প্রত্যাশা ডেস্ক : করোনাভাইরাসের নতুন ধরনকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক হিসেবে চিহ্নিত করে সেটিকে ‘ওমিক্রন’ নাম দিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের। দক্ষিণ আফ্রিকা ও বৎসোয়ানায় টিকাপ্রাপ্তরাই করোনার নতুন এই প্রজাতির দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, নয়া ভ্যারিয়েন্টের ভাবগতিক বুঝতে আরও কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে বিবৃতিতে তারা বলেছে, এই ভ্যারিয়েন্টে বিপজ্জনক মিউটেশন ঘটেছে। বস্তুত সেই কারণেই চিহ্নিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকির সর্বোচ্চ ধাপে রাখা হলো করোনার এই নয়া স্ট্রেনকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম চিহ্নিত হয়েছিল এই প্রজাতির ভাইরাস। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, তাতে ৫০টি মিউটেশন (জিনগত পরিবর্তন) ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে, যার মধ্যে ৩০টিরও বেশি হয়েছে শুধু স্পাইক প্রোটিনে। নতুন এই প্রজাতির করোনাভাইরাস যাদের আক্রমণ করেছে, তাদের শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ বা ‘ভাইরাল লোড’ খুব বেশি হয়েছে।
নতুন প্রজাতিটির উৎস নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো এইচআইভি আক্রান্তের শরীরই সম্ভবত এই ভ্যারিয়েন্টের উৎস। অতীতে করোনার বিটা ভ্যারিয়েন্টও এক এইচআইভি রোগীর শরীরে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় বুধবার যত জন সংক্রমিত হয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশের শরীরেই ওমিক্রন স্ট্রেনের ভাইরাস মিলেছে। নতুন এই প্রজাতির করোনা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে জোহানেসবার্গে। সেখানকার সংক্রমিতদের মধ্যে অধিকাংশই স্কুল-কলেজের পড়ুয়া। ফলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, নয়া প্রজাতির ভাইরাসের শিকার মূলত হচ্ছেন অল্পবয়সীরা। দক্ষিণ আফ্রিকার সেন্টার ফর এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক টুলিও ডি অলিভিয়েরা বলেছেন, এই ভ্যারিয়েন্টের ‘মিউটেশনের ধারা অস্বাভাবিক’ এবং অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট থেকে এটি ‘অনেক ভিন্ন।’ তিনি বলেন, ‘এই ভ্যারিয়েন্ট আমাদের অবাক করেছে। বিবর্তনের হিসেবে এবং পরবর্তী মিউটেশনের হিসেব করলে এটি কয়েক ধাপ লাফ দিয়েছে।’
এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক অলিভিয়েরা বলেন, সব মিলিয়ে ৫০টি মিউটেশন রয়েছে যার মধ্যে ৩০টি মিউটেশেনই স্পাইক প্রোটিনে। অধিকাংশ টিকাই স্পাইক প্রোটিনের এই ভ্যারিয়েন্টগুলোকে আক্রমণ করে।
প্রায় দুই বছর হতে চললো মহামারির কোভিডের দাপট। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় রূপ বদলেছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস। আলফা, বেটা, গামা ও ডেলটা পর এখন ‘ওমিক্রন’ ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব মেলেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ‘ওমিক্রন’ বিশ্বে এখন নতুন আতঙ্কের কারণ। ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার রোধে আফ্রিকার ৭ দেশে ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করছে একের পর এক দেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- ডব্লিউএইচও’র একটি প্যানেল ‘ওমিক্রন, বি১.১.৫২৯ কে উদ্বেগের ভ্যারিয়েন্ট অ্যাখায়িত করেছে। প্রাথমিকভাবে এখন পর্যন্ত এটিকে অত্যন্ত সংক্রমণযোগ্য ভাইরাস হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দ. আফ্রিকা, বতসোয়ানা, হংকং এবং ইসরায়েল ছাড়াও ইউরোপের একমাত্র দেশ হিসেবে বেলজিয়ামেও এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি মেলেছে। পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাউই থেকে ইসরায়েলে আসা এক পর্যটক নতুন ধরনে শনাক্ত হয়। পরিস্থিতি জটিল তা বুঝতে বাকি নেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গত শুক্রবার তিনি বলেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে আফ্রিকার ৭ দেশের সঙ্গে ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছি। যা আগামীকাল সোমবার থেকে কার্যকর হতে চলেছে।
