প্রযুক্তি ডেস্ক: যুক্তরাজ্যে নতুন অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ম কার্যকর হওয়ার পরও দেশটিতে কিশোর বয়সী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা এখনো সোশাল মিডিয়ায় বুলিয়িং, আত্মহত্যা, অস্ত্র ও প্রাণীর নির্মম মৃত্যুর মত ক্ষতিকর কনটেন্টের মুখোমুখি হচ্ছে।
বিবিসির সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। জুলাইয়ে কার্যকর হওয়া অনলাইন সেইফটি অ্যাক্টের পর থেকে অনলাইন ও সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো আইনগতভাবে শিশু-কিশোরদের নিরাপদ রাখার দায়িত্বে রয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে, পরিবর্তন এখনো অসম্পূর্ণ।
বিবিসি মর্নিং লাইভের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত অনুসন্ধানটিতে মে মাসে করা আগের তদন্তের একই প্রোফাইল ও পদ্ধতি ব্যবহার করে পরীক্ষা আবারও করা হয়েছে।
অনলাইন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ডেভিড রাইট এই ফলাফলকে “উদ্বেগজনক” বলে মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি তিনি বলেছেন, ‘বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সময় লাগবে’।
সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে রাইট বলেন, ‘সবাইকে এখনো খুব সচেতন থাকতে হবে’। তিনি যুক্তরাজ্যের ‘এসডব্লিউজিএফএল’ নামের দাতব্য সংগঠনের প্রধান নির্বাহী এবং ইউকে সেইফার ইন্টারনেট সেন্টারের পরিচালক।
টিকটক ও ইউটিউব বলছে, তাদের প্ল্যাটফর্মে কিশোরদের জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তা সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। গত বসন্তে বিবিসির দুই সাংবাদিক অ্যান্ডি হাওয়ার্ড ও হ্যারিয়েট রবিনসন ছয়টি কাল্পনিক সোশাল মিডিয়া প্রোফাইল তৈরি করেন। এর মধ্যে তিনটি ছেলে ও তিনটি মেয়ে প্রোফাইল যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর। ছেলেরা টিকটক ও ইউটিউব ব্যবহার করে এবং মেয়েরা ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক। প্রতিটি অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন প্রতিটি প্ল্যাটফর্ম ১০ মিনিট করে এক সপ্তাহ স্ক্রল করা হয়। তদন্তে দেখা যায়, টিকটক ও ইউটিউবে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসব কিশোর প্রোফাইলগুলোতে ‘উদ্বেগজনক’ কনটেন্ট দেখা গিয়েছিল। এমনকি এক প্রোফাইল ইনস্টাগ্রামে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কনটেন্টেও চলে এসেছে।
অফকমের নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পর একই গবেষণা আবার করা হয় এবং এবার ফলাফল মর্নিং লাইভ উপস্থাপক জারা ম্যাকডারমটকে দেখানো হয়।
টিকটকে ‘উদ্বেগজনক’ কনটেন্টের ঝুঁকি: এইবারের গবেষণায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে, বিশেষ করে ইনস্টাগ্রামে। এবার প্ল্যাটফর্মটিতে কোনো ক্ষতিকর কনটেন্ট পাওয়া যায়নি। বর্তমানে ইনস্টাগ্রামের টিন অ্যাকাউন্টগুলোকে পিজি-১৩ মুভির রেটিং অনুযায়ী পরিচালনা করা হয় যাতে অপ্রাপ্তবয়স্করা ঝুঁকিপূর্ণ কনটেন্ট থেকে সুরক্ষিত থাকে। তবে টিকটকের পরিস্থিতি ভিন্ন। ‘মায়া’ নামে ১৫ বছরের মেয়ের প্রোফাইলে এখনো খুব দ্রুতই বুলিয়িং, আত্মহত্যা করা কিশোরদের গল্প, মরণাপন্ন মানুষ, এবং পুরুষের সহিংসতায় নারী ও শিশুর নির্যাতনের মতো কনটেন্টে পৌঁছে গেছে।
এক-দুটি পোস্ট হয়ত নজর এড়িয়ে যেত কিন্তু ১০ মিনিটের অল্প সময়ের স্ক্রলে এসব পোস্টের প্রাচুর্য ভয়ানক আবহ তৈরি করেছে। ১৫ বছরের ‘সোফি’ নামের প্রোফাইলে এসবের উপস্থিতি কম দেখা গেছে আর ১৩ বছরের ‘আয়েশা’ নামের প্রোফাইলে উদ্বেগজনক কনটেন্ট খুব সামান্যই ছিল।
অদ্ভুতভাবে, ছেলেদের প্রোফাইলগুলোতে টিকটকে উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতিকর কনটেন্ট পাওয়া যায়নি। ইউটিউবেও তিনটির মধ্যে দুটি প্রোফাইল পরিষ্কার ছিল। তবে ১৫ বছরের ‘হ্যারি’ নামের প্রোফাইলটির ইউটিউব ফিডে ছুরি, বন্দুক, ক্রসবো রিভিউয়ের ভিডিও পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে এই প্রথমবার প্ল্যাটফর্মটিতে গুলিতে প্রাণী হত্যার দৃশ্যও সাজেশনে চলে এসেছে।
কনটেন্টগুলো অন্য সাধারণ ভিডিও যেমন ফুটবল বা গেইমিংয়ের মাঝখানে হঠাৎ করেই উঠে আসছিল, যেন ব্যবহারকারীর আগের আচরণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ভিডিওগুলো দেখার পর শিশু সুরক্ষা সংগঠন এনএসপিসিসির এমা মাদারওয়েল বলেন, আরো অনেক কিছু করা প্রয়োজন। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে শুরু থেকেই সেইফটি-বাই-ডিজাইন নীতির মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
টিকটক বলছে, তাদের টিন অ্যাকাউন্টে কনটেন্ট রেস্ট্রিকশন থেকে শুরু করে ৬০ মিনিট স্ক্রিন-টাইম সীমা পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি নিরাপত্তা ও প্রাইভেসি সেটিংস রয়েছে। তারা দাবি করছে, শিশু-কিশোরদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কনটেন্টের অধিকাংশই প্ল্যাটফর্ম থেকে নিষিদ্ধ এবং বড়দের উপযোগী কনটেন্ট শুধু যাচাইকরা ১৮ বছরের বেশি ব্যবহারকারীদের জন্য উন্মুক্ত।
ইউটিউবও বলেছে, তারা কিশোর ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং সম্প্রতি কনটেন্ট রেকমেন্ডেশনসহ কিশোর সুরক্ষা আরো শক্তিশালী করেছে। তবে কোম্পানিটির একজন মুখপাত্র বলেন, পরীক্ষায় ব্যবহার করা কাল্পনিক অ্যাকাউন্টের আচরণ বাস্তব ব্যবহারকারীর আচরণের সঙ্গে মিল নাও থাকতে পারে তাই একে ভিত্তি করে বড় কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন।
এনএসপিসিসির এমা মাদারওয়েল অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা, বিচারহীন আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে যাতে কোনো কনটেন্ট তাদের মানসিকভাবে প্রভাবিত করলে তারা সেটা জানাতে পারে। তিনি অভিভাবকদের প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার এবং প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট সাইট ব্লক করার পরামর্শ দেন।
কোডের ওপর ভরসা করে বসে থাকবেন না: ডেভিড রাইট সতর্ক করে বলেন, অভিভাবকদের জানতে হবে তাদের সন্তান কী ধরনের কনটেন্ট, অ্যাপ বা সার্ভিস ব্যবহার করছে। শুধু এই কোডগুলো চালু হয়েছে বলে সব ঠিক হয়ে যাবে এমন ধারণা করবেন না।
ইনস্টাগ্রামের পরিবর্তনগুলো উৎসাহজনক হলেও বিধান কার্যকর মানেই এক দিনে সব পাল্টে যাবে এমন নয়। পরিবর্তন ধীরে ধীরে আসবে। তার মতে, উন্নতির “আরো সুযোগ সবসময়ই থাকবে কারণ এটা কোনো বাইনারি বিষয় নয় এবং এখন এই আইন বাস্তবায়ন ও নজরদারির দায়িত্ব অফকমের।
সানা/আপ্র/১৫/১১/২০২৫

























