প্রত্যাশা ডেস্ক: রাজধানী ঢাকার রাস্তায় দাঁড়ালে মনে হয় যেন পুরো শহরটা চিৎকার করছে। বাস-অটোরিকশা-মোটরসাইকেলের হর্ন, রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির ড্রিল, আর ভবন নির্মাণের শব্দ-সব মিলিয়ে একটানা এক ভয়াবহ শব্দঝড়। এই লাগাতার শব্দ শহরের মানুষের অনুভূতিকে ধীরে ধীরে অসার করে দিচ্ছে।
সংবাদসংস্থা বাংলা ট্রিবিউন এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরে বলছে, শব্দদূষণে বড়রা ক্ষতিগ্রস্ত তো হচ্ছেনই, তবে সবচেয়ে হুমকির মুখে শিশুরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার শব্দদূষণে দীর্ঘদিন থাকলে শিশুদের স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ, ঘুম, শ্রবণক্ষমতা ও মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শব্দের আঘাত অনেক সময় শারীরিক ও মানসিক ক্ষত তৈরি করে, যার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী।
শিশুদের দৈনন্দিন জীবনে শব্দের আঘাত: নওয়াবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র এহসান, শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ ধরে রাখতে প্রতিদিনই শব্দের সঙ্গে লড়াই করতে হয় তাকে। এহসানের মা ফিরোজা ইসলাম জানান, সারাদিন স্কুলের সামনে হর্ন বাজায় ছেলের মাথাব্যথা ও ঘুমের সমস্যা বাড়ছে।
লালবাগের ১৪ বছর বয়সি তানহা বলেন, পড়ার সময় বাইরে যখন হর্ন বাজে, তখন খুব রাগ হয়। মাথা ধরে, কখনও কখনও কেঁদেও ফেলি। সাম্প্রতিক সময়ে তানহার আচরণ বদলে গেছে বলেও জানান তার মা। বাংলামোটর এলাকার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষাও একই সমস্যায় ভুগছেন। রাতভর হর্নের কারণে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না বর্ষা। তার বাবা বোরহান হোসেন বলেন, আমরা প্রধান সড়কের পাশে থাকি। রাতে সারাক্ষণ হর্ন ঠিকমতো ঘুম হয় না। ক্লান্ত হয়ে সকালে স্কুলে যায়, ক্লাসে নাকি মাঝে মাঝে ঘুমিয়েও পড়ে।
বর্ষা বলেছে, ‘মাথা ব্যথা আর চোখ ব্যথা খুব হয়। পড়ায় একদম মনোযোগ দিতে পারি না। পরীক্ষার ফল খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
তেজগাঁও মডেল হাই স্কুলের শিক্ষক হামিদা বেগম বলেন, ‘রাস্তার হর্ন এত জোরে বাজে যে শিশুদের কণ্ঠ শোনা যায় না, ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই ক্লান্ত হয়ে যায়।’
বিশ্বের সবচেয়ে শব্দদূষিত নগরীগুলোর একটি ঢাকা: বিশেষজ্ঞদের মতে, ৮০-৮৫ ডেসিবল শব্দে শ্রবণঝুঁকি তৈরি হয়; কিন্তু ঢাকায় গড় শব্দের মাত্রা অনেক সময় ১২৫ ডেসিবল পর্যন্ত পৌঁছে যায়-যা শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, শিশুদের জন্য নিরাপদ সীমা ৪৫-৫০ ডেসিবল। তবে রাজধানী ঢাকায় স্কুল, বাড়ি ও খেলার জায়গায় এই মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি শব্দে থাকে।
‘পরিবেশগত শব্দদূষণের সংস্পর্শ এবং শেখার পারদর্শিতা’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার স্কুলগুলোর শ্রেণিকক্ষের শব্দমাত্রা ৭৩ থেকে ৮১ ডেসিবল। এই উচ্চমাত্রার শব্দে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কমে, কানে চাপ পড়ে, স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা হয় এবং আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়।
মানসিক বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আরিফা রহমান বলেন, ‘শব্দদূষণে শিশুদের মনোযোগ, নির্দেশনা বুঝতে পারা, এমনকি আইকিউ-ও কমে যেতে পারে। ৬০ ডেসিবেলের বেশি শব্দে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মৌখিক নির্দেশনা বোঝার সক্ষমতা ২৫-৩০ শতাংশ কমে যায়।’
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম. কে. তালুকদার বলেন, ‘শব্দ শিশুদের দেহে স্ট্রেসের প্রতিক্রিয়া বাড়ায়। এতে বিরক্তিভাব, উদ্বেগ, অতিচঞ্চলতা, মনোযোগের অভাব ও আচরণগত সমস্যা তৈরি হয়। রাতে শব্দে ঘুম নষ্ট হলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, শেখার সক্ষমতাও হ্রাস পায়। ব্যস্ত সড়কের পাশে থাকা শিশুরা দুঃস্বপ্ন, ভয় আর দিনের বেলা ক্লান্তি অনুভব করে।’
