নিজস্ব প্রতিবেদক : বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তার বাবা বরকত উল্লাহ। গতকাল বুধবার রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আদালতের রায়ে তিনি সন্তুষ্ট। এখন দ্রুত এই রায় কার্যকর হবে, এটাই তার প্রত্যাশা। দুই বছর আগের ওই হত্যাকা-ের ঘটনায় বুধবার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ২০ জনের ফাঁসি ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ দেওয়া হয়। রায় শুনতে সকাল সকালে আদালত প্রাঙ্গণে হাজির হন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। রায় শোনার সঙ্গে সঙ্গে আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। রায় শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাতের আঙ্গুলে বিজয় চিহ্ন দেখান তিনি। নিজের সন্তোষের কথা জানিয়ে তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় আবরারের বাবা বলেন, ‘রায়ে আমি সন্তুষ্ট। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের এ রায়ই তো শেষ নয়। এরপর হাইকোর্ট, আপিল বিভাগেও যেতে পারেন আসামিপক্ষ। আমরা চাই, এই রায় বহাল থাকুক। এই রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়।’
রায় মেনে নিতে পারছেন না আসামিদের স্বজনরা : ‘আমার ছেলে ঘটনা সময় ছিল না। সে নেত্রকোনার বাড়িতে যায়। তার অপরাধ সে ছাত্রলীগ করতো।’
গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক আবু জাফর মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের আদালত বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ের পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি অমিত সাহার মা দেবী রানী সাহা অসন্তোষ প্রকাশ করেন বলেন এ কথা।
দেবী রানী আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমের চাপে আমার ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে জড়ানো হয়েছে। সে নাকি শুধু মেসেঞ্জারে কথা বলেছে, এজন্য যাবজ্জীবন! আশা করেছিলাম অমিত খালাস পাবে।’
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর আসামি মুয়াজ আবু হুরায়রাও রায় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে। রায় শুনতে তার মা আদালতেই ছিলেন। মুয়াজ বুয়েটের ইইই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র। তার মা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুয়াজ আবরারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। টাকা খরচ করে ওষুধ, স্যালাইন কিনেছে। তাকেই যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হলো।’
রায়ের সময় আসামিদের প্রিজন ভ্যান ও এজলাসে আনা-নেওয়ার সময় স্বজনদের অনেকেই তাদের সঙ্গে কথা বলেন। সাজাপ্রাপ্ত মোর্শেদ অর্মত্য ইসলামের বাবা মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পুলিশে দিয়েছি। নিজে তাকে আত্মসমর্পন করিয়েছি। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে এই রায় আশা করিনি। গণহারে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দেওয়া হলো। এতে আমরা হতবাক। এমন রায়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।’ তিনি বলেন, ‘ঘটনার আকস্মিকতায় এই হত্যাকা- ঘটেছে। কেউ পেশাদার অপরাধী না। সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী। আমরা উচ্চ আদালতে যাবো।’
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। পরে একই দিন রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি।
যা বলছেন বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় আদালতের দেওয়া রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। রায় ঘোষণার পর বুধবার দুপুরে বুয়েটের উপাচার্য ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আলাদা করে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। তাঁরা আশা প্রকাশ করেছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যেই কার্যকর হবে এই রায়। বেলা দেড়টার দিকে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে রায় নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান বুয়েটের উপাচার্য সত্যপ্রসাদ মজুমদার। আর বেলা ২টা ১০ মিনিটের দিকে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে সাংবাদিকদের কাছে রায়ের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান বুয়েট শিক্ষার্থীরা। বুয়েটের উপাচার্য সত্যপ্রসাদ মজুমদার বলেন, ‘রায়ে শাস্তি যা হয়েছে, তা যথেষ্ট। বিচার বিভাগ তাঁদের প্রজ্ঞা ও আইন অনুযায়ী যথেষ্ট সঠিকভাবে বিচার করেছেন বলে আমরা মনে করি। এর ওপর আমাদের আস্থা রাখা উচিত। আমরা আশা করি, রায়টি যেন স্বল্প সময়ের মধ্যে কার্যকর হয়। ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে যে এ ধরনের কর্মকা-ে কেউ জড়িত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ভোগ করতে হবে।’
