নারী ও শিশু প্রতিবেদন : প্রতিটি শিশু এবং কিশোর-কিশোরী শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ যতেœর দাবিদার। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদেও এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে নানা কারণে এর ব্যত্যয় ঘটছে। আদর-যতœ, সঠিক দিকনির্দেশনা ও বিদ্যমান পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিরূপ প্রভাবে অনেক শিশু-কিশোর প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জন থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। ছোট ছোট ভুল করতে করতে এক সময় তারা এমন সব কর্মকান্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। বিঘিœত হচ্ছে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। এসকল কর্মকান্ডই কিশোর অপরাধ বলে বিবেচিত। সমাজের চোখে তারা কিশোর অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। শিশুর অধিকার বাস্তবায়নে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা ও যথাযথ উদ্যোগ। এ নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার।
বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোররা বিশেষ করে যারা শহরাঞ্চলে থাকে, তারা মাঠে বা বাইরের খেলাধুলার চাইতে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটে সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। বিশেষজ্ঞরা ১৮ বছরের আগে কোন শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দেয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে এই পরামর্শের প্রতি আমাদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের আবদার রক্ষার্থে তাদেরকে দামী ও সুন্দর স্মার্টফোন এবং মটর সাইকেল কিনে দিচ্ছেন।
শিশুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘শিশু আইন, ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীতে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে শিশু আইন যুগোপযোগী করা হয়। এই আইন অনুযায়ী শিশুদের অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত ও বিচার করতে হবে। অভিযুক্ত শিশুদের বিচারের জন্য বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় শিশু আদালত রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে শিশু আদালতের দায়িত্বে রয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার মামলা শিশু আদালতগুলোতে বিচারাধীন। শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী শিশুদের বিচারের ও আদালতে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো নির্দেশনা রয়েছে। জেলা সমাজসেবা অফিস, প্রবেশন কর্মকর্তা ও প্রত্যেক থানায় শিশু ডেস্কে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত শিশুকে নিয়ে আইনের আলোকে দায়িত্ব পালন করেন। অভিযুক্ত শিশুদের কাজ করার জন্য অনেকগুলো সেফ হোম ও কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। অভিযুক্ত শিশুরা মূলতঃ জামিনের আগে পর্যন্ত ওই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করে। তাদের মানসিক উন্নয়ন এবং অপরাধ থেকে ফেরাতে কেন্দ্রগুলোতে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগন আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তারাই ভবিষ্যতে এ জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। এটা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত একটা বাক্য, যার বিপরীতে আমাদের করণীয় কী, একথা আমরা অনেকেই জানি না। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চর্চায় শিশু অধিকারের বিষয়গুলো এখনো অনেকখানি উপেক্ষিত। আমাদের অনেকেরই ধারণা, শিশুরা যেহেতু বয়সে ছোট, তাদের দাবি আদায়ের ক্ষমতাও কম। তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ অল্প। তাদের মৌলিক অধিকারগুলো তুলনামুলক কম লাগে বলে, তাদের সামাজিক মর্যাদা তুলনামূলক ছোট। আর এই মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নে আমাদের তেমন কোনো জবাবদিহি নেই। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশের বেশি শিশু। তার মধ্যে অনেক শিশুর পরিবার খুবই দরিদ্র। এই দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে রয়েছে শ্রমজীবী শিশু, গৃহকর্মী, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, বাল্যবিবাহের শিকার শিশু এবং চর, পাহাড় আর দুর্গম এলাকায় বসবাসরত শিশু। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এসকল প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কেননা, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে আইনকানুন ও নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। আমাদের শিশুনীতি, শিশু আইন, শিশুশ্রম নিরসন নীতি, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পাচার প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে শিশুদের সুরক্ষামূলক আইন রয়েছে, যা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাজের সমন্বয়ের জন্য দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বাংলাদেশে কর্মরত শিশু অধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের জন্য পৃথক একটি অধিদপ্তরের দাবি জানিয়ে আসছে, যা জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটিও সুপারিশ করেছে। কিন্তু এই সুপারিশ বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী শিশুর ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন বেড়েছে। এটা প্রতিকারে আইনি অনেক বিধান থাকলেও এই ধরনের কর্মকা- প্রতিরোধে কঠোর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামোর মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো বাজেটে শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা। বাংলাদেশে এখন শিশুদের জন্য ‘শিশু বাজেট’ নামে যে চর্চাটি রয়েছে, তা শিশুদের চাহিদা পূরণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেননা, এই শিশু বাজেট মূলতঃ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের একটি সামগ্রিক চিত্র মাত্র। এতে করে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুর চাহিদাকে মাথায় রেখে তাদের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও বাজেট করা হয় না। তাই এই বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় শিশু এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি সংগঠনগুলোর মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচারসহ শিশু অধিকার লঙ্ঘনের নানা বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে গণমাধ্যমসহ সামাজিক সংগঠনগুলো বারবার বলে আসছে। এ বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
তবে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিশু সুরক্ষা বিষয়ক চেতনাগত পরিবর্তন দরকার। পরিবার ও স্কুলগুলোতে এখনো শাসনের নামে শারীরিক নির্যাতনের প্রচলন রয়েছে, যা শিশুর বিকাশে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি পরিপত্র থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনো শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়। সময় এসেছে শিশু নির্যাতন মেনে নেয়ার বা চুপ থাকার সংস্কৃতি ভাঙার। এ জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। যেখানে সংবাদমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংগঠনগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। আর সে জন্য দরকার এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা ও যথাযথ উদ্যোগ।-