ইয়ানিস ভারুফাকিস
বিশ শতকের শেষভাগের বৈশ্বিক ব্যবস্থার অবশিষ্ট স্তম্ভগুলো একে একে ভেঙে পড়েছে এ বছর। এত দিন যাকে একটি বিশ্ব ব্যবস্থা বলে ধরে নেয়া হচ্ছিল, তার ভেতরের ফাঁপা কাঠামো উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। কয়েক দশকের এ বন্দোবস্ত ধসে পড়ার ক্ষেত্রে তিনটি আঘাতই যথেষ্ট ছিল।
বিশ শতকের শেষভাগের বৈশ্বিক ব্যবস্থার অবশিষ্ট স্তম্ভগুলো একে একে ভেঙে পড়েছে এ বছর। এত দিন যাকে একটি বিশ্ব ব্যবস্থা বলে ধরে নেয়া হচ্ছিল, তার ভেতরের ফাঁপা কাঠামো উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। কয়েক দশকের এ বন্দোবস্ত ধসে পড়ার ক্ষেত্রে তিনটি আঘাতই যথেষ্ট ছিল।
প্রথম আঘাতটি আসে ইউরোপের সম্মিলিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে রাশিয়ার আসন্ন বিজয়ের মধ্য দিয়ে। প্রায় চার বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো এক ধরনের বিপজ্জনক দ্বৈত খেলায় লিপ্ত ছিল। একদিকে তারা কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে ইউক্রেনের বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, বিজয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতে তারা আদৌ প্রস্তুত ছিল না। অন্যদিকে এ অন্তহীন যুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের ভেতরে একটি নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঐকমত্য চাপিয়ে দিয়েছে: ইউরোপের শিল্পহীনতার বিরুদ্ধে শেষ আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে সামরিক কেইনসীয়বাদ।
যে মহাদেশে বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে সবুজ বিনিয়োগ বা সামাজিক নীতিতে বড় ধরনের ব্যয় রাজনৈতিকভাবে প্রায় নিষিদ্ধ, সেখানে ইউক্রেন যুদ্ধ একটি শক্তিশালী অজুহাত তৈরি করে দেয়—প্রতিরক্ষা–শিল্প কমপ্লেক্সে সরকারি ঋণ ঢেলে দেয়ার জন্য। নীরব সত্যটি ছিল এই যে একটি অনন্ত যুদ্ধ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিল: ইউরোপের স্থবির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য কেইনসীয় পাম্প–প্রাইমিংয়ের আদর্শ ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছিল এ যুদ্ধ।
এ বৈপরীত্য ছিল প্রাণঘাতী। যদি ইউক্রেন যুদ্ধ কোনো শান্তিচুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়ে যেত, তবে এ অর্থনৈতিক পাম্প–প্রাইমিং টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ত। আবার এমন কোনো বিজয় অর্জন করা, যা এ ব্যয়ের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারে তা আর্থিকভাবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ভূরাজনৈতিকভাবে অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিল। ফলে ইউরোপ সবচেয়ে খারাপ কৌশলটিই বেছে নেয়, ইউক্রেনে ঠিক এতটুকু সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো, যাতে রক্তক্ষরণ দীর্ঘায়িত হয়। কিন্তু যুদ্ধের গতিপথ বদলায় না।
এখন যখন রাশিয়ার জয় প্রায় নিশ্চিত (একটি অনুমেয় ফলাফল; যাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কেবল ত্বরান্বিত করেছেন), তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব সুচিন্তিত পরিকল্পনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শান্তির জন্য ইউরোপের কোনো ‘প্ল্যান বি’ নেই। কারণ তার পুরো কৌশলগত অবস্থানই নির্ভরশীল ছিল যুদ্ধ অব্যাহত থাকার ওপর। ক্রেমলিন ও ট্রাম্পের লোকজন শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের ওপর যে নোংরা শান্তিচুক্তি চাপিয়ে দিক না কেন, তা কেবল একটি সীমান্ত পুনর্নির্ধারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইউরোপের জন্য রাশিয়া হুমকি থাকুক বা না থাকুক, ইউরোপ তার সদ্য জন্ম নেয়া সামরিক শিল্প বুমের অজুহাত হারাতে বসেছে; যার পরিণতি হবে নতুন এক দফা কৃচ্ছ্র।
দ্বিতীয় ধাক্কাটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে চীন জয়ী হয়েছে। ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের সময় শুরু হয়ে জো বাইডেনের অধীনে আরো তীব্র হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলটি ছিল এক ধরনের চিমটা আক্রমণ। একদিকে শুল্ক প্রাচীর তুলে চীনের বাজারে প্রবেশ ব্যাহত করা, অন্যদিকে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর ও উৎপাদন সরঞ্জামের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তার প্রযুক্তিগত উত্থান রুদ্ধ করা। ২০২৫ সালে এসে এ কৌশল তার ওয়াটারলুতে উপনীত হয়। ফলে ইউরোপের অর্থনীতিরও রক্তক্ষরণ হয়। এর জবাবে চীন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া দেখায়।
প্রথমত, বিরল মৃত্তিকা (রেয়ার আর্থ) ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজের ওপর নিজের আধিপত্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, যা সরবরাহ শৃঙ্খলে এক ধরনের চাপ তৈরি করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার সবুজ উৎপাদন খাতই বেশি অচল হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রযুক্তি নেতৃত্বের মর্যাদার জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকরভাবে চীন তার ‘সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র’কে একটি একক লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে: প্রযুক্তিগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এর ফল ছিল চোখধাঁধানো। দেশীয় চিপ উৎপাদনে অভূতপূর্ব গতি আসে; এসএমআইসি ও হুয়াওয়ের অর্জিত সাফল্যগুলো এমন একপর্যায়ে পৌঁছায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কেবল অকার্যকরই নয়, বরং উল্টো ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে। সেমিকন্ডাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও উন্নত প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জায়গায় চীনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
