ঢাকা ০৮:০৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

সংগীত ও শরীরচর্চা ছাড়া আর কী কী বন্ধ করা যায়

  • আপডেট সময় : ০৬:০১:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
  • ২২ বার পড়া হয়েছে

এ আই জেনারেটেড ছবি

  • আলমগীর খান

প্রথমিক শিক্ষা থেকে সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষকের পদ বাতিল করে দেওয়াটা এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ‘যুগান্তকার’—হায়, কী মহৎ শব্দ, যা এক যুগের পরিবর্তন করে আরেক ভিন্ন যুগের সূচনা করে। এই সিদ্ধান্তটিও এক নতুন যুগের সূচনার ইঙ্গিত বহন করছে। সামনের দিকে বা পেছনের দিকে, ওপরে বা নিচের দিকে যাই হোক— তারচেয়ে বড় কথা এক বড় যুগপরিবর্তনের প্রান্তে আমরা অবস্থান করছি। এখন লাফ দিয়ে পড়বার অপেক্ষায় শুধু। একদিক থেকে না একদিক থেকে আমাদের জাতীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ থাকতেই হবে, সামনের দিক থেকে না পারি, পেছন দিক থেকে হলেও আমরা প্রথম কাতারে থাকবই। আমাদের শিশুরা যদি বিশ্বের অন্যদেরকে গান গেয়ে হারাতে না পারে, তবে চুপ থেকে হারাবে সেই বা কম কীসে! অন্য বিষয়গুলোতেও আমরা একই কৌশল অবলম্বন করে বিশ্বে এক চমক সৃষ্টি করতে পারি কি না তা ভেবে দেখা যায়। এমনও হতে পারে, আমাদের এক বিরাট প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে যেখানে ব্যবস্থার ঠেলায় শিক্ষার প্রাণ হবে যায় যায়!

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক ও শরীরচর্চা শিক্ষক অবশ্যই একটা বড় সমস্যা তৈরি করেছে এতকাল। ওই সমস্যাটা কী? তা হলো, সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি ও যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা সব ছেলেমেয়েকে এই শিক্ষা দিতে পারছেন কি না তা নিশ্চিত করা যায়নি। এর একমাত্র যুক্তিসঙ্গত সমাধান হলো ধীরে বা দ্রুত যেভাবেই হোক সব স্কুলে এই দুই বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ। সমস্যা তবু থেকেই যাবে হয়তো। আমাদের স্কুলগুলোয় বাংলা, ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলোর শিক্ষক আছেন, কিন্তু স্কুলের ছেলেমেয়েরা কি এগুলো ভালভাবে শিখতে পারছে? বেশিরভাগ স্কুলেই তা পারছে না। শেখানোর ক্ষেত্রে স্কুলগুলোর ব্যর্থতা চরমভাবে প্রকাশিত হয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাইভেট টিউশন, কোচিং, নোট ও গাইড বইয়ের একচ্ছত্র আধিপত্যে। এতে কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থাটা মোটেও রসাতলে যায়নি, এসব বরং ঠেকনা দিয়ে ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রেখেছে বলে ধন্যবাদই পাওযার যোগ্য। এর একমাত্র সমালোচনা হচ্ছে ঠেকনাটাকেই মূল কাঠামো হিসেবে চালানো যায় না, উচিতও না। এই বিপুল ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভাগ্যিস গণিত, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়গুলো কেউ উঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন না। কেননা প্রয়োজন এসব বিষয়ে ভালো শিক্ষক নিয়োগ ও ক্লাসে তাদের ভালো পাঠদান নিশ্চিতকরণ। সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষায়ও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।

