ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
জাল সনদে শিক্ষকতার বিষয়টি বর্তমান সময়ে এক আলোচিত বিষয়। জাল সনদ দিয়ে যারা শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় প্রবেশ করেছেন তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখতে পেরেছে তা বলাই বাহুল্য। সারাদেশে এই ধরনের শিক্ষকের সংখ্যা যে কত তা শুনলে গা শিহরিত হয়ে উঠবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) থেকে প্রাপ্ত এক তথ্যের বরাতে কালের কণ্ঠের (১৪ জুলাই ২০২৪) এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘জাল সনদে ১১৫৬ শিক্ষক’।
ওই সংখ্যার মধ্যে ৭৯৩ জন শিক্ষকের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ, ২৯৬ জনের কম্পিউটার শিক্ষার সনদ এবং ৬৭ জনের বিএড, গ্রন্থাগার, সাচিবিকবিদ্যা ও অন্যান্য বিষয়ের সনদ জাল। দীর্ঘদিন চাকরির সুবাদে এসব শিক্ষক জাল সনদে সরকার থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকা বেতন বাবদ উত্তোলন করেছেন। আবার চাকরি নিয়েছেন মাস্টার্স প্রথম শ্রেণির যোগ্যতা দেখিয়ে, অনুসন্ধানে মিলেছে দ্বিতীয় শ্রেণি। কারো নিয়োগকালীন দেওয়া সনদে রয়েছে একাধিক অসংগতি। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে তুলছেন বেতন-ভাতাদি। ‘জাল সনদে ১৩ বছর ধরে চাকরি করেন ৫ শিক্ষক’ এই শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয় যুগান্তরে (১৪ মার্চ ২০২৫)।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) ও জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) যাচাই বাছাইয়ে ধরা পড়ে এ জালিয়াতির ঘটনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী ডিআইএ ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ৬৭৬ জনের সনদ জাল হিসেবে প্রমাণিত হয়। জাল সনদ চিহ্নিত হওয়াদের মধ্যে ৫১০ জনের নিবন্ধন সনদ, ১২৩ জনের কম্পিউটার, ১৫ জনের সাচিবিক বিদ্যা, ৫ জনের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান, ৫ জনের বিডিএস, একজনের বিএড এবং ১৭ জনের অন্যান্য সনদ জাল বলে প্রমাণিত হয়। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষকই ২০-২২ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছেন।
ওই ধরনের শত শত অভিযোগ আছে। চলছে আইনগত ব্যবস্থা, এমপিও বাতিল, বেতন-ভাতা বন্ধ, হচ্ছে অনেকের সাজাও। আবার কোনো রকম পাত্তা না দিয়ে রাজনৈতিক পরিচয় ও অর্থের বিনিময়ে চলছে চাকরি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। ‘টাকার জোরে চাকরিতে ফেরার চেষ্টায় জাল সনদে শিক্ষকরা’ মর্মে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে দৈনিক কালবেলায় ২২ জুন ২০২৫। অভিযোগ উঠেছে, একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট বিপুল অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বরখাস্ত এসব শিক্ষককে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করছে। সনদ জালিয়াতির এই চক্রের মধ্যে আছে প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে শুরু করে অফিসের স্টাফ পর্যন্ত।
ডিআইএ কর্মকর্তাদের ধারণা, জাল সনদে শুধু কম্পিউটার শিক্ষক রয়েছেন ৪০ হাজারের বেশি এবং অন্যান্য বিষয় রয়েছে ৩০ হাজারের মতো। কিছু অসাধু ব্যক্তির সহায়তায় নীলক্ষেত এবং বিভিন্ন কম্পিউটার দোকান থেকে জাল সনদ সংগ্রহ করে। এ ধরনের একজন এনটিআরসিএর এক ড্রাইভার। তার রয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে সাততলা বাড়ি ও আগামসি লেনে রয়েছে দামি ফ্ল্যাট, আশুলিয়ায় বাড়ি, যশোরে বিলাসবহুল ছয়তলা বাড়ি, আত্মীয়-স্বজনের নামে রয়েছে ব্যাংক ব্যালান্স ও কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি।
জাল সনদে শিক্ষকতা করার পেছনে যেসব কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তা হলো চাকরির প্রতিযোগিতা- দেশে বেকারত্বের হার বেশি। তাই অনেকে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। দুর্বল যাচাই ব্যবস্থা-শিক্ষক নিয়োগে সনদ যাচাই প্রক্রিয়া অনেক সময় দুর্বল বা প্রভাবিত হয়। দুর্নীতি ও প্রভাব- অনেক সময় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রভাবের কারণে জাল সনদধারীরাও নিয়োগ পেয়ে যায়। নৈতিক অবক্ষয়-সমাজে সততা ও নৈতিকতার অভাব বাড়ায় মানুষ সহজ পথ বেছে নেয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক বা কর্মচারীর জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে মোট সাতটি নির্দেশনা দেওয়া আছে। এগুলো হলো ১. জাল সনদধারী শিক্ষক বা কর্মচারীদের এমপিও বন্ধ ও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করা, ২. অবৈধভাবে গ্রহণকৃত বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগারে ফেরত প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ, ৩. যারা অবসরে গেছেন, তাদের অবসরের