নারী ও শিশু ডেস্ক: নভেম্বর মাসের প্রথম সাত দিনে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে অন্তত ১১ শিশু হারানোর ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকের অসতর্কতার কারণেই ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে তারা। তাই বেড়াতে গিয়ে শিশুকে সুরক্ষিত রাখতে অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে।
গত বছর শীতকালে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন আফিফ-সাবরিনা (ছদ্মনাম) দম্পতি। সুগন্ধা বিচের দোকানগুলোয় কেনাকাটা করতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করেন, সঙ্গে থাকা পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে আদোয়া নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ট্যুরিস্ট পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার হয় তাদের মেয়ে। বেড়াতে গিয়ে শিশু হারিয়ে যাওয়ার এমন ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার উত্তম প্রসাদ পাঠক বলেন, ‘ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাসকে আমরা বলি পর্যটন মৌসুম। এ সময় দেশের পর্যটন স্থানগুলোয় ভিড় করেন অনেক মানুষ। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে লোকসমাগম বেশি হয় বলে এ সময় শিশু হারানোর ঘটনা বেশি ঘটে। এ ছাড়া ঈদ ও পূজার ছুটি এবং সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে সরকারি ছুটি মিলিয়ে যখন কয়েক দিনের ছুটি থাকে, সে সময়ও এমন ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত এক বছরে হারিয়ে যাওয়া প্রায় ৪৫ শিশুকে আমরা উদ্ধার করেছি। এই শিশুদের বেশির ভাগের বয়স ৪ থেকে ১০ বছরের মধ্যে।’
উত্তম প্রসাদ পাঠকের কাছ থেকে জানা গেল, সাধারণত এমন ঘটনা ঘটে অভিভাবকের অসচেতনতা, শিশুর দুরন্তপনা এবং অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে। শিশুকে নিয়ে অভিভাবক সচেতন হলে এমন ঘটনা ৮০ শতাংশ কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি। তাই শিশুদের নিয়ে বেড়াতে গেলে যেসব বিষয় খেয়াল রাখবেন, তা নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন মনের বন্ধুর সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলর মো. ইকবাল হোসেন।
= বেড়াতে যাওয়ার আগেই প্রস্তুতি নিন শিশু বড় হতে থাকলে ধীরে ধীরে তাকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের নাম, মা-বাবার নাম শেখানো জরুরি; যাতে সে কোথাও হারিয়ে গেলেও নিজের পরিচয় বলে সাহায্য পেতে পারে। শিশুর বয়স চার বা এর বেশি হলে আপনার ফোন নম্বরও মুখস্থ করানোর চেষ্টা করুন।
= অনেক সময় পাঁচ তারকা হোটেল বা রিসোর্টে শিশুদের হাতে একধরনের রিস্ট ব্যান্ড পরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে শিশুর নাম ও অভিভাবকের ফোন নম্বর লেখা যায়। বেড়াতে গিয়ে সম্ভব হলে এমন কোনো ব্যান্ড শিশুর হাতে পরিয়ে দিতে পারেন।
= শিশু যদি আরো ছোট হয়, তাহলে তার পকেটে নাম-ঠিকানা লিখে একটা কাগজ রাখতে পারেন। হারিয়ে গেলে কারো কাছে কীভাবে সাহায্য চাইবে, তা শিশুকে শেখান। তাদের পুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবকদের পোশাক চেনানোর চেষ্টা করতে পারেন।
= দুই থেকে তিন বছর বয়সি শিশুদের বলা হয় ‘টডলার’। আর চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের চিহ্নিত করা হয় ‘প্রি-স্কুলার’ হিসেবে। এ দুই বয়সের শিশুদের মধ্যে অনেক বেশি কৌতূহল কাজ করে। এই শিশুরা সব সময় অন্যের মনোযোগ বা গুরুত্ব পেতে চায়। নতুন কোথাও বেড়াতে গেলে আশপাশের মানুষ যখন তাদের দেখে বা হাসে, তখন তারা আনন্দ পায়। এ সময় তাদের ডোপামিন বা হ্যাপি হরমোন নিঃসরণ হয়।
= কোথাও বেড়াতে গিয়ে অনেক সময় শিশুর অভিভাবকরা কেনাকাটা, ছবি তোলা, ফোনে কথা বলা কিংবা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং শিশুর প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন না। যেহেতু তার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না, তাই এমন সময় শিশু কৌতূহলবশত অন্য কোনো দিকে চলে যেতে পারে। কিংবা অন্য কেউ শিশুর মনোযোগ আকর্ষণ করে তাকে নিয়ে যেতে পারে। তাই বেড়াতে গিয়ে কখনোই শিশুর প্রতি অমনোযোগী হওয়া যাবে না।
= অনেক সময় দেখা যায়, অচেনা কেউ এসে শিশুকে আদর করছে, কোলে নিতে চাইছে বা শিশুর সঙ্গে খেলছে। মা-বাবা সারা দিন শিশুকে নিয়ে ক্লান্ত হতে পারেন। এমন সময় কাউকে পেলে তার কাছে শিশুকে দিয়ে তারা একটু রিল্যাক্স হতে চান। এ সময় শিশু অবচেতন মনে সেই অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে। এভাবেও ঘটতে পারে অঘটন। তাই অপরিচিত কারও কাছে শিশুকে দিলেও একদমই চোখের আড়াল হতে দেওয়া যাবে না।
শিশুর পছন্দের খেলনা সঙ্গে নেওয়া: শিশুর কাছে তার পছন্দের কোনো খেলনা থাকলে সে ওই খেলনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এতে শিশুর মনোযোগ অন্যদিকে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকটা কমে যায়। তাই বেড়াতে যাওয়ার সময় শিশুর পছন্দের কোনো খেলনা সঙ্গে রাখতে পারেন।
ভিড় এড়িয়ে চলা: অতিরিক্ত ভিড় ও শব্দ অনেক সময় শিশুকে বিচলিত করে তোলে। শিশু সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। তাই বেড়াতে গিয়ে শিশু বিরক্ত হবে, এমন জায়গায় না যাওয়াই ভালো। শিশুকে নিয়ে বেড়াতে গেলে খুব বেশি জনসমাগমের জায়গা এড়িয়ে চলুন।
রাগ নিয়ন্ত্রণ করা: বেড়াতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। গাড়ি আসতে দেরি হওয়া, খেতে গিয়ে পছন্দের খাবার না পাওয়া কিংবা হোটেলে পছন্দের ঘর না পাওয়া ইত্যাদি বেড়াতে গিয়ে ঘটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এমন সময় অনেক অভিভাবকের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং তারা শিশুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। শিশু তখন একধরনের মানসিক চাপে ভোগে। এ সময় সে অন্যদিকে বা অন্য কিছুতে মনোযোগী হয়ে সেদিকে চলে যেতে পারে। তাই অভিভাবকের রাগ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু হলে: বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের এমনিতেই সব সময় আলাদা যত্নের প্রয়োজন হয়। বয়স বাড়লেও এডিএইচডি বা অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা অনেক কিছুই বুঝতে পারে না। এই শিশুদের বেড়াতে নিয়ে গেলে তাদের প্রয়োজনগুলো পূরণ হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখুন। সব সময় তাদের নিজের কাছে রাখুন।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ


























