ঢাকা ০৭:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

আমার স্মৃতিতে কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক

  • আপডেট সময় : ১১:২৩:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২১
  • ১৪৭ বার পড়া হয়েছে

মোঃ মাহবুবুর রহমান : ১৯৮৯ রাকসু বার্ষিকী। আমি সম্পাদক। সম্পাদনা পরিষদের সদস্য ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, কবি আবুবকর সিদ্দিক, লেখকদের লেখক জুলফিকার মতিন। এমন একটি সম্পাদনা পরিষদ থাকায় বার্ষিকীর মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিলো না।
বিশাল সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। সব সময় নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ নেয়া আমার বৈশিষ্ট্য। বললাম, রাকসু বার্ষিকীর প্রতিটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকবে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা প্রকাশের জন্য। উগ্রবাম ছাত্র সংগঠনগুলো কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর তালিকা দিয়ে সাফ জানিয়ে দিলো-বার্ষিকীতে উনাদের লেখা না থাকলে আমাকে তারা শারীরিকভাবে আঘাত করবে। তাদের যুক্তি ছিলো-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে জাতীয় পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীদের লেখা ছাড়া বার্ষিকী ছাপার নজির নেই। তবে আমি ছিলাম অনঢ়। সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করলাম, ছাত্র-ছাত্রীরা ম্যাগাজিন ফি দেয়, অতএব রাকসু বার্ষিকীতে সবটুকু সুযোগ থাকবে শুধু তাদের জন্য। হাসান আজিজুল হক স্যার সমর্থন জানিয়ে বললেন, আমাদের লেখা তো জাতীয় দৈনিকে প্রতিদিন পাওয়া যায়। মাহবুব তো সাহিত্যের কাঁচামাল তৈরি করার চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে। ওকে করতে দাও। জুলফিকার মতিন স্যারও সমর্থন দিলেন। সাহিত্যের কাঁচামাল কথাটি ঐ প্রথম শুনলাম।
কয়েকজন নেতার ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের ফ্রি বিজ্ঞাপন ছাপার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলাম। শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা দিয়ে বার্ষিকী প্রকাশ করলাম। এমনকি সম্পাদনা পরিষদের সদস্য তিনজন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীর লেখাও ছাপা হয়নি। উগ্রপন্থীরা আহত বাঘের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। ওরা যে কোনো একটা অজুহাত খুঁজতে থাকলো। বার্ষিকীতে আমার লেখা প্রবন্ধ ‘ছাত্র রাজনীতির অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ’-এর একটি অংশ ছিলো, “বস্তুগতভাবে ছাত্ররা কোনো শ্রেণি নয়। সেজন্য ছাত্রদের কোনো শ্রেণিস্বার্থ থাকে না। ছাত্ররা সমাজ পরিবর্তনের উদ্দ্যেশ্যে কোনো আন্দোলন শুরু করলেও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃত্ব অর্জন করতে পারে না। চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সমাজের অন্য শ্রেণি এগিয়ে আসা প্রয়োজন হয়। ছাত্রদের পক্ষে ছাত্র অধিকার ভিত্তিক আন্দোলনগুলো সফল করা সম্ভব”।