করোনার নতুন স্ট্রেইন ‘ওমিক্রন’ নিয়ে যেহেতু এখনও বিস্তর তথ্য পাওয়া যায়নি, তাই এর ঝুঁকি কতটুকু তা এখনও অজানা। তবে ডব্লিউএইচও প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, এটি অন্যান্য অত্যন্ত সংক্রমণযোগ্য ভ্যারিয়েন্টের মতো ঝুঁকি রয়েছে। আর বর্তমানে বাজারে যে করোনার প্রতিষেধক টিকা রয়েছে এর বিরুদ্ধে কম কার্যকর কিনা তা জানতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ বিষয়ক কারিগরি কমিটির প্রধান মারিয়া ভন কারখোভ জানালেন, ‘ওমিক্রন, বি১.১.৫২৯ কে উদ্বেগের ভ্যারিয়েন্ট বলা হচ্ছে কারণ এর ভেতর দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে।’ মারিয়া তার টুইটারে আরও উল্লেখ করেন, ‘এই ভ্যারিয়েন্টে অনেক মিউটেশন দেখা গেছে। কিছু মিউটেশন (জিনগত পরিবর্তন) সত্যিই উদ্বেগের।’
প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ৭টি দেশের সঙ্গে ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এর ২৭ দেশ। সাময়িকভাবে আফ্রিকার এই দেশগুলো থেকে কেউ ভ্রমণ করতে পারবে না। তবে এই সাত দেশ থেকে মার্কিন নাগরিকরা নিজ দেশে ফিরতে পারবেন বলে জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এদিকে ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ তার দেশের আইনমন্ত্রীদের বলেছেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব এই বিষয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত’। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়াও আজ রোববার থেকে ভ্রমণে বিধিনিষেধের আরোপের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। উদ্বেগ প্রকাশ করে ইইউ কমিশনের প্রসিডেন্ট উরসুলা ভন বলেন, ‘নতুন স্ট্রেইন ওমিক্রন নিয়ে পরিষ্কার ধারণা না পাওয়া পর্যন্ত ফ্লাইট স্থগিত করতে হবে। শনাক্ত হওয়া দেশগুলো থেকে আসা যাত্রীদের অবশ্যই আলাদা করা উচিত। এই নিয়মগুলো কঠোরভাবে মানা উচিত’।
গত শুক্রবার সংবাদমাধ্যম সিএনএন-কে ওমিক্রন নিয়ে উদ্বেগের কথা শুনিয়ে মার্কিন শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউচি। ফাউচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত নতুন ভ্যারিন্টের অস্তিত্ব না মিললেও চিন্তার কারণ রয়েছে। গবেষণার ফলাফল হাতে না আসা পর্যন্ত আমরা এই মুহূর্তে সঠিকভাবে বলতে পারছি না’। বিশ্বের অনেক দেশ যখন আফ্রিকায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে তখন এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন আফ্রিকার কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থার পরিচালক ড. জন নেকেনগাসং। তিনি বলেন, ‘আগে যেই ভ্যারিয়েন্ট এসেছিল তার সংক্রমণ রোধে ভ্রমণসহ বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েও বিস্তার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় কাজে আসেনি’। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পড়া এবং বার বার হাত ধোয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
দেশের প্রবেশপথে স্ক্রিনিং জোরদারের নির্দেশ : দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের নতুন ধরন শনাক্ত হওয়ায় দেশের সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং জোরদার ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল শনিবার সকালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি সেকেন্ড স্পেশাল সেশন’ এ অংশ নিতে যাত্রাকালে এক অডিও বার্তায় এ কথা জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, আফ্রিকান নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিষয়ে আমরা অবহিত হয়েছি। এ ভাইরাসটি খুবই এগ্রেসিভ। বিশ্বের আক্রান্ত অন্যান্য জায়গা থেকে যারা আসবে তাদের বিষয়েও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। স্ক্রিনিং ছাড়া আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যেন দেশে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। করোনার অন্যান্য ধরনের তুলনায় ‘ওমিক্রন’ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তৎপর বলে জানান মন্ত্রী। এ বিষয়ে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। মন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ এখন স্থগিত করা হচ্ছে। সব বিমানবন্দর, ল্যান্ডপোর্ট বা দেশের সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সারাদেশে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে ও মাস্ক পরা নিশ্চিতে সব জেলা শহরের প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে যা জানা গেছে : শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ, আতঙ্ক বাড়িয়ে চলেছে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, হংকং, বেলজিয়াম ও ইসরায়েলে মাত্র কয়েক ডজন মানুষের দেহে ভাইরাসের এ নতুন ধরনটির সংক্রমণ ধরা পড়লেও এর জিন বিন্যাস ভয় দেখাচ্ছে। এর জিন কাঠামো এত বেশিবার পরিবর্তিত (মিউটেট) হয়েছে যে আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ওমিক্রন অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এবং টিকাও এর বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। অবশ্য বিজ্ঞানীরা এটাও বলছেন, এ ভ্যারিয়েন্ট কতটা সংক্রামক বা এর আক্রমণের ধরন কতটা তীব্র হবে, টিকার সুরক্ষা এড়াতে পারবে কিনা কিংবা এর কারণে মহামারী পরিস্থিতির অবনতি হবে কিনা- এসব প্রশ্নের উত্তর অনুমানের ভিত্তিতে দেওয়া যাবে না। সেজন্য আরও সময় দরকার, প্রয়োজন আরও পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ। ফলে ওমিক্রন অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে বিশ্বজুড়ে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বি.১.১.৫২৯ : দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এই নতুন ধরন বা ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত করার কথা জানান গত মঙ্গলবার। যেসব নমুনা থেকে ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া গেছে সেগুলো নেওয়া হয়েছিল ১৪ থেকে ১৬ নভেম্বরের মধ্যে।
গত বুধবার আরও পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে তারা ভ্যারিয়েন্টটি নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিষয়টি সরকারকে জানান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাইরাস ইভোলিউশন বিষয়ক টেকনিকাল গ্রুপকে বসতে বলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ মানুষের দেহে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে, যার বেশিরভাগই মিলেছে সবচেয়ে জনবহুল গৌতেং প্রদেশে। এর বাইরে বতসোয়ানা, হংকং, বেলজিয়াম ও ইসরায়েলে ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়েছে। নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছে; ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। গবেষকরা করোনাভাইরাসের এই নতুন ভ্যারিয়েন্টকে চিহ্নিত করছেন বি.১.১.৫২৯ নামে। তবে আলোচনার সুবিধার জন্য শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নাম দিয়েছে ‘ওমিক্রন’। একে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট’ শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে আলফা, বেটা, গামা ও ডেল্টার ক্ষেত্রেও একই ভাষ্য ব্যবহার করেছিল তারা। এর অর্থ হচ্ছে- প্রাথমিক তথ্য প্রমাণে ভ্যারিয়েন্টটি বেশি সংক্রামক এবং এর বিরুদ্ধে টিকা কম কার্যকর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কতটা সংক্রামক : দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যালোচনায় ভ্যারিয়েন্টটি গৌতেংয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং সম্ভবত এখন দেশের অন্য ৮টি প্রদেশেও পৌঁছে গেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। গত বৃহস্পতিবার দেশটিতে শনাক্ত রোগী মিলেছে ২ হাজার ৪৬৫ জন; এই সংখ্যা আগের দিনের প্রায় দ্বিগুণ। দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিকেবল ডিজিজেস (এনআইসিডি) নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণেই এমনটা হয়েছে তা না বললেও দেশটির বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা রোগীর ঊর্ধ্বগতির পেছনে বি.১.১৫২৯ ধরনের ভূমিকা থাকতে পারে। এখন পর্যন্ত যাদের দেহে ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়েছে, তাদের বড় অংশই তরুণ। তবে এটি টিকাদানের হার বেশি এমন এলাকায় কেমন আচরণ করবে, তা বলা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি যে দেশে ভ্যারিয়েন্টটি মিলেছে, সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় টিকাদানের হার খুবই কম। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের এক চতুর্থাংশের সামান্য বেশি কোভিডের টিকা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. জো পাহলা।
