কনক কুমার প্রামানিক : রাতের আঁধার তখনো সম্পূর্ণ কাটেনি। শেষ শরতের মেঘমুক্ত পরিবেশে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। সদ্য ঘুমজাগা পাখিরা গাছে গাছে কিচির মিচির করতে শুরু করেছে। সবার অন্তরালে সবুজ পা টিপে টিপে ঘরের দরজাটা খুলে খুব সতর্কতার সাথে নিঃশব্দে বাইরে আসে। পাশের ঘরে দরজায় মুখ লাগিয়ে খুব ধীরে একবার ময়নাকে ডাকে সে। সঙ্গে সঙ্গে ময়নাও ঘরের বাইরে চলে আসে। সেখান আর এক মূহুর্তও দাঁড়ায় না ওরা। ফিস ফিস করে কি যেন বলতে বলতে এসে দাঁড়ায় নৌকা বাঁধা ঘাটের কাছে এসে। চুপিচুপি নৌকার বাঁধন খুলে দ্রুত ওরা বিলের মধ্যে মিলিয়ে যায়। বারো বছরের সবুজ ও দশ বছর বয়সী ময়নার খুব ভাব। সারাদিন দু’জনে একসাথে হৈ হুল্লোড় করে বন বাদাড় আর এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। কখনো ওদের অমিল হয়না। এবার আশ্বিনের অকাল বন্যায় ক্ষেতের ধানসহ বাড়িঘর জলের নিচে তলিয়ে গেছে। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার খুব বড় বন্যা হয়েছে। সবুজ ময়নার পরিবারসহ এলাকার আরো শ খানেক পরিবার এসে এখন চারতলা বিশিষ্ট বড় হাই স্কুলের বন্যা আশ্রায়ন কেন্দ্রে এসে ঠাঁই নিয়েছে। ভোর ভোর সময়ে সবার ঘুম থেকে জাগার আগে ওরা দুই জন খুব সন্তপর্ণে দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সবুজ খুব জোরে জোরে নৌকার লগি ঠেলে তারাতারি বিলের মাঝখানটায় এসে পৌঁছায়। ময়না একেবারে গুটিসুটি মেরে গলুইয়ের একেবারে শেষ প্রান্তে বসে থাকে। বিলের মাঝটানে ঠান্ডা হাওয়াতে ওর শীত করছে। টুকটাক কথাও চলে ওদের মাঝে। সে কথাগুলো মিলিয়ে যায় নিরব নিঃস্তব্ধ ভোরের বাতাসে। শীতের তোয়াক্কা না করে পরনের লুঙ্গিটা গুটিয়ে নিয়ে সহসাই বিলের অথৈ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবুজ। গ্রামের ছেলে সে তাই সাঁতার সে ভালোই জানে। সারি সারি লাল সাদা শাপলার মধ্যে থেকে কয়েক গোছা শাপলা তোলে সে। নৌকার উপর থেকে সেগুলো ধরে নেয় ময়না। তারপর দ্রুত সেখান থেকে রওনা দেয় ওরা। ভেজা লুঙ্গিটার নিচের অংশের জল ছাড়িয়ে সেটি দিয়ে গা মোছার চেষ্টা করে সবুজ। নৌকাটা সাবধানে ঘাটে বেঁধে অত্যন্ত দ্রুত পা চালায় ওরা। পাশের মসজিদ থেকে সবে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। পুব আকাশের ঘুমন্ত সূর্য্যটাতে সবে লালচে রং ধরেছে। বাইরে লোকজনের আনাগোনা তখনো তেমন বাড়েনি। প্রায় কিলো দেড়েক হেঁটে ওরা পুরোনো বাজারে এসে পৌঁছায়। আজ এখানকার হাটবার। দু’চার জন করে লোকজন হাটে আসতে শুরু করেছে। বাজার ঢোকার মুখে এক কোণার দিকে সবুজ ঘাড় থেকে শাপলাগুলো নামিয়ে বিছিয়ে দোকান দিয়ে বসে। কাল সকাল থেকে দুজনে বিলে শাপলা তুলে হাটে বেচার পরিকল্পনা করে ওরা। ক্রমে বেলা বাড়তে থাকে। পুবের লালচে সূর্য্যটা প্রখর হয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। বাজারে লোকজনের সমাবেশ অনেক বেড়েছে। কেনা বেচাও বেশ জমে উঠেছে। ওরা যেখানে শাপলার দোকান খুলে বসেছে সেখান দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম লোকজন যাওয়া আসা করে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলের জলাশয়গুলোর সর্বত্র শাপলা ফুল পাওয়া যায় বলে টাকা দিয়ে কেউ শাপলার ফুল কিনে না। তাই অনেক আশা নিয়ে বিল থেকে তুলে আনা শাপলাগুলো বিক্রি হয় না। শুকাতে থাকে রোদে। বেলা এখন দ্বিপ্রহর। ক্ষুধার কাতর কিশোর কিশোরী দুটির মুখ শুকিয়ে গেছে। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি এখনো। দূরে জিলাপি, মিষ্টির দোকানে করুণ চাহনিতে তাকায় ওরা। ছোট মানুষ ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল।
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শিক্ষক রমেশ বাবু দুজন কিশোর কিশোরীকে দেখছিলেন। নিঃষ্পাপ মুখ দুটোকে লক্ষ্য করলেন তিনি। ওদের সামনে এসে শাপলাগুলো কিনতে চাইলে আনন্দে ওদের কচি মুখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
রমেশ বাবু কচি নিঃষ্পাপ দুটি মুখের হাসি কিনলেন। দু’জনে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি এনে প্রথমে পেটপুরে দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। যাবার সময় দুজনকে বাজার থেকে নতুন জামাকাপড় কিনে দিয়ে হাতে কিছু টাকাও দিলেন। এক গোছা শাপলা ফুলের বিনিময়ে যে এত কিছু পাওয়া যায় দেখে কোমল দুটি হৃদয় খানিক বিস্মিত হলো।
সন্ধ্যা বেলা ওরা বাবা মার কাছে ফিরে এলো। সারা দিন দেখতে না পেয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে ওদের। সব কথা শুনে সবুজ ময়নার বাবা মার চোখের কোণে জল চলে এলো। পরদিন বিকেলে ওরা নতুন জামা পড়ে পূজা দেখতে গেল। অনেক ঘোরাঘুরি আর কেনাকাটা করে ওরা যখন বন্যা আশ্রায়ন কেন্দ্রে ফিরে এলো তখন রাত কিছুটা ভারী হয়েছে। শরতের শুভ্র আকাশে চাঁদটা তখন হেলে পড়েছে পশ্চিমে।
নিঃস্বার্থ সুখ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