তবে যারা মনে করছেন যে, প্রাথমিক থেকে সংগীত ও শরীরচর্চা কিংবা অন্য কোনো শিক্ষা নামক পদার্থ তুলে দিলেই জাতির বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে, তাদের জন্য করুণা প্রকাশ ছাড়া আর কিইবা করতে পারি। তারা এইচ জি ওয়েলসের অন্ধদের দেশ নিয়ে গল্পটা পড়ে দেখতে পারেন। সে দেশে বংশ পরম্পরায় বিবর্তনের এক প্রক্রিয়ায় সকলেই অন্ধ। সেখানে এক চক্ষুষ্মান নায়ক যেরকম হেস্তনেস্ত হয়েছে তা থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। অন্ধদের দেশের লোকজন দৃষ্টিশক্তি হারালেও তারা এর কোনো অভাব অনুভব করেনি কারণ তাদের ঘ্রাণ, শব্দ, স্পর্শ ইত্যাদি অন্যান্য অনুভবের ইন্দ্রিয় এত বিকশিত হয়েছে যে, চক্ষুষ্মান নায়কটিই বরং সেদেশে বিপদে পড়তে থাকে ও নাস্তানাবুদ হয়। মোদ্দা কথা, সকলেই অন্ধ হওয়ার কারণে ওই জাতির কোনো ক্ষতি তো হয়ইনি, বরং তারা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছে যা চক্ষুষ্মানদের নেই।

সংগীত, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, গণিত ইত্যাদি একরকম ভাষা বা চোখও বলা যায়। মানুষ কথা বলতে পারলেই চলে না, তার ভাষাকে বিভিন্নরকম জ্ঞানের বাহন করে তোলার জন্য তাকে চর্চা ও বিকশিত করতে হয়। যদি তা না হয়, তবে সে ভাষাভাষী মানুষ চিন্তায় ও কর্মে বিশ্বে পিছিয়ে পড়ে এবং একসময় টিকে থাকার শক্তিও হারিয়ে ফেলতে পারে। সংগীত, নৃত্য, চিত্রাঙ্কনও মানুষকে ভাষাসমৃদ্ধ করে, অনেকটা চক্ষুষ্মান করে তোলার মতো। চর্মচক্ষুর বাইরে আর কোনো বাড়তি চোখ না থাকলে জীবজগতে আমাদের তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। কিন্তু মনুষ্যজগতে আমাদের এগিয়ে যাওয়া কঠিন। এইসব ভাষা শিক্ষা তাই অতি জরুরি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে এখন এক শ্রেণির মানুষের আধিপত্য অধিক যারা মনে করেন জৈবিক চক্ষু নষ্ট করে কৃত্রিম চক্ষুতেই বেশি সুন্দর দেখায় ও অর্থনৈতিকভাবেও ফায়দা বেশি। তারা তাই মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে বিদেশি ভাষা ব্যবহারে বেশি উৎসাহী। যেমন এখনও অনেক পরিবারে বাবা-মা মনে করেন যে, মায়ের বুকের দুধের চেয়ে বিদেশি কোম্পানির কেনা দুধেই বেশি পুষ্টি ও তা আভিজাত্যের সূচকও। বিদেশি দুধের কোম্পানি তুলে দেবার প্রয়োজন নেই। থাকুক। কিন্তু এখন তো বিজ্ঞান জোরের সঙ্গে বলছে, শিশুকালে মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই।

অথচ ইংরেজি ভাষাটা আমাদের কাছে এখন বিদেশি কৌটার দুধের মতো বেশি আদরণীয়। কিংবা মাতৃভাষা যদি চোখ হয়, তবে দেখা যায়, আমাদের কাছে চোখের চেয়ে চশমার কদরই বেশি কারণ তা পরলে যেমন স্মার্ট দেখায় আবার চোখের কালিটাও ঢেকে রাখা যায়। ওই কারণে বিশ্বব্যাপী অনেক মনীষী প্রাথমিকের আগে আর কোনো ভাষা শেখার প্রয়োজন নাই বললেও, আমরা জন্মের পরপরই শিশুকে বিদেশি ভাষায় পারদর্শী করে তুলতে সচেষ্ট। আমরা যারপরনাই খুশি হতাম যদি মাতৃগর্ভেই সন্তানকে ইংরেজি শিখিয়ে দিতে পারতাম ও সে চশমা পরেই ভূমিষ্ঠ হতো, তার প্রতিভা দেখে আমরা বলতে পারতাম, সন্তান বিশ্বে আমাদের মুখ কী উজ্জ্বল করেছে! বিশ্বব্যাপী লোকজনের হাসাহাসিকে আমরা বাহবা হিসেবে ধরে নিলেই হয়। ইংরেজি ভাষা শেখানোর এই জাতীয় দৌড় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সংগীত একটা উটকো ঝামেলাই বটে, বাংলাও যেমন!

যারা সংগীতকে শিশুজীবন থেকে বিদায়ের এই মহাপরিকল্পনা ফাঁদলেন তাদের ইংরেজি ভাষা শেখার চেষ্টা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কারণ তারা জানেন ইংরেজি ভাষাটা ইহকালের সুখসমৃদ্ধির দরজা খুলে দেয়। পরকালীন জীবনে এই ভাষার এক পয়সার দাম না থাকলেও ইহকালে এর মূল্য সর্বাধিক। তাই পরকাল ও ইহকাল দুই কালেরই সুখসমৃদ্ধি তাদের চাই। তাদের এই দূরদর্শিতা খুবই প্রতিভাময় ও বিস্ময়কর। মানুষের মাঝে যারা দুই কালেরই সাফল্য হিসাব করতে ও ছিনিয়ে নিতে পারেন তারা মনুষ্যজাতির ক্লাসরুমে যে ফার্স্টবয় বা দূরদর্শিতম এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা আমার কাছে বিশ্বে সবচেয়ে বড় বিস্ময়! দুই কূল রক্ষা করে বা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলবার সক্ষমতা যাদের আছে তাদের প্রতিভার কাছে আর সবাই নস্যি! সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষা যদি আমাদের ছেলেমেয়েদের দুই কূল রক্ষা করে চলবার শিক্ষায় কোনো বাধা তৈরি করে তবে তা বাদ দিয়ে দেওয়াটা একটা জরুরি সিদ্ধান্ত বৈ কি!

তবে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলবার জিমন্যাস্টিক দক্ষতা উচ্চ বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হলেও এটি মনুষ্যত্বের উল্লেখযোগ্য সাধনা নয়। দেখবার, অনুভব করবার, কল্পনা করবার শক্তির বিকাশ সাধনই শিক্ষা। সেক্ষেত্রে সংগীত ও গণিতের অবস্থান এক কাতারে— বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন প্রমুখ এমনটাই মনে করেছেন এবং এ বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। উন্নত দুনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় সংগীত চর্চার ব্যবস্থা করা হয় শিশুদের গাণিতিক জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মালয়েশিয়ার অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে’তে ২০২৩ সালে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল: ওয়ান্ট টু বি বেটার অ্যাট ম্যাথমেটিক্স? ট্রাই টেকিং আপ মিউজিক। এ সংবাদে তুরস্কের একজন গবেষকের ‘এডুকেশন স্টাডিজ’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। ওই গবেষণায় বিশ্বব্যাপী ৭৮ হাজার তরুণ শিক্ষার্থীর ওপর ৫০ বছরে পরিচালিত ৫৫টি স্টাডির ফলাফল থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়, সংগীত শিক্ষা ছেলেমেয়েদের গণিত শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়।

বর্তমান সরকার পণ্ডিত ও পশ্চিমের শিক্ষাব্যবস্থার আবহাওয়ায় বড় হওয়া বা ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতিদের পশ্চিমি কায়দায় বড় করা মাথাওয়ালা দিয়ে ভরপুর। এসব তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভালো জানেন। ভালো জানেন বলেই তারা নিজেরা যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা পাকাপোক্ত করছেন তা থেকে নিজেদের উত্তরসূরিদের কয়েক হাজার মাইল দূরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এমন শিক্ষাব্যবস্থাই চাই যা ঠিক বা সংস্কার করার জন্য আবার ভবিষ্যতে তাদের নাতিপুতিরাও আসতে পারেন এবং বংশ পরম্পরায় তারা জাতির উপকার করে যেতে পারেন। সংস্কারের বন্যায় দেশ ভেসে যাচ্ছে। সরকারে থাকা সবাই পরিবার-পরিজনসহ প্রয়োজনীয় সেবা কেবল তাদের হাতে গড়া হাসপাতাল ও স্কুল-কলেজ থেকে নিতে বাধ্য থাকবেন—এই একটা সংস্কার করা গেলেই আমরা আমজনতা বর্তে যেতাম।
লেখক: কলামিস্ট

সানা/আপ্র/১১/১১/২০২৫

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

সংগীত ও শরীরচর্চা ছাড়া আর কী কী বন্ধ করা যায়

আপডেট সময় : ০৬:০১:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
  • আলমগীর খান

প্রথমিক শিক্ষা থেকে সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষকের পদ বাতিল করে দেওয়াটা এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ‘যুগান্তকার’—হায়, কী মহৎ শব্দ, যা এক যুগের পরিবর্তন করে আরেক ভিন্ন যুগের সূচনা করে। এই সিদ্ধান্তটিও এক নতুন যুগের সূচনার ইঙ্গিত বহন করছে। সামনের দিকে বা পেছনের দিকে, ওপরে বা নিচের দিকে যাই হোক— তারচেয়ে বড় কথা এক বড় যুগপরিবর্তনের প্রান্তে আমরা অবস্থান করছি। এখন লাফ দিয়ে পড়বার অপেক্ষায় শুধু। একদিক থেকে না একদিক থেকে আমাদের জাতীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ থাকতেই হবে, সামনের দিক থেকে না পারি, পেছন দিক থেকে হলেও আমরা প্রথম কাতারে থাকবই। আমাদের শিশুরা যদি বিশ্বের অন্যদেরকে গান গেয়ে হারাতে না পারে, তবে চুপ থেকে হারাবে সেই বা কম কীসে! অন্য বিষয়গুলোতেও আমরা একই কৌশল অবলম্বন করে বিশ্বে এক চমক সৃষ্টি করতে পারি কি না তা ভেবে দেখা যায়। এমনও হতে পারে, আমাদের এক বিরাট প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে যেখানে ব্যবস্থার ঠেলায় শিক্ষার প্রাণ হবে যায় যায়!

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক ও শরীরচর্চা শিক্ষক অবশ্যই একটা বড় সমস্যা তৈরি করেছে এতকাল। ওই সমস্যাটা কী? তা হলো, সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি ও যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা সব ছেলেমেয়েকে এই শিক্ষা দিতে পারছেন কি না তা নিশ্চিত করা যায়নি। এর একমাত্র যুক্তিসঙ্গত সমাধান হলো ধীরে বা দ্রুত যেভাবেই হোক সব স্কুলে এই দুই বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ। সমস্যা তবু থেকেই যাবে হয়তো। আমাদের স্কুলগুলোয় বাংলা, ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলোর শিক্ষক আছেন, কিন্তু স্কুলের ছেলেমেয়েরা কি এগুলো ভালভাবে শিখতে পারছে? বেশিরভাগ স্কুলেই তা পারছে না। শেখানোর ক্ষেত্রে স্কুলগুলোর ব্যর্থতা চরমভাবে প্রকাশিত হয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাইভেট টিউশন, কোচিং, নোট ও গাইড বইয়ের একচ্ছত্র আধিপত্যে। এতে কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থাটা মোটেও রসাতলে যায়নি, এসব বরং ঠেকনা দিয়ে ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রেখেছে বলে ধন্যবাদই পাওযার যোগ্য। এর একমাত্র সমালোচনা হচ্ছে ঠেকনাটাকেই মূল কাঠামো হিসেবে চালানো যায় না, উচিতও না। এই বিপুল ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভাগ্যিস গণিত, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়গুলো কেউ উঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন না। কেননা প্রয়োজন এসব বিষয়ে ভালো শিক্ষক নিয়োগ ও ক্লাসে তাদের ভালো পাঠদান নিশ্চিতকরণ। সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষায়ও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।

তবে যারা মনে করছেন যে, প্রাথমিক থেকে সংগীত ও শরীরচর্চা কিংবা অন্য কোনো শিক্ষা নামক পদার্থ তুলে দিলেই জাতির বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে, তাদের জন্য করুণা প্রকাশ ছাড়া আর কিইবা করতে পারি। তারা এইচ জি ওয়েলসের অন্ধদের দেশ নিয়ে গল্পটা পড়ে দেখতে পারেন। সে দেশে বংশ পরম্পরায় বিবর্তনের এক প্রক্রিয়ায় সকলেই অন্ধ। সেখানে এক চক্ষুষ্মান নায়ক যেরকম হেস্তনেস্ত হয়েছে তা থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। অন্ধদের দেশের লোকজন দৃষ্টিশক্তি হারালেও তারা এর কোনো অভাব অনুভব করেনি কারণ তাদের ঘ্রাণ, শব্দ, স্পর্শ ইত্যাদি অন্যান্য অনুভবের ইন্দ্রিয় এত বিকশিত হয়েছে যে, চক্ষুষ্মান নায়কটিই বরং সেদেশে বিপদে পড়তে থাকে ও নাস্তানাবুদ হয়। মোদ্দা কথা, সকলেই অন্ধ হওয়ার কারণে ওই জাতির কোনো ক্ষতি তো হয়ইনি, বরং তারা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছে যা চক্ষুষ্মানদের নেই।

সংগীত, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, গণিত ইত্যাদি একরকম ভাষা বা চোখও বলা যায়। মানুষ কথা বলতে পারলেই চলে না, তার ভাষাকে বিভিন্নরকম জ্ঞানের বাহন করে তোলার জন্য তাকে চর্চা ও বিকশিত করতে হয়। যদি তা না হয়, তবে সে ভাষাভাষী মানুষ চিন্তায় ও কর্মে বিশ্বে পিছিয়ে পড়ে এবং একসময় টিকে থাকার শক্তিও হারিয়ে ফেলতে পারে। সংগীত, নৃত্য, চিত্রাঙ্কনও মানুষকে ভাষাসমৃদ্ধ করে, অনেকটা চক্ষুষ্মান করে তোলার মতো। চর্মচক্ষুর বাইরে আর কোনো বাড়তি চোখ না থাকলে জীবজগতে আমাদের তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। কিন্তু মনুষ্যজগতে আমাদের এগিয়ে যাওয়া কঠিন। এইসব ভাষা শিক্ষা তাই অতি জরুরি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে এখন এক শ্রেণির মানুষের আধিপত্য অধিক যারা মনে করেন জৈবিক চক্ষু নষ্ট করে কৃত্রিম চক্ষুতেই বেশি সুন্দর দেখায় ও অর্থনৈতিকভাবেও ফায়দা বেশি। তারা তাই মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে বিদেশি ভাষা ব্যবহারে বেশি উৎসাহী। যেমন এখনও অনেক পরিবারে বাবা-মা মনে করেন যে, মায়ের বুকের দুধের চেয়ে বিদেশি কোম্পানির কেনা দুধেই বেশি পুষ্টি ও তা আভিজাত্যের সূচকও। বিদেশি দুধের কোম্পানি তুলে দেবার প্রয়োজন নেই। থাকুক। কিন্তু এখন তো বিজ্ঞান জোরের সঙ্গে বলছে, শিশুকালে মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই।

অথচ ইংরেজি ভাষাটা আমাদের কাছে এখন বিদেশি কৌটার দুধের মতো বেশি আদরণীয়। কিংবা মাতৃভাষা যদি চোখ হয়, তবে দেখা যায়, আমাদের কাছে চোখের চেয়ে চশমার কদরই বেশি কারণ তা পরলে যেমন স্মার্ট দেখায় আবার চোখের কালিটাও ঢেকে রাখা যায়। ওই কারণে বিশ্বব্যাপী অনেক মনীষী প্রাথমিকের আগে আর কোনো ভাষা শেখার প্রয়োজন নাই বললেও, আমরা জন্মের পরপরই শিশুকে বিদেশি ভাষায় পারদর্শী করে তুলতে সচেষ্ট। আমরা যারপরনাই খুশি হতাম যদি মাতৃগর্ভেই সন্তানকে ইংরেজি শিখিয়ে দিতে পারতাম ও সে চশমা পরেই ভূমিষ্ঠ হতো, তার প্রতিভা দেখে আমরা বলতে পারতাম, সন্তান বিশ্বে আমাদের মুখ কী উজ্জ্বল করেছে! বিশ্বব্যাপী লোকজনের হাসাহাসিকে আমরা বাহবা হিসেবে ধরে নিলেই হয়। ইংরেজি ভাষা শেখানোর এই জাতীয় দৌড় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সংগীত একটা উটকো ঝামেলাই বটে, বাংলাও যেমন!

যারা সংগীতকে শিশুজীবন থেকে বিদায়ের এই মহাপরিকল্পনা ফাঁদলেন তাদের ইংরেজি ভাষা শেখার চেষ্টা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কারণ তারা জানেন ইংরেজি ভাষাটা ইহকালের সুখসমৃদ্ধির দরজা খুলে দেয়। পরকালীন জীবনে এই ভাষার এক পয়সার দাম না থাকলেও ইহকালে এর মূল্য সর্বাধিক। তাই পরকাল ও ইহকাল দুই কালেরই সুখসমৃদ্ধি তাদের চাই। তাদের এই দূরদর্শিতা খুবই প্রতিভাময় ও বিস্ময়কর। মানুষের মাঝে যারা দুই কালেরই সাফল্য হিসাব করতে ও ছিনিয়ে নিতে পারেন তারা মনুষ্যজাতির ক্লাসরুমে যে ফার্স্টবয় বা দূরদর্শিতম এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা আমার কাছে বিশ্বে সবচেয়ে বড় বিস্ময়! দুই কূল রক্ষা করে বা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলবার সক্ষমতা যাদের আছে তাদের প্রতিভার কাছে আর সবাই নস্যি! সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষা যদি আমাদের ছেলেমেয়েদের দুই কূল রক্ষা করে চলবার শিক্ষায় কোনো বাধা তৈরি করে তবে তা বাদ দিয়ে দেওয়াটা একটা জরুরি সিদ্ধান্ত বৈ কি!

তবে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলবার জিমন্যাস্টিক দক্ষতা উচ্চ বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হলেও এটি মনুষ্যত্বের উল্লেখযোগ্য সাধনা নয়। দেখবার, অনুভব করবার, কল্পনা করবার শক্তির বিকাশ সাধনই শিক্ষা। সেক্ষেত্রে সংগীত ও গণিতের অবস্থান এক কাতারে— বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন প্রমুখ এমনটাই মনে করেছেন এবং এ বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। উন্নত দুনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় সংগীত চর্চার ব্যবস্থা করা হয় শিশুদের গাণিতিক জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মালয়েশিয়ার অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে’তে ২০২৩ সালে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল: ওয়ান্ট টু বি বেটার অ্যাট ম্যাথমেটিক্স? ট্রাই টেকিং আপ মিউজিক। এ সংবাদে তুরস্কের একজন গবেষকের ‘এডুকেশন স্টাডিজ’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। ওই গবেষণায় বিশ্বব্যাপী ৭৮ হাজার তরুণ শিক্ষার্থীর ওপর ৫০ বছরে পরিচালিত ৫৫টি স্টাডির ফলাফল থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়, সংগীত শিক্ষা ছেলেমেয়েদের গণিত শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়।

বর্তমান সরকার পণ্ডিত ও পশ্চিমের শিক্ষাব্যবস্থার আবহাওয়ায় বড় হওয়া বা ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতিদের পশ্চিমি কায়দায় বড় করা মাথাওয়ালা দিয়ে ভরপুর। এসব তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভালো জানেন। ভালো জানেন বলেই তারা নিজেরা যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা পাকাপোক্ত করছেন তা থেকে নিজেদের উত্তরসূরিদের কয়েক হাজার মাইল দূরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এমন শিক্ষাব্যবস্থাই চাই যা ঠিক বা সংস্কার করার জন্য আবার ভবিষ্যতে তাদের নাতিপুতিরাও আসতে পারেন এবং বংশ পরম্পরায় তারা জাতির উপকার করে যেতে পারেন। সংস্কারের বন্যায় দেশ ভেসে যাচ্ছে। সরকারে থাকা সবাই পরিবার-পরিজনসহ প্রয়োজনীয় সেবা কেবল তাদের হাতে গড়া হাসপাতাল ও স্কুল-কলেজ থেকে নিতে বাধ্য থাকবেন—এই একটা সংস্কার করা গেলেই আমরা আমজনতা বর্তে যেতাম।
লেখক: কলামিস্ট

সানা/আপ্র/১১/১১/২০২৫