শান্তা মারিয়া
এক লোক ঠিক করেছে সে আজ মানুষের উপকারে কিছু না কিছু করবে। এই মহৎ লক্ষ্য নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তার সামনে গেছে। দেখে রাস্তার সামনে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। ওই লোক মনে করলেন এই ভদ্রমহিলাকে রাস্তা পার করিয়ে দিই। তাহলে ওর উপকার করা হবে। তিনি এগিয়ে গিয়ে জোর করে মহিলাকে ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিতে গেলেন।
ওই নারী চমকে গেলেন। আত্মরক্ষার তাগিদে লোককে মারলেন এক চড়। দুজনকে ঘিরে বেশ একটা ভিড় জমে উঠলো। লোকটি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ভাইসব, আমার দোষ নেই। আমি আন্টির উপকার করতে চেয়েছিলাম। ওকে রাস্তা পার করাতে চেয়েছি। ওই নারী তখন বললেন, আমি কি আপনার কাছে উপকার চেয়েছি? আমার তো এখন রাস্তার ওপারে যাবার দরকার নেই। আপনি জোর করে আমাকে রাস্তার ওপারে নিতে চাইবেন কেন?
গল্পটি মনে পড়লো সম্প্রতি। ফেসবুকে অনেকের টাইমলাইনে ঘুরছে একজন প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তির বক্তব্য। তিনি নাকি বলেছেন, নারীদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে পাঁচ ঘণ্টা করবেন। আবার আরেক জায়গায় দেখলাম, তিনি বলেছেন, নারীরা ঘরে বসে থাকলে সরকার সম্মাননা দেবে। এসব কথা যদি ওই ব্যক্তি সত্যিই বলে থাকেন তাহলে বলতে চাই, নারীরা কি আপনার কাছে বলেছে যে কর্মঘণ্টা কমাতে হবে, কিংবা তারা কি ঘরে বসে থাকতে চেয়েছে? আপনার কাছে কি তারা ফরিয়াদ করেছে যে, তারা কাজ করতে চায় না, বসে বসে খেতে চায়?
নারীকে অবরুদ্ধ করার জন্য আর কত ফন্দি-ফিকির করবেন বলুন তো? কর্মঘণ্টা কমানো, ঘরে সময় দিলে সম্মাননা। এসব লাগবে না। বরং নারীর কর্মপরিবেশ নিরাপদ করুন। নারীকে যেন কর্মস্থলে হয়রানির সম্মুখীন হতে না হয় সেই বিষয়ে চিন্তা করুন। যদি ক্ষমতায় যেতে চান, এবং ক্ষমতায় যেতে পারেন, তাহলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কি ব্যবস্থা নেবেন সেই পরিকল্পনা ঘোষণা করুন। প্রতিটি অফিসে এবং প্রতিটি লোকালিটিতে ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের ব্যবস্থা করার কথা ভাবুন। যেন, কর্মজীবী নারী নিশ্চিন্তে তার শিশুসন্তানকে সেখানে রেখে কাজে যেতে পারেন।
জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান যেন আরো বাড়তে পারে, এ বিষয়ে ভাবুন। ঘরে বসে সময় কাটানোর জন্য, সবার লাথি-গুঁতা খাওয়ার জন্য আর হাড়ভাঙা গৃহস্থালি শ্রম করার জন্য কেবল নারীর জন্ম হয়নি। জাতীয় উন্নয়নে নারী যেন আরো বেশি অবদান রাখতে পারেন, উপার্জিত অর্থে উন্নত জীবনমান অর্জন করতে পারেন- এদিকে পরিকল্পনা করুন। নারীকে ঘরে বসিয়ে ‘সম্মান’ দেওয়ার চিন্তা করতে হবে না; বরং নারী যেন বিজ্ঞান, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশাসন, ক্রীড়াঙ্গন, শিল্প-সাহিত্যে, বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতায় এগিয়ে যেতে পারেন ও সম্মান অর্জন করতে পারেন- এদিকে যথাসাধ্য সহায়তা করা যায় কীভাবে; সেটি ভাবুন।
বড় আসছেন, নারীদের ঘরে বসিয়ে রাখতে। মনে রাখবেন, জুলাই বিপ্লবে নারীরা ঘরে বসে থাকলে এই বিপ্লব সফল হতো না। নারীরা সবাই বেরিয়ে এসেছিল বলেই আজ স্বৈরাচার লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। মাথার ভিতর থেকে সামন্ততান্ত্রিক ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বিশ্ব কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে তাকান।
চীনের আজকের এই অভাবিত উন্নয়নের পেছনে আছে নারী-পুরুষ সবার শ্রম। ‘চীনের অর্ধেক আকাশ ধরে রেখেছে নারীরা।’ চীনের মহান বিপ্লবের পর নারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, রান্নাঘর থেকে মুক্ত হয়ে, শিল্প কারখানায়, কৃষিক্ষেত্রে পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে শ্রম দিয়েছিল বলেই তাদের অর্থনীতি এভাবে এগিয়ে গেছে। চীনে নারী উদ্যোক্তা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। নারী-পুরুষের শ্রমই দেশটাকে এগিয়ে নিয়েছে, আজকের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ বলতে গেলে, পুরুষশূন্য হয়ে গিয়েছিল। নারীদের শ্রমেই আধুনিক ইউরোপের এত রোশনাই। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প এগিয়েছে নারী শ্রমিকদের শ্রমেই। আধুনিক বিশ্বের শিল্প বিপ্লবে নারী পুরুষ শ্রমিক সবাই কৃতিত্বের দাবিদার। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ঘরে বসিয়ে রাখার চিন্তা যে করে তার কাছ থেকে আর যাই হোক অর্থনৈতিক উন্নয়নের আশা করা যায় না।
কথা বলবেন, ভালো কথা। বুঝে শুনে কথা বলুন। মানুষ আজকাল আর এত বোকা নয় যে, যা বলবেন- সেটিই গিলবে। যেসব গণ্ডমূর্খ নারীদের ঘরে বসিয়ে রাখার চিন্তাকে খুব আরামদায়ক বলে মনে করে, তাদের একটি কথা বলতে চাই।
চিন্তা করুন তো, আজ যদি সব নারী (ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব খাতের কথা বলছি) ঘরে বসে থাকে তাহলে দেশের অর্থনীতি এক মুহূর্তে যখন কলাপস করবে তখন আপনার পরিবারের নারীদের বসিয়ে রাখার মতো বাড়িটুকু থাকবে কি না। তখন তাদের খাওয়ানোর মতো আপনার অবস্থা থাকবে কি না; বরং নারীরা যেন সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরো অবদান রাখতে পারে, এ জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রকে নারীবান্ধব করুন। নারীদের নিরাপত্তা ঘরে বাইরে সব জায়গায় নিশ্চিত করুন। তাহলে আপনার ঘরের নারীও নিরাপদে থাকবে, সম্মানের সঙ্গে থাকবে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ






















