ঢাকা ০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কবরে ছড়ানো বুনো ফুল

  • আপডেট সময় : ১১:২২:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১
  • ৪০ বার পড়া হয়েছে

সেলিনা হোসেন : দুজনে কান পেতে রাখে। বাইরে কোনো পাখির ডাক নেই। রাতে ঘুমানোর আগে দুজনে বারান্দায় বসে পাখির ডাক শোনে। রাতের নীরবতায় দুজনের কাছে পাখির ডাক মধুরতম সংগীত। রবিউল বলে, ছোটবেলায় ঘুমানোর আগে মা ঘুম পাড়াত, ‘ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি মোদের বাড়ি এসো’। মায়ের কাছ থেকে এটুকু না শুনলে আমার ঘুম আসত না। এখন পাখির ডাক না শুনলে ঘুম আসে না। অনেকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে তবেই ঘুমাই।
এমন কথা ওর বন্ধুরা সবাই জানে। আকাশি ওর এমন আচরণে ভালোবাসায় গুটিয়ে পড়ে। তার নিজেরও ভালো লাগে পাখির ডাক শুনতে। গুলির শব্দে আতঙ্কিত দুজনে বিছানায় উঠে বসে।
রবিউল বলে, আমাদের গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকেছে। নাহলে এত রাতে গুলি করবে কে?
আকাশি বলে, চলো বের হয়ে দেখি। লন্ঠন জ্বালাব না। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকব।
রবিউল সায় দেয়, হ্যাঁ চলো। উঠানের বাইরে যাব না। আজকে বোধ হয় ওরা ধনিয়া গ্রাম পর্যন্ত এসেছে। কালকে হয়তো আমাদের এদিকে আসবে।
থাক থাক। এসব কথা আর চিন্তা করার দরকার নেই। চলো বাইরে যাই।
দুজনে দরজা খুলে বাইরে এসে দেখতে পায়, দাউ দাউ আগুন জ্বলছে চারদিকে। বিভিন্ন দিকে বাড়ি পুড়ছে।
পুড়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, বাস্তুভিটা; ভিটার ওপর জমে থাকছে ছাই। শহীদ হচ্ছে শত শত মানুষ। পুলিশ-ইপিআর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। নিরীহ সাধারণ মানুষ কিছু করতে পারছে না। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। ওরা শুনতে পায়, ওখানে গিয়ে অনেক যুবক যুদ্ধ করার জন্য ট্রেনিং নেয়। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসে দেশে। গড়ে উঠছে মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর তোপের মুখে অনেক সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প উড়ে যায়। এসব সাহসী ছেলের মধ্যে নিজেদের শক্তি আবিষ্কার করে রবিউল-আকাশি। ওরা শরণার্থী হলে মারুফও যোদ্ধা হতে পারবে। আসমানি কীভাবে যাবে, এ ভাবনায় নির্ঘুম রাত কেটে যায় দুজনের। টের পায় না যে বাইরে বেলা বেশ বেড়েছে।
আকাশি দরজা খুলে বের হলে দেখতে পায়, মারুফ আর আসমানি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
কী রে, কী করছিস?
তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, মা।
মারুফ এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বলে, আম্মা, আমাদের চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। কাল রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনেছি।
কী করবে, বাবা?
