ঢাকা ০২:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫

ব্যাংকের শীর্ষ পদে নিয়োগের নতুন নীতিমালা

  • আপডেট সময় : ০৮:৫২:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ২ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

সাইফুল হোসেন

দেশের ব্যাংকিং খাত যখন ইতিহাসের এক বিশেষ সংকটকাল পার করছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশ ব্যাংক এক যুগান্তকারী কিন্তু বিতর্কিত নীতিমালা জারি করেছে। নতুন এই বিধান অনুযায়ী এখন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন) এবং আইডিআরএ বা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির মতো আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নির্বাহী পরিচালক (ইডি) বা সমমানের শীর্ষ কর্মকর্তারাও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে নিয়োগের সুযোগ পাবেন।

ওই সুযোগ পেতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় কমপক্ষে ২৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা এবং জাতীয় বেতন কাঠামোর দ্বিতীয় গ্রেডভুক্ত হতে হবে। নীতিমালার প্রবক্তারা এটিকে ব্যাংকিং খাতে যোগ্য লোকের ঘাটতি পূরণের একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ হিসেবে দাবি করলেও আর্থিক বিশেষজ্ঞ ও বাজার বিশ্লেষকদের বড় অংশ এই সিদ্ধান্ত উচ্চ ঝুঁকি এবং স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) জন্ম দিতে পারে বলে গভীর শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশই এখন খেলাপি; যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬.৫ লাখ কোটি টাকা। উচ্চ হারে ঋণ-অনিয়ম, দুর্বল গভর্ন্যান্স, রাজনৈতিক প্রভাব এবং পুঁজি ঘাটতির মতো কাঠামোগত দুর্বলতা ব্যাংক খাতের ভিত্তি ক্ষয় করেছে। এমন একটি ‘পঙ্গু’ ও ‘গতিহীন’ অর্থনীতিতে, যেখানে বিনিয়োগে মন্দা চলছে, সেখানে এমডি নিয়োগের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে নীতিগত পরীক্ষা কতা যৌক্তিক, সেই প্রশ্নটিই এখন আলোচনার বিষয়।

বলা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা দুই দশকেরও বেশি সময় নীতিমালা তৈরি, শৃঙ্খলা রক্ষা, তদারকি এবং ম্যাক্রোইকোনমিক বিশ্লেষণে যুক্ত থাকলে তাদের এই অভিজ্ঞতা বাণিজ্যিক ব্যাংকের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে এই কর্মকর্তাদের বহুদিনের কাজের সম্পর্ক থাকায়, ঋণ সংস্কার বা অন্যান্য নীতিগত বিষয়ে দ্রুত বোঝাপড়া এবং যোগাযোগের সুবিধা তৈরি হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ মূলত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও নীতি নির্ধারণ; যেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডির কাজ হলো দৈনন্দিন জটিল অপারেশন, গ্রাহক পরিষেবা, করপোরেট লোন ম্যানেজমেন্ট, ট্রেজারি অপারেশন এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা।

একজন ব্যাংক এমডির প্রতিদিনের কাজের ৭০ শতাংশেরও বেশি অপারেশনাল দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ব্যাংক বা বিএসইসির ইডিরা রেগুলেশন ও পরিদর্শনে দক্ষ হলেও ওই রিটেইল ব্যাংকিং বা শাখা পরিচালনার মতো বিষয়ে অভিজ্ঞ নন। এমটিবি বা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি তাই বলেছেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ পদের দায়িত্ব ভিন্ন ভিন্ন, চ্যালেঞ্জও ভিন্ন ভিন্ন’ (প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর)।

