ঢাকা ০১:২৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫
সাড়ে ৩১ ঘণ্টায় চারবার, জোরালো সতর্কতা বিশেষজ্ঞদের

এবার দেশে একদিনে তিনবার ভূমিকম্প!

  • আপডেট সময় : ০৬:২৪:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫
  • ৪১ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

প্রত্যাশা ডেস্ক: দেশে সাড়ে ৩১ ঘণ্টায় চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার (২২ নভেম্বর) সকালে একবার ও সন্ধ্যায় পরপর দুবার ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর আগে গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা।

শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪ দশমিক ৩। একটির উৎপত্তিস্থল বাড্ডায়, আরেকটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে। এর আগে শনিবার সকালে নরসিংদীতেই আরো একটি মৃদু ভূমিকম্প হয়। জেলার পলাশ উপজেলায় সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩।

গত ২১ নভেম্বর শুক্রবার সকালে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের পরেরদিন শনিবার সকালে একবার ও সন্ধ্যায় পরপর দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হওয়া জনমনে আতঙ্ক বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন জোরালো সতর্কতা।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, শনিবার সন্ধ্যায় প্রথম ভূমিকম্পের মাত্রা ৪ দশমিক ৩। উৎপত্তিস্থল নরসিংদী থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে। এর উৎপত্তি ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। তবে ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৭।

এর আগে শনিবার সকালে নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় মৃদু ভূমিকম্প হয়। সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩।

গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ কেঁপে ওঠে। এ ঘটনায় শিশুসহ অন্তত ১০ জন নিহত এবং ছয় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে। ঢাকায় চার ও নারায়ণগঞ্জে একজন মারা যান। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে অনেকেই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন। এ ছাড়া কিছু ভবন হেলে পড়ে ও ফাটল দেখা দেয়।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: তীব্র ঝাঁকুনির ভূমিকম্পের পর এত ঘন ঘন কম্পে এখনই করণীয় ঠিক করতে তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে শুক্রবারের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো স্থানে বড় ভূমিকম্পের পর সাধারণত একাধিক পরাঘাত হয়।
শনিবার সকালের ভূমিকম্পের পর আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা রুবাঈয়্যাৎ কবীর এটি ‘আফটার শক’ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৯ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর পলাশ। এটি ছিল মৃদু মাত্রার ভূমিকম্প; রিখটার স্কেলে এটি ছিল ৩ দশমিক ৩ মাত্রার। এর আগে শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে কয়েক দশকের মধ্যে দেশের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। তাতে তিন জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ছয় শতাধিক মানুষ। ঢাকার বহু ভবনে ফাটল, কোথাও কোথাও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ‘আজকের (শনিবার) ভূমিকম্প বলা যেতে পারে ‘ফোরশক’। বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট যে ভূমিকম্প, এ সেগুলোরই অংশ।

এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা যে রয়েছে, সেটা স্মরণ করে দিয়ে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পন হলে ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ হতাহত হবে। পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ অবরুদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভেঙে পড়তে পারে ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের ভূমিকা এড়ানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভবনের মান পরীক্ষা করা, ঝুঁকির ভিত্তিতে সেগুলোকে আলাদা করা এবং নাগরিকদের সতর্ক করাসহ নিয়মিত মহড়া আয়োজনে জোর দেওয়ার কথা বলেছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার শুক্রবার বলেন, বাংলাদেশ কম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হলেও ঝুঁকির দিক দিয়ে খুব উপরে রয়েছে। যে পরিমাণ শক্তি ইন্ডিয়ান-বার্মা প্লেটের সংযোগ স্থলে জমা হয়ে আছে, সেই শক্তিটা যদি বের হয়, তাহলে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পও হতে পারে। এটা আগামীকালও হতে পারে, ৫০ বছর পরেও হতে পারে। কখন হবে, সেটা আমরা বলতে পারি না। তবে যেটা হবে, সেটা খুব মারাত্মক হবে। ‘সাবডাকশন জোনের’ ভূমিকম্প ভয়ঙ্কর হয়- বলেন অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার।