আমি আজকেই একটা গরুর গাড়ি ঠিক করব। বর্ডার পর্যন্ত গরুর গাড়িতে যাব। ওখানে গিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেব। বেনাপোল থেকে হেঁটে যশোর রোডে উঠব আমরা। ওখানে কয়েক দিন থেকে তারপর কোথায় যাব, ঠিক করব।
ঠিক আছে বাবা, তুমি যা বলো তা–ই হবে। আমি রান্নাঘরে যাই, তোমাদের জন্য পান্তাভাতের ব্যবস্থা করি। ডিম ভাজি করব। তোমরা হাত–মুখ ধুয়ে আসো।
দুজনে উঠানে নেমে যায়। আকাশি রান্নাঘরে আসে। থালায় পান্তা বেড়ে ডিম ভাজি করে। আলুভাজি গরম করে বাটিতে গোছায়। দুজনের জন্য মাদুর বিছিয়ে দেয় রান্নাঘরে। গ্লাসে পানি ঢালে কলসি থেকে। তখন দুজনে রান্নাঘরে ঢোকে। মাদুরে বসে মারুফ বলে, আম্মা, আমি ভাত খেয়েই গরুর গাড়ি দেখতে যাব। আপনারা ঘর গুছিয়ে ফেলবেন।
রবিউল ভাত খেয়ে উঠে চলে যায়। আকাশি রান্নাঘর থেকে যা নেওয়ার, তা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে। দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। আসমানিও নিজের প্রস্তুতি শেষ করেছে। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে মারুফ। বলে, গরুর গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। চলেন, আমরা হেঁটে রওনা করি। রাস্তায় দেখলাম অনেক মানুষ যাচ্ছে। একজন আমাকে ডেকে বলল, ঘরে বসে পুড়ে মরার চেয়ে, গুলি খেয়ে মরার চেয়ে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শরণার্থী হওয়া ভালো। ওখানে গিয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তুতিও নিতে পারব।
রবিউল সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়, হ্যাঁ, চলো। আমরা যাত্রা শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে খোঁজখবর রাখব, যদি কোথাও গরুর গাড়ি পাওয়া যায়।
আসমানি মৃদুস্বরে বলে, মাগো, আমি কি হাঁটতে পারব? আমার তো এই মাসেই বাচ্চা হওয়ার কথা।
মা রে, আমি তো জানি। তারপরও শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছে গেলে তোর ব্যথা উঠলে একটা কিছু করতে পারব। মন খারাপ করবি না। ওদের কিছু বলবি না।
আচ্ছা মা, চলো। যা হওয়ার হবে।
সবাই মিলে পোঁটলাগুলো মাথায় তুলে হাঁটতে শুরু করে। চারদিকে অনেক মানুষ। রাস্তায় মানুষের লাইন। সবাই তটস্থ হয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছে সীমান্তের দিকে। আসমানির জন্য দ্রুত হাঁটতে পারছে না ওরা। আকাশির মনে আতঙ্ক দানা বেঁধে ওঠে। আসমানির মুখের দিকে তাকালে ভয় পায়। কিছুক্ষণ পর আসমানি বলে, মা, আমার পানি ভেঙে গেছে। ব্যথাও উঠেছে। আমি আর এক পা–ও হাঁটতে পারব না। আমি এই বটগাছের নিচে শুয়ে পড়ি।
কী বলিস, মা?
এটাই কথা, আর অন্য কোনো কথা নেই।
আসমানি বটগাছের নিচে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে।
রবিউল জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে ওর?
বাচ্চার জন্ম হবে। মারুফ, তুমি ওই পোঁটলা থেকে দুটো শাড়ি বের করে চারদিক ঘেরাও করে দাও।
মারুফ চারদিকে তাকিয়ে বলে, রাস্তায় লোকজন কমে গেছে। সবাই অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। আমরা কিছুক্ষণ নিরিবিলি থাকতে পারব।
কথা বলতে বলতে মারুফ চারদিকের ছোট ছোট গাছ ধরে শাড়ি পেঁচিয়ে দেয়।
মাটিতে শুয়ে আসমানি কঁ কঁ শব্দ করছে। আকাশি ওকে একটি শাড়ি বিছিয়ে দিয়ে শুইয়েছে। ওর শব্দ শুনে আকাশি বুঝে যায় যে প্রবল ব্যথা উঠেছে। বাচ্চাটা বোধ হয় অল্পক্ষণে বেরিয়ে আসবে। নাড়ি কাটার জন্য ব্লেডটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করে আকাশি। একসময় ভূমিষ্ঠ হয় শিশু। কান্নার শব্দে জানান দেয় নিজের আগমনের খবর। রবিউল আর মারুফ শাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কী বাচ্চা হলো? ছেলে না মেয়ে?
ছেলে। বেশ বড়সড় হয়ে জন্মেছে।
আলহামদুলিল্লাহ। রবিউল দুই হাত ওপরে তোলে। বলে, আল্লাহ মাবুদ, আমাদের নাতিটি সুস্থ থাকুক। ওকে কোলে নিয়ে আমরা সীমান্ত পার হব। ওর মা–ও যেন সুস্থ থাকে, মাবুদ। যে ছেলে মুক্তিযুদ্ধকালে রাস্তায় জন্ম নেয়, সে আমাদের স্বাধীনতার সৈনিক। হঠাৎ করে ও তীব্র স্বরে কান্না শুরু করে। আকাশি ওকে দুই হাতে জড়িয়ে নানাভাবে দোলায়, কিন্তু ওর কান্না থামে না। ওর কান্নায় আসমানিও কান্না শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, মাগো, ও কি দুধ খাবে?