বলা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পেশাজীবীরা নেতৃত্বে এলে অপারেশনাল দক্ষতার ঘাটতির কারণে ব্যাংকের কার্যক্রমে মন্থরতা সৃষ্টি হতে পারে; যা বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যাংকের মুনাফা ও প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করবে। ওই নীতিমালার সবচেয়ে গভীর এবং বিপজ্জনক দিকটি হলো স্বার্থের সংঘাত। যে প্রতিষ্ঠান কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংককে তদারক করে, তারই সাবেক বা বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তা যদি সেই ব্যাংকের এমডি হন; তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক সহকর্মীরা সেই ব্যাংকের অনিয়ম বা দুর্বলতা তদন্তে নমনীয় ভূমিকা নিতে পারেন-এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। এ ছাড়া ব্যাংকের পর্ষদও এমডি ও সিইও নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের বাড়তি প্রাধান্য দিতে পারে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে বিভিন্ন নীতিগত সুবিধা পাওয়া এবং লিয়াজোঁর ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মকর্তারা অগ্রাধিকার পেতে পারেন। এই পরিস্থিতি অন্য ব্যাংকগুলোর জন্য অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে এবং সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের সুযোগ বৃদ্ধি করবে।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন বিধানের ফলে ব্যাংকের শীর্ষ পদে নিয়োগ পেতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়োগকারীদের এক ধরনের যোগসাজশ তৈরি হতে পারে; যা পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সুতরাং সুশাসন নিশ্চিত না করে এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু এমডি নিয়োগের ‘পুল’ বাড়ালে ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান গভীর ক্ষত সারানো সম্ভব নয়।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তা এমডি হলে তিনি হয়তো নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু বাজারের জটিলতা, গ্রাহককেন্দ্রিক সেবা এবং দ্রুত প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ের চাহিদা মেটাতে তিনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। এই উচ্চ ঝুঁকি মোকাবিলায় নীতিনির্ধারকদের উচিত কিছু কঠিন ও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া। তা হলো-

প্রথমত, বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি হতে ইচ্ছুক নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের জন্য অন্তত বিশেষায়িত অপারেশনাল ব্যাংকিং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।

দ্বিতীয়ত, স্বার্থের সংঘাত এড়াতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদ ছাড়ার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বাধ্যতামূলক ‘কুলিং পিরিয়ড’ বা বিরতি (যেমন দুই-তিন বছর) আরোপ করা।

তৃতীয়ত, নিয়োগে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কঠোর ‘ফিট অ্যান্ড প্রোপার টেস্ট’ নিশ্চিত করা; যেখানে প্রার্থীর অপারেশনাল এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। সবশেষে, পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে আনা এবং খেলাপিদের বিরুদ্ধে বাস্তব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ব্যাংক খাত বদলাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নতুন নীতিমালাটি নেতিবাচকও নয়, আবার পুরোপুরি আশাব্যঞ্জকও নয়। ব্যাংক খাতের চলমান সংকটে এ পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত বরং উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করেছে। এই ক্রান্তিকালে উক্ত নীতিমালার সফলতা নির্ভর করবে সরকারের সদিচ্ছা এবং ব্যাংক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর।

লেখক: কলামিস্ট

(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

ব্যাংকের শীর্ষ পদে নিয়োগের নতুন নীতিমালা

আপডেট সময় : ০৮:৫২:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫

সাইফুল হোসেন

দেশের ব্যাংকিং খাত যখন ইতিহাসের এক বিশেষ সংকটকাল পার করছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশ ব্যাংক এক যুগান্তকারী কিন্তু বিতর্কিত নীতিমালা জারি করেছে। নতুন এই বিধান অনুযায়ী এখন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন) এবং আইডিআরএ বা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির মতো আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নির্বাহী পরিচালক (ইডি) বা সমমানের শীর্ষ কর্মকর্তারাও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে নিয়োগের সুযোগ পাবেন।

ওই সুযোগ পেতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় কমপক্ষে ২৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা এবং জাতীয় বেতন কাঠামোর দ্বিতীয় গ্রেডভুক্ত হতে হবে। নীতিমালার প্রবক্তারা এটিকে ব্যাংকিং খাতে যোগ্য লোকের ঘাটতি পূরণের একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ হিসেবে দাবি করলেও আর্থিক বিশেষজ্ঞ ও বাজার বিশ্লেষকদের বড় অংশ এই সিদ্ধান্ত উচ্চ ঝুঁকি এবং স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) জন্ম দিতে পারে বলে গভীর শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশই এখন খেলাপি; যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬.৫ লাখ কোটি টাকা। উচ্চ হারে ঋণ-অনিয়ম, দুর্বল গভর্ন্যান্স, রাজনৈতিক প্রভাব এবং পুঁজি ঘাটতির মতো কাঠামোগত দুর্বলতা ব্যাংক খাতের ভিত্তি ক্ষয় করেছে। এমন একটি ‘পঙ্গু’ ও ‘গতিহীন’ অর্থনীতিতে, যেখানে বিনিয়োগে মন্দা চলছে, সেখানে এমডি নিয়োগের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে নীতিগত পরীক্ষা কতা যৌক্তিক, সেই প্রশ্নটিই এখন আলোচনার বিষয়।

