নীলফামারী সংবাদদাতা: শীত পোশাকের বড় মোকাম উত্তরাঞ্চলের সৈয়দপুর। সারাদেশ থেকেই এখানে পাইকার আসেন পোশাক কিনতে। শুধু দেশেই না, এখানকার তৈরি শীতের বাহারি পোশাক বিশ্ববাজারেও স্থান করে নিয়েছে। বিক্রি হচ্ছে জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলার, ট্রাউজার, টুপিসহ নানান পোশাক। মূলত শীতের সময় এর চাহিদা বাড়ে। এই সময়টায় সরগরম হয় পুরো শহর। এবার শীত মৌসুমে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকার আশা ব্যবসায়ীদের।
জানা গেছে, শুরুর দিকে স্থানীয় নারীরা ঘরে থাকা সেলাই মেশিন দিয়ে জ্যাকেট, থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ও শিশুদের পোশাক তৈরি করে স্থানীয় হাটে বিক্রি করতেন। চাহিদা বাড়ায় ধীরে ধীরে এ শিল্পের প্রসার ঘটে। ২০০২ সালে রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপ নামে পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠন গড়ে ওঠে। এরপর মালিক ও কারিগররা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ নিয়ে তাদের কাজের পরিধি বাড়িয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সৈয়দপুরের একেকটি বাড়ি যেন একেকটি গার্মেন্টস কারখানা। পাড়া-মহল্লাহ, সৈয়দপুর প্লাজা সুপার মার্কেট ও এস আর প্লাজার তিনতলা, অবাঙালি ক্যাম্প, উত্তরা আবাসনসহ গ্রামেও ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে কারখানাগুলো। যে কোনো রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ভেসে আসে মেশিনের আওয়াজ। যেন ধুম পড়েছে শীত পোশাক তৈরির। নীলফামারীর এ বাণিজ্যিক শহরে ছোট-বড় মিলে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক কারখানা। আর এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় এক লাখ শ্রমিকের।
এ শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ বা কিনে আনা হয় ঢাকার উত্তরা, গাজীপুর, মিরপুর, সাভার, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম থেকে। প্রতি কেজি ব্লেজারের ঝুট কাপড়ের মূল্য ধরা হয় ১০০ থেকে ৫৫০ টাকা, জ্যাকেট ১৫০ থেকে ৩৬০, গ্যাবার্ডিন প্যান্ট ১২০ থেকে ৩৫০, জিন্সের ঝুট ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা। আর তা দিয়ে তৈরি হয় নান্দনি ডিজাইনের জ্যাকেট, ট্রাউজার, মাফলার, টুপি ও গেঞ্জি। এসব পণ্য পাইকারি বাজারে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা লাভ ধরে গার্মেন্টস মালিকেরা বিক্রি করে থাকেন। এখানকার তৈরি এসব শীতের পোশাক দেশের বাইরে ভারতের আসাম রাজ্যে চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এরপর ভুটান ও নেপালেও এর কদর রয়েছে। ফলে এসব পোশাক রফতানি করে এখানকার ঝুট কাপড়ের ব্যবসায়ীরা প্রচুর মুনাফা করছেন। অপরদিকে সরকারি রাজস্বও আদায় হচ্ছে। এ বছর শীত মৌসুমে পাঁচ শতাধিক কারখানায় পাঁচ লাখ জ্যাকেট, তিন লাখ ট্রাউজার, দেড় লাখ মাফলার, সাত লাখ টুপি ও সাড়ে তিন লাখ পিস থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাঁচ শতাধিক কারখানা মালিকের মধ্যে মাত্র সাতজনের রপ্তানির লাইসেন্স আছে। এসব লাইসেন্স ব্যবহার করে বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। ঢাকা ও রংপুরের কয়েকজন ব্যবসায়ীর লাইসেন্সে ৮ থেকে ১০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এ বছর আরো বাড়বে। রপ্তানির ক্ষেত্রে সোনামসজিদ, সোনাহাট ও বুড়িমারী এই তিন সস্থলবন্দর ব্যবহার করেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ভারত সরকার স্থললবন্দর বন্ধ করে রেখেছে। এ কারণে তাদের গার্মেন্টস পণ্য সমদ্রপথে রপ্তানি করতে হচ্ছে। এতে প্রায় ৫-১০ শতাংশ খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রপ্তানি চাহিদ বাড়ায় খুশি তারা।
তাদের দাবি, সব স্থলবন্দর চালুর পাশাপাশি চিলাহাটি স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু করা গেলে খরচ অনেক কমে আসবে। এছাড়া এই শিল্পকে ঘিরে আলদা পল্লী গড়ার দাবিও দীর্ঘ দিনের। সংশ্লিষ্টরা এমন উদ্যোগ নিলে এই শিল্পখাতে যেমন দক্ষ শ্রমিক তৈরি হবে। একই সঙ্গে এখানকার তৈরি পোশাক বিশ্ববাজারে আলাদা স্থান তৈরি করে নিতে পারবে।