খেতে পারে। কান্না থামুক, তখন তোর কাছে দেব।
এখনই দাও, মা। ওকে আমি বুকে রাখব।
না রে, তুই একটু শান্ত থাক, মা। ওর কান্না থামুক।
আকাশি অনেক চেষ্টা করে শিশুর কান্না থামাতে পারছে না। ওর নিজেরও মন খারাপ হয়ে যায়। আকাশিও কাঁদতে শুরু করে। জন্মের পরে কোনো শিশুকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি ও। একটু পরে কান্না থেমে গেলে শিশুটি মাথা কাত করে গড়িয়ে পড়ে ওর কোলের ওপর। চোখ বন্ধ, নাকে নিশ্বাস নেই। ও বুঝতে পারে, মরে গেছে ছেলেটি। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে আকাশি। রবিউল আর মারুফ জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
মরে গেছে আমাদের নাতি।
মরে গেছে? মারুফও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। রবিউলও। কান্নার ধ্বনি চারদিকে ছড়ায়। আসমানি জ্ঞান হারিয়েছে। রবিউল শাড়ির পর্দা খুলে ফেলে। শাড়ি ভাঁজ করে আসমানিকে ঢেকে দেয়। মাথা খোলা রাখে।
ওর মাথায় পানি দিতে হবে, মারুফ।
আমিও তা–ই চিন্তা করছি। আমরা তো ছোট একটা বালতি এনেছি। সামনের এই ডোবা থেকে আমি পানি নিয়ে আসছি।
মারুফ বালতি নিয়ে দৌড়াতে থাকে। রবিউল মেয়ের মাথায় হাত বোলায়। অল্প সময়ে ফিরে আসে মারুফ। রবিউল মেয়ের মাথা ওপরে তুলে ধরলে মাথায় পানি দেয় মারুফ। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খোলে আসমানি। বাবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।
কাঁদিস না, মা। আর কাঁদিস না। ধৈর্য ধর। আমাদের অনেক পথ যেতে হবে।
আসমানি বাবার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসে। পেতে দেওয়া শাড়ি ভিজে ঘাসের সঙ্গে মিশে আছে। প্রবল অস্বস্তিতে ও চারদিকে তাকায়। দেখতে পায়, ওর মায়ের কোলে রাখা মৃত শিশুর দিকে ঘাড় নিচু করে তাকিয়ে আছে ওর মা। আসমানি মাকে বলে, ওকে আমার কোলে দাও, মা।
আকাশি বলে, হ্যাঁ, দিচ্ছি। তুই কিছুক্ষণ কোলে রাখ। ওকে তো কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এই রাস্তার ধারে?
হ্যাঁ, এখানেই দিতে হবে। আর কোথায় যাব আমরা। মারুফ, তুমি কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করো।
মারুফ প্রথমে শব্দ করে কাঁদে। তারপর দুই হাতে চোখ মোছে। রবিউল বলে দেয় কোন পোঁটলায় দা আছে। বিভিন্ন সময় দায়ের দরকার হয়। সে জন্য রবিউল পোঁটলায় ঘরের দা–টি ভরে নিয়েছিল। একটি গর্ত করার জন্য দা–টির প্রথমেই দরকার হবে, এ ভাবনা তাকে কষ্ট দেয়। দুই হাতে চোখ মুছতে থাকে। মারুফ ছোট আকারের গর্তটি করা শেষ করলে রবিউল আসমানির একটি শাড়িতে পেঁচিয়ে গর্তের ভেতর শুইয়ে দেয়। তারপর সবাই মিলে দোয়া পড়ে। কিছুক্ষণ দোয়া পড়ার পর মারুফ মাটিচাপা দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে মাটি সমান করে দেয়। তারপর চারপাশের বুনো ফুল ছিঁড়ে দেয় সন্তানের কবরের ওপর। এক মুঠো ফুল আসমানির হাতে দিয়ে বলে, তুমি ওর কবরের ওপর ছিটিয়ে দাও। ওর স্মরণে আমরা প্রতিবছর ফুল দেব এখানে এসে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

কবরে ছড়ানো বুনো ফুল

আপডেট সময় : ১১:২২:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১

সেলিনা হোসেন : দুজনে কান পেতে রাখে। বাইরে কোনো পাখির ডাক নেই। রাতে ঘুমানোর আগে দুজনে বারান্দায় বসে পাখির ডাক শোনে। রাতের নীরবতায় দুজনের কাছে পাখির ডাক মধুরতম সংগীত। রবিউল বলে, ছোটবেলায় ঘুমানোর আগে মা ঘুম পাড়াত, ‘ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি মোদের বাড়ি এসো’। মায়ের কাছ থেকে এটুকু না শুনলে আমার ঘুম আসত না। এখন পাখির ডাক না শুনলে ঘুম আসে না। অনেকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে তবেই ঘুমাই।
এমন কথা ওর বন্ধুরা সবাই জানে। আকাশি ওর এমন আচরণে ভালোবাসায় গুটিয়ে পড়ে। তার নিজেরও ভালো লাগে পাখির ডাক শুনতে। গুলির শব্দে আতঙ্কিত দুজনে বিছানায় উঠে বসে।
রবিউল বলে, আমাদের গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকেছে। নাহলে এত রাতে গুলি করবে কে?