ওরা ঐ অংশটি কোট করে আমাকে সামরিক সরকারের গোপন এজেন্ট আখ্যা দিয়ে রাকসু ভবনে আমার অফিসে আমাকে আক্রমণ করে সব পত্রিকা নষ্ট করে দেবার পরিকল্পনা করলো। আমার জন্য গোপন যোগাযোগের কাজটি পরিসংখ্যানের বন্ধু বিকাশ ভালোভাবে করতে পেরেছিলো। খবর পেয়ে মোহাম্মদ নাসের স্যার (সবার প্রিয় মিন্টু ভাই) আমাকে সাথে নিয়ে হাসান আজিজুল হক স্যারের কাছে গেলেন। উনি অতি দ্রুত শহীদুল ইসলাম স্যারকে সাথে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঐসব সংগঠনের টেন্টে গিয়ে বলে দিলেন, মাহবুব যা লিখেছে তা সঠিক। কৃষক-সমাজ ও শ্রমিক শ্রেণির সাহায্য ছাড়া দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক পড়াশুনা না করার জন্য ওদেরকে বেশ বকে দিয়েছিলেন। এতসব ঘটনা আমার সংগঠনের ভেতরে না বলে শুধু অনুরোধ করলাম- ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের দিয়ে এক রাতের মধ্যে প্রত্যেকটি হলের প্রতিটি রুমে গিয়ে সবার কাছে একটি করে বই পৌঁছে দিতে। সফলভাবে তারা কাজটি করতে পেরেছিল। স্যারের কাছে ঋণী হয়ে থাকলাম।
হাসান আজিজুল হক স্যারের কাছে শিখেছিলাম, ‘দশ বছর পরপর মায়া ত্যাগ করতে হয়।’ আমার স্বভাব হলো-কোনো কাগজ না ফেলা। আমার সংগ্রহে থাকা পুরাতন পত্রিকা, গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, বই-এর জায়গা সংকুলান সমস্যায় স্যার উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘দেখবে যেসব কাগজগুলো গত দশ বছরে একবারও দেখার প্রয়োজন হয়নি, সেগুলো ভবিষ্যতে দরকার পড়ার সম্ভাবনা কম। ওগুলোর মায়া ত্যাগ করে ফেলে দাও। তা না হলে অপ্রয়োজনীয় স্তূপ বাড়বে; যার মাঝে প্রয়োজনীয় তথ্য হারিয়ে যাবে।’
সাপ্তাহিক একতা পত্রিকা পৌঁছে দিতে সপ্তাহে একবার বিকালে স্যারের বাসায় যেতাম। ঐ নির্দিষ্ট দিনটিতে স্যার পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতেন। মাস শেষে একবার ৪ টি সংখ্যার জন্য ৮ টাকা বিল আনতে যেতাম। প্রত্যেকবার দেখতাম-স্যার এবং খালাম্মা চা আর খবরের কাগজ নিয়ে বারান্দায় বসে সুন্দর সময় কাটাচ্ছেন। স্যারের বাসার সামনের পরিবেশ এবং উনাদের বসে থাকা দেখে মনে হতো-এখানে এভাবে বসতে পারলে ভালো লেখা বের হবেই। ভাবতাম- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারলে এভাবেই আমার পারিবারিক জীবনটা পার করবো।
লেখক : সাবেক ম্যাগাজিন সম্পাদক, রাকসু; বর্তমানে জাপানে বসবাসরত।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সংবিধানে ‘মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহাল করা হবে