বলা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা দুই দশকেরও বেশি সময় নীতিমালা তৈরি, শৃঙ্খলা রক্ষা, তদারকি এবং ম্যাক্রোইকোনমিক বিশ্লেষণে যুক্ত থাকলে তাদের এই অভিজ্ঞতা বাণিজ্যিক ব্যাংকের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে এই কর্মকর্তাদের বহুদিনের কাজের সম্পর্ক থাকায়, ঋণ সংস্কার বা অন্যান্য নীতিগত বিষয়ে দ্রুত বোঝাপড়া এবং যোগাযোগের সুবিধা তৈরি হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ মূলত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও নীতি নির্ধারণ; যেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডির কাজ হলো দৈনন্দিন জটিল অপারেশন, গ্রাহক পরিষেবা, করপোরেট লোন ম্যানেজমেন্ট, ট্রেজারি অপারেশন এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা।

একজন ব্যাংক এমডির প্রতিদিনের কাজের ৭০ শতাংশেরও বেশি অপারেশনাল দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ব্যাংক বা বিএসইসির ইডিরা রেগুলেশন ও পরিদর্শনে দক্ষ হলেও ওই রিটেইল ব্যাংকিং বা শাখা পরিচালনার মতো বিষয়ে অভিজ্ঞ নন। এমটিবি বা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি তাই বলেছেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ পদের দায়িত্ব ভিন্ন ভিন্ন, চ্যালেঞ্জও ভিন্ন ভিন্ন’ (প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর)।

বলা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পেশাজীবীরা নেতৃত্বে এলে অপারেশনাল দক্ষতার ঘাটতির কারণে ব্যাংকের কার্যক্রমে মন্থরতা সৃষ্টি হতে পারে; যা বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যাংকের মুনাফা ও প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করবে। ওই নীতিমালার সবচেয়ে গভীর এবং বিপজ্জনক দিকটি হলো স্বার্থের সংঘাত। যে প্রতিষ্ঠান কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংককে তদারক করে, তারই সাবেক বা বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তা যদি সেই ব্যাংকের এমডি হন; তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক সহকর্মীরা সেই ব্যাংকের অনিয়ম বা দুর্বলতা তদন্তে নমনীয় ভূমিকা নিতে পারেন-এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। এ ছাড়া ব্যাংকের পর্ষদও এমডি ও সিইও নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের বাড়তি প্রাধান্য দিতে পারে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে বিভিন্ন নীতিগত সুবিধা পাওয়া এবং লিয়াজোঁর ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মকর্তারা অগ্রাধিকার পেতে পারেন। এই পরিস্থিতি অন্য ব্যাংকগুলোর জন্য অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে এবং সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের সুযোগ বৃদ্ধি করবে।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন বিধানের ফলে ব্যাংকের শীর্ষ পদে নিয়োগ পেতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়োগকারীদের এক ধরনের যোগসাজশ তৈরি হতে পারে; যা পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সুতরাং সুশাসন নিশ্চিত না করে এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু এমডি নিয়োগের ‘পুল’ বাড়ালে ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান গভীর ক্ষত সারানো সম্ভব নয়।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তা এমডি হলে তিনি হয়তো নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু বাজারের জটিলতা, গ্রাহককেন্দ্রিক সেবা এবং দ্রুত প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ের চাহিদা মেটাতে তিনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। এই উচ্চ ঝুঁকি মোকাবিলায় নীতিনির্ধারকদের উচিত কিছু কঠিন ও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া। তা হলো-

প্রথমত, বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি হতে ইচ্ছুক নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের জন্য অন্তত বিশেষায়িত অপারেশনাল ব্যাংকিং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।

দ্বিতীয়ত, স্বার্থের সংঘাত এড়াতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদ ছাড়ার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বাধ্যতামূলক ‘কুলিং পিরিয়ড’ বা বিরতি (যেমন দুই-তিন বছর) আরোপ করা।

তৃতীয়ত, নিয়োগে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কঠোর ‘ফিট অ্যান্ড প্রোপার টেস্ট’ নিশ্চিত করা; যেখানে প্রার্থীর অপারেশনাল এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। সবশেষে, পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে আনা এবং খেলাপিদের বিরুদ্ধে বাস্তব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ব্যাংক খাত বদলাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নতুন নীতিমালাটি নেতিবাচকও নয়, আবার পুরোপুরি আশাব্যঞ্জকও নয়। ব্যাংক খাতের চলমান সংকটে এ পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত বরং উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করেছে। এই ক্রান্তিকালে উক্ত নীতিমালার সফলতা নির্ভর করবে সরকারের সদিচ্ছা এবং ব্যাংক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর।

লেখক: কলামিস্ট

(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