ঢাকা ১১:১৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
প্রাথমিকে সংগীত-শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ প্রস্তাবনা বাতিল

এক লাখ ৩১ হাজার কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ

  • আপডেট সময় : ০৯:১৬:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫
  • ২০ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে ১ লাখ ৩১ হাজার ১৬৬ জনের কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ করলো সরকার। এতে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথও বন্ধ হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভুল। শুধু জনতুষ্টির জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়বে। একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে সরকার।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের একটি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত এবং শারীরচর্চা বিষয়ক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গত ২৮ আগস্ট ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এ পরিবর্তন আনা হয়। বিধিমালায় সংগীত শিক্ষক এবং শারীরিক শিক্ষা নামে নতুন দুটি পদ সৃষ্টি করা হয়। গত সোমবার (৩ নভেম্বর) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘সহকারী শিক্ষক (সংগীত)’ ও ‘সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা)’ পদে নিয়োগের নিয়ম ও যোগ্যতার অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়।

একটি সংবাদসংস্থা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী সংস্থাটিকে বলেছেন, অরাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ প্রত্যাশিত অন্তর্বর্তী সরকার এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আমাদের হতাশ করেছে। আমরা বৃহত্তর নাগরিক সমাজ বিক্ষুব্ধ। শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা একজন হিসেবে আমি বলবো-এই সরকারের অনেক বিদগ্ধ মানুষজন আছেন, তাদের তো জানার কথা বিশ্বব্যাপী গবেষণায় স্বীকৃত যে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ হয় শ্রেণিকক্ষে পাঠন-পাঠানে, কিন্তু মননের বিকশের জন্য এক্সট্রা করিকুলাম এক্টিভিটিজ লাগে। তার মধ্যে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চা শিক্ষার্থীদের মনোজগতের বিকাশের জন্য। এখানে যে বিষয়টা উঠে আসে যেটা শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের সহায়ক হয়। তিনি বলেন, ধর্ম বাদ দিয়ে কিছু করার কথা কেউ বলেনি। ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে কারা একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড় করালো সেটা দেখার বিষয়। ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিরোধ তো থাকার কথা নয়। ধর্ম মানুষের চিন্তাকে পরিশীলিত করে। আর সংস্কৃতি ও ক্রীড়া চর্চা মানবিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য গঠনে সহায়ক হয়। এগুলো বিশ্বব্যাপী গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত নীতিনির্ধারক মনোবিদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ; তিনি তো জানেন শিক্ষার্থীদের মনোজগতের বিকাশে এটার কত প্রয়োজন। তারপরও কেন এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এটা বোধগম্য নয়।

কেন সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিলো? জানতে চাইলে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর চাপে এটা করলো কিনা? কিন্তু শিক্ষা তো কোনো গোষ্ঠীর ব্যাপার নয়, শিশুদের মনোজগতের বিকাশ তো কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর বিষয় নয়। পুরো জাতির আগামীর সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দিলো।

শিক্ষা গবেষক ও উন্নয়নকর্মী কে এম এনামুল হক সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ বিকাশে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিশ্বব্যাপী যখন স্বাস্থ সহায়ক বিদ্যালয় নীতিমালা প্রণয়ন, প্রসার ও চর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তখন এমন সিদ্ধান্ত আমাদের হতাশ করে। আশা করি সরকার এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে এবং সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হেলথ প্রমোটিং স্কুল ও গ্লোবাল সিটিজেনশিপ এডুকেশন ফ্রেমওয়ার্কের আলোকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিগত সরকার ২০২০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত এবং শারীরচর্চা বিষয়ক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এসব বিদ্যালয়ে তিন লাখ ৮৪ হাজার শিক্ষক কর্মরত আছেন। দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম পর্যায়ে মাত্র পাঁচ হাজার ১৬৬ জন শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে সংগীত বিষয়ে দুই হাজার ৫৮৩ জন এবং শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে দুই হাজার ৫৮৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়। একইসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল, পর্যায়ক্রমে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন করে সংগীত বিষয়ক শিক্ষক এবং একজন করে শারীরিক বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৮ আগস্ট ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এ পরিবর্তন আনা হয়। সেখানে সংগীত শিক্ষক এবং শারীরিক শিক্ষা নামে নতুন দুটি পদ সৃষ্টি করা হয়।