আবরারের পরিবারের প্রতি সব সময় সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন বুয়েট উপাচার্য। তিনি বলেন, ‘আবরারের পরিবারের প্রতি আমরা সব সময়ই সহমর্মিতা দেখিয়েছি। বুয়েটের পক্ষ থেকে যত দূর সম্ভব আইনি ও আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতাও করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও করা হবে। আইনি সহায়তা, আনুষঙ্গিক খরচ প্রভৃতি সবকিছুই আমরা বুয়েট থেকে বহন করছি। এ বাবদ এখন পর্যন্ত ৫৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক সংকটে পড়ায় আবরারের পরিবারকে গত ১ জুলাই থেকে প্রতি মাসে ৭৫ হাজার টাকা করে আমরা দিচ্ছি। নৈতিক দায়িত্বের জায়গা থেকে আমরা এই সহযোগিতা করে যাব।’
যেসব ছাত্রের শাস্তি হলো, তাঁদের বিপথে যাওয়ার দায় বুয়েট কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের দায় আছে কি না, সেটি বিচার বিভাগই দেখবেন। এখানে আমাদের পক্ষ থেকে বলার কিছু নেই। আমাদের সিস্টেমে কোনো ফল্ট আছে কি না, সেটি আমরা ভেবে দেখছি। সে জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা হচ্ছে।’ পরে বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একটি লিখিত প্রতিক্রিয়া সাংবাদিকদের সামনে পড়ে শোনানো হয়। সেখানে বলা হয়, ‘আমরা মনে করি, আবরার হত্যার রায়ে সবার আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা এই রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি এবং আবরারের পরিবারের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে আশাবাদ ব্যক্ত করছি যে এ রায় শেষ পর্যন্ত বহাল থাকবে ও বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। একই সঙ্গে আমাদের প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক কাউকেই যেন রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বলি হতে না হয় এবং সব ক্ষেত্রে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে। লিখিত প্রতিক্রিয়ায় আবরার হত্যার পলাতক তিন আসামিকেও দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
আবরার হত্যাকারীদের যারা ক্রিমিনাল বানাল, তাদের তো কোনো বিচার না হওয়ায় আবুল হায়াতের আক্ষেপ : বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকা-ের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্র, অভিনেতা, নাট্যকার ও লেখক আবুল হায়াত। দুই বছর পর যখন আবরার হত্যার বিচারের রায় হয়, তখন তিনি ছিলেন একটি নাটকের শুটিংয়ে। দুপুরে একটি সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে তাঁকে ফোন করা হলে জানতে পারেন আদালতের দেওয়া রায়। দ্রুততার সঙ্গে বিচার হওয়ার ব্যাপারটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আবুল হায়াত। তিনি বললেন, ‘অপরাধীর শাস্তি হলে অন্য অপরাধীরা সাবধান হবে। এরপর কোনো অপরাধ করার আগে দশবার চিন্তা করবে। যখন দেখে যে বিচার হয় না, তখন অপরাধীদের সাহস বেড়ে যায়।’
আবুল হায়াত বলেন, ‘অন্যায়ের বিচার তো করতেই হবে, এটা অবধারিত। অন্যায়ের বিচার না করলে অন্যায় বেড়ে যায়, এটা আমরা জানি। সে হিসেবে বলব, দ্রুততার সঙ্গে রায় হয়েছে, যা পজিটিভ সাইড।’ কথায় কথায় আবুল হায়াত খারাপ লাগার কথাও জানালেন। তিনি বললেন, ‘খারাপ লাগছে এই ভেবে যে আবরার হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে একটা পরিবারের আশা-ভরসা, স্বপ্ন-সব ধুয়েমুছে চলে গেছে। সেই সঙ্গে হত্যাকা-ে জড়িত আরও ২৫ জনের জীবন, তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে গেল। এটা সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু জানতে চাই, এর জন্য দায়ী কারা? তাদের তো কোনো বিচার হলো না। কারা তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে এ ধরনের অপকর্ম করতে, অপরাধ করতে, সেটার তো কোনো ইনভেস্টিগেশনও হলো না। এই ছেলেগুলো যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল, বাবা-মায়ের স্বপ্ন নিয়েই এসেছিল। বাবা-মায়ের দুঃখ-কষ্ট যদি থেকেও থাকে, তারা সেখান থেকে তাদের আলো দেখাবে, এমন স্বপ্ন নিয়েই এসেছিল। তারা তো ক্রিমিনাল হিসেবে কেউ আসে নাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাহলে তাদের ক্রিমিনাল বানাল কে? তাঁদের উদ্বুদ্ধ করল কে বা কারা এই ধরনের একটা নিকৃষ্টতম কাজ করতে, বীভৎসতম কাজ করতে। এসব প্রশ্নগুলো থেকে যাচ্ছে আরকি।’
রায় দ্রুত কার্যকর চান আবরারের বাবা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