চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীর হাতব্যাগে ছিল হাতে লেখা একটি শপথনামা, সেই শপথ কণ্ঠে নিয়েই একাত্তরের এই শব্দসৈনিককে শেষ বিদায় জানালো চট্টগ্রাম।
গতকাল বুধবার সকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে অশ্রু আর ফুলে সংগ্রামী এই নারীর কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানান স্বজন, গুণগ্রাহী, অনুজ আর অনুসারীরা। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করায় ১৯৭১ সালের এপ্রিলে মুশতারী শফীর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফীকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। সেই শোক বুকে চেপেই মুশতারী শফী যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীনতার সংগ্রামে। স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। শহীদ মিনারের সামনে জাতীয় পতাকায় মোড়া কফিনে শায়িত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শব্দসৈনিককে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান। ফুলে ফুলে ছেঁয়ে যায় শোক মঞ্চ। গার্ড অব অনার শেষে মুশতারী শফীর মেয়ে শারমিন শফী বলেন, তার মায়ের ব্যাগে হাতে লেখা একটি শপথনামার সন্ধান পেয়েছেন তিনি। তা পড়ে শোনালে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে উপস্থিত সবাই তার সঙ্গে শপথ নেন। সেখানে বলা হয়- “এখন প্রতিবাদ চাই। প্রতিরোধ চাই। চাই রাজনৈতিক আদর্শিক সংগ্রাম। যারা ১৯৭১ এ নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে এবং নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, সে খুনিদের সাথে কোনো আপোষ হতে পারে
“এবার বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের এই অঙ্গীকার হোক। অতীতের সব ত্রুটি বিচ্যুতি ঝেড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক।”
বেগম মুশতারী শফীর মেয়ে রুমানা শফী সাংবাদিকদের বলেন, “আমার মা সারা জীবন যুদ্ধ করেছেন। সমাজের অসহায় গরিব দুখী নারীদের পাশে ছিলেন সবসময়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তিনি অন্যতম সংগঠক। “আমরা, সন্তানরা শুধু না, চট্টগ্রামের লাখো সন্তান মা হারালেন। উনার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তি। নারী ও দরিদ্রদের মুক্তি। তার শেষ চাওয়া ছিল, চট্টগ্রামে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এজন্য তিনি অনেক জায়গায় গিয়েছেন। কিন্তু তা দেখে যেতে পারেননি। শেষ সময়ে অনেক কথা বলতে চেয়েছেন। অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধু’। তার অন্তরে চেতনায় ছিল- বঙ্গবন্ধু, মুক্ত বাংলাদেশ ও স্বাধীনতা।”
ছেলে মেহরাজ তাহসিন শফী বলেন, “কোনো পদকের জন্য মা মুক্তিযুদ্ধ বা নারীদের জন্য সংগ্রাম করেননি। করেছেন দেশের জন্য, মনের তাগিদে। বিভিন্ন সময় সরকারগুলো তাকে মূল্যায়ন করেননি নানা কারণে। যা করা দরকার ছিল।
“আমাদের বাবা ডা. শফী শুধু একজন মুক্তিযুদ্ধের শহীদ নন, তিনি একজন বুদ্ধিজীবীও ছিলেন। তার নামে একটি সড়ক বা স্থাপনা চট্টগ্রামে হওয়া উচিত ছিল, যা হয়নি।
“আমার মায়ে স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, যার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। এখনো হয়নি। একটি জমি বরাদ্দ হয়েছে। উনার স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামের সব বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা, যাতে তরুণ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। তাও হয়নি।”
শ্রদ্ধা জানাতে আসা কবি সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, “আজ অত্যন্ত শোকের দিন। শহীদ জায়া ও ভগ্নিকে আমরা হারিয়েছি। তিনি একটি পুরো সংগ্রামী জীবন কাটিয়েছেন।
“স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শুরুর বৈঠকগুলো তাদের বাড়িতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বামী ও ভাইকে হারিয়েছেন। সেই অবস্থায় ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভূমিকা পালন করেন। “ফিরে এসে দেখেন বাড়ি লুণ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি নিঃশেষিত হননি। সামাজিক সাংস্কৃতিক নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত হন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। আজীবন সংগ্রামী অভিভাবক হয়ে ভূমিকা পালন করেন।”
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রাম মহানগরীর এনায়েত বাজারে মুশতারী শফীর বাড়িতেই কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল। শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ডা. মোহাম্মদ শফী ও তার স্ত্রী মুশতারী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার বলেন, “শহীদ জায়া, শব্দ সৈনিক মুশতারী শফীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। উনার স্বামী ও ভাইকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল উনার চোখের সামনে। উনার প্রেসটি ধ্বংস করা হয়েছিল।
“কিন্তু স্বাধীনতার পরও তিনি আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওনার মতো মানুষকে আজ বড় প্রয়োজন ছিল। তিনি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তিনি মানুষের হৃদয়ে থাকবেন।”
নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, “প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছিল ওনার সরব উপস্থিতি। আজ মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে মানুষের হৃদয়ে ওনার স্থান কতটুকু।”
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা বলেন, “বেগম মুশতারী শফী গত ৫০ বছর ধরে অসম সাহসে লড়েছেন একটি প্রগতির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। লড়াকু এক মানুষ তিনি। প্রগতি, শোষণমুক্তি ও ন্যায়ের সংগ্রাম শানিত হলে বেগম মুশতারী শফীকে সেখানে খুঁজে পাব আমরা।” একাত্তরের শুরুর সময় থেকেই ডা. মোহাম্মদ শফী ও তার স্ত্রী মুশতারী শফী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, সেবা ও অর্থায়নসহ নানা কাজে যুক্ত ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বাসায় রাখায় ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল ডা. মোহাম্মদ শফী এবং মুশতারীর ভাই এহসানুল হক আনসারীকে স্থানীয় রাজাকাররা ধরে নিয়ে যার। পরে তাদের হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের তপন দত্ত বলেন, “একাত্তরে তার বাড়িতে সেই অস্ত্র আমরা রেখে এসেছিলাম। এর জন্য উনার স্বামী ও ভাইকে ধরে নিয়ে যায়।”
শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেণু কুমার দে, বীর মুক্তিযোদ্ধা বালাগাত উল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, সাংবাদিক ওমর কায়সার, প্রমা আবৃত্তি সংসদের সভাপতি রাশেদ হাসান। এছাড়া নগর আওয়ামী লীগ, কোতোয়ালী আসনের সাংসদ মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, প্রজন্ম ৭১, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওডিসি, সনাক, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, ন্যাপ, জাসদ মার্কসবাদী, গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাসদ, সিআরবি রক্ষা মঞ্চ, নাগরিক সমাজ চট্টগ্রাম, শিল্পকলা একাডেমি, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটি, নারী যোগাযোগ কেন্দ্র, যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বিটা, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংসদ কমান্ডসহ বিভিন্ন সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আ স ম জামশেদ খন্দকারের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক বেগম মুশতারী শফীকে গার্ড অব অনার দেয় পুলিশের একটি দল। এসময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) আমিনুল ইসলাম এবং মুশতারী শফীর জামাতা লেফ. কর্নেল (অব.) সাংসদ নজরুল ইসলাম। ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া মুশতারী শফী ছিলেন চট্টগ্রামসহ সারাদেশের প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রামের প্রায় সব নাগরিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয়। ১৯৬৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে নারীদের জন্য মাসিক ‘বান্ধবী’ সাময়িকীর প্রকাশনা শুরু করেন এবং ‘বান্ধবী সংঘ’র প্রতিষ্ঠা করেন। একাত্তরে স্বামী আর ভাইকে হারানোর পর ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দ সৈনিক হিসেবে কাজ করেন মুশতারী শফী। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য ২০১৬ সালে মুশতারী শফীকে ফেলোশিপ দেয় বাংলা একাডেমি। ২০২০ সালে তিনি বেগম রোকেয়া পদক পান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গত শতকের ৯০ এর দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করলে তাতে সক্রিয় হন মুশতারী শফী। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পরও আন্দোলন এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে প্রায় এক দশক আগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেও অনুপ্রেরণাদানকারী হিসেবে ছিলেন মুশতারী শফী। তিনি মহিলা পরিষদে যুক্ত ছিলেন এবং সর্বশেষ উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি ছিলেন। মুশতারী শফী লেখালেখিতেও ছিলেন সমান সক্রিয়। ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’, ‘একুশের গল্প’, ‘দুটি নারী ও একটি যুদ্ধ’, একদিন এবং অনেকগুলো দিন’, ‘আমি সুদূরের পিয়াসি’সহ বেশ কিছু কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বেগম মুশতারী শফীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে। সেখানে জানাজা শেষে নগরীর চৈতন্য গলি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
শতকণ্ঠের শপথে শব্দসৈনিক মুশতারী শফীকে শেষ বিদায়
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