নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মারা গেছেন; তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান, তারেকের স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান, দুই মেয়ে জাহিয়া রহমান, জাফিয়া রহমান, খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, প্রয়াত সাইদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার, খালেদা জিয়ার মেজ বোন সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের সদস্যরা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ সময় হাসপাতালে ছিলেন।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে। হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সদের অনেককে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়।
এই শোক সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ায়। অনেকেই শোক প্রকাশ করে পোস্ট দেন।
লিভার সংক্রান্ত জটিলতা, কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিস ও ইনফেকশনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন খালেদা জিয়া। গত ২৩ নভেম্বর থেকে তিনি বসুন্ধরায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে তার বড় ছেলে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং পরিবারের সদস্যারা হাসপাতালে ছুটে যান। রাত ২টার পর এজেডএম জাহিদ হোসেন হাসপাতালের সামনে এসে সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়া ‘অত্যন্ত সঙ্কটকময়’ সময় অতিক্রম করছেন। উনার পরিবারের পক্ষ থেকে উনার সুস্থতার জন্য মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে দেশবাসীকে দোয়া করার আহ্বান জানাচ্ছি।
এর কয়েক ঘণ্টা পর হাসপাতালের চিকিৎসকরা বিএনপি চেয়ারপারসনকে মৃত ঘোষণা করেন।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে রাজপথের আন্দোলনে। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো তিনি হারেননি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্ম অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে, ১৯৪৬ সালের ১৫ অগাস্ট। পারিবারিক নাম খালেদা খানম, ডাক নাম পুতুল। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের বাড়ি ফেনীতে হলেও তিনি জলপাইগুড়িতে বোনের বাসায় থেকে পড়ালেখা করেন। পরে সেখানে চা ব্যবসায় জড়ান ইস্কান্দার; বিয়েও করেন তিস্তা পাড়ের শহরটিতে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর খালেদা জিয়ার পরিবার বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। সেখানে মিশনারি স্কুলে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরানোর পর দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন খালেদা।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খালেদার বিয়ে হয়। পরে স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি গঠন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া, তখন তিনি একজন গৃহবধূ।
১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সাত দলীয় জোট গঠন করে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনে এরশাদ সরকারের সঙ্গে কখনো আপস করেননি খালেদা।
অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতা করলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি কোনো সমঝোতায় যায়নি। তাই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তার নাম হয় আপসহীন নেত্রী।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বহু প্রতীক্ষিত সংসদ নির্বাচনে জীবনে প্রথমবার ভোট করেন খালেদা জিয়া। পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই বিজয়ী হন। আর বিএনপি এ নির্বাচনে সংসদের বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।
এরপর ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে ভোট করে সবকটিতেই জয় পান খালেদা জিয়া। তিনি সবশেষ নির্বাচন করেছেন ২০০৮ সালে, সেবারও তিন আসনের সবকটিতে বিজয়ী হন। মাঝে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অধিকাংশ দলের বর্জনে এক তরফা নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করলেও সেই সরকারের মেয়াদ ছিল এক মাসেরও কম।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সঙ্গে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। খালেদা জিয়া ফের প্রধানমন্ত্রী হন।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে গ্রেফতার হন খালেদা জিয়া এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমান। এক বছর পর ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন।
তারেকও মুক্তি পেয়ে লন্ডনে চলে যান। দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৫ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফেরেন।
জিয়া-খালেদা দম্পতির আরেক সন্তান আরাফাত রহমান কোকো প্রয়াত হয়েছেন এক দশক আগেই।
জরুরি অবস্থার মধ্যে খালেদা জিয়া যখন গ্রেফতার হয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনাও কাছাকাছি সময়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশ গেলেও খালেদা জিয়া যেতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এটাই আমার ঠিকানা। এদেশ এদেশের মাটি মানুষই আমার সব কিছু । কাজেই আমি দেশের বাইরে যাব না।
ওই সময়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্য নেতা-কর্মী ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যোগালেও শেষ রক্ষা হয়নি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পায়। সেই ভরাডুবির পর আর কখনো ক্ষমতায় যেতে পারেনি খালেদা জিয়ার দল।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শহীদ মইনুল সড়কের বাসা থেকে উৎখাত হন খালেদা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি সংসদের বাইরে চলে যায়, রাজপথই হয় দলটির ঠিকানা। রাজনৈতিকভাবে সেই চাপের সময়ে খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় একের পর এক মামলা। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তাকে কারাগারে পাঠায় আদালত।
এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাতেও তার সাজার রায় হয়। মহাবিপদে পড়া বিএনপি লন্ডনে থাকা তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ অনেকটা আকস্মিকভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয় খালেদা জিয়াকে। শর্ত অনুযায়ী তাকে থাকতে হয় গুলশানের বাসায়, চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতিও তার ছিল না। ফলে মুক্তি পেয়েও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন একপ্রকার বন্দি জীবন কাটতে থাকে বিএনপি চেয়ারপারসনের। এর মধ্যে কয়েকবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কয়েক দফা বড় ধরনের অস্ত্রোপচারও হয়।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ওই বছর ৭ অগাস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। পরে উচ্চ আদালত তাকে দুই মামলা থেকেও খালাস দেয়। ফলে তার দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হওয়ার কালিমা ঘোচে। কিন্তু নানা ধরনের অসুস্থতা তাকে ততদিনে অনেকটাই কাবু করে ফেলেছে। মুক্তি মিললেও দলের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তিনি আর সশরীরে অংশ নেননি। এর মধ্যে চলতি বছর জানুয়ারিতে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসেন খালেদা জিয়া। বহু বছর পর বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে তার দেখা হয়।
সবশেষ গত ২১ নভেম্বর ঢাকায় সেনা সদরের সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল খালেদা জিয়াকে। এর ৪০ দিনের মাথায় তার মৃত্যু হলো।
[সৌজন্যে: বিডিনিউজ]
এসি/সানা/আপ্র/৩০/১২/২০২৫



















