখে দেশের প্রেসিডেন্ট খুব খুশি হয়েছিলেন। এটি আমাদের জনগণের জন্য বড় আশা নিয়ে আসে।’
২. জীববৈচিত্র্য এবং কার্বন নির্গমন : ২০২১ সালের অক্টোবরে চীনের খুনমিং-এ জীববৈচিত্র্যসংক্রান্ত কনভেনশনে স্বাক্ষরকারীদের পঞ্চদশ সভা (ঈঙচ১৫) অনুষ্ঠিত হয়। এতে খুনমিং ঘোষণা গৃহীত হয়। নভেম্বরে ‘জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন কাঠামো কনভেশন’-এর সম্মেলন ব্রিটেনের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ‘প্যারিস চুক্তি’ বাস্তবায়নের বিস্তারিত নিয়ম নিয়ে দেশগুলো মতৈক্যে পৌঁছায়।
৩. অলিম্পিক : ২০২১ সালের জুলাই ও আগস্টে ৩২তম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়। অলিম্পিকের চেতনা বিশ্বকে মহামারীর মধ্যেও একত্রিত করে। আর আসন্ন ২০২২ বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক অবশ্যই অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকবে। ইতালির অলিম্পিক গেমসের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের সাফল্য কামনা করি। আমরা সকলেই জানি এই শীতকালীন অলিম্পিক কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে। আমরা একটি ভাল অলিম্পিকের পরিবেশ ও মানবজাতির চেতনা তুলে ধরতে চাই।’
৪. দারিদ্র্য : ২০২১ সাল ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকী। চীনে সার্বিকভাবে স্বচ্ছল সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য দূর করেছে। মানবজাতির জন্য একটি অভিন্ন ভাগ্যের কমিউনিটি গড়ে তুলতে চীন ২০২১ সালেও কাজ করে গেছে। তানজানিয়ার শস্য ব্যবসায়ী কামভিরা বলেন, ‘আমি চার বছর ধরে খাবারের ব্যবসা করছি। এই সময়ের মধ্যে, আমি তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়েতে ভ্রমণ করেছি। ট্রেনের টিকিট বাসের টিকিটের চেয়ে সস্তা ছিল। তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে আমার জীবনকে আরও উন্নত করেছে এবং আমার সন্তানদের জীবন আরও ভালো হয়েছে।’
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা অফিসের অন্তর্র্বতীকালীন পরিচালক আবদুলাতিফ বলেন, ‘চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দুই পর্যায়ে সাহায্য করে থাকে। একদিকে উন্নয়নের পথ দেখায়, অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহায়তাও দেয়।’
৫. অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার : যদিও বিশ্ব অর্থনীতি এখনও মহামারির ছায়ায় রয়েছে, আগের বছরের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির তুলনায় ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই বছর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের যোগদানের ২০তম বার্ষিকী এবং ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ প্রস্তাবের অষ্টম বছর। নভেম্বর মাসে, চীন আবার আমদানি মেলা সফলভাবে আয়োজন করে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ২০২২ সালে মানবজাতি মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং যুদ্ধের মতো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হবে। শুধুমাত্র হাত মেলানো, সত্যিকারের বহুপাক্ষিকতার চর্চা এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে জাতিসংঘের মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার মাধ্যমেই সব দেশ ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, মানুষের একটিই পৃথিবী রয়েছে। এই পৃথিবীতে সবাইকে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে যেতে হবে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বিদায় ঘটনাবহুল ২০২১ মহামারি আর কত দিন?