আকাশি বলে, চলো বের হয়ে দেখি। লন্ঠন জ্বালাব না। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকব।
রবিউল সায় দেয়, হ্যাঁ চলো। উঠানের বাইরে যাব না। আজকে বোধ হয় ওরা ধনিয়া গ্রাম পর্যন্ত এসেছে। কালকে হয়তো আমাদের এদিকে আসবে।
থাক থাক। এসব কথা আর চিন্তা করার দরকার নেই। চলো বাইরে যাই।
দুজনে দরজা খুলে বাইরে এসে দেখতে পায়, দাউ দাউ আগুন জ্বলছে চারদিকে। বিভিন্ন দিকে বাড়ি পুড়ছে।
পুড়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, বাস্তুভিটা; ভিটার ওপর জমে থাকছে ছাই। শহীদ হচ্ছে শত শত মানুষ। পুলিশ-ইপিআর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। নিরীহ সাধারণ মানুষ কিছু করতে পারছে না। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। ওরা শুনতে পায়, ওখানে গিয়ে অনেক যুবক যুদ্ধ করার জন্য ট্রেনিং নেয়। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসে দেশে। গড়ে উঠছে মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর তোপের মুখে অনেক সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প উড়ে যায়। এসব সাহসী ছেলের মধ্যে নিজেদের শক্তি আবিষ্কার করে রবিউল-আকাশি। ওরা শরণার্থী হলে মারুফও যোদ্ধা হতে পারবে। আসমানি কীভাবে যাবে, এ ভাবনায় নির্ঘুম রাত কেটে যায় দুজনের। টের পায় না যে বাইরে বেলা বেশ বেড়েছে।
আকাশি দরজা খুলে বের হলে দেখতে পায়, মারুফ আর আসমানি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
কী রে, কী করছিস?
তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, মা।
মারুফ এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বলে, আম্মা, আমাদের চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। কাল রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনেছি।
কী করবে, বাবা?