উৎপত্তিস্থল এলাকার মাটিতে ফাটল থেকে নমুনা সংগ্রহ: ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশালের বিভিন্ন এলাকার মাটিতে ফাটল থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ। শনিবার ভূতত্ত্ব বিভাগের ৭ সদস্যের একটি দল এসব এলাকা পরিদর্শন ও নমুনা মাটি সংগ্রহ করেন বলে জানিয়েছেন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ.স.ম ওবায়দুল্লাহ। তারা ঘোড়াশাল পৌর এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ঘোড়াশাল ডেইরি ফার্ম ও পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে ধসে পড়া মাটির নমুনা সংগ্রহ করেন তারা।

এসময় আ.স.ম ওবায়দুল্লাহ বলেন, প্রাথমিকভাবে ফাটল ধরা মাটির নমুনা সংগ্রহ করেছেন তারা। এসব নমুনা সংগ্রহের পর তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কী ধরণের ভূমিকম্প হয়েছে বা কতটুকু গভীরতায় হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এর আগে শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর জানান, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর মাধবদীতে, কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। স্থায়ীত্ব ছিল ২৬ সেকেন্ড।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) উপকেন্দ্র বলছে উৎপত্তিস্থল নরসিংদী সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পশ্চিম দক্ষিণ-পশ্চিমে। কয়েক দশকের মধ্যে দেশের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১০ জন,ছয়শ ছাড়িয়েছে আহতের সংখ্যা। এর মধ্যে ঢাকায় ৪ জন, নরসিংদীতে ৫ জন এবং নারায়ণগঞ্জে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদিকে ভূমিকম্পে নরসিংদীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে কাজ করছে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন ইউনিট। কমিটি গঠন করেছে পৌর প্রশাসন। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু তাহের মো. শামসুজ্জামান।

ভূমিকম্পে ঢাকাসহ ৪ জেলায় যত ক্ষয়ক্ষতি: ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শুক্রবার সকালের ভূমিকম্পে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১০ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, ও ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক অফিস।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পে ঢাকার আরমানীটোলা, মাতুয়াইল, কলাবাগান, খিলগাঁও ও নিউমার্কেট এলাকার কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ঢাকা কলেজের ইলিয়াস হল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূমিকম্পে ঢাকায় তিনজন নিহত এবং ৫৯ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে হুড়োহুড়ি করে উঁচু ভবন থেকে নামতে গিয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। সন্ধ্যা সোয়া ৬টা পর্যন্ত ৪ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাবস্টেশনে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে যায়। পরে সাবস্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়াও সাবস্টেশনের বিপুল পরিমাণ পিটি (প্রডাকশন ট্রান্সফর্মার) ভূ-কম্পনের ফলে ভেঙে পড়ে। পরে আবার তা স্বাভাবিক হয়।

ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার কারখানার ইউরিয়া প্রডাকশন ভূমিকম্পন জনিত কারণে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ভূ-কম্পনের সময় ইঞ্জিন মেশিনারিজ ভাইব্রেশনের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যায় এবং মেশিনারিজ চেকিং অপারেশনে আছে। এছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও সার্কিট হাউজসহ শতাধিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ভূমিকম্পে দেওয়াল ধসে একজন শিশু ঘটনাস্থলে মারা গেছে। শিশুর মায়ের অবস্থাও গুরুতর। এছাড়া একজন পথচারী গুরুতর আহত হয়েছে। নিহত শিশুর মা ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছে। শিশুটির পরিবারকে প্রাথমিকভাবে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আহত হয়ে ২৪ জন বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। কারো আঘাতই অতি গুরুতর নয়। ভূমিকম্পের কারণে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির তথ্যাদি সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এদিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, ভূমিকম্পে সেখানে অবকাঠামোত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য নেই। তবে জেলার বিভিন্ন স্থানে শিল্প কারখানায় তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে শতাধিক শ্রমিক আহত হন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অধিকাংশই প্রথামিক চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। কিছু শ্রমিক এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

সানা/আপ্র/২২/১১/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

ভূমিকম্পে শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত, রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত

সাড়ে ৩১ ঘণ্টায় চারবার, জোরালো সতর্কতা বিশেষজ্ঞদের

এবার দেশে একদিনে তিনবার ভূমিকম্প!