আপডেট সময় : ০২:৫১:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১

বিশেষ প্রতিনিধি ঃ আজ বিদায় নিচ্ছে ২০২১ সাল। বৈশ্বিক মহামারি করোনাসহ নানা কারণে ঘটনাবহুল ছিল বছরটি। সব বিদায়ের সঙ্গেই লুকিয়ে থাকে আনন্দ-বেদনার কাব্য। বিশেষ করে মহামারির কারণে বহুল আলোচিত ঘটনার জন্য মানুষের কাছে বিদায়ী বছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বছরজুড়ে ছিল প্রাণঘাতী করোনা মহামারির খবর।
কোভিড-১৯ মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক মন্দা-২০২১ সালে বিশ্ব অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। আবার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পৃথিবীর মানুষ সাফল্যও পেয়েছে, যা আশার কথা। ২০২২ সালেও এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। মহামারি সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, যতক্ষণ না ঐক্যবদ্ধ হবো, ততক্ষণ মহামারির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শতভাগ সফলতা মিলবে না। ২০২১ সালের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ইস্যু নিয়েই এই প্রতিবেদন।
সারা বিশ্বের মতো দেশের মানুষও লকডাউনের বিধি-নিষেধ মধ্যে ছিলো। সংক্রমণ ঠেকাতে অভাবনীয় লকডাউনে জীবনযাত্রা থমকে যাওয়ার এমন দিন আর দেখেনি বাংলাদেশ; সে কারণে বড় একটা সময় ঘরবন্দি করে রাখার মহামারির দ্বিতীয় বছরে স্বাস্থ্য খাতই ছিল আলোচনায়, যার সর্বাগ্রে ছিল ডেল্টা, রেকর্ড সংক্রমণ, মৃত্যুর ভয়াবহতা আর ভ্যাকসিন ইস্যু।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে দেশে ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম লকডাউনে ১৮ দফা বিধিনিষেধ দেয় সরকার। পরে তা দুই দিন বাড়িয়ে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। সে সময় সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানা, গণপরিবহন চালু ছিল।
এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ সব অফিস ও পরিবহন বন্ধের পাশাপাশি বাজার-মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ হয়। বছরের মাঝামাঝি সময়ে সংক্রমণের তীব্রতায় শনাক্ত ও মৃত্যুর মিছিলের দিনের পর দিন রেকর্ড ভেঙে দেশজুড়ে ভয়াল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
জুনের শুরু থেকে এটি দ্রুতই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ভয়াবহ দাপট দেখে বাংলাদেশ। এ সময় শনাক্ত ও মৃত্যুর সব রেকর্ড ভেঙে যায়।
২৮ জুলাই সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন আক্রান্ত হয়। ৫ ও ১০ অগাস্ট সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়, যা দেশে এক দিনে মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড। করোনায় লাগামহীন এমন বিস্তার ও গুরুতর অসুস্থতার ভয়াবহতার আগে প্রতিষেধক হিসেবে টিকাদান শুরুর কার্যক্রমে যে আশা জেগেছিল, তা হতাশায় পরিণত হয় ভারত ভ্যাকসিনদান বন্ধ করে দিলে।
তবে মহামারি প্রতিরোধে ভ্যাকসিনদান আবারও গতি পায় সরকারের বিকল্প টিকা সংগ্রহের পদক্ষেপে। দুই মাসের বিরতির রেশ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশের ১১ কোটি মানুষকে অন্তত এক ডোজ দেয়া এবং সবাইকে ভ্যাকসিন দিতে মজুদ বাড়ানোর ব্যবস্থাও হয়েছে এ বছরেই। এছাড়া কয়েক দফায় নজিরবিহীন কঠোর লকডাউন ও নানা বিধিনিষেধের মধ্যে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার ইতিবাচক ফলও মিলেছে। হুহু করে বাড়তে থাকা করোনা সংক্রমণ অবশেষে অগাস্টের শেষ দিক থেকে নি¤œমুখী হতে থাকে।তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা থাকে উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানা। আর লকডাউনের মধ্যে ব্যাংকে লেনদেনের সময় নির্ধারণ করা সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। এরপর দফায় দফায় বাড়ানো হয় লকডাউনের বিধিনিষেধ।
এতে বিপাকে পড়ে নি¤œ আয়ের মানুষ। পরিবহন, হাট-বাজার-মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বন্ধ হওয়ায় কাজ হারায় অনেকেই। কাজ না থাকায় রাজধানী ছেড়ে অনেক মানুষ চলে যায় গ্রামে। তবে লকডাউনের শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি জন জীবনে স্বস্তি ফেরাতে রাজনৈতিক সহ নানা মহল থেকে দাবি ওঠে লকডাউন প্রত্যাহারের। এরপর ১১ আগস্ট থেকে কঠোর লকডাউন তুলে নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা দেয় সরকার। গণপরিবহনসহ সমস্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট সব খুলে দেয়া হয়। স্বাভাবিক হয় জীবন যাত্রা। তবে বছরের শেষের দিকে বিশ্বজুড়েপরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হচ্ছিল ঠিক তখনই আবার শনাক্ত হয় নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’। এ নিয়ে নতুন করে সবাই উদ্বিগ্ন। তবে ইতিমধ্যে ভাইরাসটি প্রাদুর্ভাবের প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ৩০ হাজারের বেশি ও বিশে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়েও এর প্রকোপ শেষ হয়নি। এর মধ্যে নতুন এক ধরন শনাক্ত হওয়ায় আবার বেড়েছে উদ্বেগ। তবে এই করোনা পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে, আরও কত সংক্রমণ ও কত প্রাণ কাড়বে, সেটা অজানা।