সুবিধাপ্রাপ্তি বাতিল করা, ৪. যারা স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন তাদের আপত্তির টাকা অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে আদায় করা, ৫. বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জাল সনদধারী শিক্ষক বা কর্মচারীদের অবসরের ভাতা বা কল্যাণ ট্রাস্টের ভাতা বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাল সনদধারীদের তালিকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো, ৬. জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানপ্রধান কর্তৃক ফৌজদারি অপরাধের মামলা দায়ের করা এবং ৭. জাল সনদধারীদের নিয়োগ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এদিকে ওই জালিয়াতি শনাক্ত ও প্রতিরোধের উপায় হতে পারে- ১. সনদ যাচাই প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা: শিক্ষক নিয়োগের সময় শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে প্রতিটি সনদ যাচাই বাধ্যতামূলক করতে হবে। ২. ডিজিটাল সনদ যাচাই ব্যবস্থা চালু করা: ব্লকচেইন বা ডিজিটাল ডাটাবেস ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিটি সার্টিফিকেট যাচাই করা যেতে পারে। ৩. কঠোর শাস্তি: জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে চাকরিচ্যুতি, কারাদ- ও অর্থদ-সহ। ৪. নৈতিক শিক্ষা জোরদার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা: শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই সততা ও নৈতিকতা শেখানো জরুরি। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে কাজ করে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
শিক্ষা হলো সমাজের আলোকবর্তিকা। শিক্ষক ওই আলোকবর্তিকার বাহক। তিনি অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। শিক্ষক কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেন না; বরং শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, মানবিকতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধ শেখান। কিন্তু যখন জাল সনদধারীরা এই পেশায় প্রবেশ করে, তখন শিক্ষকতার মহান আদর্শ কলুষিত হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে পড়ে। ‘জাল সনদে শিক্ষকতা’ আজ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ ও শিক্ষকতার মর্যাদার ওপর এক কলঙ্কের দাগ।
জাল সনদধারী শিক্ষক শুধু শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, সমাজের নৈতিক ভিত্তিকেও ধ্বংস করে। শিক্ষার্থীরা তাদের কাছ থেকে শিখে কীভাবে প্রতারণার মাধ্যমে সফল হতে হয়। ফলে সমাজে দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও অদক্ষতার বিস্তার ঘটে, যা একটি জাতিকে দীর্ঘমেয়াদে দুর্বল করে দেয়। জাল সনদধারী শিক্ষক মানে একজন প্রতারক শিক্ষক। তিনি প্রকৃতভাবে যোগ্য নন, তাই তার পক্ষে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। যখন শিক্ষক নিজেই প্রতারণার মাধ্যমে পেশায় আসে, তখন সে শিক্ষার্থীদের কাছে কোনো নৈতিক উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে না।
ওই ধরনের অযোগ্য শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পাঠদান করতে পারেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। জাল সনদধারীরা চাকরি পাওয়ায় প্রকৃত মেধাবীরা সুযোগ হারায়, যা সমাজে বৈষম্য ও হতাশা সৃষ্টি করে। অভিভাবক ও সমাজ যখন দেখে যে শিক্ষকরা জাল সনদধারী, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের আস্থা নষ্ট হয়।
শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়াতে হলে, নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে আরও উন্মুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। নিয়োগের প্রতিটি ধাপ, যেমন বিজ্ঞপ্তি, যোগ্যতা, নিয়োগ পরীক্ষায় স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত রাখা এবং চূড়ান্ত বাছাইয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে প্রকৃত মেধাবীদের সুপারিশ করা উচিত। এ পর্যায়ে যে কোনো অস্বচ্ছতা ও অসংগতি দূর করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করলে প্রক্রিয়াটি দ্রুত ও সহজতর হবে।
প্রক্রিয়াটি চলাকালেই প্রার্থীদের জমাকৃত সনদগুলো সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মাধ্যমে ভেরিফাই করে আনতে হবে। কোনো অসংগতি দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। কোনোভাবেই জাল সনদধারীরা যাতে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আসতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে জাল সনদে শিক্ষকতা যেমন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কলঙ্ক, তেমনি এটি পুরো জাতির জন্যও এক লজ্জাজনক অধ্যায়।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ


