এক লাখ ৩১ হাজার ১৩৪ জনের কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ: দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ের একজন এবং শরীরচর্চা বিষয়ক একজন শিক্ষকের মোট পদ দাঁড়ায় ১ এক লাখ ৩১ হাজার ১৩৪টি। এই পদ দুটি বাতিলের কারণে বড় সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ হাতছাড়া হলো। কর্মসংস্থানের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিশেষ করে এই গোষ্ঠী কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় না। এই সিদ্ধান্তে তাদের কর্মসংস্থানের পদ বন্ধ হলো। তিনি বলেন, আজকাল আমাদের ক্রীড়া জগতে বিশেষ করে ক্রিকেটে আমরা পরাজিত হচ্ছি বার বার। শিশুকাল থেকে শিশুদের যদি আমরা গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে ক্রিকেট-ফুটবলের ক্ষেত্রেও এটা উপকারে আসতো। আমরা কী করলাম-এমনিতেই পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মাঠ থেকে ফিরছি, তারপর যদি এই ঘটনা ঘটে তাহলে হতাশ না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

শিক্ষার্থীদের ডিভাইস আসক্তি: শিক্ষার্থীদের যদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলা বা শরীরচর্চা থেকে বিরত রাখা হয় তাহলে বর্তমানে যে ডিভাইসমুখি অবস্থা চলছে তা থেকে আর বের হওয়া যাবে না বলে জানান শিক্ষাবিদরা। রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, মাদক ও ডিভাইস আসক্তি থেকে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ফেরাতে হলে ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল বিটিভিতে ‘নতুন কুঁড়ি’ শুরু হয়েছে। সেই ‘নতুন কুঁড়ি’র অডিশনে অভিভাবকরা বলছেন, তারা খুশি যে এটি তাদের বাচ্চাদের ডিভাইসমুখিতা কমাতে সহায়তা করছে। আমরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেদের কথা চিন্তা করবো না; অভিভাবকদের পাশ কাটিয়ে, শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দকে অগ্রহ্য করে এমন একটা সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো বুঝতে পাচ্ছি না। নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যা প্রত্যাশিত ছিল না।

সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারর দাবি: নীতিমালা পরিবর্তন করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ক শিক্ষক এবং শারীরচর্চা বিষয়ক শিক্ষক পদ বিলুপ্ত করা হয়েছে, যা সঠিক হয়নি। এই প্রজ্ঞাপন যেন সরকার দ্রুত প্রত্যাহার করে নেয় সেই দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের হুমকির মুখে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে মূলত একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের নতজানু চরিত্রের প্রকাশ পেয়েছে উদীচীসহ কয়েকটি সংগঠন সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে।

সানা/আপ্র/০৫/১১/২০২৫

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

প্রাথমিকে সংগীত-শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ প্রস্তাবনা বাতিল

এক লাখ ৩১ হাজার কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ

আপডেট সময় : ০৯:১৬:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে ১ লাখ ৩১ হাজার ১৬৬ জনের কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ করলো সরকার। এতে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথও বন্ধ হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভুল। শুধু জনতুষ্টির জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়বে। একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে সরকার।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের একটি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত এবং শারীরচর্চা বিষয়ক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গত ২৮ আগস্ট ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এ পরিবর্তন আনা হয়। বিধিমালায় সংগীত শিক্ষক এবং শারীরিক শিক্ষা নামে নতুন দুটি পদ সৃষ্টি করা হয়। গত সোমবার (৩ নভেম্বর) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘সহকারী শিক্ষক (সংগীত)’ ও ‘সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা)’ পদে নিয়োগের নিয়ম ও যোগ্যতার অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়।

একটি সংবাদসংস্থা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী সংস্থাটিকে বলেছেন, অরাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ প্রত্যাশিত অন্তর্বর্তী সরকার এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আমাদের হতাশ করেছে। আমরা বৃহত্তর নাগরিক সমাজ বিক্ষুব্ধ। শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা একজন হিসেবে আমি বলবো-এই সরকারের অনেক বিদগ্ধ মানুষজন আছেন, তাদের তো জানার কথা বিশ্বব্যাপী গবেষণায় স্বীকৃত যে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ হয় শ্রেণিকক্ষে পাঠন-পাঠানে, কিন্তু মননের বিকশের জন্য এক্সট্রা করিকুলাম এক্টিভিটিজ লাগে। তার মধ্যে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চা শিক্ষার্থীদের মনোজগতের বিকাশের জন্য। এখানে যে বিষয়টা উঠে আসে যেটা শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের সহায়ক হয়। তিনি বলেন, ধর্ম বাদ দিয়ে কিছু করার কথা কেউ বলেনি। ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে কারা একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড় করালো সেটা দেখার বিষয়। ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিরোধ তো থাকার কথা নয়। ধর্ম মানুষের চিন্তাকে পরিশীলিত করে। আর সংস্কৃতি ও ক্রীড়া চর্চা মানবিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য গঠনে সহায়ক হয়। এগুলো বিশ্বব্যাপী গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত নীতিনির্ধারক মনোবিদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ; তিনি তো জানেন শিক্ষার্থীদের মনোজগতের বিকাশে এটার কত প্রয়োজন। তারপরও কেন এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এটা বোধগম্য নয়।

