ঢাকা ০৭:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সবার ভেতরেই পোশাকি বচন

  • আপডেট সময় : ১০:২৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১
  • ১১৫ বার পড়া হয়েছে

book

তুষার আবদুল্লাহ : গতকাল রাতে ভেবেছিলাম আজ লিখবো না কিছু। লেখা কিংবা কথা বলা, সবই তো অপচয়। পত্রিকা বা পোর্টালের জায়গা ভরাট করে দেওয়ার জোগালি করা মাত্র। যা নিজে বিশ্বাস করি না তাই হয়তো লিখছি। যা বিশ্বাস করি তা হয়তো লিখতে পারছি না। বলার বেলায়ও একই চিত্র। এই যে মন ও কর্ম বা আচরণের দূরত্ব, এটা এক ধরনের অসুস্থতা। যারা রাজনীতি করছেন আর আমরা যারা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত, সবাই পোশাকি বচন নিয়ে আছি। একে অপরকে পোশাকি বচনে তুষ্ট বা দমন করে রাখতে চাই। কিন্তু যার সঙ্গে বিশ্বাস বা মনের যোগাযোগ নেই, সেই বচন টেকসই হয় না। দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতা ‘ফনা’ তুলে দাঁড়ালেও বীণার কৃত্রিম সুর তাকে বশ মানাতে ব্যর্থ হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতা ‘ফোঁস’ করে উঠলে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর দিকে আঙুল তুলি আমরা। নির্দিষ্ট করে ধর্মভিত্তিক দল বলে কিছু নেই এখন। সব রাজনৈতিক দলই ভোটবাজারে ধর্মকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করছে। রাজনীতি কি শুধু সরকারি-বেসরকারি দফতরে কাজ আদায় কিংবা কাজ ফাঁকিতে? শিক্ষা, ব্যবসা, পণ্য বিক্রিতে উদারভাবে ধর্মের ব্যবহার হচ্ছে।
ধর্ম নিয়ে কট্টর অবস্থান সব অনুসারীর মধ্যেই আছে। হিন্দু-মুসলমানদের এ বিষয়ে একতরফা দোষারোপ করা যাবে না। রোগটি শুধু বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মিয়ানমারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। সবাই রোগাক্রান্ত গোলকের। ভেতরে একটু উঁকি দিলেই, জীবন আচরণ ও অন্য ধর্মের প্রতি রাগ-অনুরাগ প্রত্যক্ষ করলেই রোগের লক্ষণ বোঝা যাবে। বাংলাদেশ ও এর চারপাশের ব্রিটিশশাসিত দেশগুলোতে ব্রিটিশরা যে বিষফোঁড়া ফাটিয়ে দিয়ে গেছে, সেই পুঁজ এখনও প্রবাহিত। উত্তাপটা বাড়ছেই। মানুষ সাম্প্রদায়িক হলো কবে? ইতিহাস এর নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা দেবে কিনা জানি না। কোনও ইতিহাসই সংশয় ও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। সবাই নিজ নিজ মতলব মতো ইতিহাস তৈরি করে নিয়েছে। রাজনীতি, ধর্ম সবাই। তবে নিশ্চিত করে আমরা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ও বিশ্বাসীরা বলতে পারি- আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অস্ত্র হিসেবে যখন ধর্মের ব্যবহার শুরু হলো তখন থেকেই ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হতে শুরু করে। এখন ক্ষমতায় আরোহন এবং টিকে থাকাও ধর্মের ওপর নির্ভরশীল। অসাম্প্রদায়িকতার পতাকা উড়ে বিস্ফোরিত হয় অসাম্প্রদায়িকতার ফাঁকা বুলি। আমরা ভোটের মতলবে, সামাজিক স্বার্থে অসাম্প্রদায়িকতার বসন নেই। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে, আচরণে, চর্চায় আমাদের বহিঃপ্রকাশ সাম্প্রদায়িক। এজন্যই দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী যখন তাদের স্বার্থ হাসিলের রণক্ষেত্রের নকশা তৈরি করে, তখন মুফতে পেয়ে যায় আমাদের মতো সৈনিক।
সাম্প্রদায়িক শক্তি যেকোনও জনপদেই লঘুদের ওপর চড়াও হয়। এটাই আধিপত্যবাদের ধর্ম। লঘুরা নির্যাতনের শিকার হলে, বিপন্ন বোধ করলে, নিরাপত্তাহীনতায় কুঁকড়ে থাকলে, অসাম্প্রদায়িকতার চাদর নিয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এগিয়ে যায়। নিপীড়িতরা প্রথম প্রথম কারও কারও প্রতি বিশ্বাস রাখতো। কিন্তু দেখা গেলো- তাতে আগুন নেভে না। জমি, কন্যা, স্ত্রী, মায়ের ওপর থেকে লোভের চোখ সরে না। অঙ্ক কষে দেখা যায়, ভোটবাজারে বিক্রি হতে হতে আর কোনও ভাগশেষ নেই। অভিবাসনের অন্যতম একটি কারণ সাম্প্রদায়িক আক্রমণ। দেশভাগের পর থেকে কম মানুষ তো ভিটে ছেড়ে এপার-ওপার হলো না। সব ভূখ-েই এমন ভিটে ছাড়া মানুষের দল আছে। কিন্তু নতুন বসতিতেও কি তারা নিশ্চিত যাপনে আছে? সিদুঁর রাঙা মেঘ সর্বত্র তাদের তাড়া করেই বেড়াচ্ছে। কারণ ‘সাম্প্রদায়িকতা’র মতো আর কোনও পণ্যের চৌকাঠ অবধি বাজারজাত হয়নি। দুয়ার বন্ধ রেখেও কি এই পণ্যের প্রবেশ রোধ করা যাচ্ছে? যাচ্ছে না বলেই লেখন, বচন সবই অপচয়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সবার ভেতরেই পোশাকি বচন