আমি আজকেই একটা গরুর গাড়ি ঠিক করব। বর্ডার পর্যন্ত গরুর গাড়িতে যাব। ওখানে গিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেব। বেনাপোল থেকে হেঁটে যশোর রোডে উঠব আমরা। ওখানে কয়েক দিন থেকে তারপর কোথায় যাব, ঠিক করব।
ঠিক আছে বাবা, তুমি যা বলো তা–ই হবে। আমি রান্নাঘরে যাই, তোমাদের জন্য পান্তাভাতের ব্যবস্থা করি। ডিম ভাজি করব। তোমরা হাত–মুখ ধুয়ে আসো।
দুজনে উঠানে নেমে যায়। আকাশি রান্নাঘরে আসে। থালায় পান্তা বেড়ে ডিম ভাজি করে। আলুভাজি গরম করে বাটিতে গোছায়। দুজনের জন্য মাদুর বিছিয়ে দেয় রান্নাঘরে। গ্লাসে পানি ঢালে কলসি থেকে। তখন দুজনে রান্নাঘরে ঢোকে। মাদুরে বসে মারুফ বলে, আম্মা, আমি ভাত খেয়েই গরুর গাড়ি দেখতে যাব। আপনারা ঘর গুছিয়ে ফেলবেন।
রবিউল ভাত খেয়ে উঠে চলে যায়। আকাশি রান্নাঘর থেকে যা নেওয়ার, তা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে। দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। আসমানিও নিজের প্রস্তুতি শেষ করেছে। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে মারুফ। বলে, গরুর গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। চলেন, আমরা হেঁটে রওনা করি। রাস্তায় দেখলাম অনেক মানুষ যাচ্ছে। একজন আমাকে ডেকে বলল, ঘরে বসে পুড়ে মরার চেয়ে, গুলি খেয়ে মরার চেয়ে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শরণার্থী হওয়া ভালো। ওখানে গিয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তুতিও নিতে পারব।
রবিউল সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়, হ্যাঁ, চলো। আমরা যাত্রা শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে খোঁজখবর রাখব, যদি কোথাও গরুর গাড়ি পাওয়া যায়।
আসমানি মৃদুস্বরে বলে, মাগো, আমি কি হাঁটতে পারব? আমার তো এই মাসেই বাচ্চা হওয়ার কথা।
মা রে, আমি তো জানি। তারপরও শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছে গেলে তোর ব্যথা উঠলে একটা কিছু করতে পারব। মন খারাপ করবি না। ওদের কিছু বলবি না।
আচ্ছা মা, চলো। যা হওয়ার হবে।
সবাই মিলে পোঁটলাগুলো মাথায় তুলে হাঁটতে শুরু করে। চারদিকে অনেক মানুষ। রাস্তায় মানুষের লাইন। সবাই তটস্থ হয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছে সীমান্তের দিকে। আসমানির জন্য দ্রুত হাঁটতে পারছে না ওরা। আকাশির মনে আতঙ্ক দানা বেঁধে ওঠে। আসমানির মুখের দিকে তাকালে ভয় পায়। কিছুক্ষণ পর আসমানি বলে, মা, আমার পানি ভেঙে গেছে। ব্যথাও উঠেছে। আমি আর এক পা–ও হাঁটতে পারব না। আমি এই বটগাছের নিচে শুয়ে পড়ি।
কী বলিস, মা?
এটাই কথা, আর অন্য কোনো কথা নেই।
আসমানি বটগাছের নিচে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে।
রবিউল জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে ওর?
বাচ্চার জন্ম হবে। মারুফ, তুমি ওই পোঁটলা থেকে দুটো শাড়ি বের করে চারদিক ঘেরাও করে দাও।
মারুফ চারদিকে তাকিয়ে বলে, রাস্তায় লোকজন কমে গেছে। সবাই অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। আমরা কিছুক্ষণ নিরিবিলি থাকতে পারব।
কথা বলতে বলতে মারুফ চারদিকের ছোট ছোট গাছ ধরে শাড়ি পেঁচিয়ে দেয়।
মাটিতে শুয়ে আসমানি কঁ কঁ শব্দ করছে। আকাশি ওকে একটি শাড়ি বিছিয়ে দিয়ে শুইয়েছে। ওর শব্দ শুনে আকাশি বুঝে যায় যে প্রবল ব্যথা উঠেছে। বাচ্চাটা বোধ হয় অল্পক্ষণে বেরিয়ে আসবে। নাড়ি কাটার জন্য ব্লেডটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করে আকাশি। একসময় ভূমিষ্ঠ হয় শিশু। কান্নার শব্দে জানান দেয় নিজের আগমনের খবর। রবিউল আর মারুফ শাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কী বাচ্চা হলো? ছেলে না মেয়ে?
ছেলে। বেশ বড়সড় হয়ে জন্মেছে।
আলহামদুলিল্লাহ। রবিউল দুই হাত ওপরে তোলে। বলে, আল্লাহ মাবুদ, আমাদের নাতিটি সুস্থ থাকুক। ওকে কোলে নিয়ে আমরা সীমান্ত পার হব। ওর মা–ও যেন সুস্থ থাকে, মাবুদ। যে ছেলে মুক্তিযুদ্ধকালে রাস্তায় জন্ম নেয়, সে আমাদের স্বাধীনতার সৈনিক। হঠাৎ করে ও তীব্র স্বরে কান্না শুরু করে। আকাশি ওকে দুই হাতে জড়িয়ে নানাভাবে দোলায়, কিন্তু ওর কান্না থামে না। ওর কান্নায় আসমানিও কান্না শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, মাগো, ও কি দুধ খাবে?