যে ধাক্কার প্রভাব সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে, সেটি সম্ভবত প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট। ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করেছে যে তারা চীনের উত্থান ঠেকাতে অক্ষম। উল্টো অজান্তেই চীনের প্রযুক্তি খাতকে পূর্ণ স্বনির্ভরতার পথে ঠেলে দিয়েছে। আর ইউরোপ—হোয়াইট হাউজের নির্দেশে চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে নিষ্ঠার সঙ্গে অংশ নিয়ে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। একদিকে উচ্চমূল্যের ইউরোপীয় পণ্যের জন্য লাভজনক চীনা বাজারে তাদের প্রবেশ ক্রমেই সীমিত হয়েছে; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের (পরবর্তী সময়ে বাতিল হয়ে যাওয়া) ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্টের উদার ভর্তুকি ও দেশে উৎপাদন ফিরিয়ে আনার কোনো সুফলই তারা পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উপঠিকাদার হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজের শিল্পহীনতাকে আরো দ্রুততর করেছে। এটি কোনো বাণিজ্যযুদ্ধে পরাজয় ছিল না; ছিল এক ভূরাজনৈতিক চেকমেট, যেখানে ইউরোপ ছিল কেবল পরাজিত পক্ষের একটি গুটি।
তৃতীয় ধাক্কাটি ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে ট্রাম্পের বিস্ময়কর সহজ বিজয়। স্কটল্যান্ডে ট্রাম্পের একটি গলফ ক্লাবে আয়োজিত বৈঠকের শেষে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনকে সর্বোচ্চ অপমানের মঞ্চ স্থাপন করেছিলেন যেন ট্রাম্পের লোকজন। একটি আত্মসমর্পণমূলক দলিলকে ‘ঐতিহাসিক চুক্তি’ হিসেবে তুলে ধরতে হিমশিম খাচ্ছিলেন উরসুলা ভন ডার লিয়েন। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইউরোপীয় পণ্য রফতানির ওপর শুল্ক যেখানে আগে ছিল প্রায় ১ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ২৫ শতাংশ এমনকি ৫০ শতাংশেও পৌঁছায়। বহুদিন ধরে কার্যকর থাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানীকৃত মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক বাতিল করা হয়। সর্বশেষ ও সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প খাতে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের ইউরোপীয় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি। বড় অংকের এ বিনিয়োগ করতে হয়তো জার্মান বিনিয়োগ সংকোচন করা হবে। ইউরোপ ছেড়ে তা হয়তো টেক্সাসের রাসায়নিক কারখানা ও ওহাইওর গাড়ি কারখানায় বিনিয়োগ হবে।
এটি কেবল একটি খারাপ চুক্তির চেয়েও বেশি কিছু ছিল। এটি ছিল নজিরবিহীন একটি পুঁজি নিষ্কাশন চুক্তি। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শিল্পপ্রতিযোগী থেকে ভিক্ষাপ্রার্থী শক্তিতে রূপান্তরকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হলো। ইউরোপ এখন হবে পুঁজির উৎস, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের জন্য একটি নিয়ন্ত্রিত বাজার এবং প্রযুক্তিগতভাবে নির্ভরশীল এক জুনিয়র অংশীদার। অপমানের ওপর অপমান হিসেবে এ নতুন বাস্তবতাকে একটি বাধ্যতামূলক অঙ্গীকারের মাধ্যমে আইনি রূপ দেয়া হয়েছে, যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য রাষ্ট্র সম্মতি দিয়েছে। ফলে সার্বভৌমত্বের যেকোনো ভান থেকেও ব্লকটি বঞ্চিত হয়েছে। ওয়াশিংটন–বেইজিং অক্ষকে কেন্দ্র করে গঠিত একটি জি-টু বিশ্বের যে কল্পনা ট্রাম্প বাস্তবায়ন করতে চান, তার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজির একটি অংশ এখন চুক্তিভিত্তিকভাবে ইউরোপ থেকে পশ্চিম মুখে প্রবাহিত হতে বাধ্য।
এ তিন ধাক্কা মিলেই একটি পারস্পরিক শক্তিবর্ধক ত্রয়ী গড়ে তুলেছে। ইউক্রেনে ইউরোপের পরাজয় তার কৌশলগত দুর্বলতার জায়গাগুলো উন্মোচিত করেছে এবং সামরিক কেইনসীয় মতবাদের ফাঁপা বেলুন ফুটিয়ে দিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রতি ট্রাম্পের নতি স্বীকার ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনা রফতানির ঢল নামিয়েছে। স্কটল্যান্ডের সেই ‘ঝাঁকুনি’ ইউরোপের সঞ্চিত পুঁজি ও সমমর্যাদার শেষ আশাটুকুও কেড়ে নিয়েছে।
জি টু বিশ্বের বাস্তবতায় কল্পিত বৈশ্বিক গ্রামটি এখন এক রক্তক্ষয়ী গ্ল্যাডিয়েটর অঙ্গন, যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য দিশাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইউরোপীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার কবরের ওপর দাঁড়িয়ে এক নতুন, আরো কঠোর ও শীতল বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এ বছরের দীর্ঘস্থায়ী শিক্ষা হলো অস্তিত্বগত লড়াইয়ের যুগে কোনো দেশের ওপর কৌশলগত নির্ভরশীলতা নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করার প্রাথমিক ধাপে প্রবেশ করা। [স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]
লেখক: গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী; মিরা টোয়েন্টি ফাইভ দলের নেতা ও এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ


