কেন সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিলো? জানতে চাইলে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর চাপে এটা করলো কিনা? কিন্তু শিক্ষা তো কোনো গোষ্ঠীর ব্যাপার নয়, শিশুদের মনোজগতের বিকাশ তো কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর বিষয় নয়। পুরো জাতির আগামীর সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দিলো।

শিক্ষা গবেষক ও উন্নয়নকর্মী কে এম এনামুল হক সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ বিকাশে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিশ্বব্যাপী যখন স্বাস্থ সহায়ক বিদ্যালয় নীতিমালা প্রণয়ন, প্রসার ও চর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তখন এমন সিদ্ধান্ত আমাদের হতাশ করে। আশা করি সরকার এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে এবং সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হেলথ প্রমোটিং স্কুল ও গ্লোবাল সিটিজেনশিপ এডুকেশন ফ্রেমওয়ার্কের আলোকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিগত সরকার ২০২০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত এবং শারীরচর্চা বিষয়ক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এসব বিদ্যালয়ে তিন লাখ ৮৪ হাজার শিক্ষক কর্মরত আছেন। দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম পর্যায়ে মাত্র পাঁচ হাজার ১৬৬ জন শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে সংগীত বিষয়ে দুই হাজার ৫৮৩ জন এবং শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে দুই হাজার ৫৮৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়। একইসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল, পর্যায়ক্রমে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন করে সংগীত বিষয়ক শিক্ষক এবং একজন করে শারীরিক বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৮ আগস্ট ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এ পরিবর্তন আনা হয়। সেখানে সংগীত শিক্ষক এবং শারীরিক শিক্ষা নামে নতুন দুটি পদ সৃষ্টি করা হয়।

এক লাখ ৩১ হাজার ১৩৪ জনের কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ: দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ের একজন এবং শরীরচর্চা বিষয়ক একজন শিক্ষকের মোট পদ দাঁড়ায় ১ এক লাখ ৩১ হাজার ১৩৪টি। এই পদ দুটি বাতিলের কারণে বড় সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ হাতছাড়া হলো। কর্মসংস্থানের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিশেষ করে এই গোষ্ঠী কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় না। এই সিদ্ধান্তে তাদের কর্মসংস্থানের পদ বন্ধ হলো। তিনি বলেন, আজকাল আমাদের ক্রীড়া জগতে বিশেষ করে ক্রিকেটে আমরা পরাজিত হচ্ছি বার বার। শিশুকাল থেকে শিশুদের যদি আমরা গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে ক্রিকেট-ফুটবলের ক্ষেত্রেও এটা উপকারে আসতো। আমরা কী করলাম-এমনিতেই পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মাঠ থেকে ফিরছি, তারপর যদি এই ঘটনা ঘটে তাহলে হতাশ না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

শিক্ষার্থীদের ডিভাইস আসক্তি: শিক্ষার্থীদের যদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলা বা শরীরচর্চা থেকে বিরত রাখা হয় তাহলে বর্তমানে যে ডিভাইসমুখি অবস্থা চলছে তা থেকে আর বের হওয়া যাবে না বলে জানান শিক্ষাবিদরা। রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, মাদক ও ডিভাইস আসক্তি থেকে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ফেরাতে হলে ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল বিটিভিতে ‘নতুন কুঁড়ি’ শুরু হয়েছে। সেই ‘নতুন কুঁড়ি’র অডিশনে অভিভাবকরা বলছেন, তারা খুশি যে এটি তাদের বাচ্চাদের ডিভাইসমুখিতা কমাতে সহায়তা করছে। আমরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেদের কথা চিন্তা করবো না; অভিভাবকদের পাশ কাটিয়ে, শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দকে অগ্রহ্য করে এমন একটা সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো বুঝতে পাচ্ছি না। নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যা প্রত্যাশিত ছিল না।

সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারর দাবি: নীতিমালা পরিবর্তন করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ক শিক্ষক এবং শারীরচর্চা বিষয়ক শিক্ষক পদ বিলুপ্ত করা হয়েছে, যা সঠিক হয়নি। এই প্রজ্ঞাপন যেন সরকার দ্রুত প্রত্যাহার করে নেয় সেই দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের হুমকির মুখে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে মূলত একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের নতজানু চরিত্রের প্রকাশ পেয়েছে উদীচীসহ কয়েকটি সংগঠন সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে।

সানা/আপ্র/০৫/১১/২০২৫