আমার স্মৃতিতে কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক

আপডেট সময় : ১১:২৩:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২১

মোঃ মাহবুবুর রহমান : ১৯৮৯ রাকসু বার্ষিকী। আমি সম্পাদক। সম্পাদনা পরিষদের সদস্য ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, কবি আবুবকর সিদ্দিক, লেখকদের লেখক জুলফিকার মতিন। এমন একটি সম্পাদনা পরিষদ থাকায় বার্ষিকীর মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিলো না।
বিশাল সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। সব সময় নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ নেয়া আমার বৈশিষ্ট্য। বললাম, রাকসু বার্ষিকীর প্রতিটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকবে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা প্রকাশের জন্য। উগ্রবাম ছাত্র সংগঠনগুলো কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর তালিকা দিয়ে সাফ জানিয়ে দিলো-বার্ষিকীতে উনাদের লেখা না থাকলে আমাকে তারা শারীরিকভাবে আঘাত করবে। তাদের যুক্তি ছিলো-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে জাতীয় পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীদের লেখা ছাড়া বার্ষিকী ছাপার নজির নেই। তবে আমি ছিলাম অনঢ়। সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করলাম, ছাত্র-ছাত্রীরা ম্যাগাজিন ফি দেয়, অতএব রাকসু বার্ষিকীতে সবটুকু সুযোগ থাকবে শুধু তাদের জন্য। হাসান আজিজুল হক স্যার সমর্থন জানিয়ে বললেন, আমাদের লেখা তো জাতীয় দৈনিকে প্রতিদিন পাওয়া যায়। মাহবুব তো সাহিত্যের কাঁচামাল তৈরি করার চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে। ওকে করতে দাও। জুলফিকার মতিন স্যারও সমর্থন দিলেন। সাহিত্যের কাঁচামাল কথাটি ঐ প্রথম শুনলাম।
কয়েকজন নেতার ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের ফ্রি বিজ্ঞাপন ছাপার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলাম। শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা দিয়ে বার্ষিকী প্রকাশ করলাম। এমনকি সম্পাদনা পরিষদের সদস্য তিনজন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীর লেখাও ছাপা হয়নি। উগ্রপন্থীরা আহত বাঘের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। ওরা যে কোনো একটা অজুহাত খুঁজতে থাকলো। বার্ষিকীতে আমার লেখা প্রবন্ধ ‘ছাত্র রাজনীতির অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ’-এর একটি অংশ ছিলো, “বস্তুগতভাবে ছাত্ররা কোনো শ্রেণি নয়। সেজন্য ছাত্রদের কোনো শ্রেণিস্বার্থ থাকে না। ছাত্ররা সমাজ পরিবর্তনের উদ্দ্যেশ্যে কোনো আন্দোলন শুরু করলেও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃত্ব অর্জন করতে পারে না। চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সমাজের অন্য শ্রেণি এগিয়ে আসা প্রয়োজন হয়। ছাত্রদের পক্ষে ছাত্র অধিকার ভিত্তিক আন্দোলনগুলো সফল করা সম্ভব”।
ওরা ঐ অংশটি কোট করে আমাকে সামরিক সরকারের গোপন এজেন্ট আখ্যা দিয়ে রাকসু ভবনে আমার অফিসে আমাকে আক্রমণ করে সব পত্রিকা নষ্ট করে দেবার পরিকল্পনা করলো। আমার জন্য গোপন যোগাযোগের কাজটি পরিসংখ্যানের বন্ধু বিকাশ ভালোভাবে করতে পেরেছিলো। খবর পেয়ে মোহাম্মদ নাসের স্যার (সবার প্রিয় মিন্টু ভাই) আমাকে সাথে নিয়ে হাসান আজিজুল হক স্যারের কাছে গেলেন। উনি অতি দ্রুত শহীদুল ইসলাম স্যারকে সাথে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঐসব সংগঠনের টেন্টে গিয়ে বলে দিলেন, মাহবুব যা লিখেছে তা সঠিক। কৃষক-সমাজ ও শ্রমিক শ্রেণির সাহায্য ছাড়া দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক পড়াশুনা না করার জন্য ওদেরকে বেশ বকে দিয়েছিলেন। এতসব ঘটনা আমার সংগঠনের ভেতরে না বলে শুধু অনুরোধ করলাম- ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের দিয়ে এক রাতের মধ্যে প্রত্যেকটি হলের প্রতিটি রুমে গিয়ে সবার কাছে একটি করে বই পৌঁছে দিতে। সফলভাবে তারা কাজটি করতে পেরেছিল। স্যারের কাছে ঋণী হয়ে থাকলাম।
হাসান আজিজুল হক স্যারের কাছে শিখেছিলাম, ‘দশ বছর পরপর মায়া ত্যাগ করতে হয়।’ আমার স্বভাব হলো-কোনো কাগজ না ফেলা। আমার সংগ্রহে থাকা পুরাতন পত্রিকা, গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, বই-এর জায়গা সংকুলান সমস্যায় স্যার উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘দেখবে যেসব কাগজগুলো গত দশ বছরে একবারও দেখার প্রয়োজন হয়নি, সেগুলো ভবিষ্যতে দরকার পড়ার সম্ভাবনা কম। ওগুলোর মায়া ত্যাগ করে ফেলে দাও। তা না হলে অপ্রয়োজনীয় স্তূপ বাড়বে; যার মাঝে প্রয়োজনীয় তথ্য হারিয়ে যাবে।’
সাপ্তাহিক একতা পত্রিকা পৌঁছে দিতে সপ্তাহে একবার বিকালে স্যারের বাসায় যেতাম। ঐ নির্দিষ্ট দিনটিতে স্যার পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতেন। মাস শেষে একবার ৪ টি সংখ্যার জন্য ৮ টাকা বিল আনতে যেতাম। প্রত্যেকবার দেখতাম-স্যার এবং খালাম্মা চা আর খবরের কাগজ নিয়ে বারান্দায় বসে সুন্দর সময় কাটাচ্ছেন। স্যারের বাসার সামনের পরিবেশ এবং উনাদের বসে থাকা দেখে মনে হতো-এখানে এভাবে বসতে পারলে ভালো লেখা বের হবেই। ভাবতাম- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারলে এভাবেই আমার পারিবারিক জীবনটা পার করবো।
লেখক : সাবেক ম্যাগাজিন সম্পাদক, রাকসু; বর্তমানে জাপানে বসবাসরত।