উদ্বেগ কেন : উদ্বেগের কারণ এ ভাইরাসের জিন বিন্যাসে মিউটেশন বা রূপবদলের সংখ্যা। কোয়াজুলু-নাটাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সিকোয়েন্সিং প্ল্যাটফর্মের পরিচালক তুলিও ডি অলিভিয়েরা বলছেন, নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের ‘মিউটেশনের ধারা খুবই অস্বাভাবিক’, যার মধ্যে ৩০ এরও বেশিবার মিউটেশন হয়েছে কেবল স্পাইক প্রোটিনেই।
সব ভাইরাসই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদলায়। তবে বেশিরভাগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই ভাইরাসটি যে দেহে আশ্রয় নেয় তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না, বা ফেললেও তা এত সামান্য যে টেরই পাওয়া যায় না। তবে কিছু কিছু পরিবর্তন ভাইরাসটি কত দ্রুত ছড়াতে পারে, তার আক্রমণের তীব্রতা কেমন হবে এবং টিকার কার্যকারিতা- এসব বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবদেহের কোষে প্রবেশে ভাইরাস যে স্পাইক প্রোটিনকে ব্যবহার করে, বি.১.১.৫২৯ এর সেই স্পাইক প্রোটিনেই মিউটেশন হয়েছে ৩০ বারের বেশি, যা ডেল্টার মিউটেশনের প্রায় দ্বিগুণ এবং উহানে শনাক্ত হওয়া আদি ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে ‘উল্লেখযোগ্য পার্থক্য’ সৃষ্টি করেছে। কোভিড মোকাবেলায় বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে তার সবগুলোই বানানো হয়েছে করোনাভাইরাসের আদি রূপকে ধরে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভ্যারিয়েন্টটির কিছু কিছু পরিবর্তন মানুষের শরীরের অ্যান্টিবডিকে অকার্যকর এবং দ্রুত সংক্রমিত হওয়ার সক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে অন্য অনেক পরিবর্তন সম্বন্ধে এখনও কিছুই জানা যায়নি, তাই এটি আদতেই কেমন আচরণ করতে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
অন্য ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে পার্থক্য কতটা : ভ্যারিয়েন্টটি এখন পর্যন্ত পাওয়া অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় অনেক বেশিবার জিনের বিন্যাস বদলেছে; যাকে ‘ভয়ঙ্কর’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন এক বিজ্ঞানী, আরেকজন বলেছেন তারা এর চেয়ে খারাপ ভ্যারিয়েন্ট এখন পর্যন্ত দেখেননি। বি.১.১.৫২৯ এ পাওয়া কয়েকটি মিউটেশন এর আগে অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। সেসব মিউটেশনের ফলে ভ্যারিয়েন্টটি দ্রুত সংক্রমিত হতে পারবে বলে আন্দাজ করা হচ্ছে। কিন্তু নতুন ভ্যারিয়েন্টে আরো কিছু মিউটেশন রয়েছে যার কারণে হয়তো শরীরের অ্যান্টিবডি ভাইরাসকে শনাক্ত করতে পারবে না এবং ভ্যাকসিন অপেক্ষাকৃত কম কার্যকর হবে, বলছেন বিজ্ঞানীরা।
“মিউটেশনগুলো ভাইরাসকে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ছড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শক্তিশালী করেছে বলে আশঙ্কা করছি আমরা। ইমিউন সিস্টেমের বিভিন্ন অংশকে পাশ কাটিয়ে শরীরে প্রবেশ করার সক্ষমতাও থাকতে পারে এগুলোর,” বলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজুলু-নাটাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সিকোয়েন্সিং প্ল্যাটফর্মের রিচার্ড লেসেলস।