শ্রবণহানি-উদ্বেগজনক বাস্তবতা: পরিবেশ অধিদফতর ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ (২০২৫)-এর হিসাব অনুযায়ী, দেশের ১১ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের কারণে শ্রবণঝুঁকিতে আছে। শিশুদের কান বেশি সংবেদনশীল হওয়ায় তারা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ডা. এম. কে. তালুকদার বলেন, ‘অনেক বাবা-মা বুঝতেই পারেন না শিশুর কী পরিমাণ শ্রবণক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি শব্দ এমনকি স্থায়ী শ্রবণহানি ঘটাতে পারে।’
শব্দদূষণের উৎস: ঢাকার শব্দের প্রধান উৎস হলো-যানবাহনের হর্ন এবং নির্মাণকাজ। সাম্প্রতিক মেগা প্রকল্পগুলো-যেমন ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, সড়ক সম্প্রসারণ, নতুন ভবন-সব মিলিয়ে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ৮০-১০০ ডেসিবেল শব্দ ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটে) আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. দিপিতা হোসেন বলেন, ‘নির্মাণস্থলে শব্দ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে এগুলো খুব কমই ব্যবহার করা হয়। সাইলেন্সার নেই, কাজের সময় মানা হয় না, অনেক জায়গায় রাতভর কাজ চলে। স্কুল বা বাড়ির পাশে নির্মাণকাজ শিশুদের জন্য আরো ভয়ংকর।’
শুধু মহানগর নয়- ঢাকার আশুলিয়া, সাভারের শিল্পাঞ্চলেও ভারী যন্ত্রের শব্দে শিশুদের ঘুম ও পড়াশোনা ব্যাহত হয়। ড. দিপিতা হোসেন বলেন, ‘শব্দকে আমরা তেমন গুরুত্ব দিই না। কিন্তু এটি শিশুদের দেহঘড়ি, ঘুম-জাগরণের সময়সূচি, শেখার ক্ষমতা, এমনকি হৃদ্স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদি শব্দ কমিয়ে দেয় উৎপাদনশীলতা- যা ভবিষ্যৎ নিয়ে মারাত্মক সতর্কবার্তা।’
অভিভাবকদের হতাশা: অভিভাবকরা অনেক সময় আর্থিক কারণে বিকল্প বেছে নিতে পারেন না। আবু জহির নামে একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমার ৯ বছর বয়সি ছেলে খুব অস্থির হয়ে গেছে। চুপ করে বসে থাকতে পারে না। ডাক্তার বলেছে শব্দের কারণে সে ‘হাইপার অ্যারাউজাল’-এর মধ্যে থাকে-মানে তার স্নায়ুতন্ত্র সবসময় উত্তেজিত থাকে। আমরা কখনো ভাবিনি শব্দ এত ক্ষতি করতে পারে।’
শিশুদের উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত: বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও দেশীয় গবেষণা অনুযায়ী- দীর্ঘমেয়াদি শব্দদূষণ শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও শিক্ষাগত বিকাশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৫-৭০ শতাংশ শিশু ঘুমের সমস্যায়, ১৮-৩৪ শতাংশ মাথাব্যথায়, ২২-৪০ শতাংশ আচরণগত সমস্যায়, ৮-১৫ শতাংশ টিনিটাস বা শ্রবণ সমস্যায় ভুগছেন। উচ্চ শব্দযুক্ত শ্রেণিকক্ষে শেখার দক্ষতা ৪-১০ শতাংশ কমে যায়।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা: ড. দিপিতা হোসেন সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা শব্দদূষণকে তুচ্ছ ভাবি, কিন্তু এর প্রভাব গভীর। নিয়ন্ত্রণ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক বিকাশ, আচরণ ও শেখার সক্ষমতা সবকিছুই ঝুঁকিতে পড়বে। শব্দদূষণ এক নীরব মহামারি। শহরকে শিশু-বান্ধব করতে হলে নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব নিতে হবে, এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে।’
আইন আছে, প্রয়োগ নেই: শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫, রাতে ৪৫ ডেসিবেল; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০, রাতে ৬০ ডেসিবেল; হাসপাতাল-স্কুল-অফিস-আদালতের আশপাশের ১০০ মিটার এলাকায় দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবেল সীমা নির্ধারিত। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেক এলাকায় দিনে শব্দমাত্রা ৭০-৯০ ডেসিবেল, কখনো ১০০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়। হর্ন নিষেধাজ্ঞা মানা হয় না, নির্মাণস্থলে সাউন্ড ব্যারিয়ার থাকে না। নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা-কোথাও বিধিনিষেধ ঠিকভাবে পালন হয় না।
সানা/আপ্র/০৬/১২/২০২৫
























