ফারহানা আফরোজ
একটি জাতীয় পত্রিকায় ৬ অক্টোবর জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবসে প্রকাশিত একটি খবর আমাকে গভীরভাবে বিস্মিত এবং ব্যথিত করেছে- বাল্যবিয়ের শিকার মা-বাবার সন্তানরা জন্মনিবন্ধন ও টিকাদানসহ অন্যান্য মৌলিক নাগরিক সেবায় বাধার মুখে পড়ছে।
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নেওয়া নানা উদ্যোগের মধ্যে একটি হলো বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য ব্যবহৃত বিডিআরআইএস সফটওয়্যারটি মা-বাবার বয়স যাচাইয়ের জন্য প্রোগ্রাম করা। ফলে মায়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে বা বাবার বয়স ২১ বছরের নিচে হলে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করা সম্ভব হচ্ছে না।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ১৮ বছরের নিচে মা এবং ২১ বছরের নিচে বাবার সন্তানের জন্মনিবন্ধন বন্ধ রয়েছে অর্থাৎ সিস্টেম দ্বারা বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। তবে সরকারি টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত না হওয়ার জন্য টাইফয়েড টিকার ক্ষেত্রে অক্টোবর পর্যন্ত সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছে।
এক শিশুর অধিকার রক্ষার নামে আরেক শিশুর অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো ওই বিধান নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সরকার কেন বা কীভাবে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হলো তা বোধগম্য নয়। বিশেষত যখন ইউএনএফপিএর ‘স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০২৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি এক হাজারে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি মেয়ের মধ্যে ৭১ জনের এক বা একাধিক সন্তান রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু জন্মনিবন্ধন থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
শিশু সুরক্ষার ভিত্তি শুরু হয় জন্মনিবন্ধন ও জীবনরক্ষাকারী টিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। অথচ শুধু মা-বাবা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন বলে তাদের সন্তানকে জন্মনিবন্ধনের বাইরে রাখা হচ্ছে; যা জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮-এর পরিপন্থী। আইন অনুযায়ী জন্মনিবন্ধন একটি আইনি বাধ্যবাধকতা ও নাগরিকের অধিকার।
গত ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বিষয়টি উল্লেখ করে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে একটি চিঠি পাঠান। পরবর্তী সময়ে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত সিস্টেমে শিথিলতা আনা হয়; যাতে শিশুরা অন্তত টাইফয়েড টিকা নিতে পারে; কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন উদাহরণ পাওয়া যায়নি—যেখানে একটি শিশুর জন্মনিবন্ধন মা–বাবার বয়সের ওপর নির্ভর করছে।
ধরে নেওয়া যায়, সরকারের উদ্দেশ্য মহৎ বাল্যবিয়ের পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। কিন্তু বাস্তবে এমন কোনো সচেতনতামূলক বার্তা বা প্রচার প্রচেষ্টা এখনো চোখে পড়েনি। বা এই সচেতনতা আদতে কোনো সুফল বয়ে আনবে কি না, তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ আইন সংশোধনের সময় আমার মনে পড়ে আরো কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল। যেমন- ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়ের বিয়ে দিলে পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে বাদ দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- যে পরিবার বা মা ভিজিএফ কিংবা ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় আসার যোগ্য, তার আর্থসামাজিক অবস্থাই তো দুর্বল। ওই পরিবারকে নিরাপত্তার আওতা থেকে বাদ দিলে ঝুঁকি আরো বাড়বে, কমবে না বলে আমার মতামত।
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী নানা মডেল ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর হার খুব একটা কমেনি; বরং কোভিড-১৯-এর পর অনেক দেশে এটি বেড়েছে। বাংলাদেশেও ২০০০ সালের পর থেকে একাধিক প্রকল্পভিত্তিক কর্মসূচি চালু হয়েছে, ১৯২৯ সালের আইন ২০১৭ সালে হালনাগাদ করা হয়েছে। তবু ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে ৬৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে; যা ২০২১ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। ১৫ বছরের নিচে মেয়ের বিয়ের হার বেড়েছে ৮ শতাংশ; যা আগে ছিল ৫ শতাংশ।
বাল্যবিয়ে কেন হয়, তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ আমাদের জানা। তবে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের নামে কোনো শিশুকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ন্যায্য নয়। একজনের অপরাধে আরেকজনের শাস্তি মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থী।
আইনের কাজ সুরক্ষা দেওয়া, বাদ দেওয়া নয়।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ


