উদ্বেগ কি অহেতুক? এর আগেও করোনাভাইরাসের বেশ কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেসব আতঙ্ক কেবল কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন, এ বছরের শুরুতে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক তৈরি করেছিল বেটা ভ্যারিয়েন্ট, কেননা ইমিউন সিস্টেমকে পাশ কাটিয়ে শরীরে প্রবেশ করার সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি ছিল করোনাভাইরাসের এই ধরনটির। কিন্তু দ্রুত সংক্রমিত হওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কাছে এটি ধরা খেয়ে যায়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবি গুপ্ত বলছেন: “বেটা কেবল ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিত, আর কিছু না। কিন্তু ডেল্টার ছিল বেশি সংক্রমণ ও ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দেওয়ার মাঝারি মাত্রার সক্ষমতা। নতুন ভ্যারিয়ন্টের দুই ধরণের ক্ষতি করার সামর্থ্যই উচ্চ মাত্রার থাকতে পারে।”
তবে এখন পর্যন্ত ওমিক্রন শনাক্ত হওয়াদের দেহে নতুন অস্বাভাবিক কোনো উপসর্গ পাওয়া যায়নি; আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর মতো এটির ক্ষেত্রেও এমন অনেককেই পাওয়া গেছে যাদের কোনো উপসর্গই নেই, বলেছে দক্ষিণ আফ্রিকার এনআইসিডি। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরই মত, গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে আরো পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যাবে কিন্তু প্রকৃতিতে এই ভাইরাস কেমন আচরণ করে, তা পর্যবেক্ষণ করলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর খানিকটা আগে পাওয়া সম্ভব। আমাদেরও সম্ভবত সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে। উদ্বেগ, আতঙ্ক থেকেই বিশ্বের অনেক দেশ এরই মধ্যে সতর্কতামূলক পদক্ষেপও নিয়ে নিয়েছে। কেননা মহামারীর শিক্ষাই হচ্ছে- সবসময় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করলে আপনার চলবে না, আগেই পদক্ষেপ নিতে হবে, সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে।
স্থগিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন : করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিওর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বর এই সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। চার বছরের মধ্যে এটি ছিল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৃহত্তম বাণিজ্য সম্মেলন। জেনেভায় এই সম্মেলনে ১৬৪টি সদস্য দেশের ১০০ বেশি মন্ত্রী এবং চার হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশ নেয়ার কথা ছিল। সংস্থাটির নতুন মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা আশা করছিলেন, এই সম্মেলনে মতভেদ দূর করতে, কোভিড ভ্যাকসিনের পেটেন্ট তুলে নেওয়ার বিষয় একটি চুক্তির দিকে অগ্রসর হতে এবং মহামারি মোকাবিলায় ডব্লিউটিওর ভূমিকা তুলে ধরার জন্য সুযোগ পাবেন। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগজনক ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনের নাম ঘোষণার পরে এই বাণিজ্য সম্মেলন শুরুর চার দিন আগে তা স্থগিত করা হয়।
ব্যতিক্রম চীন : বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে উদ্বিগ্ন ঠিক সে সময়ই উহানে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি ও পর্যটন মেলা। ‘সুন্দর চীন, সুখী জীবন’ স্লোগান নিয়ে গত শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) এই মেলা শুরু হয়েছে। এতে চীনের ২৯টি অঞ্চল ও ১৩টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। এছাড়া দুইটি আন্তর্জাতিক সংগঠনও রয়েছে তিনদিনের এ মেলায়। চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটনমন্ত্রী হু হেপিং বলেন, আইকনিক সাংস্কৃতিক ও পর্যটন পণ্য, নতুন উন্নয়ন মডেল ও শিল্পের অগ্রগতি প্রদর্শনের জন্য মেলায় একটি বিনিময় ও যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় ৬০ হাজার বর্গ মিটার এলাকাজুড়ে অনুষ্ঠিত এ মেলায় উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য যেমন ওএলইডি স্ক্রিন ও রোবট প্রদর্শন করা হচ্ছে। এই রোবটগুলো চা ও কফি তৈরি করতে পারে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার বিভাগ, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ও হুবেই সরকারের যৌথ উদ্যোগে এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি প্রতি বছর উহানে অনুষ্ঠিত হবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। খবর শিনহুয়া নিউজ এজেন্সির।
মহামারিতে নতুন আতঙ্ক ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