আপডেট সময় : ১০:২৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১

তুষার আবদুল্লাহ : গতকাল রাতে ভেবেছিলাম আজ লিখবো না কিছু। লেখা কিংবা কথা বলা, সবই তো অপচয়। পত্রিকা বা পোর্টালের জায়গা ভরাট করে দেওয়ার জোগালি করা মাত্র। যা নিজে বিশ্বাস করি না তাই হয়তো লিখছি। যা বিশ্বাস করি তা হয়তো লিখতে পারছি না। বলার বেলায়ও একই চিত্র। এই যে মন ও কর্ম বা আচরণের দূরত্ব, এটা এক ধরনের অসুস্থতা। যারা রাজনীতি করছেন আর আমরা যারা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত, সবাই পোশাকি বচন নিয়ে আছি। একে অপরকে পোশাকি বচনে তুষ্ট বা দমন করে রাখতে চাই। কিন্তু যার সঙ্গে বিশ্বাস বা মনের যোগাযোগ নেই, সেই বচন টেকসই হয় না। দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতা ‘ফনা’ তুলে দাঁড়ালেও বীণার কৃত্রিম সুর তাকে বশ মানাতে ব্যর্থ হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতা ‘ফোঁস’ করে উঠলে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর দিকে আঙুল তুলি আমরা। নির্দিষ্ট করে ধর্মভিত্তিক দল বলে কিছু নেই এখন। সব রাজনৈতিক দলই ভোটবাজারে ধর্মকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করছে। রাজনীতি কি শুধু সরকারি-বেসরকারি দফতরে কাজ আদায় কিংবা কাজ ফাঁকিতে? শিক্ষা, ব্যবসা, পণ্য বিক্রিতে উদারভাবে ধর্মের ব্যবহার হচ্ছে।
ধর্ম নিয়ে কট্টর অবস্থান সব অনুসারীর মধ্যেই আছে। হিন্দু-মুসলমানদের এ বিষয়ে একতরফা দোষারোপ করা যাবে না। রোগটি শুধু বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মিয়ানমারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। সবাই রোগাক্রান্ত গোলকের। ভেতরে একটু উঁকি দিলেই, জীবন আচরণ ও অন্য ধর্মের প্রতি রাগ-অনুরাগ প্রত্যক্ষ করলেই রোগের লক্ষণ বোঝা যাবে। বাংলাদেশ ও এর চারপাশের ব্রিটিশশাসিত দেশগুলোতে ব্রিটিশরা যে বিষফোঁড়া ফাটিয়ে দিয়ে গেছে, সেই পুঁজ এখনও প্রবাহিত। উত্তাপটা বাড়ছেই। মানুষ সাম্প্রদায়িক হলো কবে? ইতিহাস এর নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা দেবে কিনা জানি না। কোনও ইতিহাসই সংশয় ও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। সবাই নিজ নিজ মতলব মতো ইতিহাস তৈরি করে নিয়েছে। রাজনীতি, ধর্ম সবাই। তবে নিশ্চিত করে আমরা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ও বিশ্বাসীরা বলতে পারি- আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অস্ত্র হিসেবে যখন ধর্মের ব্যবহার শুরু হলো তখন থেকেই ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হতে শুরু করে। এখন ক্ষমতায় আরোহন এবং টিকে থাকাও ধর্মের ওপর নির্ভরশীল। অসাম্প্রদায়িকতার পতাকা উড়ে বিস্ফোরিত হয় অসাম্প্রদায়িকতার ফাঁকা বুলি। আমরা ভোটের মতলবে, সামাজিক স্বার্থে অসাম্প্রদায়িকতার বসন নেই। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে, আচরণে, চর্চায় আমাদের বহিঃপ্রকাশ সাম্প্রদায়িক। এজন্যই দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী যখন তাদের স্বার্থ হাসিলের রণক্ষেত্রের নকশা তৈরি করে, তখন মুফতে পেয়ে যায় আমাদের মতো সৈনিক।
সাম্প্রদায়িক শক্তি যেকোনও জনপদেই লঘুদের ওপর চড়াও হয়। এটাই আধিপত্যবাদের ধর্ম। লঘুরা নির্যাতনের শিকার হলে, বিপন্ন বোধ করলে, নিরাপত্তাহীনতায় কুঁকড়ে থাকলে, অসাম্প্রদায়িকতার চাদর নিয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এগিয়ে যায়। নিপীড়িতরা প্রথম প্রথম কারও কারও প্রতি বিশ্বাস রাখতো। কিন্তু দেখা গেলো- তাতে আগুন নেভে না। জমি, কন্যা, স্ত্রী, মায়ের ওপর থেকে লোভের চোখ সরে না। অঙ্ক কষে দেখা যায়, ভোটবাজারে বিক্রি হতে হতে আর কোনও ভাগশেষ নেই। অভিবাসনের অন্যতম একটি কারণ সাম্প্রদায়িক আক্রমণ। দেশভাগের পর থেকে কম মানুষ তো ভিটে ছেড়ে এপার-ওপার হলো না। সব ভূখ-েই এমন ভিটে ছাড়া মানুষের দল আছে। কিন্তু নতুন বসতিতেও কি তারা নিশ্চিত যাপনে আছে? সিদুঁর রাঙা মেঘ সর্বত্র তাদের তাড়া করেই বেড়াচ্ছে। কারণ ‘সাম্প্রদায়িকতা’র মতো আর কোনও পণ্যের চৌকাঠ অবধি বাজারজাত হয়নি। দুয়ার বন্ধ রেখেও কি এই পণ্যের প্রবেশ রোধ করা যাচ্ছে? যাচ্ছে না বলেই লেখন, বচন সবই অপচয়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী