ঢাকা ০৫:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

অস্থিরতা, ঘি ও দমবন্ধ করা রাজনীতি

  • আপডেট সময় : ০৮:২৭:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

চিররঞ্জন সরকার

দেশের রাজনীতি এখন এক টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত আওয়ামী লীগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও চোরাগোপ্তা মিছিলের মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, অন্যদিকে সারা দেশে বিরাজ করছে এক ‘কী হয় কী হয়’ অবস্থা। দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা-ককটেল ফাটছে। যানবাহনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্বৃত্তরা কোথাও ধরা পড়ছে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। খোদ রাজধানীতে দিনে-দুপুরে খুনের ঘটনা ঘটছে। এই অস্থিরতার কেন্দ্রে রয়েছে জুলাই সনদ এবং গণভোট আয়োজন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন অবস্থান।

বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন এবং নির্বাচন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক দলের জোট নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে বড় মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে গণভোটের সময়কাল নিয়ে: জামায়াত বলছে নির্বাচনের আগে গণভোট, আর বিএনপি চাইছে নির্বাচনের দিনই তা আয়োজন করতে। এই আপাত-বিরোধ সত্ত্বেও, সমগ্র পরিস্থিতি যে এক গভীর সংকটের দিকে নির্দেশ করছে, তা স্পষ্ট। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ এবং আন্দোলন চলমান রয়েছে। জামায়াতসহ আটটি দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে এবং এই দাবি না মানলে ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন অদ্ভুত এবং গুরুতর মুহূর্ত অতীতে আর কখনো আসেনি। ইতিহাস যেন আজ উল্টো পথে যাত্রা করেছে। একাত্তরে যারা এই দেশের জন্মকে রক্তে রঞ্জিত করতে চেয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা যাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, আজ সেই জামায়াতে ইসলামীই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সরাসরি হুমকি দিচ্ছে। দলের এক শীর্ষ নেতা সম্প্রতি বলেছেন, তাদের ‘ঘি’ চাই। সোজা আঙুলে এই ঘি না উঠলে তারা আঙুল বাঁকা করবে।

জামায়াতের এই ‘ঘি’ হলো তাদের পাঁচ দফা দাবি: জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও নভেম্বরের মধ্যে গণভোট আয়োজন; আগামী নির্বাচনে উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি চালু করা; অবাধ নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকারের জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির দৃশ্যমান বিচার এবং ‘স্বৈরাচারের দোসর’ জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। এই দাবি মানা না হলে তারা ঢাকা শহর ‘অচল’ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এই ঘোষণায় সমাজের বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে- কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউ নীরব দর্শকের ভূমিকায়, আবার কেউবা স্বার্থের রাজনীতিতে গা ভাসিয়ে সমর্থনও দিচ্ছে।

আসলে বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক কৌতুকময় ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছে; যেখানে সত্য-মিথ্যা এবং অধিকারের সংজ্ঞা ওলটপালট। যারা একদিন ছিল নিষিদ্ধ, তারা এখন দেশের ভবিষ্যৎ ঠিক করার পরামর্শদাতা। যারা একাত্তরে বাঙালির অস্তিত্ব মুছে দিতে চেয়েছিল, তারা এখন মুক্তির গান শোনাচ্ছে জাতিকে। এই রাজনৈতিক কৌতুক হয়তো পৃথিবীর অন্য কোনো ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া ভার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু একটি জীবন নয়, একটি চেতনাকেও হত্যা করা হয়েছিল। এরপর রাজনীতি থেকে মানবিকতার আলো নিভে যায়, খুনিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ওই সময়ই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ‘রাজনৈতিক দলের অবমুক্তি’ নীতির সুযোগে পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে আসে এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। জিয়ার এই উদারতা পরবর্তী সময়ে জামায়াতকে শক্তিশালী করে তোলে এবং বিএনপি’র সঙ্গে জোট বেঁধে তারা ক্ষমতারও অংশীদার হয়। যে পতাকা একাত্তরে পোড়াতে চেয়েছিল, সেই পতাকা নিজামী-মুজাহিদদের গাড়িতে মন্ত্রী পরিচয়ে শোভা পায়— বাংলাদেশের ইতিহাসের এর চেয়ে বড় আত্মবিরোধ আর কী হতে পারে?

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ইতিহাসও এক বিস্ময়কর যাত্রা। স্বাধীনতা এনে দেওয়া এই দলটি ১৯৭৫-এর পর হয়ে যায় রাষ্ট্রের ‘অপছন্দের’ নাম। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করে। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় মনে হচ্ছিল, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতির কবর খোঁড়া হয়ে গেছে। কিন্তু রাজনীতি কখনো কেবল কবর খোঁড়ে না, কখনো কখনো মৃতদেরও জীবিত করে তোলে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির মানচিত্র পুরোপুরি উল্টে যায়। ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে হঠাৎ নিষিদ্ধ করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারকাজ শেষ হয়ে রায় না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর সকল সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম ও অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয় এবং রাজনৈতিক দলটির নিবন্ধন স্থগিত করা হয়। আর এই ‘নিষিদ্ধ’করণের পর দেশে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় জামায়াতে ইসলামী।

যে দল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়ে বাঙালি হত্যা করেছিল, দীর্ঘ প্রায় ৫৪ বছর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করেছে তারাই এখন নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করছে। প্রকান্তরে তাদের সিদ্ধান্তই সরকারের মাধ্যমে কার্যকর হচ্ছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যারা এই মাটিকে স্বাধীন করেছিল, তাদের উত্তরাধিকারীরা আজ নিজেদের রক্ষা করতে লড়ছে সেই শক্তির বিরুদ্ধে- যাদের পরাজিত করেই দেশটি স্বাধীন হয়েছিল।

২০২৪-এর আগস্টের পর জামায়াতই এখন দেশের সবচেয়ে সংহত রাজনৈতিক শক্তি। তারা আর আড়ালে নেই; তারা রাজপথে, শিক্ষাঙ্গনে, প্রশাসনে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের লক্ষ্য এখন একটাই—ক্ষমতা দখল। তারা জানে, এটা তাদের “নাও অর নেভার” মুহূর্ত। জামায়াত নেতার “সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে, আঙুল বাঁকা করব—কিন্তু ঘি আমাদের চাইই,” এমন উক্তি শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, এক ভয়াবহ আগ্রাসনের প্রতীক।

অন্যদিকে বিএনপি এখন পুরোপুরি ব্যাকফুটে। এক সময় জামায়াতকে যারা ব্যবহার করত, আজ সেই দলই জামায়াতের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা জানে, একা কিছু করা সম্ভব নয়—জামায়াতের শক্তিই এখন তাদের একমাত্র লাইফলাইন। রাজনীতির এই অদ্ভুত পরিহাসে, যে দল জামায়াতকে হাতিয়ার বানিয়েছিল, আজ সেই হাতিয়ারই তাদের গলায় ফাঁস হয়ে ফিরে এসেছে। এটা কেবল রাজনৈতিক আত্মসমর্পণ নয়—এটা ইতিহাসের প্রতি এক আত্মঘাতী বিশ্বাসঘাতকতা।

আজ বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক গিরিখাতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে- যেখান থেকে নিচে পড়লে হয়তো আর ফেরা সম্ভব হবে না। যদি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। স্কুল পাঠ্যবইয়ে হয়তো দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে। মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো আদালতে নিজেদের ‘দোষ’ প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকবে। এই আশঙ্কা কল্পনা নয়, ইতিহাসে এর উদাহরণ আছে। যে নাৎসি দল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিলুপ্ত হয়েছিল, তারাও আজ জার্মানির নির্বাচনে ভোট পায়। যে তালেবান এক সময় নিষিদ্ধ ছিল, তারা আজ আফগানিস্তানের সরকার চালায়। আমাদের দেশেও তেমন কিছু দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

আসলে বাংলাদেশ বর্তমানে এক ঘোরতর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। আমরা যদি এখনও বিরোধ-বিসংবাদ মিটিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারি, তাহলে অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। এখনও সময় আছে। ইতিহাস যখন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে কীভাবে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, তখন সেই স্মৃতি আমাদের নির্দেশ করে—স্বাধীনতার মূল্য রক্ষায় আমরা কখনই আপস করতে পারি না।

রাজনীতির মঞ্চে যদি হিংসা, ভয়ের রাজনীতি ও স্বৈরাচারী প্রবণতা শক্তিশালী হয়ে ওঠে—তাহলে সেই সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকারমুখী হবে। আমরা যদি সত্যিকারভাবে স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধ থাকি, তবে আজকের বিভ্রান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার একমাত্র পথ হলো—আইনের শাসনের আলোকে পরিচালিত হওয়া, দলীয় স্বার্থ ভুলে দেশের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, সব রাজনৈতিক শক্তিকে সংলাপে নিয়ে এসে সমস্যার শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক সমাধান বের করা।

ঘি যদি রাজনীতির মাপদণ্ড হয়, তাহলে সেটি একদিন পুরো দেশের স্বপ্নকে পোড়াবে। আর ওই আগুন অবশ্যই কেউ জ্বালাতে দেবেন না। আমাদের অভীষ্ট হওয়া উচিত—একটি স্বাভাবিক, নিরাপদ ও ন্যায়নিষ্ঠ বাংলাদেশ- যেখানে ইতিহাস সম্মানিত হয়, অপরাধীর বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজের দেশকে গর্বের সঙ্গে বলতে পারে—আমাদের দেশ স্বাধীন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

অস্থিরতা, ঘি ও দমবন্ধ করা রাজনীতি

আপডেট সময় : ০৮:২৭:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫

চিররঞ্জন সরকার

দেশের রাজনীতি এখন এক টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত আওয়ামী লীগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও চোরাগোপ্তা মিছিলের মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, অন্যদিকে সারা দেশে বিরাজ করছে এক ‘কী হয় কী হয়’ অবস্থা। দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা-ককটেল ফাটছে। যানবাহনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্বৃত্তরা কোথাও ধরা পড়ছে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। খোদ রাজধানীতে দিনে-দুপুরে খুনের ঘটনা ঘটছে। এই অস্থিরতার কেন্দ্রে রয়েছে জুলাই সনদ এবং গণভোট আয়োজন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন অবস্থান।

বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন এবং নির্বাচন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক দলের জোট নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে বড় মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে গণভোটের সময়কাল নিয়ে: জামায়াত বলছে নির্বাচনের আগে গণভোট, আর বিএনপি চাইছে নির্বাচনের দিনই তা আয়োজন করতে। এই আপাত-বিরোধ সত্ত্বেও, সমগ্র পরিস্থিতি যে এক গভীর সংকটের দিকে নির্দেশ করছে, তা স্পষ্ট। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ এবং আন্দোলন চলমান রয়েছে। জামায়াতসহ আটটি দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে এবং এই দাবি না মানলে ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন অদ্ভুত এবং গুরুতর মুহূর্ত অতীতে আর কখনো আসেনি। ইতিহাস যেন আজ উল্টো পথে যাত্রা করেছে। একাত্তরে যারা এই দেশের জন্মকে রক্তে রঞ্জিত করতে চেয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা যাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, আজ সেই জামায়াতে ইসলামীই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সরাসরি হুমকি দিচ্ছে। দলের এক শীর্ষ নেতা সম্প্রতি বলেছেন, তাদের ‘ঘি’ চাই। সোজা আঙুলে এই ঘি না উঠলে তারা আঙুল বাঁকা করবে।

জামায়াতের এই ‘ঘি’ হলো তাদের পাঁচ দফা দাবি: জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও নভেম্বরের মধ্যে গণভোট আয়োজন; আগামী নির্বাচনে উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি চালু করা; অবাধ নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকারের জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির দৃশ্যমান বিচার এবং ‘স্বৈরাচারের দোসর’ জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। এই দাবি মানা না হলে তারা ঢাকা শহর ‘অচল’ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এই ঘোষণায় সমাজের বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে- কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউ নীরব দর্শকের ভূমিকায়, আবার কেউবা স্বার্থের রাজনীতিতে গা ভাসিয়ে সমর্থনও দিচ্ছে।

আসলে বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক কৌতুকময় ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছে; যেখানে সত্য-মিথ্যা এবং অধিকারের সংজ্ঞা ওলটপালট। যারা একদিন ছিল নিষিদ্ধ, তারা এখন দেশের ভবিষ্যৎ ঠিক করার পরামর্শদাতা। যারা একাত্তরে বাঙালির অস্তিত্ব মুছে দিতে চেয়েছিল, তারা এখন মুক্তির গান শোনাচ্ছে জাতিকে। এই রাজনৈতিক কৌতুক হয়তো পৃথিবীর অন্য কোনো ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া ভার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু একটি জীবন নয়, একটি চেতনাকেও হত্যা করা হয়েছিল। এরপর রাজনীতি থেকে মানবিকতার আলো নিভে যায়, খুনিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ওই সময়ই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ‘রাজনৈতিক দলের অবমুক্তি’ নীতির সুযোগে পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে আসে এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। জিয়ার এই উদারতা পরবর্তী সময়ে জামায়াতকে শক্তিশালী করে তোলে এবং বিএনপি’র সঙ্গে জোট বেঁধে তারা ক্ষমতারও অংশীদার হয়। যে পতাকা একাত্তরে পোড়াতে চেয়েছিল, সেই পতাকা নিজামী-মুজাহিদদের গাড়িতে মন্ত্রী পরিচয়ে শোভা পায়— বাংলাদেশের ইতিহাসের এর চেয়ে বড় আত্মবিরোধ আর কী হতে পারে?

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ইতিহাসও এক বিস্ময়কর যাত্রা। স্বাধীনতা এনে দেওয়া এই দলটি ১৯৭৫-এর পর হয়ে যায় রাষ্ট্রের ‘অপছন্দের’ নাম। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করে। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় মনে হচ্ছিল, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতির কবর খোঁড়া হয়ে গেছে। কিন্তু রাজনীতি কখনো কেবল কবর খোঁড়ে না, কখনো কখনো মৃতদেরও জীবিত করে তোলে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির মানচিত্র পুরোপুরি উল্টে যায়। ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে হঠাৎ নিষিদ্ধ করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারকাজ শেষ হয়ে রায় না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর সকল সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম ও অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয় এবং রাজনৈতিক দলটির নিবন্ধন স্থগিত করা হয়। আর এই ‘নিষিদ্ধ’করণের পর দেশে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় জামায়াতে ইসলামী।

যে দল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়ে বাঙালি হত্যা করেছিল, দীর্ঘ প্রায় ৫৪ বছর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করেছে তারাই এখন নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করছে। প্রকান্তরে তাদের সিদ্ধান্তই সরকারের মাধ্যমে কার্যকর হচ্ছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যারা এই মাটিকে স্বাধীন করেছিল, তাদের উত্তরাধিকারীরা আজ নিজেদের রক্ষা করতে লড়ছে সেই শক্তির বিরুদ্ধে- যাদের পরাজিত করেই দেশটি স্বাধীন হয়েছিল।

২০২৪-এর আগস্টের পর জামায়াতই এখন দেশের সবচেয়ে সংহত রাজনৈতিক শক্তি। তারা আর আড়ালে নেই; তারা রাজপথে, শিক্ষাঙ্গনে, প্রশাসনে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের লক্ষ্য এখন একটাই—ক্ষমতা দখল। তারা জানে, এটা তাদের “নাও অর নেভার” মুহূর্ত। জামায়াত নেতার “সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে, আঙুল বাঁকা করব—কিন্তু ঘি আমাদের চাইই,” এমন উক্তি শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, এক ভয়াবহ আগ্রাসনের প্রতীক।

অন্যদিকে বিএনপি এখন পুরোপুরি ব্যাকফুটে। এক সময় জামায়াতকে যারা ব্যবহার করত, আজ সেই দলই জামায়াতের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা জানে, একা কিছু করা সম্ভব নয়—জামায়াতের শক্তিই এখন তাদের একমাত্র লাইফলাইন। রাজনীতির এই অদ্ভুত পরিহাসে, যে দল জামায়াতকে হাতিয়ার বানিয়েছিল, আজ সেই হাতিয়ারই তাদের গলায় ফাঁস হয়ে ফিরে এসেছে। এটা কেবল রাজনৈতিক আত্মসমর্পণ নয়—এটা ইতিহাসের প্রতি এক আত্মঘাতী বিশ্বাসঘাতকতা।

আজ বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক গিরিখাতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে- যেখান থেকে নিচে পড়লে হয়তো আর ফেরা সম্ভব হবে না। যদি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। স্কুল পাঠ্যবইয়ে হয়তো দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে। মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো আদালতে নিজেদের ‘দোষ’ প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকবে। এই আশঙ্কা কল্পনা নয়, ইতিহাসে এর উদাহরণ আছে। যে নাৎসি দল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিলুপ্ত হয়েছিল, তারাও আজ জার্মানির নির্বাচনে ভোট পায়। যে তালেবান এক সময় নিষিদ্ধ ছিল, তারা আজ আফগানিস্তানের সরকার চালায়। আমাদের দেশেও তেমন কিছু দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

আসলে বাংলাদেশ বর্তমানে এক ঘোরতর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। আমরা যদি এখনও বিরোধ-বিসংবাদ মিটিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারি, তাহলে অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। এখনও সময় আছে। ইতিহাস যখন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে কীভাবে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, তখন সেই স্মৃতি আমাদের নির্দেশ করে—স্বাধীনতার মূল্য রক্ষায় আমরা কখনই আপস করতে পারি না।

রাজনীতির মঞ্চে যদি হিংসা, ভয়ের রাজনীতি ও স্বৈরাচারী প্রবণতা শক্তিশালী হয়ে ওঠে—তাহলে সেই সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকারমুখী হবে। আমরা যদি সত্যিকারভাবে স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধ থাকি, তবে আজকের বিভ্রান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার একমাত্র পথ হলো—আইনের শাসনের আলোকে পরিচালিত হওয়া, দলীয় স্বার্থ ভুলে দেশের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, সব রাজনৈতিক শক্তিকে সংলাপে নিয়ে এসে সমস্যার শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক সমাধান বের করা।

ঘি যদি রাজনীতির মাপদণ্ড হয়, তাহলে সেটি একদিন পুরো দেশের স্বপ্নকে পোড়াবে। আর ওই আগুন অবশ্যই কেউ জ্বালাতে দেবেন না। আমাদের অভীষ্ট হওয়া উচিত—একটি স্বাভাবিক, নিরাপদ ও ন্যায়নিষ্ঠ বাংলাদেশ- যেখানে ইতিহাস সম্মানিত হয়, অপরাধীর বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজের দেশকে গর্বের সঙ্গে বলতে পারে—আমাদের দেশ স্বাধীন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