উপজেলা শহরের পাইকারি বাজারের বড় মার্কেট রয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ সড়কে। এখানে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে আসেন।
পাঁচবিবি থেকে শীত কাপড় পাইকারি দরে কিনতে আসা ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম মিয়া জানান, তিনি শীত মৌসুমে শুধু গরম কাপড়ের ব্যবসা করেন। অন্য সময় ভগ্নিপতির সঙ্গে ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। ঢাকার থেকে সৈয়দপুরে গরম কাপড়ের পাইকারি দাম কম। এ কারণে তিনি ঢাকায় না গিয়ে এখানে আসনে গরম কাপড় কিনতে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে প্রায় অর্ধকোটি টাকার ব্যবসা করেন তিনি।
এসব গার্মেন্টস কারখানার মালিকের কাছে বাকিতে গরম কাপড় কিনে বিক্রি করেন শহরের প্রায় তিন শতাধিক মৌসুমী ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে একজন হলেন শওকত আলী।
তিনি বলেন, অন্য মৌসুমে রাজমিস্ত্রি, কখনও হোটেলে কাজ করেন। অন্য সময় ভালো করে তিন বেলা দু’মুঠো খেতে না পারলেও শীত মৌসুমে পরিবার নিয়ে ভালোই চলে। এতে যা লাভ হয়, তা দিয়ে সমিতির ঋণ পরিশোধ করে কিছু সঞ্চয় থেকে যায়।
শহরের বাঁশবাড়ি এলাকার শাম্মি আক্তার বলেন, প্রথমে মাত্র দুইটি সেলাই মেশিন নিয়ে নিজের ঘরেই ঝুট কাপড় থেকে পোশাক তৈরি শুরু করেছিলেন। ওই দুইটি মেশিনই তার ভাগ্য খুলে দেয়। এখন তিনি নিজের কারখানা দিয়েছেন। আর মেশিনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০টি। সেখানে শ্রমিক কাজ করছে প্রায় শতাধিক। তার মাসে গড়ে আয় হচ্ছে ৫০ হাজার টাকার মতো। তার ইচ্ছা রপ্তানিকারক হয়ে সরাসরি ভারত, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানি করবেন।
ফারুক গার্মেন্টেস কারখানার শ্রমিক ফিরোজ আলী সরকার বলেন, স্বামী অটোরিকশা চালায়। তার আয় দিয়ে চার ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হতো। পরে এই কারখানায় দুই মাস কাজ শিখে এখন তিনি প্রতিদিন আয় করছেন ৮০০-১০০০ হাজার টাকা। এখন সংসারের যাবতীয় খরচ চালিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ ভালোভাবে চালাতে পারছেন।
এম আর গার্মেন্টসের মালিক ও রপ্তানি কারক মতিয়ার রহমান দুলু জানান, ভারত, নেপাল ও ভুটানে তিনি প্রতিবছর শীত মৌসুমে পোশাক রপ্তানি করেন। এ বছর তিনি শীতকালীন টুপির এক কোটি টাকার অর্ডার পেয়েছেন। এর অর্ধেকের বেশি রপ্তানি করা হয়েছে সমুদ্রপথে। সামনে আরও দুই কোটি টাকা অর্ডার পাবেন।
সৈয়দপুর রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহিন আখতার মতে, এ শিল্পে সম্ভাবনার পাশাপাশি সমস্যাও অনেক। ঝুট কাপড়ের কাঁচামাল চার-পাঁচ হাত ঘুরে আমাদের কাছে আসে। ঢাকায় বা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঝুট কাপড় কিনতে গেলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কিনতে হয়। সরাসরি গার্মেন্টস থেকে কিনতে পারলে আরো মুনাফা করা যেত। আবার সব কিছুর দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুট কাপড় ও কারিগরদের পারিশ্রমিকও বেড়েছে।
সৈয়দপুর রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক সমিতির সভাপতি আকতার হোসেন খান বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে আব্দুল মালেক নামে এক কাপড় ব্যবসায়ী প্রথম এই ব্যবসা শুরু করেন। পরে তার দেখাদেখি অন্যরাও এ ধরনের কারখানা গড়ে তোলেন। কিন্তু এখনও স্বীকৃতি মিলেনি। আগে কম সুদে এসএমই ঋণ পাওয়া যেতো। সেটিও এখন বন্ধ। ব্যাংক ঋণেও তেমন কোনো সুবিধা পাওয়া যায় না। অথচ ঝুটের পোশাক কয়েক বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাতে পরিণত হচ্ছে। সরকারি সহায়তা পেলে এ শিল্প আরো বিকশিত হবে।
এসি/আপ্র/০৮/১২/২০২৫

