খেতে পারে। কান্না থামুক, তখন তোর কাছে দেব।
এখনই দাও, মা। ওকে আমি বুকে রাখব।
না রে, তুই একটু শান্ত থাক, মা। ওর কান্না থামুক।
আকাশি অনেক চেষ্টা করে শিশুর কান্না থামাতে পারছে না। ওর নিজেরও মন খারাপ হয়ে যায়। আকাশিও কাঁদতে শুরু করে। জন্মের পরে কোনো শিশুকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি ও। একটু পরে কান্না থেমে গেলে শিশুটি মাথা কাত করে গড়িয়ে পড়ে ওর কোলের ওপর। চোখ বন্ধ, নাকে নিশ্বাস নেই। ও বুঝতে পারে, মরে গেছে ছেলেটি। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে আকাশি। রবিউল আর মারুফ জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
মরে গেছে আমাদের নাতি।
মরে গেছে? মারুফও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। রবিউলও। কান্নার ধ্বনি চারদিকে ছড়ায়। আসমানি জ্ঞান হারিয়েছে। রবিউল শাড়ির পর্দা খুলে ফেলে। শাড়ি ভাঁজ করে আসমানিকে ঢেকে দেয়। মাথা খোলা রাখে।
ওর মাথায় পানি দিতে হবে, মারুফ।
আমিও তা–ই চিন্তা করছি। আমরা তো ছোট একটা বালতি এনেছি। সামনের এই ডোবা থেকে আমি পানি নিয়ে আসছি।
মারুফ বালতি নিয়ে দৌড়াতে থাকে। রবিউল মেয়ের মাথায় হাত বোলায়। অল্প সময়ে ফিরে আসে মারুফ। রবিউল মেয়ের মাথা ওপরে তুলে ধরলে মাথায় পানি দেয় মারুফ। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খোলে আসমানি। বাবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।
কাঁদিস না, মা। আর কাঁদিস না। ধৈর্য ধর। আমাদের অনেক পথ যেতে হবে।
আসমানি বাবার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসে। পেতে দেওয়া শাড়ি ভিজে ঘাসের সঙ্গে মিশে আছে। প্রবল অস্বস্তিতে ও চারদিকে তাকায়। দেখতে পায়, ওর মায়ের কোলে রাখা মৃত শিশুর দিকে ঘাড় নিচু করে তাকিয়ে আছে ওর মা। আসমানি মাকে বলে, ওকে আমার কোলে দাও, মা।
আকাশি বলে, হ্যাঁ, দিচ্ছি। তুই কিছুক্ষণ কোলে রাখ। ওকে তো কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এই রাস্তার ধারে?
হ্যাঁ, এখানেই দিতে হবে। আর কোথায় যাব আমরা। মারুফ, তুমি কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করো।
মারুফ প্রথমে শব্দ করে কাঁদে। তারপর দুই হাতে চোখ মোছে। রবিউল বলে দেয় কোন পোঁটলায় দা আছে। বিভিন্ন সময় দায়ের দরকার হয়। সে জন্য রবিউল পোঁটলায় ঘরের দা–টি ভরে নিয়েছিল। একটি গর্ত করার জন্য দা–টির প্রথমেই দরকার হবে, এ ভাবনা তাকে কষ্ট দেয়। দুই হাতে চোখ মুছতে থাকে। মারুফ ছোট আকারের গর্তটি করা শেষ করলে রবিউল আসমানির একটি শাড়িতে পেঁচিয়ে গর্তের ভেতর শুইয়ে দেয়। তারপর সবাই মিলে দোয়া পড়ে। কিছুক্ষণ দোয়া পড়ার পর মারুফ মাটিচাপা দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে মাটি সমান করে দেয়। তারপর চারপাশের বুনো ফুল ছিঁড়ে দেয় সন্তানের কবরের ওপর। এক মুঠো ফুল আসমানির হাতে দিয়ে বলে, তুমি ওর কবরের ওপর ছিটিয়ে দাও। ওর স্মরণে আমরা প্রতিবছর ফুল দেব এখানে এসে।