আপডেট সময় : ০৬:২৪:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: দেশে সাড়ে ৩১ ঘণ্টায় চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার (২২ নভেম্বর) সকালে একবার ও সন্ধ্যায় পরপর দুবার ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর আগে গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা।

শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪ দশমিক ৩। একটির উৎপত্তিস্থল বাড্ডায়, আরেকটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে। এর আগে শনিবার সকালে নরসিংদীতেই আরো একটি মৃদু ভূমিকম্প হয়। জেলার পলাশ উপজেলায় সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩।

গত ২১ নভেম্বর শুক্রবার সকালে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের পরেরদিন শনিবার সকালে একবার ও সন্ধ্যায় পরপর দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হওয়া জনমনে আতঙ্ক বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন জোরালো সতর্কতা।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, শনিবার সন্ধ্যায় প্রথম ভূমিকম্পের মাত্রা ৪ দশমিক ৩। উৎপত্তিস্থল নরসিংদী থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে। এর উৎপত্তি ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। তবে ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৭।

এর আগে শনিবার সকালে নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় মৃদু ভূমিকম্প হয়। সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩।

গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ কেঁপে ওঠে। এ ঘটনায় শিশুসহ অন্তত ১০ জন নিহত এবং ছয় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে। ঢাকায় চার ও নারায়ণগঞ্জে একজন মারা যান। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে অনেকেই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন। এ ছাড়া কিছু ভবন হেলে পড়ে ও ফাটল দেখা দেয়।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: তীব্র ঝাঁকুনির ভূমিকম্পের পর এত ঘন ঘন কম্পে এখনই করণীয় ঠিক করতে তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে শুক্রবারের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো স্থানে বড় ভূমিকম্পের পর সাধারণত একাধিক পরাঘাত হয়।
শনিবার সকালের ভূমিকম্পের পর আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা রুবাঈয়্যাৎ কবীর এটি ‘আফটার শক’ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৯ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর পলাশ। এটি ছিল মৃদু মাত্রার ভূমিকম্প; রিখটার স্কেলে এটি ছিল ৩ দশমিক ৩ মাত্রার। এর আগে শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে কয়েক দশকের মধ্যে দেশের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। তাতে তিন জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ছয় শতাধিক মানুষ। ঢাকার বহু ভবনে ফাটল, কোথাও কোথাও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ‘আজকের (শনিবার) ভূমিকম্প বলা যেতে পারে ‘ফোরশক’। বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট যে ভূমিকম্প, এ সেগুলোরই অংশ।

এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা যে রয়েছে, সেটা স্মরণ করে দিয়ে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পন হলে ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ হতাহত হবে। পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ অবরুদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভেঙে পড়তে পারে ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের ভূমিকা এড়ানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভবনের মান পরীক্ষা করা, ঝুঁকির ভিত্তিতে সেগুলোকে আলাদা করা এবং নাগরিকদের সতর্ক করাসহ নিয়মিত মহড়া আয়োজনে জোর দেওয়ার কথা বলেছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার শুক্রবার বলেন, বাংলাদেশ কম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হলেও ঝুঁকির দিক দিয়ে খুব উপরে রয়েছে। যে পরিমাণ শক্তি ইন্ডিয়ান-বার্মা প্লেটের সংযোগ স্থলে জমা হয়ে আছে, সেই শক্তিটা যদি বের হয়, তাহলে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পও হতে পারে। এটা আগামীকালও হতে পারে, ৫০ বছর পরেও হতে পারে। কখন হবে, সেটা আমরা বলতে পারি না। তবে যেটা হবে, সেটা খুব মারাত্মক হবে। ‘সাবডাকশন জোনের’ ভূমিকম্প ভয়ঙ্কর হয়- বলেন অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার।

উৎপত্তিস্থল এলাকার মাটিতে ফাটল থেকে নমুনা সংগ্রহ: ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশালের বিভিন্ন এলাকার মাটিতে ফাটল থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ। শনিবার ভূতত্ত্ব বিভাগের ৭ সদস্যের একটি দল এসব এলাকা পরিদর্শন ও নমুনা মাটি সংগ্রহ করেন বলে জানিয়েছেন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ.স.ম ওবায়দুল্লাহ। তারা ঘোড়াশাল পৌর এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ঘোড়াশাল ডেইরি ফার্ম ও পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে ধসে পড়া মাটির নমুনা সংগ্রহ করেন তারা।

এসময় আ.স.ম ওবায়দুল্লাহ বলেন, প্রাথমিকভাবে ফাটল ধরা মাটির নমুনা সংগ্রহ করেছেন তারা। এসব নমুনা সংগ্রহের পর তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কী ধরণের ভূমিকম্প হয়েছে বা কতটুকু গভীরতায় হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এর আগে শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর জানান, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর মাধবদীতে, কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। স্থায়ীত্ব ছিল ২৬ সেকেন্ড।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) উপকেন্দ্র বলছে উৎপত্তিস্থল নরসিংদী সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পশ্চিম দক্ষিণ-পশ্চিমে। কয়েক দশকের মধ্যে দেশের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১০ জন,ছয়শ ছাড়িয়েছে আহতের সংখ্যা। এর মধ্যে ঢাকায় ৪ জন, নরসিংদীতে ৫ জন এবং নারায়ণগঞ্জে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদিকে ভূমিকম্পে নরসিংদীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে কাজ করছে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন ইউনিট। কমিটি গঠন করেছে পৌর প্রশাসন। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু তাহের মো. শামসুজ্জামান।

ভূমিকম্পে ঢাকাসহ ৪ জেলায় যত ক্ষয়ক্ষতি: ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শুক্রবার সকালের ভূমিকম্পে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১০ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, ও ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক অফিস।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পে ঢাকার আরমানীটোলা, মাতুয়াইল, কলাবাগান, খিলগাঁও ও নিউমার্কেট এলাকার কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ঢাকা কলেজের ইলিয়াস হল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূমিকম্পে ঢাকায় তিনজন নিহত এবং ৫৯ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে হুড়োহুড়ি করে উঁচু ভবন থেকে নামতে গিয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। সন্ধ্যা সোয়া ৬টা পর্যন্ত ৪ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাবস্টেশনে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে যায়। পরে সাবস্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়াও সাবস্টেশনের বিপুল পরিমাণ পিটি (প্রডাকশন ট্রান্সফর্মার) ভূ-কম্পনের ফলে ভেঙে পড়ে। পরে আবার তা স্বাভাবিক হয়।

ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার কারখানার ইউরিয়া প্রডাকশন ভূমিকম্পন জনিত কারণে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ভূ-কম্পনের সময় ইঞ্জিন মেশিনারিজ ভাইব্রেশনের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যায় এবং মেশিনারিজ চেকিং অপারেশনে আছে। এছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও সার্কিট হাউজসহ শতাধিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ভূমিকম্পে দেওয়াল ধসে একজন শিশু ঘটনাস্থলে মারা গেছে। শিশুর মায়ের অবস্থাও গুরুতর। এছাড়া একজন পথচারী গুরুতর আহত হয়েছে। নিহত শিশুর মা ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছে। শিশুটির পরিবারকে প্রাথমিকভাবে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আহত হয়ে ২৪ জন বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। কারো আঘাতই অতি গুরুতর নয়। ভূমিকম্পের কারণে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির তথ্যাদি সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এদিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, ভূমিকম্পে সেখানে অবকাঠামোত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য নেই। তবে জেলার বিভিন্ন স্থানে শিল্প কারখানায় তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে শতাধিক শ্রমিক আহত হন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অধিকাংশই প্রথামিক চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। কিছু শ্রমিক এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

সানা/আপ্র/২২/১১/২০২৫