সফিউল আযম : পুরো পৃথিবী যখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একযোগে মহামারি থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে, ঠিক তখনেই যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস-কপ ২৬। যার মূল লক্ষ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা এবং বিশ্বের জনগণকে এর ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে অবহিত করা এবং মানব সভ্যতাকে অস্থির অবস্থা থেকে একটি সহনশীল অবস্থায় নিতে সম্মিলিত ও সমন্বিতভাবে কাজ করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম দেশ বাংলাদেশ। তাই এই সম্মেলনে বাংলাদেশের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। এ বছরের জুনে উক্ত কপ-২৬ সম্মেলনের প্রাক্কালে সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট ও ব্রিটিশ এমপি অলোক শর্মা ঢাকা সফর করেন। তিনি সফরে জলবায়ু তহবিলসহ নানা বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
জানা যায়, চারটি লক্ষ্যকে এবারের সম্মেলনে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। ১. ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যতে নামিয়ে আনতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা ২. জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং পুনরুদ্ধার করা, প্রতিরক্ষা ও সতর্ক ব্যবস্থা তৈরি, অবকাঠামো তৈরি ও কৃষি ব্যবস্থাকে আরো স্থিতিস্থাপক করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা ৩. এসব কাজ সম্পাদনের জন্য প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল করার জন্য উন্নত দেশগুলোকে ভূমিকা রাখা এবং ৪. জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করা।
বিশ্বব্যাপী সকলে জলবায়ু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের মধ্যে ৭ম দেশ বলে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়, যদিও বাংলাদেশ এর জন্য দায়ী নয়। ১৯৯২ সাল হতে বাংলাদেশ ইউএনএফসিসি নীতিমালা অনুসরণ করে আসছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ইত্যাদি কোন বিষয়েই বাংলাদেশ দায়ী নয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনুসরণও করছে। সবুজ পরিবেশ আনয়নে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়েছে এবং সারা দেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক দলও বৃক্ষরোপণে এগিয়ে আসছে।
আমরা প্যারিস চুক্তির ৫ বছর পার করেছি। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে এবারের সম্মেলনে এটিকে আরো জোরদার করার বিকল্প নাই। একথা ঠিক যে, উন্নয়নশীল দেশগুলো মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ পরিমাণ নিতান্তই কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব তা বেশিরভাগই পোহাতে হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে মোকাবিলায় প্রস্তুতির জন্য যে অর্থ প্রয়োজন তার যোগানও সীমিত। নিজেদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ দরকার। আশার কথা বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাধিক বিস্তৃত অভ্যন্তরীণ সৌরশক্তি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তুলতে কারও সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে বাংলাদেশ প্রথম এলডিসি হিসেবে নিজস্ব ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত, ২৭টি মন্ত্রণালয়ে ২৯ হাজার টাকা জলবায়ু বাজেট প্রদান ও ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০ প্রণয়ন করেছে, যা সত্যিই একটা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ যেহেতু ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) ও ভালনারেবল টোয়েন্টি (ভি২০) গ্রুপের চেয়ার হিসেবে বর্তমানে কাজ করছে। ফলে বৈশ্বিক মহামারি করোনার মাঝেও বাংলাদেশ বেশ কিছু সাহসী কার্যক্রম সম্পন্ন করে, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো থিমেটিক অ্যামবাসাডর নিয়োগ, গ্লোবাল সেন্টার অব অ্যাডাপটেশনের (জিসিএ) দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক অফিস স্থাপন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কর্তৃক আহুত জলবায়ু বিষয়ক ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ, ভি২০ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফিন্যান্স প্রথম সামিট সম্পন্নকরণ, দ্য জুলাই মিনিস্ট্রিয়াল-এ অংশগ্রহণ প্রভৃতি। একথা ঠিক যে, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, বন্যার প্রভাব বাংলাদেশে অনেক বেশি হওয়ার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক মানুষ জোরপূর্বক মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের পরিবেশগত দিকে প্রভাব বেশ পড়ছে, যার সমাধান আশু হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশ ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, যা জলবায়ু ঝুঁকি থেকে জলবায়ু সহনশীলতার দিকে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডাকা ‘মেজর ইকোনমিজ ফোরাম অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লাইমেট’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রস্তাবে যেসব বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন, সেগুলো হলো-প্রধান কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোকে বেশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার লক্ষ্যে তাদের কার্বন নির্গমন হ্রাস করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ। জলবায়ু তহবিলের জন্য উন্নত দেশগুলোর বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে এবং অভিযোজন ও প্রশমনের মধ্যে ৫০:৫০ বিতরণ করা, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রযুক্তি হস্তান্তরের পাশাপাশি সবচেয়ে কার্যকর জ্বালানি সমাধানে উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে উত্তরণের ক্ষেত্রে, জাতি-রাষ্ট্রগুলোর সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন অগ্রাধিকারগুলোর হিসাব নেয়া এবং তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লোকসান ও ক্ষতির বিষয়গুলো বিবেচনা করা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীর ভাঙন, বন্যা ও খরার কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সকল দেশের ভাগ করে নেয়া।
বাংলাদেশকে দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের ফোরামে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। যেসব দেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী নয়, তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। জলবায়ুবিষয়ক সর্বোচ্চ বিশ্ব ফোরাম, জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি)-এর কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (সিওপি)-এ ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্বজড়ে দেড় হাজারেরও বেশি স্থানে জলবায়ু কর্মীরা রাস্তায় নেমেছিল। বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকে পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধিকারী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ব্যাপকভাবে হ্রাস করার জন্য আরো উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপ নিশ্চিত করার দাবি তোলেন তারা। করোনা মহামারি শুরুর পর জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের তরুণ জলবায়ু কর্মীরা রাস্তায় নামে।
ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে তৎপরতার সঙ্গে লড়তে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যত রেখে যেতে সার্বিক বৈশ্বিক উদ্যোগসহ জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে বিশ্বনেতাদের। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে তাদের অভিযোজন ও প্রশমন প্রচেষ্টায় সহায়তা করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। জলবায়ু ঝুঁকি থেকে সহনশীল এবং সহনশীলতা থেকে দিন দিন উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নতি থেকে সমৃদ্ধির মহাসোপানে বর্তমান বাংলাদেশ। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য উন্নত বিশ্ব রেখে যেতে বিশ্বনেতাদের এখনই সোচ্চার হতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, সমাজসেবা সম্পাদক, গ্রিণ এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্ট ও উপদেষ্টা, ধরিত্রী ফাউন্ডেশন। ংধভরঁষ.ধুধধস@মসধরষ.পড়স
কপ ২৬: চাই প্রজন্মের বাসযোগ্য পৃথিবী
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