কয়েকটি আলোচিত ঘটনা : ১. টিকা : ২০২১ সালে কোভিড-১৯ টিকার ব্যবহার হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এ পর্যন্ত বিশ্বে মোট ৮০০ কোটি ডোজ কোভিড-১৯ টিকা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এক্ষেত্রে ব্যবধান ছিল আকাশ-পাতাল। এরই মধ্যে চীনসহ অনেক দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকার ন্যায্য বন্টন নিয়ে কাজ করেছে এবং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ বাড়াতে সচেষ্ট থেকেছে। চীন গোটা বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করেছে এবং নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে।
ফিলিপিন্সের মহামারি প্রতিরোধ কার্যালয়ের জেনারেল কো-অর্ডিনেটর বলেন, ‘আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, চীনা বিমানটি জীবন রক্ষাকারী ভ্যাকসিন নিয়ে ফিলিপিন্সে আসতে দেখে দেশের প্রেসিডেন্ট খুব খুশি হয়েছিলেন। এটি আমাদের জনগণের জন্য বড় আশা নিয়ে আসে।’
২. জীববৈচিত্র্য এবং কার্বন নির্গমন : ২০২১ সালের অক্টোবরে চীনের খুনমিং-এ জীববৈচিত্র্যসংক্রান্ত কনভেনশনে স্বাক্ষরকারীদের পঞ্চদশ সভা (ঈঙচ১৫) অনুষ্ঠিত হয়। এতে খুনমিং ঘোষণা গৃহীত হয়। নভেম্বরে ‘জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন কাঠামো কনভেশন’-এর সম্মেলন ব্রিটেনের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ‘প্যারিস চুক্তি’ বাস্তবায়নের বিস্তারিত নিয়ম নিয়ে দেশগুলো মতৈক্যে পৌঁছায়।
৩. অলিম্পিক : ২০২১ সালের জুলাই ও আগস্টে ৩২তম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়। অলিম্পিকের চেতনা বিশ্বকে মহামারীর মধ্যেও একত্রিত করে। আর আসন্ন ২০২২ বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক অবশ্যই অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকবে। ইতালির অলিম্পিক গেমসের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের সাফল্য কামনা করি। আমরা সকলেই জানি এই শীতকালীন অলিম্পিক কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে। আমরা একটি ভাল অলিম্পিকের পরিবেশ ও মানবজাতির চেতনা তুলে ধরতে চাই।’
৪. দারিদ্র্য : ২০২১ সাল ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকী। চীনে সার্বিকভাবে স্বচ্ছল সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য দূর করেছে। মানবজাতির জন্য একটি অভিন্ন ভাগ্যের কমিউনিটি গড়ে তুলতে চীন ২০২১ সালেও কাজ করে গেছে। তানজানিয়ার শস্য ব্যবসায়ী কামভিরা বলেন, ‘আমি চার বছর ধরে খাবারের ব্যবসা করছি। এই সময়ের মধ্যে, আমি তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়েতে ভ্রমণ করেছি। ট্রেনের টিকিট বাসের টিকিটের চেয়ে সস্তা ছিল। তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে আমার জীবনকে আরও উন্নত করেছে এবং আমার সন্তানদের জীবন আরও ভালো হয়েছে।’
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা অফিসের অন্তর্র্বতীকালীন পরিচালক আবদুলাতিফ বলেন, ‘চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দুই পর্যায়ে সাহায্য করে থাকে। একদিকে উন্নয়নের পথ দেখায়, অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহায়তাও দেয়।’
৫. অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার : যদিও বিশ্ব অর্থনীতি এখনও মহামারির ছায়ায় রয়েছে, আগের বছরের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির তুলনায় ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই বছর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের যোগদানের ২০তম বার্ষিকী এবং ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ প্রস্তাবের অষ্টম বছর। নভেম্বর মাসে, চীন আবার আমদানি মেলা সফলভাবে আয়োজন করে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ২০২২ সালে মানবজাতি মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং যুদ্ধের মতো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হবে। শুধুমাত্র হাত মেলানো, সত্যিকারের বহুপাক্ষিকতার চর্চা এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে জাতিসংঘের মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার মাধ্যমেই সব দেশ ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, মানুষের একটিই পৃথিবী রয়েছে। এই পৃথিবীতে সবাইকে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে যেতে হবে।